Saturday, April 20, 2024
Homeঐকতানআইজেনস্টাইন ও তাঁর সৃষ্টি এবং ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা’ - মেজবাহ উদ্দিন

আইজেনস্টাইন ও তাঁর সৃষ্টি এবং ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা’ – মেজবাহ উদ্দিন

১৯৩০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যাবেলা। মস্কো শহরের একটি অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে ছবি দেখছেন রবীন্দ্রনাথ। দুটি ছবি দেখলেন – ‘ব্যাটলশিপ পটেমকিন’ (Battleship Potemkin) এবং ‘জেনারেল লাইন’ (The General Line)। মুগ্ধ ও বিস্মিত রবীন্দ্রনাথ দেখলেন কিছু যন্ত্রপাতি আর সেলুলয়েডের ফিতায় কী অসাধারণ সার্থক শিল্প সৃষ্টি সম্ভব হতে পারে! চলচ্চিত্র দু’টির পরিচালকের সাথে পরিচিত হতে চাইলেন রবীন্দ্রনাথ। যখন জানলেন ২৭ বছরের একজন যুবক এই শিল্প সৃষ্টি করেছেন তখন তাঁর বিস্ময় আরও বেড়ে গেল। শিল্প হিসেবে চলচ্চিত্রের অমিত সম্ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ নিঃসন্দেহ হলেন। পরিচালক তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকায় তাঁর সাথে পরিচয়ের সুযোগ হলো না রবীন্দ্রনাথের।

সাল ১৯৫৮। চলচ্চিত্র শিল্প ততদিনে অনেক পরিণত। ইতোমধ্যে ‘দি গোল্ড রাশ’ (The Gold Rush), ‘বাইসাইকেল থিভস’ (Bicycle Thieves), ‘রশোমন’ (Rashomon), ‘পথের পাঁচালী’, ‘ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ’ (The 400 Blows) থেকে হলিউডের চাকচিক্যময় ছবি ‘দি টেন কম্যান্ডমেন্টস’ (The Ten Commandments)-সহ অনেক বিখ্যাত চলচ্চিত্র মানুষের সামনে এসেছে। চলচ্চিত্রের তত্ত্বগত দিকে অনেক নতুন তত্ত্ব ততদিনে হাজির হয়েছে, আবার কারিগরি দিকেও অনেক নতুন সংযোজন চলে এসেছে। ঠিক এই সময়েই বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে বসলো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের আসর। নানান দেশ থেকে এসেছেন বড় বড় চিত্রপরিচালকেরা। তাদের বেশিরভাগই হয় হলিউডের নয়তো পশ্চিম ইউরোপের এবং পশ্চিমী চিন্তাধারার মানুষ। তাঁরা সেদিন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্বাচন করলেন। সর্বসম্মতভাবে নির্বাচিত হলো ‘ব্যাটলশিপ পটেমকিন’। ‘ব্যাটলশিপ পটেমকিন’-সহ মাত্র সাতটি ছবি তৈরি করে আর চলচ্চিত্রের তত্ত্বের উপর চারটি বই লিখে যে মানুষটি বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক বিশাল স্থান করে নিয়েছেন তিনি ছিলেন সোভিয়েত দেশের মানুষ। সেই অসামান্য শিল্পীর নাম সের্গেই মিখাইলোভিচ আইজেনস্টাইন।

১৯১৭-এর অক্টোবরে পৃথিবীর মানুষ এক নতুন দেশের কথা শুনেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন। রাশিয়ার কথা কে না জানত, কিন্তু গরিব, একেবারে নীচের তলার মানুষের হাতে গড়া সোভিয়েতের কথা এর আগে কেউ শোনেনি। মানুষের ইতিহাসে পূর্ব-নজিরবিহীন এই সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে গিয়ে সোভিয়েত নেতাদের এগোতে হয়েছে পথ তৈরি করে করে। প্রয়োজন অনুভূত হলো শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে নতুন তৈরি সমাজের মতাদর্শ, ধ্যান-ধারণা ও মূল্যবোধ সঞ্চারিত করার। পুঁজিবাদে সবকিছু পরিচালিত হয় ব্যক্তিস্বার্থে বা মুনাফার স্বার্থে। সেখানে দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা বা সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার কোনো মূল্যই নেই। ফলে পরিবর্তিত সমাজে নতুন মানুষ, নতুন সমাজ গড়ে তুলতে সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রয়োজন পড়লো শিল্প-সাহিত্য-শিক্ষার ক্ষেত্রে নতুন রীতি তৈরি করার। আর এ ব্যাপারে চলচ্চিত্র যে সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে অক্টোবর বিপ্লবের নায়ক লেনিন তা বুঝতে পেরেছিলেন। ১৯১৯ সালের ২৭ আগস্ট জারের আমলের স্টুডিও জাতীয়করণের সময় লেনিন বলেছিলেন, ‘আমাদের জন্য চলচ্চিত্র হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম’। চলচ্চিত্রের অসীম সম্ভাবনা লেনিন উপলব্ধি করেছিলেন। না, এই উপলব্ধি হলিউডের মতো করে নয়। লেনিনের কাছে চলচ্চিত্র বাণিজ্য করার মাধ্যম ছিল না। ছিল মানুষের কাছে নতুন সমাজের বাণী নিপুণতম উপায়ে পৌঁছে দেয়ার মাধ্যম। তখন সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের নিতান্তই শৈশবকাল। ফলে শিল্প-সাহিত্যে নতুন মানুষ গড়ে তোলার এই উপলব্ধি তৈরি করাটা নিঃসন্দেহে খুবই কঠিন ছিল। সাহিত্যের ক্ষেত্রে তবুও অতীতের সমৃদ্ধ সাহিত্য থেকে উপাদান আহরণের সুযোগ ছিল। কিন্তু সদ্য বিকশিত চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে তার কোনো সুযোগই ছিল না। সেই সময়ে লেনিন দুর্ভিক্ষপীড়িত, শত্রু আক্রান্ত অনিশ্চিত অস্তিত্বের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দেশটিতে ‘ওডেসা ফিল্ম স্টুডিও’-র জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের ব্যবস্থা করেছিলেন। আর এই অত্যন্ত কঠিন দায়িত্ব পালন করেছিলেন তৎকালীন সোভিয়েত নবীন চলচ্চিত্রকাররা। যার পুরোধা ব্যক্তিত্বরা হলেন আলেকজান্দ্রভ, কোয়াসিমভ, কুলেশভ, ভের্তব, পুদভকিন, দবঝেনকো এবং নিঃসন্দেহে আইজেনস্টাইন।

১৮৯৮ সালের ২৩ জানুয়ারি লাটভিয়ার রিগাতে জন্মগ্রহণ করেন চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম প্রতিভা সের্গেই আইজেনস্টাইন। রাশিয়াতে তখন ঝড়ের সময়। আইজেনস্টাইনের জন্মের বছরই অনুষ্ঠিত হল রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রথম কংগ্রেস। মহামতি লেনিন তখন তাঁর বিপ্লবী চিন্তাকে ক্রমাগত শাণিত করে চলেছেন। আইজেনস্টাইনের শৈশব থেকে যৌবন পর্যন্ত রাশিয়া জেগে উঠেছে ১৯০৫ আর ১৯১৭ সালের বিপ্লবের প্রস্তুতি পর্ব ও প্রক্রিয়ায়। সমগ্র রাশিয়া তখন উত্তাল শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবের ঝড়ো আন্দোলনে। তাই তাঁর চিন্তা, ক্রিয়ায়, কর্মে শ্রমিকদের লড়াই তথা মুক্তি। তাঁর সব চলচ্চিত্রে সহস্র মানুষের সমবেত উপস্থিতি। তারা সকলেই নায়ক। আইজেনস্টাইনের বাবা ছিলেন জার্মান ইহুদী এবং মা ছিলেন রাশিয়ান। বাবা পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, মা অত্যন্ত বিদূষী নারী। শৈশব থেকেই আইজেনস্টাইন রাশিয়ান, জার্মান, ফরাসি ও ইংরেজি ভাষায় লিখতে-পড়তে শিখেছিলেন। দশ বছর বয়স থেকেই তিনি চিত্রাঙ্কনে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। যার ছাপ তাঁর উপর সবসময় ছিল এবং তাঁর চলচ্চিত্রেও এই ছাপ সুস্পষ্টভাবে পড়েছিল। আইজেনস্টাইনের কৈশোরে তাঁদের পরিবার সেন্টপিটার্সবার্গে বাস করতে চলে আসে। তিনি পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে স্থাপত্যবিদ্যায় পড়াশোনা করেন।

রাশিয়ান চলচ্চিত্র শিল্প তখনো ভ্রুণাকারে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে রাশিয়া প্রধানত ছিল হলিউড এবং ইউরোপীয় ছবির বাজার। এই ছবিগুলো দেখে জার এবং অনেক পুঁজিপতি ছবি তৈরির ব্যাপারে আগ্রহী হন। প্রথম মহাযুদ্ধের ফলে বাইরের ছবি আসা বন্ধ হলে নিজের দেশে ছবি তৈরির হার দ্রুত বেড়ে যায়। মায়াকোভস্কি, মেয়ারহোল্ড-সহ বেশ কয়েকজন শিল্পী-সাহিত্যিক এ ব্যাপারে উৎসাহিত হলেও পুরো ব্যাপারটা ছিল জার এবং পুঁজিমালিকের নিয়ন্ত্রণে। উল্লেখযোগ্য কোনো কিছুই তৈরি হয়নি সেসময়।

১৯১৭ সালের ২৫ অক্টোবর (পুরনো ক্যালেন্ডার অনুযায়ী) উনিশ বছরের যুবক আইজেনস্টাইন মানবসমাজের মহত্তম ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করলেন। লেনিনের নেতৃত্বে যেদিন বিপ্লবী বলশেভিকরা উইন্টার প্যালেস আক্রমণ করলেন, সেদিন আইজেনস্টাইন সে শহরেই বাস করছিলেন। অসংখ্য তরুণ যুবার মতো এ ঘটনা তাঁর জীবনের মোড়ও ঘুরিয়ে দিল। তিনি ও তাঁর বন্ধুরা অনেকেই বিপ্লবী লালফৌজে যোগ দিলেন। ১৯১৮ সালের গৃহযুদ্ধের সময় লালফৌজের হয়ে পূর্বপ্রান্তের রণাঙ্গনে প্রচারমূলক রেলগাড়িতে ছবি আঁকতেন আইজেনস্টাইন। বিপ্লব পরবর্তীতে প্রলেটকাল্ট থিয়েটার সৃষ্টি হয়েছিল সোভিয়েতের নাটকের প্রয়োজনে। লালফৌজ থেকে এসে তিনি যোগ দিলেন সেখানে। আইজেনস্টাইন ডিজাইন এবং সেট নির্মাণের কাজ করতেন থিয়েটারে। সেই সময় বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব মেয়ারহোল্ডের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটলো। মেয়ারহোল্ড নাটকে তখন ছবির ব্যবহার করতেন। আইজেনস্টাইন-সহ অনেক চিত্রপরিচালকের ক্যামেরার সাথে পরিচয় ঘটলো মেয়ারহোল্ডের মাধ্যমে।

প্রলেটকাল্টে অস্ত্রভস্কির নাটক ‘এনাফ সিমপ্লিসিটি ইন এভরি ওয়াইজম্যান’-এ কুড়ি মিনিটের ভিডিও’র মাধ্যমে আইজেনস্টাইন-এর চলচ্চিত্রে হাতেখড়ি। সেই সময় শ্রমিকদের নিয়ে বাস্তবভিত্তিক নাটক করার জন্য কারখানায় ‘গ্যাস মাস্কস’ নাটকটি মঞ্চস্থ করেন আইজেনস্টাইন। বাস্তব জীবনের শ্রমিকদের নিয়ে একেবারে সত্যিকারের কারখানার মধ্যে মঞ্চস্থ হওয়া নাটকটি সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। আইজেনস্টাইন বুঝলেন নাটকের আঙ্গিকগত দুর্বলতাকে এবং বুঝলেন নাটকে যা দেখানোর সুযোগ নেই চলচ্চিত্রে তার অবারিত দ্বার। নাটক ছেড়ে সিনেমার লোক হলেন আইজেনস্টাইন। ইতোমধ্যে চলচ্চিত্র নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন কুলেশভ, ভের্তব, পুদভকিনরা। এ পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাথে চলতো তর্ক-বিতর্কও। আইজেনস্টাইনও যুক্ত হলেন তাতে।

১৯২৩ সালের ১৭ আগস্ট একটি ইস্তাহার জারি করে সোভিয়েত সরকার। এই ইস্তাহারে সমস্ত বেসরকারি চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান তুলে দিয়ে চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিবেশনার দায়িত্ব নিল সরকার। বস্তুত এই নির্দেশনা সোভিয়েত চলচ্চিত্র শিল্পের রাস্তাকে অবারিত করলো। নির্মাতারা পেল ভরসা। নির্বাক যুগে একের পর এক অসামান্য চলচ্চিত্রের জন্ম দিল সোভিয়েত পরিচালকেরা। কুলেশভের ‘মিঃ ওয়েস্ট’, পুদভকিনের ‘ডেথস রে’ ও ‘মেকানিকস অব দ্য ব্রেইন’, ভের্তবের ‘কিনো আই’ আর আইজেনস্টাইনের ‘স্ট্রাইক’ মুক্তি পেল। বস্তুত বিপ্লবের জোয়ার এল বিশ্বচলচ্চিত্রে।

আইজেনস্টাইনের প্রথম ছবি ‘স্ট্রাইক’ (Strike) তৈরি হয় ১৯২৪ সালে। পৌনে দু’ঘণ্টার এ ছবিতে প্রচলিত অর্থে কোনো কাহিনী ছিল না। একদল শ্রমিকের ধর্মঘটকে চিত্রায়িত করাই ছিল এ ছবির উদ্দেশ্য। চলচ্চিত্রকে জাতীয়করণের পর সোভিয়েত তথা রাশিয়ার সংগ্রামী ইতিহাস তুলে ধরে নানা চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা হয়। তার অংশ হিসেবে ১৯০৫-এর বিপ্লবের পূর্ববর্তী শ্রমিক আন্দোলনকে উপজীব্য করে ‘স্ট্রাইক’ চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। কতগুলো বিচ্ছিন্ন প্রকল্প বা ইমেজকে একত্রে সন্নিবেশিত করে এই ছবিটি নির্মিত। এই ছবির আলোকচিত্রী হিসেবে এডওয়ার্ড টিসে অনবদ্য কাজ করলেন, যিনি পরবর্তীতে আইজেনস্টাইনের সব ছবিতে সঙ্গী হয়ে ছিলেন। চলচ্চিত্রের তত্ত্বগত ক্ষেত্রে আইজেনস্টাইনের অবদান রাখা শুরু হলো এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই। তাঁর বহুল আলোচিত ‘মন্তাজ অব অ্যাট্রাকশন’ (Montage of Attractions) তত্ত্বের প্রথম প্রয়োগ হলো। ‘স্ট্রাইক’ সর্বার্থেই একটি বৈপ্লবিক চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের পর্দায় একজন বিশেষ ব্যক্তি নয়, জনসাধারণ নায়ক হিসেবে দেখা দিল। বুর্জোয়া নায়কের ব্যক্তিত্ববাদী ধারণাকে বাতিল করে নায়ক হল জনতা। ‘জনগণ নায়ক’ আইজেনস্টাইনের চলচ্চিত্রের এক বৈপ্লবিক বৈশিষ্ট্য।

১৯২৫ সাল ছিল ১৯০৫-এর বিপ্লবের ২০ বছর পূর্তি। সাধারণভাবে দেখতে গেলে এ বিপ্লব ব্যর্থ, কিন্তু তা ১৯১৭ সালের বিপ্লবের পথকে প্রশস্ত করল। এর ইতিহাস চলচ্চিত্র আকারে চিত্রিত করবার ভার পড়ল আইজেনস্টাইনের উপর। প্রথমে পুরো ঘটনা নিয়ে চিত্রনাট্য তৈরি হয়। পরবর্তীতে ‘পটেমকিন’ জাহাজের নৌ-বিদ্রোহের ঘটনাকে নিয়ে চিত্রনাট্য তৈরি করা হলো। বিপ্লবকে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলতে, তার মর্মার্থ বুঝতে বিপ্লবের জীবিত কুশীলবদের সাথে সাক্ষাত করলেন তিনি। তার সাথে নিজের গবেষণাধর্মী শিল্পগুণকে যুক্ত করলেন আইজেনস্টাইন। টিসের আলোকচিত্র মিলে তৈরি হলো বিশ্বের সর্বকালের সেরা ছবি ‘ব্যাটলশিপ পটেমকিন’। পাঁচটি অংশে বিভক্ত চলচ্চিত্রটিতে তাঁর শিল্পগুণ ও চলচ্চিত্র স¤পাদনার জন্য চলচ্চিত্র শিল্পের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বিশেষত তাঁর ‘ওডেসার সিঁড়ি’ অংশটিতে শট বা দৃশ্যের মধ্যে দ্বন্দ্বের মাধ্যমে চলচ্চিত্র সম্পাদনাকে অন্যরকম উচ্চতায় হাজির করলেন। তিনি বোঝালেন চলচ্চিত্রের প্রতিটি শট, প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি ধ্বনি, প্রতিটি অভিব্যক্তি, গতির ব্যবহার মানুষের চিন্তাকে নাড়িয়ে দেবে এবং সে ভাববে চলচ্চিত্রের প্রতিটি উপাদান সম্পর্কে।

১৯২৭ সাল ছিল সোভিয়েত বিপ্লবের দশম বার্ষিকী। বিপ্লব নিয়ে চলচ্চিত্রকারদের অনুরোধ করা হলো কিছু চলচ্চিত্র তৈরি করতে। জন রীডের বিখ্যাত উপন্যাস “দুনিয়া কাঁপানো দশদিন”-কে অবলম্বন করে আইজেনস্টাইন ‘অক্টোবর’ (October) নামে চিত্রনাট্য লিখলেন। ১৯১৭ সালের বিপ্লবের উপর নির্মিত হলো পৌনে তিন ঘণ্টার ছবি। আঙ্গিক নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন আইজেনস্টাইন এ ছবিতে। মানুষ ও বস্তুকে প্রতীকী অর্থে ব্যবহারের জন্য ছবিটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। গণআন্দোলনের দৃশ্য নিয়ে সাব-টাইটেল বা ধারাবিবরণীসহ এমন সমৃদ্ধ ছবি দুর্লভ। ‘অক্টোবর’ তুলতে গিয়ে বহু মানুষকে মিলিতভাবে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে আইজেনস্টাইন লিখেছেন : “রাতের পর রাত লেনিনগ্রাদের চার থেকে পাঁচ হাজার শ্রমিক উইন্টার প্যালেস আক্রমণের দৃশ্যটি তুলবার জন্য স্বেচ্ছায় অংশ নিয়েছেন। সরকার আমাদের সৈন্যবাহিনী, অস্ত্রশস্ত্র এবং ইউনিফর্ম দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। ‘অরোরা’ জাহাজটিও আমাদের দেওয়া হয়েছিল। ট্যাঙ্ক এবং গোলন্দাজ বাহিনীর সহযোগিতাও আমরা পেয়েছিলাম।”

‘অক্টোবর’ নির্মাণের আগেই আইজেনস্টাইন আরেকটি ছবির কাজ শুরু করেছিলেন – ‘দি জেনারেল লাইন’। যৌথ কৃষিব্যবস্থাকে জনপ্রিয় করে তোলা এবং কৃষক সমাজকে পুরানো ও জরাজীর্ণ কৃষি পদ্ধতি পরিত্যাগ করে নতুন যান্ত্রিক কৌশলকে আয়ত্ত করবার কাজে উদ্বুদ্ধ করাই ছিল এ ছবির উদ্দেশ্য। আইজেনস্টাইন এ ছবিতে প্রথম একজন ব্যক্তি নায়িকাকে মুখ্য চরিত্রে দেখালেন। ১৯২৯ সালে মুক্তি পেল ছবিটি। এই ছবিতে আইজেনস্টাইন টাইপেজ (Typage) ও মন্তাজের (Montage) প্রয়োগ এবং চিত্রকলাবিদ্যাতেও পারদর্শিতা দেখালেন। সিনেমাটোগ্রাফিতেও এ ছবি নতুনত্বের স্বাক্ষর রাখলো। কিন্তু অনেকক্ষেত্রে আইজেনস্টাইনের অতিরিক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বুদ্ধিবাদের প্রয়োগ হলো এ ছবিতে। বিষয়বস্তুকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল আঙ্গিক, যা ছবিকে দুর্বোধ্য করে তুলেছিল।

আইজেনস্টাইনের তখন দুনিয়াজোড়া খ্যাতি। ১৯২৯ সালে প্যারামাউন্ট পিকচার্সের আমন্ত্রণে হলিউডে পাড়ি জমালেন আইজেনস্টাইন। দুটো উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি হলিউড গিয়েছিলেন। তাঁর অনেকদিনের পরিকল্পনা কার্ল মার্কসের “পুঁজি” নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরি করবেন। ফলে পুঁজিবাদের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রূপটিকে অবলোকন করা ছিল তাঁর একটা উদ্দেশ্য। অন্যদিকে তখন চলচ্চিত্র নির্বাক থেকে সদ্য সবাক হয়েছে। সেসব সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান নেয়াও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। মাঝপথে কিছুদিন ইউরোপে কাটালেন তিনি। তরুণ নির্মাতাদের ক্লাস নিলেন।

হলিউডে নেমে আইজেনস্টাইন পুঁজিবাদী দুনিয়ার নির্মমতার সম্মুখীন হলেন। চলচ্চিত্র এখানে শিল্প নয়, গণমাধ্যম নয়। পুঁজি আর মুনাফার উপকরণ মাত্র। সোভিয়েতে চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্রনির্মাতাকে যথার্থ ছবি বানানোর জন্য পৃষ্ঠপোষকতা করছে সরকার। আর আমেরিকায় দেখলেন ব্যবসায়ীরা চলচ্চিত্রে পুঁজি বিনিয়োগ করছে। হলিউডে তিনি ‘গ্লাস হাউস’ নামে একটি কমেডির খসড়া করেন। একটি বাড়ি যেটি পুরোটাই স্বচ্ছ কাঁচ দিয়ে তৈরি, ফলে বসবাসের অযোগ্য। আসলে এটি ছিল মার্কিনী জীবনযাত্রার প্রতি তীব্র ব্যঙ্গের ছবি। ফলে কেউ অর্থলগ্নী করল না। পরবর্তীতে ‘সাটারস গোল্ড’ নামে স্কুলশিক্ষকের জীবন নিয়ে ছবি করতে চাইলেন। যে শিক্ষক ক্যালিফোর্নিয়াতে অনেক প্রতিক্রিয়ার বাঁধা অতিক্রম করে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হলিউডের মতে এটি অতি বিপ্লবী ছবি, ফলে বাতিল হলো। পরে মেক্সিকো গিয়ে মেক্সিকোর সামন্ততান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে চিত্রনাট্য ‘কিউ ডিভা মেক্সিকো’ তৈরি করলেন। চার্লি চ্যাপলিনের অনুরোধে এ ছবিতে অর্থায়ন করলেন ক্যালিফোর্নিয়ার সিনক্লেয়ার। এই ছবির বেশিরভাগ কাজ শেষ হওয়ার পর মার্কিনী অভিজাতদের সাথে সম্পর্কের কারণে চুক্তি ভঙ্গ করে এই ছবির অর্থায়ন বন্ধ করে দেন সিনক্লেয়ার। এমনকি ছবির সমস্ত রিলগুলোও রেখে দেন। কুৎসিত পুঁজিবাদী দুনিয়ার চিত্রটা দেখে আইজেনস্টাইন ১৯৩২ সালে দেশে ফিরলেন। ফিরে মস্কোর ‘ইনস্টিটিউট অফ সিনেমাটোগ্রাফি’-তে অধ্যাপনার দায়িত্ব নিলেন তিনি। তিনি নিজের তত্ত্বগত পড়াশুনা আর গবেষণায় মনোযোগ দেন। অধ্যাপনাতেও নিজের পান্ডিত্য এবং মৌলিক কল্পনা ও চিন্তাশক্তির স্বাক্ষর রাখলেন।

আইজেনস্টাইন ১৯৩৫-এ ইভান তুর্গেনেভের গল্প অবলম্বনে ‘বেজহিন মেডো’ ছবির নির্মাণ কাজ অনেকটুকু শেষ করলেও সম্পূর্ণ করতে পারেননি। আইজেনস্টাইন তারপর হাত দিলেন ইতিহাসধর্মী ছবি ‘আলেকজান্ডার নেভস্কী’ নির্মাণে। ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বরে ছবিটি মুক্তি পেল। চলচ্চিত্রের কাহিনী ও দৃশ্যের বিস্তারে ছিল কয়েকশ’ বছর আগেকার যুদ্ধের পটভূমি। ছবিটি যখন নির্মিত হচ্ছে তখন ফ্যাসিস্ট হিটলারের জার্মানি গোটা দুনিয়াকে হুমকি দিয়ে বেড়াচ্ছিল। রাশিয়ার উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সে সময়ে সাতশ’ বছর আগের জার্মান কর্তৃক রাশিয়া আক্রমণ এবং নেভস্কীর নেতৃত্বে রাশিয়ার লড়াইয়ের ঘটনা নিয়ে চলচ্চিত্রটি আলোড়ন তুললো। আইজেনস্টাইন যেন সেই ঘটনাকেই বাস্তবে দেখতে পেলেন। দৃশ্যাবলির বিশালত্ব ও চমকের সাথে সাথে এই চলচ্চিত্র, আইজেনস্টাইনের সমসাময়িক রাশিয়া থেকে অনেক অতীতে নিয়ে গেল কাহিনীকে। নেভস্কী ছিলেন নভোগরদের রাজকুমার। অত বছর আগের সেই চরিত্র নিয়ে একটি বাস্তবসম্মত ছবি তৈরি করা অত্যন্ত কঠিন। আইজেনস্টাইন তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে সেই দুরূহ কাজটি করলেন। চলচ্চিত্রে বরফের উপর যুদ্ধের দৃশ্যটি (ব্যাটল অফ আইস) অসাধারণ এক দৃশ্য। এই চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করলেন বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ প্রকোভিয়েভ। এটি আইজেনস্টাইনের প্রথম সবাক ছবি। ছবিটি দর্শক ও সমালোচক মহলে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পায়। এ ছবির জন্য ১৯৩৯ সালে আইজেনস্টাইনকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘অর্ডার অফ লেনিন’-এ ভূষিত করা হয়।

আইজেনস্টাইন জীবনের শেষ ছবি তোলেন ষোড়শ শতাব্দীর রাশিয়ার জাতীয় ঐক্যের নিয়ন্তা জার ‘আইভান দি টেরিবল’-এর জীবনকাহিনী অবলম্বনে। তিন খ-ে বিভক্ত বিশাল ছবিটি। কিন্তু দুটি পর্ব তোলার পরেই তাঁর মৃত্যু হওয়ায় তৃতীয় পর্বটি আর করতে পারেননি। ‘আইভান দি টেরিবল’-এর প্রথম অংশে নিকোলাই-এর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন আরেক বিখ্যাত সোভিয়েত পরিচালক পুদভকিন। এই ছবির প্রধান চরিত্র জার আইভান এক জটিল দ্বন্দ্বক্ষুব্ধ মানব চরিত্র। লুস্কোভির রাজপুত্র আইভান মাত্র ১৭ বছর বয়সে রাজা হন। তিনি রাজা হওয়ার পর কাহিনীতে নানা চরিত্র আসে। কখনো তার বিয়েকে কেন্দ্র করে, কখনো গির্জাকে বা ধর্মকে কেন্দ্র করে। অবশেষে একটি সময়ে বিশ্বাসঘাতকতা এবং পরাজয় আইভানের মধ্যে এক ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

প্রথম পর্বের কাহিনী যেখানে শেষ হয়েছে, ঠিক সেখান থেকেই দ্বিতীয় পর্বের কাহিনী শুরু। দ্বিতীয় পর্বের কাহিনী শেষ হয়েছে একজন স্বৈরতন্ত্রীর স্বরূপ উদঘাটনের মধ্য দিয়ে। ‘আইভান দি টেরিবল’-এর দ্বিতীয় পর্ব নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়। এটির মুক্তি তিনি জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারেননি। এই ছবিটির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর আইজেনস্টাইন অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ সময় ‘আইভান দি টেরিবল’-এর মুক্তি বন্ধ করে দেয় সরকার। বাস্তবে এ ছবিতে ঐতিহাসিক চরিত্রটির অনেকক্ষেত্রে ভুল ব্যাখ্যা করা হয়। জার আইভান ছিলেন একজন জাতীয়তাবাদী শাসক। আবার তিনি অনেক শক্ত মন ও চরিত্রের মানুষ ছিলেন। কিন্তু তাকে দেখানো হয়েছে হ্যামলেট-এর মতো দুর্বল চরিত্র হিসেবে। এখানে আইভানের বাহিনী ‘অপ্রিচনিকি’কেও ভুলভাবে দেখানো হয়। আইজেনস্টাইন সুস্থ হওয়ার পর তাকে ডেকে পাঠান স্তালিন। ১৯৪৭-এর ফেব্রুয়ারিতে আইজেনস্টাইন এবং চেরকাসভ স্তালিনের সাথে সাক্ষাত করতে যান। এসময় স্তালিনের সাথে ছিলেন বলদানভ এবং মলোটভ। ছবিটি নিয়ে এবং নানা বিষয়ে দীর্ঘ আলাপ হয় তাঁদের। ইতিহাসের অনেক ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখান স্তালিন। আবার ছবির ও অভিনেতাদের কিছু দুর্বলতার কথা বলেন তিনি। আবার আইজেনস্টাইনের অনেক কাজের প্রশংসা করেন স্তালিন। আইজেনস্টাইন প্রয়োজনীয় সংশোধনী নিয়ে আসার কথা ব্যক্ত করেন।

‘আইভান দি টেরিবল’-এর দ্বিতীয় অংশ নতুন করে তৈরি এবং তৃতীয় অংশ শুরু করার পরিকল্পনা করেছিলেন আইজেনস্টাইন। কিন্তু এই সময় তাঁর অসুস্থ শরীর আর কিছুতেই সুস্থ হয়ে উঠছিল না। তাছাড়া প্রচুর পড়াশোনা এবং ছাত্রদের মধ্যে বক্তৃতা দেয়ার কাজেও বেশ পরিশ্রম হচ্ছিল। আইজেনস্টাইনের বিখ্যাত বই ‘ফিল্মসেন্স’ এই সময়ে প্রকাশিত হয়। ১৯৪৮-এর ফেব্রুয়ারিতে ‘রঙিন ছবির তত্ত্ব’ নামে এক গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লেখায় হাত দেন। ১০ ফেব্রুয়ারি ওই প্রবন্ধ লেখা অবস্থায় হার্ট অ্যাটাক হয় আইজেনস্টাইনের। ১৯৪৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে এই মহান প্রাজ্ঞ শিল্পীর জীবনের যবনিকা ঘটলো। সমাপ্তি ঘটলো বিশ্বচলচ্চিত্রের সবচেয়ে স্মরণীয় এক অধ্যায়ের।

বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সের্গেই মিখাইলোভিচ আইজেনস্টাইনের মতো এত প্রখর পা-িত্য, মৌলিক কল্পনাশক্তি, অসাধারণ বিশ্লেষণ ও বহুমুখী সৃজনী ক্ষমতা নিয়ে আর কোনো চলচ্চিত্র পরিচালক আবির্ভূত হন নি। কিন্তু কেন আইজেনস্টাইন নিয়ে বা তাঁর ছবি ‘ব্যাটলশিপ পটেমকিন’ নিয়ে এত আলোচনা? এর একদিকে আছে আইজেনস্টাইনের দর্শন, আরেকদিকে তার প্রায়োগিক ক্ষেত্রে তত্ত্বগত অবদান। শুরুতেই বলছিলাম, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন নতুন মানুষ গড়ে তোলার জন্য তার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে নতুন রূপে গড়ে তুলতে চেয়েছে। আর এ লক্ষ্যে তারা যে দর্শনগত চিন্তাকে ভিত্তি করেছে তা হচ্ছে – ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা’। সাধারণভাবে বাস্তববাদ হচ্ছে বাস্তবের যথাযথ প্রতিফলন। সমাজে যা ঘটছে তাকে যথার্থ রূপে যে শিল্পে বা সাহিত্যে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে তাই বাস্তববাদী বা রিয়েলিস্টিক শিল্প বা সাহিত্য। আর সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতায় চিন্তার কেন্দ্রেই হচ্ছে মানুষ। আর সেখানে শিল্প-সাহিত্যের কাজ হচ্ছে দ্বন্দ্বের মাধ্যমে মানুষের চিন্তার ক্রমবিকাশ ঘটানো। এই চিন্তার অগ্রণী সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কি এ প্রসঙ্গে বলছেন : “সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা হচ্ছে ‘পুরনো পৃথিবীর’ ও তার বিষাক্ত প্রভাবের মূলোৎপাটনের লক্ষ্যে পরিচালিত এক সংগ্রাম, যার মূল দায়িত্ব হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক ও বিপ্লবী এক বিশ্ববীক্ষণ ও চেতনার বিকাশ ঘটানো”। গোর্কি আরও বলছেন : “আমার কাছে বস্তু বা ভাবের স্রষ্টা হচ্ছে মানুষ, কেবলমাত্র মানুষ। সে হচ্ছে ঐন্দ্রজালিক, সমস্ত প্রাকৃতিক শক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ামক। আমাদের এই পৃথিবীর সুন্দরতম জিনিস সৃষ্টি হয়েছে মানুষের দক্ষ হাতে, মানুষেরই পরিশ্রমের ফলে মানুষের কাছে আমি প্রণত হই, কারণ মানুষের মূর্ত যুক্তি ও কল্পনার বাইরে এই পৃথিবীতে আমি কিছুই দেখি না, অনুভব করি না।”(আমার জবানবন্দি – ম্যাক্সিম গোর্কি)

আইজেনস্টাইনের দর্শন ছিল ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা’র ভিত্তির উপর দাড়ানো। এ সম্পর্কে আইজেনস্টাইন বলছেন : “সদাসর্বদায় অভিজ্ঞতার সবচেয়ে বড় ঐশ্বর্যময় উৎস হচ্ছে মানুষ নিজেই। তার আচরণকে বোঝা এবং বিশেষত তার বাস্তবকে উপলব্ধির এবং বাস্তবের ভাবমূর্তি তৈরির পদ্ধতি বোঝার ব্যাপারটাই আমাদের (শিল্প-সাহিত্যের) নির্ধারক বিষয়।

আইজেনস্টাইনকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আলোচকরা প্রধানত জোর দিয়েছেন তাঁর শিল্পকলা বা প্রায়োগিক কৌশলের উপর। চলচ্চিত্র সম্পর্কে তাঁর দর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা সামাজিক তাৎপর্য নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয়নি। কিন্তু শিল্পের অন্তর্নিহিত দর্শন বা সামাজিক তাৎপর্যকে এড়িয়ে গিয়ে শিল্প সম্পর্কে যথার্থ উপলব্ধি নেয়া সম্ভব নয়। আইজেনস্টাইন চলচ্চিত্রের প্রায়োগিক দিক নিয়ে যে গবেষণা করেছেন তাঁর মাধ্যমেও তিনি নিজের দর্শনগত অবস্থান দেখিয়েছেন।
সাধারণভাবে আমরা জানি শিল্প বা সাহিত্যের দু’টি দিক থাকে। একটি তার বিষয়গত দিক (content), আরেকটি আঙ্গিকগত দিক (form)। প্রত্যেকটি শিল্প বা শিল্পকর্ম একটি বিষয়বস্তুকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আর তা নিয়ে যাওয়ার জন্য আলাদা আলাদা আঙ্গিকের দরকার হয়। অর্থাৎ তার বিষয়গত দিকটা মুখ্য। কিন্তু এই বিষয়বস্তুর সাথে আঙ্গিকের সম্পর্কটা হতে হয় দ্বান্দ্বিক। একটা ভালো বিষয়বস্তু কখনো শিল্প হয়ে উঠতে পারে না যদি তার আঙ্গিক যথাযথ না হয় এবং এই আঙ্গিক ক্রমাগত উন্নত করতে হয়। চলচ্চিত্রেরও একটা আঙ্গিক আছে। আইজেনস্টাইন তাঁর বিষয়বস্তুকে সঠিকভাবে পৌঁছানোর জন্য আঙ্গিক নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন এবং চলচ্চিত্রে কিছু মৌলিকতার জম্ম দিয়েছেন। ‘স্ট্রাইক’ ছবিটির একটি বিশেষ তাৎপর্য আইজেনস্টাইন কর্তৃক ‘মন্তাজ অব অ্যাট্রাকশন’-এর সচেতন ব্যবহার। পরবর্তীতে ‘ব্যাটলশিপ পটেমকিন’-এ এর ব্যবহার চলচ্চিত্রের ভাষাকে বদলে দিল।

‘মন্তাজ’ শব্দটি কলকারখানার শব্দ। এর সহজ অর্থ জোড়া লাগানো। চলচ্চিত্রে বিভিন্ন শট অথবা দৃশ্যের যোগফলকে বলা হচ্ছে ‘মন্তাজ’। কবির প্রাথমিক হাতিয়ার যদি হয় শব্দ, চিত্রকরের রেখা, সেক্ষেত্রে চলচ্চিত্রকারের শট। শট-এর পর শট জোড়া লাগিয়ে তৈরি হয় চলচ্চিত্র। হলিউড পরিচালক ডি. ডব্লিউ. গ্রিফিত চলচ্চিত্রে প্রথম মন্তাজের প্রয়োগ করেন। আর আইজেনস্টাইন মন্তাজ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এর অন্তর্গত অর্থটাকেই আমূল পাল্টে দিলেন। গ্রিফিত বা তৎপরবর্তী পরিচালকেরা মন্তাজ মানে শট অথবা দৃশ্যের জোড়া লাগানোকেই বুঝেছিলেন। আইজেনস্টাইন বললেন, মন্তাজ হচ্ছে দৃশ্যের সাথে দৃশ্যের দ্বন্দ্ব। না, এই উপলব্ধি শুধুমাত্র একজন পরিচালকের সম্পাদনা টেবিলের কারিগরি দিকের উপলব্ধি নয়। এর দর্শনগত দিক অনেক বৃহৎ। এ নিয়ে আইজেনস্টাইনের সাথে কুলেশভ, পুদভকিনসহ অনেকের সাথে তর্ক-বিতর্ক হয়। পরবর্তীতে তাঁরা আইজেনস্টাইনের চিন্তাকে সঠিক মনে করেন।

আইজেনস্টাইন এই বিষয়টাকে বুঝতে চাইলেন সম্পূর্ণ মার্কসীয় দ্বন্দ্বতত্ত্বের আলোকে। মার্কসীয় দ্বান্দ্বিক তত্ত্ব থিসিস-এন্টিথিসিস-সিনথেসিসের উপর ভিত্তি করে আইজেনস্টাইনের ‘মন্তাজ তত্ত্ব’ দাঁড়িয়েছে। বিরোধী সত্তার মধ্যে সংঘাতচেতনা আইজেনস্টাইনের শিল্পভাবনা ও কর্মের প্রধান উৎস। সে বিরোধ বস্তুতে বস্তুতে, বস্তুতে ও ভাবে, দৃশ্যে ও শ্রাব্যে, গতির দিক পরিবর্তনে এবং ক্যামেরাতে ধরা শটের সঙ্গে শটের। একটি স্বতন্ত্র শটের আলাদা করে কোনো মানে থাকে না। একই রকম আরেকটি শটেরও কোনো মানে থাকে না। কিন্তু ওই দুটি শটের সংযুক্তিতে, আইজেনস্টাইনের মতে সংঘর্ষের ফলে, নতুন অর্থ তৈরি হচ্ছে। ‘অক্টোবর’ সিনেমার একটি শটে আমরা দেখছি কেরেনস্কি মুকুট নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। কাট, পরের শট। পরের শটেই আমরা দেখছি কারখানার হুইসেল বাজছে। দু’টি আপাত বিচ্ছিন্ন শট। দু’টি মিলিয়ে আমরা বুঝতে পারলাম কেরেনস্কি জারের মতোই স্বৈরাচারী পথে যাবে, ফলে প্রস্তুত হতে হবে শ্রমিকশ্রেণিকে। ‘অক্টোবর’-এর আরেকটি শটে আমরা দেখছি প্রতিবিপ্লবী জেনারেল কর্নিলভ বিপ্লবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামছে ধর্মের নামে। কাট, পরের শট। এ শটে দেখানো হচ্ছে যিশুকে, ডিম্বাকৃতি দেবীকে। এর মাধ্যমে যুগে যুগে ধর্মের ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে উঠলো দর্শকের সামনে।

আইজেনস্টাইন মানুষের চিন্তাশক্তিকে নাড়া দিতে চেয়েছেন। তাই পরবর্তীতে ‘মন্তাজ’কে নাম দিয়েছেন ‘ইন্টেলেকচুয়াল মন্তাজ’। অর্থাৎ তা বুদ্ধিবৃত্তিকে প্রভাবিত করবে। আইজেনস্টাইনের ভাষায়, “ইন্টেলেকচুয়াল সিনেমা কেবলমাত্র কাহিনী বা ঘটনার দৃশ্য বর্ণনা করবে না, তার সার্থকতা নির্ভর করবে মানুষের চিন্তাকেও দৃশ্যমান করার উপর।” আইজেনস্টাইন শুধুমাত্র দর্শকের আবেগকে নাড়া দিতে চান না, তার চিন্তাকেও প্রভাবিত করতে চান।

আইজেনস্টাইনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ‘টাইপেজ’। মানুষের মুখের বা শরীরের কিংবা বস্তুর বিশেষ অংশ দেখিয়ে তার সম্পর্কে একটি উপলব্ধি তৈরি করাকে বলা হচ্ছে ‘টাইপেজ’। ‘দি জেনারেল লাইন’ চলচ্চিত্রে আমরা উল্লেখযোগ্য টাইপেজের কাজ দেখি। দৃশ্যায়নের ক্ষেত্রেও আইজেনস্টাইন একটি বড় পরিবর্তন আনেন। ক্যামেরাকে অতীতের ধরাবাঁধা ফ্রেম থেকে মুক্ত করেন। বিভিন্ন জ্যমিতিক কোণ থেকে দৃশ্য ক্যামেরায় নিলেন। তাঁর এ ধরনের দৃশ্যায়নের ক্ষেত্রে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এবং জাপানের জ্যামিতিক চিত্রকলার প্রভাব ছিল। ‘পটেমকিন’-এ কামানের কৌণিক ভঙ্গিমা, টপ এঙ্গেল শটে প্যারাম্বুলেটর গড়িয়ে যাবার দৃশ্য কিংবা বৃদ্ধার চশমার জ্যামিতিক রেখাচিত্র বা ডায়াগোনাল অ্যাঙ্গেল শট চলচ্চিত্রে নতুন মাত্রা যুক্ত করল। এতসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে অনেকসময় বিষয়বস্তু ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটেছিল। চিন্তার উপর কাজ করতে গিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবেগের জায়গাটা বাদ পড়েছিল। আঙ্গিক-এর উপর মাত্রাতিরিক্ত জোরও পড়েছিল। তবে এক্ষেত্রে প্রদর্শনপ্রিয়তা বা তাক লাগিয়ে দেয়ার জন্য এটা তিনি করেননি। শিল্পটিকে অনেক বেশি আয়ত্তে আনা বা শিল্পের রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য নানবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন আইজেনস্টাইন।

মুষ্টিমেয় যে কয়েকজন প্রতিভা চলচ্চিত্র নামক যন্ত্র ও বিজ্ঞাননির্ভর এই মাধ্যমটিকে অল্প সময়ে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন আইজেনস্টাইন তাঁদের মধ্যে প্রথম সারির প্রথম ব্যক্তি। আইজেনস্টাইন জানতেন চলচ্চিত্র অত্যন্ত শক্তিশালী একটি মাধ্যম। অক্টোবর বিপ্লবের চেতনা দেশের জনগণের কাছে ও সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার এক অগ্রণী সৈনিক আইজেনস্টাইন। এটা সহজেই অনুমেয় কেন আইজেনস্টাইন আমেরিকা গেলে হলিউডে সিনেমার হর্তা-কর্তারা তাঁকে তাড়াবার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠেন।
পৃথিবীর সর্বত্র চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মধ্যে আইজেনস্টাইন অসংখ্যবার চর্চিত হয়েছে। কিন্তু তাঁর চিন্তা কতটুকু উপলব্ধিতে এসেছে? আইজেনস্টাইন লিখেছেন : ‘ভবিষ্যতের জন্য আমরা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে সমৃদ্ধ হবো। আমরা নিশ্চয় নিরলসভাবে কাজ করবো। আমরা অবশ্যই অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাব। শিল্পকলার নতুন যুগ ও নতুন দায়িত্বকে আমরা সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করবো। আমরা নিশ্চয়ই কাজ, কাজ এবং কাজ করে যাবো সেই শিল্পকলার জন্য, যার সৃষ্টি আমাদের যুগের সবচেয়ে প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণাকে লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে’। চ্যাপলিনের জয়ন্তীতে আইজেনস্টাইন শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছিলেন : “হ্যালো, চ্যাপলিন! আমরা যেন আগামী বহু বছর ধরে একসাথে হাঁটি, সুন্দরতম মানবিক আদর্শের জন্য লড়াই করে চলি।” এখনকার শিল্পপ্রেমীরা, চলচ্চিত্রপ্রেমীরা কি মানুষকে নিয়ে ভাবছে?

আইজেনস্টাইন একটি সুন্দর দেশে তাঁর কাজ করেছিলেন একটি সুন্দর, মানবিক, চিন্তাশীল পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য। তিনি মাত্র পঞ্চাশ বছর বেঁচেছিলেন, কিন্তু তাঁর চিন্তা, কর্ম শত শত বছরকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আজকে তাঁর চিন্তা আর ক্রিয়ার মর্মবস্তুটাকে যতটুুকু ধারণ করতে পারবো ততটুকুই তাঁর প্রতি সম্মান জানানো হবে।

সহায়কগ্রন্থ:
ফিল্মফর্ম – সের্গেই আইজেনস্টাইন
সের্গেই আইজেনস্টাইন : জীবন ও চলচ্চিত্র – সৌমেন গুহ
সিনেমার ইতিবৃত্তান্ত – পার্থ রাহা
চলচ্চিত্র চর্চা – সের্গেই আইজেনস্টাইন সংখ্যা

নভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষে ঐকতান – চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments