Tuesday, March 19, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - অক্টোবর ২০১৮ইয়েমেন সংকট: সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণে বিপর্যস্ত মানবতা

ইয়েমেন সংকট: সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণে বিপর্যস্ত মানবতা

112457

কয়েকদিন আগে পত্রিকার পাতায় চোখ বুলাতে গিয়ে একটি ছবি দেখে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠেনি এমন মানুষ বিরল। ছবিতে সারি সারি ছোট ছোট কবর। সৌদী বোমায় ইয়েমেনের সাদা প্রদেশের স্কুলবাসে হামলা করে হত্যা করেছে ৪০ শিশুসহ মোট ৫১ জনকে। শুধু তাই নয় এই নৃশংস হামলাকে যৌক্তিক বলেও দাবী করে সৌদি আরব। পরে অবশ্য আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে এই বক্তব্য ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয় তারা। সম্প্রতি আবার বোমা হামলায় সৌদি জোট হত্যা করেছে আরও ২২ শিশুকে। ইয়েমেনে এই হত্যাকান্ড চলছে ২০১৫ সাল থেকে। সাম্রাজ্যবাদী নকশা বাস্তবায়নে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করছে সৌদি-আরব আমিরাত জোট আর মদদদাতা হলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স।

অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ও সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণ

সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে ‘আরব বসন্ত’ শুরু হলে তার হাওয়া ইয়েমেন এসে পৌছায়। ১৯৯০ সাল থেকে ইয়েমেনে পুঁজিবাদী শাসন ব্যবস্থা চালু হয়। ফলে এ সময়ে সরকারগুলো ছিল পুঁজিপতি ও সাম্রাজ্যবাদীদের তোষণকারী। শোষণ-লুন্ঠনে অতিষ্ঠ জনতার প্রতিরোধে  প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহ তার ডেপুটি আবদারাবুহ মানসুদ হাদীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়। কিন্তু আরব বসন্তের অন্যান্য দেশের মতই সঠিক রাজনৈতিক মতাদর্শের নেতৃত্বের অভাবে পূর্বের ধারাবাহিকতায় দেশ পরিচালিত হতে থাকে। তাই বিক্ষোভ আবারও দানা বাঁধে। আর এ সময়েই বিদ্রোহী হুতি আন্দোলনের কর্মীরা সাদা প্রদেশ দখল করে নেয়। অন্য সম্প্রদায়ের মানুষজনও হুতিদের সমর্থন জানায়। এরপর তারা রাজধানী সানার নিয়ন্ত্রণ নেয়। এ পর্যায়ে হুতিরা আর নিরাপত্তাবাহিনীগুলো প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহ এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। প্রেসিডেন্ট হাদী এ সময় দেশ থেকে পালিয়ে যায়। আর এ পরিস্থিতির সুযোগ নেয় স্বার্থান্বেষী সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীগুলো। প্রেসিডেন্ট হাদীকে পুনর্বহাল করতে ২০১৫ সালে সৌদি আরব আরও ৮টি ইসলামিক দেশসহ জোটবদ্ধ হয়ে ইয়েমেনে আক্রমণ পরিচালনা করে। এই জোটকে লজিস্টিক এবং ইন্টেলিজেন্স সহায়তা প্রদান করে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স। অপরদিকে  হুতিদের পেছনে ইরানের সমর্থন রয়েছে বলে জানা যায়। ইরানের বিরুদ্ধে হুতিদেরকে অস্ত্র দেয়ার অভিযোগ থাকলেও ইরান তা বরাবরই অস্বীকার করছে। ২০১৫ সালে হুতিদের সরিয়ে এডেন দখল করে সৌদি জোট। পলাতক প্রেসিডেন্ট হাদী দেশে না ফিরলেও তার সমর্থিত সরকার এডেন থেকে অস্থায়ীভাবে কার্যক্রম শুরু করে। অপরদিকে হুতিসহ অন্যান্যরা সাদা, সানা, হুদেইদাহ প্রভৃতি অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে। সৌদি জোট ২০১৭ সালে ইয়েমেনে মিসাইল হামলা শুরু করে। এ সময় তারা দেশটির চারিদিকে অবরোধ জারি করে। আকাশপথে অবরোধ জারি করায় মানবাধিকার কর্মীরা দেশটি ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়।

মানবসৃষ্ট সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়

সৌদি জোটের দাবি জঙ্গি সন্ত্রাস দমনে তারা এ আক্রমণ পরিচালনা করছে। কিন্তু বাস্তবে তাদের মিসাইলগুলোর বেশিরভাগের লক্ষ্যবস্তু ছিল বেসামরিক স্থাপনা, যেমন-আশ্রয়শিবির, হাসপাতাল, স্কুল, কৃষিখামার, অফিস-আদালত প্রভৃতি জায়গা। ফলাফল গত ৩ বছরে ইয়েমেনে ১০ হাজারের বেশী মানুষ নিহত হয়েছে আর আহত হয়েছে প্রায় ৫৩ হাজার জন। এদের বেশীরভাগই বেসামরিক লোকজন। নিয়মিত বোমাবর্ষণে দেশটির পানি এবং স্যানিটারী ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছে। ফলে কলেরার মত সামান্য রোগও চিকিৎসার অভাবে মহামারীরূপ ধারণ করেছে। ডিপথেরিয়াও মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশটির ৭৫% মানুষের জরুরী মানবিক সহযোগিতা প্রয়োজন। অন্তত সোয়া কোটি মানুষের বেঁচে থাকার জন্য জরুরী খাদ্য সহায়তা দরকার। ৫ বছর বয়সের নিচের প্রায় ৪ লাখ শিশু চরম অপুষ্টিতে ভুগছে। অথচ দেশটির চারিদিকে আবরোধ থাকায় সেখানে মানবাধিকার কর্মী বা ত্রাণ পাঠানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। জাতিসংঘের মতে,“বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবসৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়”।

আধিপত্য বিস্তারই এই আক্রমণের কারণ

সংশোধনবাদী নেতৃত্বের ফলাফল হিসেবে পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর পতন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভে সাম্রাজ্যবাদ শোষণ লুন্ঠনের খোলা ময়দান পেয়ে যায়। ফলে মুক্তবাজার অর্থনীতি বা বিশ্বায়নের নামে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো ‘উন্নয়ন আর গনতন্ত্রের’ বুলি দিয়ে দেশি-বিদেশি পুঁজিকে অবাধ লুন্ঠনের উন্মুক্ত পথ প্রদান করে। আর শোষণ লুন্ঠনের এই মুক্তবাজার অর্থনীতি নির্ভর করে দেশে দেশে সামরিক শক্তির প্রয়োগের  উপরে। যদিও সাম্রাজ্যবাদীরা তা আড়াল করতে চায়। তাই সামরিক শক্তির প্রয়োগের কারণ হিসেবে তারা হাজির করে জঙ্গিবাদের জুজু বা গণতন্ত্র রক্ষার মধুর বুলি। ঠিক এমনটাই ঘটেছে ইয়েমেনের ক্ষেত্রেও। আরব বসন্তের পর ইয়েমেনের খনিজ তেল, বন্দরে মার্কিন আধিপত্য হুমকির মুখে পড়ে। আবার দেশটির সংঘাতের সময় সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও প্রকট হয়ে ওঠে। অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদদপুষ্ট সৌদি আরব এবং রাশিয়ান সাম্রাজ্যবাদের সাথে যুক্ত ইরানের আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে। তাই ইয়েমেনে পুনরায় দখলদারিত্ব স্থাপন করতে, সেখানে নিজেদের পুতুল সরকার বসাতে আক্রমণ করে মার্কিন সৌদি জোট। অথচ তা আড়াল করতে আক্রমণের কারণ হিসেবে তারা বলছে জঙ্গি সন্ত্রাস দমনের কথা। বাস্তবে ইয়েমেনে আই এস, আল কায়েদার মত জঙ্গি সংগঠনের উত্থানের পেছনে রয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরাই। ১৯৬৭ সালে ইয়েমেন যখন কমিউনিস্ট শাসনের অধীনে ছিল তখন আফগানিস্তানে তালেবানদের নতুন কর্মী তৈরীর জন্য এ জায়গাকে বেছে নেয় মার্কিনরা। তখনই জঙ্গিবাদের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় ইয়েমেনে। শুধু তাই নয়, বর্তমানেও জঙ্গিবাদে মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতার বহু প্রমাণও পাওয়া গেছে। তাই জঙ্গিবাদ দমন নয়, ইয়েমেনে আধিপত্য বিস্তারই এই আক্রমণের প্রধান কারণ।

শিশু হত্যার অস্ত্র ব্যবসায় বাঁচার পথ খোঁজে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতি

পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয় বলে জনগনের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে পারে না। ফলে উৎপাদিত পণ্য বাজারে পড়ে থাকে বিক্রি হয় না, অর্থাৎ মন্দা সৃষ্টি হয়। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা বারবার এই মন্দার মধ্যে পড়ে। আর এই  মন্দাবস্থা কাটিয়ে অর্থনীতি সচল রাখতে অর্থনীতির সামরিকীকরণ এই ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আর সামরিক খাত চাঙ্গা রাখতে প্রয়োজন যুদ্ধের। লেনিন বলেছেন “সাম্রাজ্যবাদ অনিবার্যভাবে যুদ্ধের জন্ম দেয়”। কমরেড শিবদাস ঘোষ সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির সামরিকীকরণ আরও স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন। তাঁর মতে, পুঁজিবাদ এখন অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে সামরিক উৎপাদন করছে এবং সেজন্য বিশ্বযুদ্ধ বাধাতে না পারলেও সর্বদা ছোটখাট যুদ্ধ করছে, তাও না পারলে সর্বদা যুদ্ধের হুমকি বজায় রাখছে। আর তার প্রমাণস্বরূপ আমরা দেখি যে, মিথ্যাচার করে ইরাকে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে মার্কিনিরা। এই রক্তাক্ত ইতিহাস আরও রচিত হয়েছে যুগোশ্লাভিয়া, আফগানিস্তান, লেবানন, হাইতিসহ ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে। ইয়েমেন আক্রমণের হেতুও এর ব্যতিক্রম নয়। মরণাপন্ন মার্কিন পুঁজি প্রাণ বাঁচাতে ইয়েমেনে শিশু হত্যার অস্ত্র বিক্রির পথ বেছে নিয়েছে। ১০ অক্টোবর ২০১৬ ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল থেকে জানা যায় এই আক্রমণের জন্য সৌদি আরবের কাছে প্রায় ১.১০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ট্যাঙ্ক ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাজ্য বিক্রি করেছে ১ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের বৃটিশ জেট, বোমা এবং মিসাইল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৭ সালের মে মাসে সৌদি আরব সফরকালে ১১০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি চুক্তি করেছেন। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে সৌদি আরবের কাছে আরও ৬৭০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি চুক্তি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে সাম্রাজ্যবাদ মুখে শান্তিরক্ষার কথা বলে অস্ত্র ব্যবসার মাধ্যমে বাজার চাঙ্গা রাখতেই চালাচ্ছে রক্তের এই হোলি খেলা। আর বিশ্বের মানবিক মানুষের কাছে এই নোংরামো আড়াল করতে বলছে এ যুদ্ধ শিয়া-সুন্নীর দ্বন্দ্ব, এ সমস্যা জঙ্গিবাদের আর তাদের ভূমিকা ত্রাতার। আর এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ ভূমিকা পালন করছে নীরব দর্শকের। 

ধর্মের মোড়ল সৌদি আরবের হাত আজ মুসলমানের খুনে রঞ্জিত

সৌদি আরবের ইয়েমেন আক্রমণ প্রমাণ করে দিল যে কথায় কথায় ইসলামের দোহাই দেয়া সৌদি আরব ইসলামকে ন্যূনতম তোয়াক্কা করে না। তা না হলে ইয়েমেনের উপর এমন ধ্বংসযজ্ঞ তারা চালাতে পারতো না। সৌদি আরব মুসলিম দেশ নিয়ে কনফারেন্স করে, দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানোর জন্য সারা বিশ্বের হাজার হাজার ইসলামী সংগঠনকে বরাদ্দ দেয় – অথচ নিজে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে হামলা চালায় যার বেশিরভাগ মানুষ মুসলমান। সে দেশের শিশুদের সে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। যে ধরণের যুদ্ধই চলুক না কেন, যুদ্ধ চলাকালে শিশুদের উপর আক্রমণ কোন নীতির মধ্যে পড়ে না। এই সামান্য নিয়মটুকু না মেনে নির্মমভাবে স্কুলবাসে হামলা চালালো সৌদি আরব। যারা সৌদি টাকায় সংগঠন গড়ে দ্বীনের দাওয়াত মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেন, তাদের একটু ভাবা উচিত, আদতেই দ্বীন বলে কোন ব্যাপার সৌদি আরবের আছে কি না, আরবের মোড়ল দেশগুলোর আছে কি না। আরব বিশ্বের আর কোন দেশও এর প্রতিবাদ করেনি। প্রতিবাদ করেনি বাংলাদেশের তথাকথিত ইসলামী দল ও সংগঠনগুলো।  

সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই বাঁচার একমাত্র পথ

ইয়েমেনে একের পর এক ভয়াবহ আক্রমণের পর সে দেশে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও প্রতিরোধ গড়ে তুলছে সে দেশের মানুষ। সৌদি জোটের আক্রমণের এক বছর পূর্তিতে মিছিল বের করেছে লাখো জনতা। তারা বলেছে “আমাদের সমস্যা সমাধানে বাইরের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই। আমাদের সমাধান আমরাই খুঁজে নেব।” সাম্রাজ্যবাদী এ আক্রমণের প্রতিবাদ করছে সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষ। মার্কিন দেশের সাধারণ মানুষও এই সমস্ত আক্রমণের প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নামছে। ফলে এক মেরু বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদ অনায়াসে শোষণ-লুন্ঠন চালানোর যে স্বপ্ন দেখেছিল, তা ল্যাটিন আমেরিকা বা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের জনতার মত ইয়েমেনের জনতাও চুরমার করে দিচ্ছে। আর এ পরিস্থিতিতে এই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনকে জোরদার করতে বাংলাদেশের জনতাকে বিশ্বের মুক্তিকামী  মানুষের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তার সাথে তাদের বুঝতে হবে সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের স্বার্থের কাছে ধর্ম কোন ব্যাপার নয়, ধর্ম তাদের কাছে ব্যাপার হয় তখনই যখন তাদের স্বার্থে এর অনুভূতিকে ব্যবহার করার দরকার হয়।

সাম্যবাদ অক্টোবর ২০১৮

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments