Friday, April 26, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - মে ২০১৮গণপরিবহনে চরম অব্যবস্থাপনার দায় কার?

গণপরিবহনে চরম অব্যবস্থাপনার দায় কার?

rajibs_hand
রাজিবের বিচ্ছিন্ন হাত

পটুয়াখালী উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম দাসপাড়া। এ গ্রাম থেকে অনেক স্বপ্ন নিয়ে একদিন ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। এসেছিলেন বেঁচে থাকার লড়াই করতে। কিন্তু সেই লড়াই শেষ হলো না, মাঝপথেই জীবনযোদ্ধা রাজীবকে পটুয়াখালী ফিরতে হলো কফিনবন্দী হয়ে। গাড়ির চাপে একটি হাত শরীর থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল তার। ডাক্তারদের প্রাণান্তকর চেষ্টার পরও রাজীব চলে গেছে না ফেরার দেশে।

মো. আলম পঞ্চগড় থেকে পেটের দায়ে রিকশা চালাতে এসেছিলেন ঢাকা শহরে। বাড়িতে তার স্ত্রী ও সন্তানরা থাকত। আলমের উপার্জনের টাকায় সংসার চলত। পুরো সংসারের দায়িত্ব ছিল তার। কিন্তু গাড়ির ধাক্কায় জীবনের সমস্ত দায়িত্ব থেকে মুক্তি মিলেছে আলমের।

ঘটনাগুলো এই সময়ের। রাজধানীর গণপরিবহনে চরম নৈরাজ্যকর অবস্থার খ-চিত্র। বেসরকারি একটি হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ৯ হাজার থেকে ২১ হাজার মানুষ। এর কারণ হিসাবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) গবেষণা বলছে, ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্য অতিরিক্ত গতি ও চালকের বেপরোয়া মনোভাব দায়ী। বাস-মিনিবাসের বেপরোয়া চলাচল ও প্রতিযোগিতার বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। যেখানে-সেখানে যাত্রী ওঠানামা, ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করা ও বিশৃঙ্খলা এখন ঢাকার গণপরিবহনের সাধারণ চিত্র। কিন্তু পরিস্থিতি কেন এমন? কিংবা অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে কেন? – এই বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করা দরকার।

ঢাকা ও এর আশেপাশে এখন বাস-মিনিবাস চালাতে হলে দিনে ৭০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। প্রতিদিন চাঁদা ওঠে প্রায় ১ কোটি টাকা। মন্ত্রী, এমপি, সরকারদলীয় ব্যক্তিরা এই চাঁদা নিয়ন্ত্রণ করে। এই প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বেশিরভাগই বাস কোম্পানির মালিক হয়েছে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখানে দর্শকের ভূমিকা পালন করে। তাই তারা ফিটনেসবিহীন ও রংচটা পরিবহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না।

বিআরটি’এর হিসাব অনুযায়ী, সারাদেশে ১২ লাখ পরিবহনের লাইসেন্স নেই। আর ২ লাখ পরিবহনের লাইসেন্স পেয়েছে যোগ্যতার যথাযথ পরীক্ষা ছাড়াই। এ ধরনের অব্যবস্থাপনার মাশুল দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। মন্ত্রী ও এমপিরা ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সরকার সমর্থক কাউন্সিলরসহ প্রায় ২০-২৫ জন নিজ নামে বা পরিবারের সদস্যদের নামে কোম্পানি করে বাস পরিচালনা করছে। আর নিজেদের পকেট ভারী করছে। সড়ক দুর্ঘটনায় আপনজন হারিয়ে যারা আজ দিশেহারা, সেই মানুষদের কান্না অনুভব করতে পারার কথা নয় এই লুটেরাদের।

প্রতিটি বাস-মিনিবাস দিনের শুরুতে যে আয় করে, তা থেকে কোম্পানির চাঁদা পরিশোধ করে। জিপি, ওয়েবিল বা রুট খরচের নামে যে চাঁদা তোলা হয়, এর একটা অংশ খরচ হয় কোম্পানির অফিস ব্যবস্থাপনায়। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হয়রানি বন্ধে, স্থানীয় রাজনৈতিক চাঁদাবাজদের পেছনেও কিছু টাকা ব্যয় হয়। এসব কিছুর বাইরে মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নের নামে ৭০ টাকা করে চাঁদা দেয়া হয়। সব মিলিয়ে ১৫০ থেকে ২০০ টাকার বেশি নয়। বাকিটা কোম্পানির প্রভাবশালী চেয়ারম্যান ও এমডিদের পকেটে যায়। সরকারি দলের লোকজন প্রায় সবগুলো গণপরিবহন ব্যবসায় যুক্ত আছে। ফলে এতে ‘আইন’ বলে কোনো শব্দ থাকছে না। দুর্নীতি ও লুটপাটের চরম শিখরে এখন গণপরিবহন খাত।

কথা হচ্ছিল ‘মৈত্রী’ পরিবহনের একজন যাত্রী সিদ্দিকুর রহমানের সাথে। তিনি দায়ী করলেন ঢাকার যানজটকে। বললেন, ‘তীব্র যানজটের কারণে দীর্ঘসময় আটকে থাকে গাড়ি। এরপর যখন ছাড়ে, তখন একটা গাড়ির সাথে আরেকটা গাড়ির প্রতিযোগিতা শুরু হয় – কে আগে যাত্রী তুলবে এবং আগে যাবে। চালকদের কাছে যাত্রীদের সময়ের যেমন দাম নাই, তেমনি জীবনেরও নাই।’ পাশাপাশি গাড়ির ড্রাইভার-হেলপারকে সারাদিনের পরিশ্রমের সিংহভাগ টাকা মালিককে দিয়ে দিতে হয়। একজন হেলপার ২৫০-৪০০ টাকার উপর আয় করতে পারে না, ড্রাইভারের আয় এর সামান্য বেশি। ফলে ড্রাইভার-হেলপারের উদ্দেশ্যই থাকে কতবেশি এবং কার আগে যাত্রী তোলা যায়। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় পড়ে প্রাণ যায় অসহায় যাত্রীর।

সড়ক দুর্ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলোও যথাযথ গুরুত্ব পায় না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি অপরাধের প্রবণতা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। সম্প্রতি দৈনিক প্রথম আলো সাতটি সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে একটি জরিপ করেছে। এতে দেখা যায়, সাম্প্রতিক আলোচিত সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে শুধু পুলিশের পরিদর্শক দেলোয়ার হোসেনের ক্ষেত্রে হত্যাচেষ্টার মামলা হয়েছে। বাকি মামলাগুলো দ-বিধির যেসব ধারায় হয়েছে, তাতে ঘটনার মর্মান্তিকতা যথাযথ গুরুত্ব পায়নি, সাজা অপেক্ষাকৃত কম এবং মামলা জামিনযোগ্য। সাত দুর্ঘটনায় হওয়া মামলাগুলোর চারটিতে আসামিরা জামিন পেয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী বললেন, মন্ত্রী ও চালকদের ভুল-ত্রুটি দেখার আগে যাত্রী কতটা সতর্ক ছিল সেটিই আগে বিবেচনা করতে হবে। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, এ বছরে এখন পর্যন্ত ২,১২৩ জন মৃতের সবাই কি অসতর্ক ছিলেন? এই অসুস্থ রাষ্ট্রব্যবস্থার কি কোনো দায় নেই? সরকার প্রধানের এমন বক্তব্য চূড়ান্ত দায়িত্বহীনতার নামান্তর।

সাধারণ মানুষের যাতায়াতের প্রধান বাহন হলো গণপরিবহন। তাদের জীবন বিপন্ন করেই এখানে যানবাহন চলাচল করছে। এতে কেবল যাত্রীদের প্রাণ বিপন্ন হচ্ছে না, শোষিত হচ্ছে পরিবহন শ্রমিকও। জনগণের জীবনকে জিম্মি করে, শ্রমিকদের ঠকিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে মালিকরা। তথাকথিত শ্রমিক নেতারাও এক্ষেত্রে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। পরিবহন শ্রমিকদের অধিকারের কথা বলে চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট ব্যবসা, ভুয়া লাইসেন্সের ব্যবসাসহ অসংখ্য বেআইনি কাজ করে অঢেল বিত্ত-বৈভবের মালিক এখন তারা। দেশের সাধারণ জনগণ এবং পরিবহন শ্রমিক – সকলকে এই শোষকদের চেনা প্রয়োজন।

সাম্যবাদ মে ২০১৮

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments