Saturday, April 20, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - মে ২০১৮উন্নয়নে নাভিশ্বাস!

উন্নয়নে নাভিশ্বাস!

image-6524-1515906138

কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলার এক স্বনামধন্য সাংবাদিক ছিলেন মোনাজাত উদ্দিন। সারাজীবন ওই অঞ্চলের গরিব-খেটে খাওয়া মানুষের সাথে তিনি তাঁর জীবন অতিবাহিত করেছেন। গভীরভাবে দেখেছেন সমাজের প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে শাসকদের রাজনীতি। তাই একটি বইয়ের উৎসর্গপত্রে তিনি লিখেছিলেন, ‘যারা ভোটের সময় ভোট নেয় কিন্তু তারপর মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে যায়, তাদের জন্য আমার সমস্ত ঘৃণা। যারা মানুষের উন্নয়নের কথা বলে কিন্তু ক্ষমতায় যাবার পর নিজের সম্পদ গড়ে, তাদের জন্য আমার সমস্ত ধিক্কার।’ শাসকদের তথাকথিত উন্নয়নকে কটাক্ষ করে লিখেছেন, ‘গোটা দেশের উন্নয়ন বলতে কি থানা সদর কেন্দ্র কিংবা আশপাশের দু-একটি ইউনিয়নের পাকা সড়ক আর বিদ্যুৎ সম্প্রসারণ? থানা প্রশাসনিক ভবনের চাকচিক্য, নতুন নতুন মোটর সাইকেলের আমদানি, সিনেমা হল? কিছু নতুন টিভি সেটের এন্টেনা? উন্নয়নের নামে চিলমারীতে এক যুগে এ-ই হয়েছে। অথচ হয়নি কোনো শিল্প-কারখানা। হয়নি একটি হিমাগার। এই অঞ্চলের পাট দিয়ে দড়ি-সুতলির কারখানা হতে পারে, বিভিন্ন কৃষিভিত্তিক ছোট ছোট কারখানা হতে পারে, এসব হয়নি।’ হয়নি বলেই সর্বশেষ খানা জরিপ মতে ৭৭ শতাংশ গরীব মানুষের বাস চিলমারীতে। হয়নি বলেই কুড়িটি নদ-নদীর জেলাবাসী সবচেয়ে কম মাছ খেতে পায়। দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অপুষ্টির শিকার এ অঞ্চলের মানুষ। এ অঞ্চলে আজও কলার থোড়, গাছআলু অনেক মানুষের খাদ্য। এই বুভুক্ষু-নিরন্ন মানুষগুলোর কাছে দেশের বড় বড় শহরের সুউচ্চ দালান কোটা, কোটি টাকার প্রাইভেট কার আর আলো ঝলমলে বিপণিবিতানের ‘উন্নয়ন’ কেবলই পরিহাস। আর মোনাজাতউদ্দিন যাদের প্রতি সুতীব্র ঘৃণা আর ধিক্কার জানিয়েছিলেন, তারাই এই উন্নয়নের ফেরিওয়ালা।

এমন দুঃসহ অবস্থাটা কেবল চিলমারীতে নয়, গোটা দেশেরই চিত্রটা প্রায় একই। বেশিরভাগ মানুষ ভালো নেই। সরকারের উন্নয়ন তাদের জীবনকে ছুঁতে পাচ্ছে না। কেননা এই উন্নয়ন কেবল আকাশের দিকে, ঊর্দ্ধমুখী। মাটির কোটি কোটি মানুষ তার কাছে অচেনা। এমন উন্নয়ন পরিস্থিতি সমস্যায় ফেলছে বেশিরভাগ মানুষকে। রিপোর্টে বলছে বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো ঝুঁকির মধ্যে আছে। অথচ উন্নয়ন হচ্ছে রাস্তাঘাটের, প্রযুক্তির, অবকাঠামোর। যদিও বিদ্যুতের দাম বেড়েছে কিন্তু আমরা ‘ডিজিটাল’ হয়েছি, কথা বলা রোবট এসেছে দেশে। এমনকি সব ঝুঁকি, প্রতিবাদ উপেক্ষা করে ঢুকে গেছি ‘পারমাণবিক’ যুগের সম্মানিত পর্বে! তবুও মানুষ ভালো নেই।

ভালো না থাকার কারণ হিসাবে অনেকে বলবে নৈতিক অবনমনের কথা। নৈতিক অবক্ষয় ঘটেছে কথাটা মিথ্যা নয়। কিন্তু নৈতিকতা জিনিসটা তো আর আকাশ থেকে পড়ে না। মানুষের মনেই থাকে তার স্থান। আর মন চলে বাস্তব জগতের শাসনে। বাস্তব পরিস্থিতিটা কেমন তাই নির্ধারণ করে দেয় নৈতিক-অনৈতিকতার শক্তিকে। চারপাশে অবারিত লুটপাট-তছরুপের পরিবেশ থাকলে, চরিত্রটাও আর উন্নত থাকে না। দুটো তো একসাথে চলতে পারে না। ফলে বোঝা যায়, লুটপাটের ব্যবস্থাটা অনৈতিকতার জন্য দায়ী। তাহলে প্রশ্ন হলো — এই ব্যবস্থাটা চালায় কারা?

বেশিরভাগ মানুষ যে চালায় না, তা তাদের পতিত দশা দেখলেই বোঝা যায়। এর বাইরে যে অল্প সংখ্যক থাকে, যারা সংখ্যায় খুব বেশি হলে ৫ শতাংশ, তাদের দেখা যাচ্ছে প্রভূত উন্নতি। এরাই রাষ্ট্র ক্ষমতায় আর প্রতিষ্ঠায় দোর্দন্ড প্রতাপশালী। এদের একটা উন্নতির দর্শন আছে—যেটি মানবিকতা, মনুষ্যত্ব, পরিবেশ কোনো কিছুই না চিনলেও বোঝে কেবল মুনাফা। এই দর্শনটির নাম পুঁজিবাদী দর্শন। যারা এই দর্শনের ধারক, তারা হলো পুঁজিবাদী। পুঁজিবাদীরা মুনাফা আর ক্ষমতার জন্য পারে না এমন কোনো কাজ নেই। তাদের লোলুপতার সীমা-পরিসীমা নেই। ঈশপের গল্পে নেকড়ে যেমন মেষ শাবককে খাবেই, তেমনি এরা নিজেদের লাভের জন্য মানুষ, প্রাণী, পরিবেশ, নদী-নালা-খাল-বিল, বন, পাহাড়, সবকিছুকে গোগ্রাসে গিলবেই। নেকড়ের তবুও খাবার চাহিদার সীমা থাকে, এদের তাও নেই। এরা যত বেশি অপরের ধন লুট করে, তত ক্ষুধা বেড়ে যায়। বর্ধিত পাকস্থলি পূরণ করতে তখন আরও বেশি হিংস্র, বর্বর হয়ে ওঠে। বের করে শোষণের নতুন নতুন অস্ত্র। এই মুনাফা লোলুপ মানুষরা জগতের সকল প্রাণীর চেয়েও অধম।

কিন্তু এই অধমরাই সকল কিছুর শিরোমণি, তাদের সুবিধা করে দিতেই গোটা ব্যবস্থাটা সাজানো থাকে। রাষ্ট্র, সরকার সবকিছুই থাকে তাদের নিয়ন্ত্রণে। যত উন্নয়ন, অগ্রগতি সব কিছু হয় তাদের কল্যাণেই। তার ছিটেফোঁটা পেয়ে সাধারণ মানুষ কোনো রকমে দিন কাটায়। ফলে উন্নয়ন শব্দটিরও কোনো একক অর্থ নেই। কার উন্নয়ন — এই প্রশ্নটি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
একইভাবে যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্পের সাথে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, পরিবেশগত অগ্রগতির প্রশ্নটি জড়িয়ে থাকে। যদি শাসকরা ব্যাপারগুলোকে আলাদা করে দেখাতে চায়। যেমন- তারা বিদ্যুৎ উৎপাদনে রেকর্ডের কথা বলে। কিন্তু বলে না এজন্য তারা কয়েকগুণ ব্যয়বহুল, ক্ষণস্থায়ী, ভাড়াভিত্তিক প্ল্যান্ট দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। এই বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলেই তারা সুন্দরবনের অদূরে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং শত শত শিল্প কারখানা নির্মাণ করছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হলেও চিরতরে ধ্বংস হবে বাংলাদেশের ফুসফুস খ্যাত সুন্দরবন। যোগাযোগ ব্যবস্থার যুগান্তকারী পরিবর্তনের কথা বলে পদ্মা সেতুর কাজ চালালেও এখন পর্যন্ত প্রাথমিক ব্যয় থেকে তিনগুণ বেশি অর্থ খরচ করা হয়েছে। চিকিৎসা সেবার উন্নতি বোঝাতে হাসপাতাল, ক্লিনিক, নার্সিং হোমের সংখ্যা বৃদ্ধি দেখালেও পরিসংখ্যান বলছে, চিকিৎসা করতে গিয়ে দেশের ৫% মানুষ সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়ছে। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-আবাসন-খাদ্য সকল ক্ষেত্রেই এই চিত্র পাওয়া যাবে। এর ফলে বেশিরভাগ মানুষ ক্রমাগত নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে গেলেও অল্প কিছু মানুষের হাতে জমছে সম্পদের পাহাড়। ধনী আর ভিক্ষুকের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। একটা তথ্য দিলেই বোঝা যাবে সাম্প্রতিক সময়গুলোতে কী পরিমাণ অর্থ লুটপাট হয়েছে — গত সাত বছরে ছয়টি বড় আর্থিক কেলেঙ্কারিতে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি চুরি বা আত্মসাৎ হয়েছে। চুরি হওয়া টাকা কোথাও তো গেছে। কিন্তু এ টাকা উদ্ধার হয়নি, দোষীদেরও শাস্তি হয়নি। বোঝাই তো যাচ্ছে উন্নয়নটা হচ্ছে কার?

কেবল রাঘব বোয়ালরা নয়, এমন উন্নয়নের ভাগ স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-নেত্রীরাও পায়। কয়েকদিন আগেই দেশের ২৮১ টি পৌরসভার প্রত্যেকটির জন্য ৪/৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। প্রকল্পটির নাম ‘নগর অবকাঠামো উন্নয়ন’ দেওয়া হলেও আসলে নির্বাচনের আগে স্থানীয় পৌর মেয়র, দলীয় নেতা-কর্মীদের অর্থ তছরুপের সুযোগ করে দিতেই যে এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। শুধু তাই নয়, এমন উন্নয়নের চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরতে ৬০ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছে গণযোগাযোগ অধিদপ্তর। এমনই উন্নয়ন করেছে সরকার যে তা জনগণকে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে হচ্ছে!

শাসকের এই উন্নয়ন দর্শন বুঝিয়ে দিচ্ছে দেশের অবস্থা। এ এমন এক প্রক্রিয়া যেখানে তীব্র শোষণে জনগণকে ছিড়ে ছ্যাবড়া না বানালে শাসকের অঢেল বিত্তের মালিক হওয়া সম্ভব নয়। এখানে জনগণ আর শাসকের স্বার্থ পরস্পর বিরোধী; একই সাথে দুই পক্ষেরই উন্নতি কোনোভাবেই সম্ভবপর নয়। এই চরম সত্য কথাটি আজ বুঝবার সময় এসেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যদি তার অবস্থার পরিবর্তন করতে চায় তবে তাকে তার নিজস্ব শক্তির উপরই দাঁড় হতে হবে। আর হতে হবে সংগঠিত। কেননা শোষণমূলক পরিস্থিতির উৎস লুকিয়ে আছে এই রাষ্ট্রের মধ্যেই। এই রাষ্ট্র ১৯৭১ সালে স্বাধীন হলেও, শাসনের মালিকানা পরিবর্তিত হলেও, শাসকের চরিত্র পাল্টায়নি। তাই একই শোষণমূলক প্রক্রিয়া জারি আছে। এই রাষ্ট্রব্যবস্থা স্বাধীনতার পর পর এদেশের উঠতি ধনিক শ্রেণিকে চোরাচালানি, মজুতদারি, পারমিট, লাইসেন্স, সম্পদ আত্মসাতের সুযোগ দিয়ে সংগঠিত হবার সুযোগ দিয়েছে। পরবর্তীতে তারাই ব্যাংক ঋণ, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের মালিকানা লাভ করেছে। বেশিরভাগ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়ে ব্যক্তিগত মালিকানার প্রসার ঘটানো হয়েছে। এখন তারাই পুরো ব্যাংক, শিল্প-কারখানা, তেল-গ্যাস-বন্দর লুটপাটের অবাধ সুযোগ পেয়েছে। পুরো দেশটাই তাদের কাছে হয়ে উঠেছে বিক্রি করার পণ্যভূমি। উন্নয়নের যত গল্পই আমরা শুনি না কেন, সবকিছু এদের সুবিশাল পকেটে যাবার জন্যই প্রস্তুতকৃত।

এরাই নিয়ন্ত্রণ করছে দেশের রাজনীতি। এদের হাতে গণমাধ্যম, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা সবকিছু কুক্ষিগত। এরাই চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামাত-জাতীয় পার্টি কিংবা তথাকথিত সুশীল সমাজ ও বাম দল বলে পরিচিত জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দল প্রভৃতি। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে নিজস্ব রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার পাশাপাশি চিহ্নিত করতে হবে সেই সব শক্তিকে, যারা প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষভাবে শাসকের পক্ষে কাজ করে। কেননা শাসকের পক্ষে থাকলে আর যাই হোক মুক্তি মিলবে না।

সাম্যবাদ মে ২০১৮

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments