Monday, March 18, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - জানুয়ারি ২০১৮গুম এবং ফিরে আসার রহস্য— রাষ্ট্রীয় আক্রমণে ক্ষত-বিক্ষত বেঁচে থাকার অধিকার

গুম এবং ফিরে আসার রহস্য— রাষ্ট্রীয় আক্রমণে ক্ষত-বিক্ষত বেঁচে থাকার অধিকার

1514985709006-510873041 copy

গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়ের একটি হল ‘গুম’। ২০১৭ সালের শেষ দিকে এই ‘গুম-অপহরণ’ নানা কারণেই আলোচনায় প্রাধান্য পায়। কবি ও বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহারের গুম-অপহরণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় চলে আসে। এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই পর পর কয়েকটি গুমের ঘটনা এবং গুম থাকা কয়েকজন ব্যক্তির ফিরে আসার ঘটনা ঘটেছে এ সময়ে। ফিরে আসা ব্যক্তিদের কেউ কেউ জানিয়েছেন তারা সন্ত্রাসীদের দ্বারা অপহরণের শিকার হয়েছিলেন, মুক্তিপণ আদায় ছিল গুমের উদ্দেশ্য। যদিও তাদের বক্তব্য মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা পায়নি।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে নিখোঁজ বা অপহরণের শিকার হয়েছেন ২৮৪ জন। তাদের মধ্যে মৃতদেহ উদ্ধার হয় ৪৪ জন ব্যক্তির। নিখোঁজের পর গ্রেপ্তার দেখানো হয় ৩৬ জনকে এবং পরিবারের কাছে বিভিন্নভাবে ফিরে আসেন ২৭ জন। আসক-এর প্রতিবেদনে এসব গুম-অপহরণের ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।

বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ২০১৩ সাল থেকে শত শত মানুষকে বেআইনিভাবে গোপন স্থানে আটকে রেখেছে বলে
কিছু দিন আগেই অভিযোগ তোলে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও গুমের অভিযোগ করে আসছে।

কোথায় গিয়ে থামবে?
‘গুম-অপহরণে’র এসব ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতি এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য মামলা দায়ের করা, পুলিশ দিয়ে অযথা হয়রানি করা, বিনা বিচারে আটকে রাখার কাজ এদেশে ব্রিটিশ আমল থেকেই সরকারগুলো করেছে। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামী, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা-কর্মী প্রায় সকলেই এসব অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে গিয়েছেন। এরপর এসেছে ‘ক্রসফায়ার’ আমল। শুধু চিহ্নিত অপরাধী নয়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকেও বিনা বিচারে ‘ক্রসফায়ার’ নাম দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। শাসকদের ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতিতে সর্বশেষ সংযোজন ‘গুম-অপহরণে’র ঘটনা।

যারা মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজকে ব্যাখ্যা করেন তারা রাষ্ট্রকে একটি দমনমূলক হাতিয়ার মনে করেন। আর এই দমন করার কাজটি প্রত্যক্ষভাবে করে অস্ত্রধারী বাহিনী অর্থাৎ সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র‍্যাব প্রমুখ বাহিনী। মার্কসবাদ যারা মানেন না, কিন্তু একটা গণতান্ত্রিক সমাজ ও শাসন দেখতে চান, তারাও প্রত্যক্ষ নানা অভিজ্ঞতায় বুঝতে পেরেছেন যে রাষ্ট্রের এই অস্ত্রধারী বাহিনীর হাতেই প্রধানত রাষ্ট্রের নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হতে থাকে। আর সে কারণেই তারা অস্ত্রধারী বাহিনীকে সবেচেয়ে বেশি জবাবদিহির অধীনে রাখা, নিয়মের অধীনে রাখার দাবি করেন। তা যদি করা না যায়, বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এসব বাহিনীর হাতে সাধারণ মানুষ তো বটেই এমনকি শাসকগোষ্ঠীর সদস্যরাও নিরাপদে থাকেন না। র‌্যাব সদস্যদের হাতে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা, বিভিন্ন স্থানে র‍্যাব-পুলিশ সদস্যদের ডাকাতি, টাকা লুট বা অপহরণের সাথে যুক্ত থাকার ঘটনা তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। এর বিস্তৃতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে থামবে, তা সত্যি আশঙ্কার বিষয়।

বাড়ছে অবিশ্বাস ও সন্দেহ
সম্প্রতি গুম অবস্থা থেকে ফিরে এসেছেন কয়েকজন। দুই মাসের বেশি নিখোঁজ থেকে ফিরে এসেছেন সাংবাদিক উৎপল দাস। নিখোঁজদের মধ্যে তার আগে সর্বশেষ পরিবারের কাছে ফেরেন ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ রায়, তিনিও আড়াই মাস ‘অজ্ঞাতবাসে’ ছিলেন। উৎপলের পর ফিরেছেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোবাশ্বার হাসান সিজার। এরা প্রায় সবাই জানিয়েছেন যে মুক্তিপণ আদায়ের জন্য কিংবা ব্যবসায়িক বিরোধ থেকে তাদের অপহরণ করা হয়েছিল। কিন্তু তারা যে বক্তব্য দিয়েছেন, মানুষ তা বিশ্বাস করতে পারছে না। এতদিন মানুষ সরকারি ভাষ্যে বিশ্বাস করত না, এখন গুম হওয়া লোকজনের ভাষ্যেও বিশ্বাস করতে পারছে না।

নিখোঁজ থাকা কয়েকজন যখন ফিরে আসছেন তখন ঠিক সে সময়ে আমরা দেখছি যে চার মাস আগে ঢাকা থেকে ‘নিখোঁজ’ বিএনপি নেতা ব্যবসায়ী সৈয়দ সাদাত আহমেদকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে পুলিশ। সাদাতকে গত ২২ আগস্ট ’১৭ কয়েকজন তুলে নিয়ে যায় বলে তার স্বজনরা জানিয়েছিলেন। ওই ঘটনার চার মাস পর ঢাকার রামপুরা এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় গোয়েন্দা পুলিশ।

গুম-অপহরণ ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিল বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিনের ঘটনাটি। ২০১৪ সালের ১০ মার্চ রাতে ঢাকার উত্তরা এলাকার একটি ভবন থেকে ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী’ পরিচয়ে একদল অস্ত্রধারী সালাহউদ্দিন আহমদকে ‘অপহরণ’ করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। এক বছর দুই দিন ‘গুম’ থাকার পর ২০১৫ সালের ১২ মার্চ ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলংয়ের গলফ কোর্স ময়দানে চোখবাঁধা অবস্থায় সালাহউদ্দিন আহমদকে পাওয়া যায়। এরপর এ বছর ফরহাদ মজহারকে অপহরণের চেষ্টা নিয়ে যে নাটকীয়তা দেশবাসী দেখেছেন তাতে বিশ্বাস অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব আরো তীব্র হয়েছে।

সংসদে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য উদ্বেগ বাড়িয়েছে
রূপকথার গল্পে এক রাক্ষসের কথা বোধ হয় অনেকেই জানেন। সে যখন বলে উত্তরে যাবে, তখন সে যায় দক্ষিণে, যদি বলে পশ্চিমে যাবে, তখন সে যায় পূর্বে। ঠিক একই রকম না হলেও আমাদের দেশের সরকারের কর্তাব্যক্তিরা যখন যা বলেন, দেশের মানুষ তার বিপরীতটাই ভাবতে ও বিশ্বাস করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

যেমন আমাদের শিক্ষামন্ত্রী যখন বলেন, প্রশ্ন ফাঁস হয়নি, তখন আমরা বুঝতে পারি প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীকে গ্রেফতার করা হবে, তখন আমরা ভাবতে থাকি আগামী ৪৮ বছরেও অপরাধীকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর খোদ প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, ‘গুম শুধু বাংলাদেশেই হয় না। ব্রিটেন আমেরিকায়ও হয়।’ তখন আমরা ভাবতে থাকি যে গুম নামের এই হাতিয়ারটি সরকার আরো চাতুর্যের সঙ্গে ব্যবহার করবে।

সংসদে বিরোধী দলীয় প্রধান অভিযোগ করেছিলেন যে গত ৫ বছরে নিখোঁজ হয়েছে ৫১৯ জন মানুষ। তিনি বলেন যে মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। আর তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়েই প্রধানমন্ত্রী বলেন যে ব্রিটেন-আমেরিকার গুমের পরিস্থিতি বাংলাদেশের চেয়ে আরো ভয়াবহ।

অনেকেরই হয়তো মনে আছে, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি নিজ বাসায় খুন হওয়ার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, অপরাধী যেই হোক ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাদের গ্রেফতার করা হবে। সেই ৪৮ ঘণ্টা আজো পার হয়নি। আর সে সময় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সমালোচনার মুখে প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিক দম্পতির দিকে কুৎসিত ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘কারো বেডরুম পাহারা দেওয়া সম্ভব নয়।’ অথচ আইনের লঙ্ঘন যেখানেই হোক, বেডরুম অথবা রাজপথ, তার প্রতিকারের দায়িত্ব সরকার-প্রশাসনের। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের।

আমরা মনে করি, শুধু বাংলাদেশ নয় সারা দুনিয়া জুড়েই রাষ্ট্রব্যবস্থা দিন দিন ফ্যাসিবাদী চেহারা নিচ্ছে। একেক দেশে তার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে একেকভাবে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি শুরু থেকেই ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম নিয়েছে। আর যত দিন যাচ্ছে তার ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্য ততই প্রকট হচ্ছে। সরকার নিজেই অপরাধের জন্ম দিচ্ছে এবং সরকার জনগণের নিরাপত্তা ও অধিকার হরণ করছে। এর প্রতিকার কোথায়? আমরা বহুবার বলেছি যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শক্তি বৃদ্ধিই এর প্রতিষেধক। রাজপথে আন্দোলনের পাশাপাশি সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী মহলের সোচ্চার ভূমিকাও অত্যন্ত জরুরি।

সাম্যবাদ জানুয়ারি ২০১৮

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments