Friday, April 19, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - মার্চ ২০১৮আরজ আলী মাতুব্বর — আলো হাতে চলা আঁধারের এক যাত্রী

আরজ আলী মাতুব্বর — আলো হাতে চলা আঁধারের এক যাত্রী

arojali rachana somorgro‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর’ কথাটি শোনেনি এমন মানুষ আমাদের দেশে কম। চারপাশের সমাজ-পরিবেশে এ কথাটিই আমরা শিখি প্রতিনিয়ত — তর্ক করতে নেই, বিশ্বাস করো। ছোটবেলাতেও যে শিশুটি বেশি প্রশ্ন করে তাকে ‘বাচাল’ বলে আমরা প্রায়ই থামিয়ে দিই। এমন প্রশ্নহীন পরিবেশে কখন যে অনুসন্ধিৎসু-কৌতুহলী মনটা মরে যায়, কেউ তার হদিস পায় না। তাই তো চারপাশে এমএ-বিএ ডিগ্রিধারীদের ছড়াছড়ি হলেও ভাগ্য বা কপালে বিশ্বাস করে না, এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যায়।

বিশ্বাসের এমন বদ্ধতা আমরা অনেকেই অতিক্রম করতে না পারলেও পেরেছিলেন দূর পাড়াগাঁয়ের ‘অশিক্ষিত’ এক মানুষ। আজকাল শিক্ষা যে ডিগ্রি আর সার্টিফিকেটের মাপকাঠিতে দেখা হয়, সেটা তাঁর ছিল না। দ্বিতীয় শ্রেণির উপরে উঠতে পারেননি। কিন্তু তথাকথিত শিক্ষিত মানুষরা যা পারে না, স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের এমন এক উন্নত স্তরে তিনি উঠেছিলেন যা দেখলে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যেতে হয়। সমাজ আর মানুষের প্রতি প্রবল দায়বোধ আর জ্ঞান সাধনার প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ — এই মানুষটিকে উন্নীত করেছে এদেশের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক দার্শনিকের আসনে। আজ সেই মানুষটিরই গল্প শুনবো আমরা, তবে খুব ছোট্ট পরিসরে।

আরজ আলী মাতুব্বর তাঁর নাম। বরিশাল শহরের অদূরে লামচরি গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে তাঁর জন্ম ১৯০০ সালের ১৭ ডিসেম্বর। শৈশবেই তিনি বাবাকে হারিয়ে ছিলেন। বাবা মারা গেলে খাজনার দায়ে কৃষি জমিটুকু নিলাম করিয়ে নেন লাখুটিয়ার জমিদার। সেসময় গ্রামে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। শরিয়তি শিক্ষালাভের জন্য এক মুন্সি সাহেবের মক্তবে কিছুদিন অবৈতনিকভাবে লেখাপড়া করেছিলেন। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে মক্তবটি বন্ধ হয়ে গেলে তাঁরও পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়। মক্তবেই তিনি স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ শেখেন। বই, শ্লেট কেনার সঙ্গতি ছিল না। তালপাতা-কলাপাতাতেই অক্ষর লেখা শিখেছিলেন। প্রবল দারিদ্র্যের পরও পড়ালেখার প্রতি তাঁর প্রচন্ড আগ্রহ দেখে এক আত্মীয় ‘বাল্যশিক্ষা’ নামের একটি বই কিনে দেন। এই বইটিই ছিল তাঁর বাল্যশিক্ষার একমাত্র সম্বল। কতটা খুশি হয়েছিলেন বোঝা যায়, “সেদিন ছিল আমার জীবনের সর্বপ্রথম বই হাতে ছোঁবার দিন। তাই আনন্দে আমার মনটা ফেটে যাচ্ছিল, … সে বইখানা ছিল আমার ক্ষুধার্ত মনের খাদ্য।”

এরপর তাঁর পড়াশুনা আর খুব বেশি অগ্রসর হয়নি। দারিদ্র্যের নির্মম কষাঘাতে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার প্রবল ইচ্ছাকে জলাঞ্জলি দিতে হয়েছিল। কত নির্মম ছিল সেই অবস্থা তা আজ বলে শেষ করা যাবে না। আমাদের এ রচনার উদ্দেশ্যও তা নয়। বরং এমন তীব্র প্রতিকূলতার মধ্যেও আরজ আলী মাতুব্বর কোন শক্তির বলে জ্ঞানের শিখরে উঠলেন এবং দার্শনিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন তা-ই আমরা দেখব।

প্রতিষ্ঠানভিত্তিক পড়াশুনা অগ্রসর না হলেও যুবক বয়স থেকে আরজ আলী মাতুব্বর বরিশাল জেলার পাবলিক লাইব্রেরিসহ বিভিন্ন লাইব্রেরিতে জ্ঞানসাধনা চালিয়ে যান। পড়াশুনার পাশাপাশি তাঁর ছিল সমাজের চারপাশটাকে দেখার তীক্ষ্ন অনুসন্ধানী চোখ। এই আগ্রহ তাঁর এমনি এমনি তৈরি হয়নি। সে সময়ের সামাজিক কর্তৃত্ব, নানা কুসংস্কার, অযৌক্তিক সামাজিক রীতি-নীতিকে অস্বীকার করার অব্যাহত লড়াই থেকে তাঁর এটি তৈরি হয়েছিল। আরজ আলী মাতুব্বর সমাজের মুখোমুখি দাঁড়াতে গিয়ে বুঝেছিলেন ধর্মীয় কূপমন্ডূকতা কীভাবে সমাজের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে আর সেগুলোকে কীভাবে ব্যবহার করছে সমাজের দন্ডমুন্ডের কর্তারা। তাই তিনি যেসব প্রশ্ন তুলেছিলেন সেগুলো আপাতদৃষ্টিতে ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন মনে হলেও আসলে সেগুলো ছিল সমাজের আধিপত্যবাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে।

তাঁর চিন্তার বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছিল প্রাণপ্রিয় মায়ের মৃত্যুকালের একটি ঘটনায়। আরজ আলী ধার্মিক মায়ের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য একটি ছবি তুলে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই কাজটি করতে গিয়ে সমাজের কাছে অমানবিক আচরণের শিকার হলেন। তাঁর মায়ের জানাজায় গ্রামের কেউ অংশ নিল না, ‘ছবি তোলা ধর্মবিরোধী কাজ’ আখ্যা দিয়ে। তিনি বলেছিলেন, ‘দোষ যদি কিছু হয় সেটি তার, মৃত মানুষের তো কোনো দায় এতে নেই।’ কিন্তু সেদিন সমাজের কর্তারা তাঁর কথা শোনেনি। মায়ের এই অবমাননা তাঁকে ভীষণভাবে আহত করেছিল। এই ঘটনা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল যুক্তিবাদী হতে, ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হতে।

কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে মানুষের চেতনায় আঘাত করে মুক্তচিন্তার উন্মেষ ঘটানোর চেষ্টাই ছিল তাঁর সংকল্প। তাঁর রচিত এক একটি বাক্য ছিল সমাজের অচলায়তনে এক একটি আঘাত। বলেছেন, যার ব্যবহারিক ক্রিয়াকলাপ নেই তার অস্তিত্ব স্বীকার করার কোনো যুক্তি নেই। তাঁর মতে যেসব ঘটনার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো প্রমাণ নেই অথবা কার্যকারণ সম্বন্ধ ব্যাখ্যা করার কোনো প্রয়াস নেই, এক কথায় যুক্তি যেখানে অনুপস্থিত এই রকম কাহিনীতে বিশ্বাস রাখার নামই হলো অন্ধবিশ্বাস। বিজ্ঞানের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ আস্থা। কতটা বিজ্ঞানমনস্ক ছিলেন তা বোঝা যায় এই কথায় — “বিজ্ঞান প্রত্যক্ষ ও অনুমানের উপর প্রতিষ্ঠিত তাই কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে আমাদের সন্দেহ নাই। বিজ্ঞান যাহা বলে, তাহা আমরা অকুণ্ঠ চিত্তে বিশ্বাস করি। কিন্তু অধিকাংশ ধর্ম এবং ধর্মের অধিকাংশ তথ্য অন্ধ বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত।”

আরজ আলী মাতুব্বর চেয়েছিলেন সমাজের সমস্ত স্তরে প্রশ্ন করার অভ্যাস গড়ে উঠুক। যেকোনো কিছুকে বিনা বাক্যে মেনে নেয়াকে একদমই পছন্দ করতেন না তিনি। মনে করতেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের জন্মই হয়েছে এই প্রশ্ন করার মানসিকতা থেকে। বলেছেন, “বাক্যস্ফূরণ আরম্ভ হইলেই শিশু প্রশ্ন করিতে থাকে, এটা কি? ওটা কি? বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্কুলে, কলেজে ও কাজে-কর্মে অনুরূপ প্রশ্ন চলিতে থাকে, এটা কি, ওটা কি, এরূপ কেন হইল, ওরূপ কেন হইল না ইত্যাদি। এই রকম ‘কি’ ও ‘কেন’র অনুসন্ধান করিতেই মানুষ আজ গড়িয়া তুলিয়াছে বিজ্ঞানের অটল সৌধ।”

বিশ্বখ্যাত দার্শনিক ভলতেয়ার যেমন বলেছিলেন, ‘what is reasonable that is acceptable, that is truth`;  আরজ আলী মাতুব্বরও মনে করতেন ‘যুক্তিই সত্য’। মানুষের সক্ষমতার উপর ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। মনে করতেন মানুষকে কোনো নিয়ম দিয়ে আটকে রাখা যায় না। সে তার নিজের ভাগ্য নিজেই তৈরি করে নিতে পারে। মানুষ কোনো জড় পদার্থ নয়, সজীব ও সচেতন অস্তিত্বশীল জীব হিসাবেই সে শির উন্নত করে দাঁড়াবে। তাই সমাজ প্রভুরা যখন কোনো কিছু না হবার পিছনে কপালের দোষ দেয় কিংবা ভাগ্যে ছিল না বলে তখন আরজ আলী ব্যঙ্গ করে বলেন, “হিন্দুধর্মে দেবদেবী সম্পদ বিতরণের মালিক হওয়ার কারণে কেষ্টসাধু (আরজ আলীর প্রতিবেশি) পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত কলা গাছকে লক্ষ্মী সাজিয়ে পূজা করে ধনী হতে পারেনি। অথচ আমেরিকার ফোর্ড সাহেব (হেনরি ফোর্ড) লক্ষ্মী পূজা না করেও সারা পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী ব্যক্তি ছিলেন।” সমাজের এত অভাব-দুর্দশা যে ঈশ্বরের ইচ্ছাতে হয় না তা তিনি বলেছেন এভাবে — “বর্তমানে খাদ্যের অভাব ঘটিয়াছে তাহা সত্য, কিন্তু ইহা খাদ্য-খাদকের সমতার অভাবেই ঘটিয়াছে, ‘বে-ঈমান’ বা অবিশ্বাসের জন্য নয়।”

ধর্মীয় নানান অপব্যাখ্যা যেগুলো মানুষকে ন্যায়নিষ্ঠা সম্পর্কে ভুল ধারণা দেয় সেগুলোকে অনুপম ব্যাখ্যায় তিনি খন্ডন করেছিলেন। প্রত্যেকটি ধর্ম যে বিভিন্ন সময়ের সমাজ বাস্তবতার নিরিখে এসেছিল তা তিনি বুঝেছিলেন। তাই নানা কল্পকাহিনীর বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা তিনি দিতে পেরেছেন। বলেছেন, ‘… কুশ-লবকে গ্রহণ করলেও সীতাকে গ্রহণ করেননি রামচন্দ্র সেদিনও। ….তাই তিনি (সীতা) ক্ষোভে দুঃখে হয়তো আত্মহত্যা করেছিলেন। নারী হত্যার অপবাদ লুকানোর উদ্দেশ্যে এবং ঘটনাটি বাইরে প্রকাশ পাওয়ার ভয়ে শ্মশানে দাহ করা হয়নি। সীতার শবদেহটি, হয়তো লুকিয়ে প্রোথিত করা হয়েছিল মাটির গর্তে, পুরীর মধ্যেই। আর তা-ই প্রচারিত হয়েছে, ‘স্বেচ্ছায় সীতা দেবীর ভূগর্ভে প্রবেশ বলে’।’ ইসলাম ধর্মে ‘হিল্লা প্রথা’ নিয়ে বলেছেন, “তালাকের ঘটনা যে ভাবেই ঘটুক না কেন, ত্যাজ্য স্ত্রীকে পুনঃগ্রহণে স্ত্রী যে নির্দোষ, ইহাই প্রমাণিত হয়। …..ইহাতে দেখা যায় যে, স্ত্রীর উপর মিথ্যা দোষারোপ করিয়া অথবা ক্রোধাদির বশবর্তী হইয়া স্ত্রীত্যাগে স্বামীই অন্যায়কারী বা পাপী, অথচ পুনঃগ্রহণযোগ্য নির্দোষ স্ত্রীকে পুনঃগ্রহণে ‘হিল্লা’ প্রথার নিয়মে স্বামীর পাপের প্রায়শ্চিত্র করিতে হয় সেই নির্দোষ স্ত্রীকেই। অপরাধী স্বামীর অর্থদন্ড বেত্রাঘাত ইত্যাদি না-ই হউক, অন্তত তওবা (পুনরায় পাপকর্ম না কবিবার শপথ) পাবারও বিধান নাই, আছে নিষ্পাপিনী স্ত্রীর ইজ্জতহানির ব্যবস্থা। একের পাপে অন্যকে প্রায়শ্চিত্র করিতে হয় কেন?”

সমাজের নিপীড়িত মানুষের কান্না তাঁকে প্রবলভাবে আলোড়িত করত। আকণ্ঠ দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হয়েছেন বলে বুঝতেন তার কষ্ট। ধর্মীয় নৈতিকতাকে তিনি যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। কিন্তু দেখেছেন দুখী-দরিদ্র মানুষদের জন্য তথাকথিত ধর্মপ্রাণ মানুষদের অবহেলা। দেখেছেন ধর্ম পালনের নামে আনুষ্ঠানিকতার পেছনেই হাজার হাজার টাকা ব্যয়। তাই আক্ষেপ করে বলেছেন, “যে দেশে লক্ষ লক্ষ নর-নারী ও শিশু অনাহারে অস্থি-কঙ্কালসার হয়ে সমস্ত দিন ঘুরে ঘুরে একমুঠো অন্ন পাচ্ছে না, সে দেশের বিমানবাহী হাজিদের নিজে উড়ে, টাকা উড়িয়ে হজ্বব্রত পালনের কোনো সার্থকতা নাই। যে দেশের হাজার হাজার গৃহহীন মানুষ মুক্তাকাশের তলে পথে-প্রান্তরে রাত কাটাচ্ছে, সে দেশে উপাসনা মন্দিরে সাততলা মিনার তৈয়ারে কোনো সার্থকতা নাই।” এমন সত্যউচ্চারণ আজ কতজন করতে পারে?

নারীদের ব্যাপারে তাঁর ছিল অসামান্য সংবেদনশীলতা। তিনি স্ত্রী-পুরুষের ভূমিকাকে কখনও পৃথক করে দেখেননি এবং সেভাবে শ্রম বিভাজনের নীতি গ্রহণ করেননি। এ ব্যাপারে কতটা ইতিহাসমনস্ক ছিলেন বোঝা যায়, “আদিম কালের মেয়েদের হাতেই প্রবর্তন হইল গম ও বার্লির চাষ অর্থাৎ কৃষিকাজের সূচনা। বস্তুত পৃথিবীতে কৃষিকাজের প্রবর্তন করিয়াছিল নারীরা, যীশুখ্রিষ্ট জন্মিবার প্রায় সাড়ে চারি হাজার বৎসর আগে।” সেই মেয়েদের এত অপমান, তাঁর মায়ের অপমান তাই তিনি সহ্য করতে পারেননি।

উপরের আলোচনা থেকে বোঝা যায় আরজ আলী মাতুব্বর কতটা সমাজমনস্ক মানুষ ছিলেন। ধর্মের ব্যবহার নিয়ে নানা প্রশ্ন তুললেও তার প্রতিটি বিষয় ছিল আসলে সমাজের নানা অসঙ্গতিকে তুলে ধরার প্রয়াস। কিন্তু তাঁর এই কর্মকান্ড তৎকালীন সমাজপ্রভুরা মেনে নেয়নি। এখনও যেমন নেয় না। ধর্মীয় নানা কাহিনী ও বিশ্বপ্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর প্রশ্নগুলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর এ কর্মকান্ড সমাজের জন্য ক্ষতিকর হচ্ছে বলে তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট ও তাবলিগ জামাতের আমির করিম সাহেব আরজ আলীর সাথে দেখা করতে আসেন। ম্যাজিস্ট্রেট নানা জেরা করার পর আরজ আলী তাকে একটি প্রশ্নের তালিকা দেন। এ কথাও বলেন যদি এসব প্রশ্নের জবাব পান তবে জামাতের সদস্যও হবেন। কিন্তু আরজ আলী সেসব প্রশ্নের উত্তর পাননি। বরং তাঁকে ‘কমিউনিস্ট’ আখ্যা দিয়ে ফৌজদারি অপরাধে আসামী করা হয়। তিনি কিছুদিন জেলও খাটেন।

আরজ আলী মাতুব্বর কেবল প্রশ্ন ছুড়ে দেননি, খুঁজেছেন সমাধানও। চেয়েছিলেন সমতাভিত্তিক সাম্যের একটি সমাজ। একজন মানবতাবাদী দার্শনিক হয়েও তাঁর চিন্তার স্তর সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। মার্কসবাদী দার্শনিকের মতোই বলেছিলেন, “প্রত্যেকে নিজের ‘সাধ্য’ অনুযায়ী সমাজকে দেবে এবং নিজের ‘প্রয়োজন’ অনুসারে নেবে। এ সমাজে কারো কাজের অনিশ্চয়তা থাকবে না, ধনী ও দরিদ্রের প্রভেদ থাকবে না। মেহনতি মানুষের শোষণ করার মতো মালিক বা মুনাফা শিকারির দল থাকবে না, থাকবে না শ্রেণিগত বৈষম্যের বিশাল প্রাচীর।” জ্ঞানার্জনের আধুনিক কোনো সুযোগ-সুবিধা না পেলেও, উন্নত পারিপার্শিক সংশ্রব না থাকলেও কেবল প্রশ্নের অনুসন্ধানের জোরে আর নিপীড়িত মানুষের প্রতি প্রবল ভালোবাসা থেকে আরজ আলী মাতুব্বর কতটা উন্নত চিন্তা ধারণ করতে পেরেছিলেন, তা আজ ভাবলে অবাক হতে হয়।
শুধু নিজে জ্ঞানচর্চা করেননি, যে লাইব্রেরি ব্যবহার করে তিনি এতবড় সম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন তা নিজের গ্রামেও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিনা বেতনে ১৯২৫ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত সাফল্যের সাথে শিক্ষকতা করেছিলেন। ১৯২৫ সালে লামচরি গ্রামে একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন। শেষ জীবনে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরি’। সারা জীবনের অর্জিত সম্পত্তির বেশিরভাগ দান করেছেন এই পাবলিক লাইব্রেরির জন্য। ১৯৮৫ সালের ১৫ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

দেশের এত বড় একজন জ্ঞানসাধক, দার্শনিক সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি না। জানি না কারণ শাসকরা এই মানুষটির চিন্তা-জীবন সংগ্রাম আমাদের সামনে আনতে চায় না। কেননা যে নিপীড়িত মানুষের পক্ষে আরজ আলী মাতুব্বর দাঁড়িয়েছিলেন, সেই মানুষগুলোর অবস্থা আজও পাল্টেনি। যে যুক্তির শক্তি দিয়ে তিনি ধর্মীয় কূপমন্ডুকতা, অন্ধবিশ্বাসের বেড়াজাল ভেদ করেছিলেন; আজও সেগুলো শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রবলভাবে সমাজে বহমান। এ কারণেই আরজ আলী মাতুব্বরের শিক্ষা, তাঁর দার্শনিক চিন্তাকে শাসকরা ভুলিয়ে দিতে চায়। কিন্তু আমরা যারা অন্ধকারের বিরুদ্ধে সত্যের মশাল জ্বালব বলে লড়ছি তারা কী করব? প্রখ্যাত সাহিত্যিক, সমাজচিন্তক আহম্মদ শরীফ বলেছিলেন, “চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কুসংস্কারের, অশিক্ষার, কুশিক্ষা ও অবৈজ্ঞনিকতার। তারই মধ্যে হাতে একটি আলো নিয়ে ঘুরেছেন এই বৃদ্ধ একাকী।” আরজ আলী যদি জীবনভর সত্যের আলো জ্বালিয়ে রাখার নিরবিচ্ছন্ন সাধনা করে যেতে পারেন, আমরা কেন পারব না?

সাম্যবাদ মার্চ ২০১৮

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments