Friday, April 19, 2024
Homeফিচারনারীমুক্তির পথদিশা সোভিয়েত সমাজতন্ত্র — নারীমুক্তি কেন্দ্র

নারীমুক্তির পথদিশা সোভিয়েত সমাজতন্ত্র — নারীমুক্তি কেন্দ্র

final Book Narimukti-page-001-3

১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর পৃথিবীর বুকে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছিল। মার্কস-এঙ্গেলস বিপ্লবের যে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব দার্শনিকভাবে উপস্থাপন করেছেন; ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন সেই তত্ত্বকে প্রয়োগ করে রাশিয়ায় প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করেছিলেন। শ্রমিক-কৃষক-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শ্রেণিশোষণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে বুর্জোয়া কেরেনস্কি সরকারের শাসনের অবসান ঘটিয়ে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে তিনি শ্রমিকের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই বিপ্লব রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সূচনা করেছিল নতুন অধ্যায়ের। এই বিপ্লব ব্যক্তিগত মালিকানার পরিবর্তন ঘটিয়ে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেছিল। পৃথিবীর বুকে নতুন মানুষ ও সমাজ বিনির্মাণে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। মার্কসবাদকে সঠিকভাবে উপলব্ধির ভিত্তিতে লেনিনের পাশে যে মানুষটি অতন্দ্র প্রহরীর মতো স্থিরচিত্তে সমাজতন্ত্র বিনির্মিাণে ভূমিকা পালন করেছিলেন, তিনি লেনিনের সহযোদ্ধা জোসেফ স্তালিন। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রই জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করেছিল। বিশেষ করে পুঁজিবাদী শাসন ও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বিরুদ্ধে নারীর সর্বাঙ্গীণ মুক্তির পথ সোভিয়েত সমাজতন্ত্রই দেখিয়েছিল। ঘরে-বাইরে-শিক্ষা-দীক্ষা-ক্রীড়া-কর্মক্ষেত্রে-কারখানায়-গবেষণাগার-মহাকাশ সর্বত্রই ছিল নারীর পদচারণা। নারীর যথার্থ মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিল সমাজতন্ত্রই। ২০১৭ সাল এ বিপ্লবের শতবর্ষ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শতবর্ষ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্র শতবর্ষ উদ্যাপনের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। তারই অংশ হিসেবে  ‘নারীমুক্তির পথদিশা সোভিয়েত সমাজতন্ত্র’ পুস্তিকাটি প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে নারীমুক্তি আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই পুস্তিকাটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা রাখি।

সম্পাদনা পরিষদ/৩ অক্টোবর ২০১৭

২০১৭ সাল মহান রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের শতবর্ষ। ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর থেকে ১৭ নভেম্বর — দুনিয়া কাঁপানো এই দশ দিনের মধ্য দিয়ে রাশিয়ার বুকে জন্ম হয়েছিল বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের। এই বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ার মাটিতে ক্ষুধা, ব্যাধি, দারিদ্র, অভাব, কর্মহীনতা, শিক্ষার সংকট ও স্বাস্থ্যহীনতা বিশেষ করে নারীর প্রতি নির্যাতন ও অসম্মান দূর করা সম্ভব হয়েছিল। যা দেখে তৎকালীন বিশ্বের দেশে দেশে মুক্তিকামী জনগণ অনুপ্রাণিত হয়েছে, মুগ্ধ বিস্ময়ে স্বাগত জানিয়েছে। এই বিপ্লবের মাধ্যমে মানব ইতিহাসে শোষিত মানুষ প্রথমবারের মতো মুক্তির প্রকৃত স্বাদ পেয়েছিল। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শোষিত জনগণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শোষণের শিকার নারী। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে একদিকে নারীর উপর শোষণ-নিপীড়ন যেমন চলে, অন্যদিকে চলে পুরুষতন্ত্রের আধিপত্য । সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন নারীদেরকে শোষণ ও পুরুষতন্ত্রের আধিপত্য থেকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিল। সকল ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাধাহীন করেছিল। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া যে দর্শনের ভিত্তিতে এই অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেছিল, তার তাত্ত্বিক ও দার্শনিক ভিত্তি নির্মাণ করেছিলেন মহামতি কার্ল মার্কস এবং তাঁর আজীবন সহযোদ্ধা ফ্রেডরিক এঙ্গেলস। মার্কস-এঙ্গেলস ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’-এ সমাজে নারীর অধস্তন-এ নিপীড়িত-অপমানজনক অবস্থানের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এছাড়াও ১৮৭৯ সালে অগাস্ট বেবেল রচিত ‘নারী ও সমাজতন্ত্র’ এবং ১৮৮৪ সালে ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের ‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ এই গ্রন্থ দু’টি সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ও নারীমুক্তি আন্দোলনকে অবিচ্ছেদ্য হিসেবে দেখার মতাদর্শ, ঐতিহাসিক ও যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণের ক্ষেত্রে ভিত্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে।

শিল্পে তুলনামূলকভাবে অনগ্রসর ও নারীদের সামাজিক অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও, রুশ বিপ্লব শিল্পোন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর তুলনায় নারীর আইনগত, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল তা তৎকালীন বিশ্বে ছিল অভাবনীয়। ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সামাজিকভাবে নারীর অগ্রযাত্রা সূচিত হলেও সেই ফ্রান্সে ১৯৪৪ সালে নারীরা প্রথম পূর্ণ ভোটাধিকার লাভ করে। ‘গণতন্ত্রের পীঠস্থান’ বলে কথিত যুক্তরাজ্যে মেয়েরা ছেলেদের সমান বয়সে ভোটাধিকার লাভ করে ১৯২৮ সালে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ যেমন, ফিনল্যান্ডে ১৯০৬ সালে, নরওয়েতে ১৯১৩ সালে, অস্ট্রিয়ায় ১৯১৮ সালে, জার্মানি ও সুইডেনে ১৯১৯ সালে, কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯২০ সালে, ইতালিতে ১৯৪৫ সালে, সুইজারল্যান্ডে ১৯৭১ সালে মেয়েরা ভোটাধিকার পায়। কিন্তু এসকল পুঁজিবাদী দেশে আইনগতভাবে ভোটাধিকার ঘোষিত হলেও সর্বত্র তার বাস্তবায়ন ছিল না। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়া ১৯১৭ সালেই জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সর্বপ্রথম সকলের জন্য ভোটাধিকার নিশ্চিত করেছিল। ১৯৭০ সালের পূর্ব পর্যন্ত ইতালিতে বিয়ে-বিচ্ছেদ আইনগতভাবে স্বীকৃতি পায়নি। অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশগুলোতে নারী-পুরুষের সমান মজুরির বিধান পাশ হয় ৬০ ও ৭০-এর দশকে। সমাজাতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়া বিপ্লবের পরেই নারী-পুরুষের ‘সমকাজে সমমজুরি’, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মাতৃত্বকালীন ছুটি, শিশুর লালন-পালনসহ সকল নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করেছিল। সর্বক্ষেত্রে নারীর সমমর্যাদা-সমঅধিকার-সমঅংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছিল। শোষণমুক্তির লক্ষ্যে একটি রাজনৈতিক পরিবর্তনই পারে সত্যিকার অর্থে নারীমুক্তি আনতে, রুশ বিপ্লব আমাদের সামনে সেই শিক্ষাই রেখে গেছে।

বিপ্লব পূর্ব রাশিয়ার সামাজিক প্রেক্ষাপট ও নারীসমাজ
ইউরোপের সাথে সংযোগ থাকলেও রাশিয়া ছিল একটি পিছিয়ে পড়া দেশ। জমিদারি প্রথা আর জারতন্ত্রের শাসনে মধ্যযুগীয় পশ্চাৎপদতা, সামন্তী সংস্কৃতি বিস্তৃত ছিল গোটা দেশ জুড়ে। দেশের অধিকাংশ মানুষই ছিল কৃষক। ইউরোপের বহু দেশে যখন শিল্প বিপ্লব হয়েছে, সে সময়ে ১৮৬১ সালে রাশিয়া থেকে ভূমিদাস প্রথা বিলোপের ডিক্রি জারি হয়। কিন্তু আধা ভূমিদাসত্ব ১৯১৭ সালের বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত বলবৎ ছিল। এছাড়াও সাম্রাজ্য বিস্তারের লক্ষ্যে রাশিয়ার শাসকরা দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত ছিল। ফলে জারের অত্যাচারী শাসন-শোষণে দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা ছিল ভয়াবহ।

সামন্তী অর্থনীতির পরিপূরক সামন্তী সংস্কৃতির নিগড়ে বাঁধা ছিল রাশিয়ার সমাজ তথা পারিবারিক জীবন। পরিবারের কর্তা ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। পরিবার পরিচালনায় নারীর কাজ ছিল মূলত নির্দেশ পালন করা। গৃহস্থালি ও সন্তান লালন-পালন করাই ছিল নারীদের কাজ। উচ্চবিত্ত ঘরের কিছু সংখ্যক নারী খানিকটা স্বাধীনতা ভোগ করলেও তা সীমাবদ্ধ ছিল মূলত আড্ডা, হৈহুল্লোড়, বল-নাচের আসরে অংশগ্রহণ পর্যন্ত।

বিপ্লবপূর্ব রাশিয়ায় গণিকাবৃত্তি ছিল অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপার, মনে করা হত পুরুষের মঙ্গলের জন্য সমাজে গণিকাবৃত্তি টিকিয়ে রাখা প্রয়োজন । নারীর এই ক্লেদাক্ত জীবনকে আইনসঙ্গত করা হয়েছিল। গণিকা নারীদের কোনও নাগরিক অধিকার ছিল না। পাসপোর্টের পরিবর্তে তাদেরকে গ্রহণ করতে হতো কুখ্যাত হলুদ কার্ড এবং সারা জীবন তাকে এই কলঙ্কময় জীবনের বোঝা বহন করতে হতো।

উনবিংশ শতাব্দির মধ্যভাগ থেকে অর্থাৎ সামন্ত সমাজের গর্ভে রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটেছিল এবং রাশিয়ার পশ্চিম অংশে মূলত পেট্রোগ্রাড, মস্কোতে ধীরে ধীরে শিল্প কারখানা গড়ে ওঠেছিল। এসব জায়গায় সামাজিক জীবনে তখন গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছিল। আবির্ভাব ঘটেছিল শ্রমিকশ্রেণির। জমি থেকে মুক্ত হয়ে দলে দলে মানুষ শহরে শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে আসতো। দশ-বারো ঘন্টা কারখানায় হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটতো। অমানুষিক পরিশ্রমের পর মদের আসরে ও ফূর্তির নাচে টাকা উড়িয়ে ক্লান্ত অবসন্ন দেহে ঘরে ফিরতো তাদের একটা বড় অংশ। এর ফলে নারীদের জীবন আগের থেকে আরও কঠিন ও জটিল হয়ে ওঠেছিল । অল্প আয়ের অধিকাংশই যখন মদের আসরে ব্যয় হতো, তখন সংসার চালানো আরো কঠিন হয়ে পড়তো। সেই কঠিন দায়িত্বটিই ছিল নারীর কাঁধে। আলো-বাতাসহীন অন্ধকার স্যাঁতসেতে ঘরে ক্ষুধাতুর শিশুর কান্নায় যখন মায়ের বুক ফেটে যেতো, তখন চোয়াল শক্ত করে সংগ্রাম করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকতো না সেই নারীর। সংসার সামলাতে গিয়ে স্বামীর কাছে টাকা চাইলে বা মদ খেতে বারণ করলে জুটতো শারীরিক নির্যাতন। ম্যাক্সিম গোর্কী’র ‘মা’ উপন্যাস পড়লে এই রকমই চিত্র দেখতে পাব। পুরনো সামন্তী অভ্যাসের বশে থাকার কারণে প্রতিবাদ করার সাহস নারীদের ছিল না ।

সংসার সচল রাখতে অনেক নারীই কারখানায় কাজ করতে শুরু করেছিল। মূলত বস্ত্র বয়ন, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ বা ঐ জাতীয় হাল্কা কাজের শিল্পেই তারা নিযুক্ত ছিল। ফলে শিল্প কারখানায় নারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে। তখন মাতৃত্বকে বোঝা মনে করা হতো। মাতৃত্বের উপর চলতো সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিপীড়ন। তাই চাকুরি হারানোর ভয়ে গর্ভপাত করাতে গিয়ে তখন অসংখ্য নারীর মৃত্যু হতো।

সংখ্যায় কম, মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের অবস্থাটা ছিল খানিকটা আলাদা। যেসব পরিবারের পুরুষেরা মূলত সরকারি দপ্তরে বা সৈন্যবিভাগে গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করতো বা ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল, সেইসব ঘরের মেয়েদের অনেকেরই পড়াশোনার সুযোগ ছিল। সেই সূত্রে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক ধ্যানধারণার সংস্পর্শে ছিল তাদের অনেকে। রুশ বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী ও নেতৃত্বকারী অনেক বিপ্লবী নারীই এই ধরনের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ঘর থেকে এসেছিলেন।

বিপ্লবের প্রস্তুতি পর্বে নারীদের ভূমিকা
রাশিয়ার জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রথম চরমপন্থী আন্দোলনের বিকাশ ঘটে নারদনিকদের মাধ্যমে। এরা ছিলেন নৈরাজ্যবাদী। বাকুনিন ছিলেন এদের নেতা। এরপর প্লেখানভের মাধ্যমে উনবিংশ শতাব্দীর আটের দশকে মার্কসবাদী আন্দোলনের বিকাশ ঘটে। ১৮৮৩ সালে গঠিত হয় রাশিয়ার প্রথম সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সংগঠন ’শ্রমিক মুক্তি সংঘ’। এই সংগঠনের উল্লেখযোগ্য নারী বিপ্লবী ছিলেন ভেরা ইভানোভনা। ‘শ্রমিক মুক্তি সংঘ’-এর উদ্যোগে বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট মার্কসবাদী পাঠচক্র গড়ে উঠেছিল। এই সমস্ত পাঠচক্রে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও যোগ দিত। পেট্রোগ্রাড শহরে এরকম বেশ কিছু পাঠচক্র গড়ে উঠেছিল যার মাধ্যমে যুক্ত হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নারী। তাঁদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ছিলেন আলেকজান্দ্রা কোলনতাই, নাদেজদা ক্রুপস্কায়া, ইয়েলেনা ডিমিট্রিয়েভনা স্টাসোভা প্রমুখ। বিভিন্ন শহরে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ সংগঠকের ভূমিকা পালন করতেন এবং বলশেভিক পার্টিতেও তারা নানা প্রকার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতেন। নাদেজদা ক্রুপস্কায়া বিপ্লবী মতাদর্শ প্রচারে গোপন সংবাদ পত্র ‘ইসক্রা’ প্রকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। এছাড়া তিনি লেখক, শিক্ষাবিদ ও পার্টির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। ইয়েলেনা ডিমিট্রিয়েভনা স্টাসোভা বলশেভিক পার্টির টেকনিক্যাল সেক্রেটারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। আলেকজান্দ্রা কোলনতাই বিপ্লব পূর্ববর্তী সময়ে নারী ইস্যুসহ বিভিন্ন বিষয়ে লিখতেন এবং বিপ্লব পরবর্তী সময়ে বিশ্বের মধ্যে প্রথম নারী রাষ্ট্রদূত হিসেবে সুইডেনে দায়িত্ব পালন করতেন।

১৮৯৮ সালে লেনিনের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টি’, সংক্ষেপে আর.এস.ডি.এল.পি। এতে যুক্ত হয়েছিল অসংখ্য নারী। শ্রমিক-কৃষক নারীদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমান অধিকার অর্জনের লক্ষ্যে বলশেভিক পার্টি লাগাতার আন্দোলন শুরু করেছিল। ১৯০৫ সালে সমগ্র রাশিয়া জুড়ে ৮ ঘন্টা কাজের দাবিসহ উপযুক্ত পারিশ্রমিকের জন্য বিভিন্ন কলকারখানায় শ্রমিক ধর্মঘট শুরু হয়। এই পার্টির সক্রিয় প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে এই আন্দোলনে নারীরা যুক্ত হতে থাকে। ১৯০৬-১৯০৭ সালের মধ্যে দলে নারীদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। তাদের মধ্যে কয়েকজন সংগ্রামী নারীর অসাধরণ লড়াই উল্লেখযোগ্য।

১৯০৫ সালের বিপ্লবে মস্কোর অন্তর্ভুক্ত ক্রাসনাইয়া প্রেসনিয়াতে, ট্রেখগরনাইয়া মানুলাকটুরা ফ্যাক্টরির শ্রমিকরা সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। ঐ ফ্যাক্টরির নারী শ্রমিকরা টেলিগ্রাফ পোল নামিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করেছিল এবং চারদিকের জায়গাগুলোকে তার দিয়ে ঘিরে দিয়েছিল। ঐ কারখানার এক নারী শ্রমিক সল্টিকোভায় সংগ্রামী আহত শ্রমিকদের সেবায় নার্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করত। তার স্বামীও ছিল সশস্ত্র শ্রমিকদের একজন। তারা দু’জনেই দু’টি বাচ্চাকে এক যুবতীর কাছে রেখে কাজে বেরিয়ে পড়ত। তারা একথা জানত যে, তারা হয়তো আর ফিরবে না, সন্তানদের দেখতেও পাবে না। দু’সপ্তাহ পরে ঐ নারী শ্রমিক ফিরে এলেও তার স্বামী পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিল এবং পুলিশ গুলি করে তাকে হত্যা করেছিল। ঐ নারী শ্রমিকও ফ্যাক্টরি থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। বিপ্লবী কাজে ভূমিকা পালনের জন্য এরকম বহু নারী শ্রমিককে অত্যাচার-নির্যাতন ও হত্যাকান্ডের শিকার হতে হয়েছিল। ফ্যাক্টরির নারীশ্রমিকদের বাইরেও গৃহপরিচারিকা, ধোপাসহ বিভিন্ন সার্ভিস সেক্টরের নারীরা আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল। শ্রমজীবী নারীদের পাশাপাশি শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী নারীও এই বিপ্লবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল।

মারিয়া ভোনারেভা তার মধ্যে একজন। তিনি ছিলেন পেশায় গৃহশিক্ষিকা। তাঁর বাবা পিটাসবুর্গে রেলের কাজে যুক্ত ছিলেন। বাবার সূত্রে তিনি রেল কর্মচারীদের মধ্যে কাজ শুরু করেছিলেন। রেল কর্মচারীদের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে তিনি দক্ষ সংগঠকে পরিণত হয়েছিলেন। ১৯০৫ সালে পিটাসবুর্গের রেলকর্মচারীরা তাঁকে তাদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করেছিলো। পরবর্তীতে তিনি সোভিয়েতের সদস্য হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছিলেন।

পিটার্সবুর্গে অন্য একজন নারী ভ্যালেনটিনা বাগ্রোভা। তিনি দোকান কর্মচারী ইউনিয়নের পক্ষ থেকে সোভিয়েতের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। নারী-পুরুষ সকলের মধ্যে তিনি ছিলেন গ্রহণযোগ্য। এরকম বহু নারী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনেও যুক্ত হয়েছিল।
এছাড়াও বলশেভিক পার্টি সমস্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে নারীদের যুক্ত করার উদ্দেশ্যে ১৯১৩ সাল থেকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ পালন শুরু করেছিল। প্রথমে সেন্ট পিটাসবুর্গে এই ‘নারী দিবস’ পালিত হয় এবং নারীরা তাদের রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের লক্ষ্যে এই দিবসের কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছিল। বলশেভিক পার্টির পক্ষ থেকে ‘উইমেন ওয়াকার্স’ নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশিত হয়েছিল। নারীদের শ্রেণি সচেতন করার লক্ষ্যে ১৯১৫ সালে বলশেভিক পার্টি ‘আন্তর্জাতিক নারীদিবস’-এর ঘোষণাপত্র বিলি করেছিল। এই ধরনের বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে এ পার্টির নেতৃত্বে হাজার হাজার কর্মজীবী-শ্রমজীবী নারীরা বিপ্লবী আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল।

সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতে নারীর অবস্থান
রাশিয়ায় প্রথম নারীশ্রমিক সম্মেলনে লেনিন বলেছিলেন, “সমস্ত সভ্য দেশে, এমনকি সবচেয়ে উন্নত দেশেও নারীরা আজ এমন অবস্থায় আছে, তাদের পারিবারিক দাসীই বলা চলে। একটি ধনতান্ত্রিক দেশে, এমনকি সবচেয়ে স্বাধীন রিপাবলিকেও নারীরা সম্পূর্ণ সমান অধিকার পায় না। …আজও পরিবারের একঘেয়ে কাজ তাদের নিষ্পেষিত করে। আর এর থেকে তারা মুক্তি পাবে তখনই, যখন দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে।”

একটি গণতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের পাশাপাশি বিভিন্ন কাজে নারীদের অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। তাই নারীদেরকে বিভিন্ন কাজে যুক্ত করার প্রশ্নে লেনিন ৩ নং প্রবাসীর পত্রে লিখেছিলেন,“আমরা যদি নারীদের জনহিতকর কাজে, মিলিশিয়ায়, রাজনৈতিক জীবনে টেনে না নামাই; আমরা যদি মেয়েদের গৃহকাজ ও ঘরকন্নার মারাত্মক আবহাওয়া থেকে টেনে না আনি; তাহলে সত্যিকারের স্বাধীনতা লাভ অসম্ভব, এমন কি, গণতন্ত্র কায়েম করাও অসম্ভব, সমাজতন্ত্র তো দূরের কথা।”

বিপ্লবের পর সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংবিধানের ১২২ নং ধারায় ঘোষণা করা হয়েছিল — “সোভিয়েত রাশিয়ার মেয়েরা অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ভোগ করবে। পুরুষদের সঙ্গে সমান অধিকারসহ মেয়েরা যাতে একই বেতনে ছুটি ও বিশ্রামসহ কাজ করতে পারে, সমাজবিমা ও শিক্ষালাভ করতে পারে সেই ব্যবস্থা চালু করবে, জননী ও শিশুদের স্বার্থ রক্ষণাবেক্ষণ করবে, পরিবারের জননী ও অবিবাহিত জননীদের জন্য সরকারি সাহায্য, পুরো বেতনসহ প্রসূতির ছুটি, ব্যাপকভাবে মাতৃসদন, শিশু বিদ্যালয় ও কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়সমূহের ব্যবস্থা করবে, যাতে মেয়েরা এই অধিকারগুলো কাজে লাগাতে পারে—সেরকম উপায় অবলম্বন করবে ”। ১৩৭ নং ধারায় ঘোষণা করা হয়েছিল—“পুরুষের মতো একই শর্তসাপেক্ষে নারীদের নির্বাচিত করার ও হওয়ার অধিকার থাকবে।”

১৯১৮ সালে রুশ সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রথম যে পারিবারিক আইন ঘোষণা করেন তা ছিল তৎকালীন বিশ্বে সবচেয়ে অগ্রসর পারিবারিক আইন। তৎকালীন কোনো ইউরোপীয় দেশে বিবাহ, বিয়ে-বিচ্ছেদ, গণিকাবৃত্তি সংক্রান্ত কোনো আইন প্রণীত হয়নি। এরপর গর্ভপাত বৈধকরণ ও রোধ, জন্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ইত্যাদি আইনও রাশিয়ায় প্রণয়ন করা হয়। তবে এই আইন বাস্তবায়ন করা সহজসাধ্য ছিল না। কঠোর সংগ্রামের মাধ্যমে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়।
সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতে পরিবার ও পারিবারিক সম্পর্ক

সোভিয়েত নেতৃত্ব বুঝেছিলেন সুস্থ ও সবল জাতি গঠনের জন্য প্রয়োজন পরিবার ও বিবাহিত জীবনের নতুন বিন্যাস। সে কারণে ১৯১৮ সালে ‘জন্ম, বিবাহ ও মৃত্যু’ এবং বিবাহ ও অভিভাবকত্ব সম্বন্ধে বিস্তারিত আইন-কানুন জারি করেছিল। ১৯৩৬ ও ১৯৪৪ সালে আরো কিছু ছোটখাটো বিধান কার্যকর করেছিল। এই বিধানসমূহ গৃহীত হওয়ার পূর্বে সোভিয়েত সরকার সেগুলো সারা দেশবাসীর সামনে উপস্থিত করেছিল এবং জনসাধারণের মতামত ও সংশোধনীগুলো বিচার করার পর তা সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছিল।

সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ বিবাহের ক্ষেত্রে সকল অসাম্য দূর করার লক্ষ্যে বিবাহ সম্পর্কিত নতুন আইন পাশ করেছিল। এটি ছিল সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্ট বা লৌকিক বিবাহ আইন। দুই পক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে বিয়ে রেজিস্ট্রি হতো, এখানে তৃতীয় পক্ষের কোনো প্রয়োজন হতো না। সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান ছিল ব্যক্তির ইচ্ছানির্ভর। এই আইন পাশ হওয়ার পর গোটা দুনিয়া বিরোধিতা করেছিল। রাশিয়ার প্রখ্যাত আইনবিদ জেনিয়া বেলোশোভার ভাষ্য ছিল — “মানুষের প্রতি মানুষের সব ধরনের অসাম্য ও নির্যাতন বন্ধ করাই ছিল অক্টোবর বিপ্লবের উদ্দেশ্য। স্বাভাবিকভাবেই পরিবারের মতো মানব সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে এই বিপ্লব হাত না দিয়ে পারেনি, ১৯১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে জারি হওয়া সোভিয়েত বিবাহ আইন, পরিবার সম্পর্কে নতুন বিধি প্রণয়ন করল। তা হলো, পছন্দ করার স্বাধীন অধিকার এবং সোভিয়েত পরিবারের ভিত্তি হবে প্রীতি, পারিবারিক শ্রদ্ধা ও সমানাধিকার।”

একই সাথে সোভিয়েত সরকার বিবাহ-বিচ্ছেদের ক্ষেত্রেও সব বিধি-নিষেধ দূর করেছিল। ১৯১৭ সালের বিবাহ আইন অনুযায়ী — “স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই যদি বিবাহ বাতিল করতে চায়, তাহলে সেই বৈবাহিক সম্পর্ক বাতিল বলে গণ্য হবে। রেজিস্টার অফিসে গিয়ে তা বাতিল করা যাবে। এজন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে না।”

বিবাহপর্ব ও বিবাহ-বিচ্ছেদের ব্যয় ছিল অতি সামান্য। আর বিবাহ বিচ্ছেদের পর সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের সমান দায়বদ্ধতা ছিল, কেউই সন্তানের দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারত না। সন্তান বাবা-মা যার কাছেই থাকুক, অন্যজনকে তার দায়িত্ব সমানভাবে পালন করতে হতো। বাবা-মা দু’জনেই যদি সন্তান পালনে অযোগ্য বিবেচিত হতো, তাহলে রাষ্ট্র তার দায়িত্ব নিতো, সেক্ষেত্রে বাবা-মাকে নির্দিষ্ট অর্থ রাষ্ট্রীয় তহবিলে জমা দিতে হতো। তাদের আয়ের উপর ভিত্তি করে তা নির্ধারিত হতো।
সন্তানের পরিচয় নিয়ে যে সামাজিক সংকট ছিল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়া সেই সংকটেরও সমাধান করেছিল। সকল সন্তানই রাষ্ট্রের নাগরিক—এই ছিল দৃষ্টিভঙ্গি।

গৃহস্থালি কাজ সম্পর্কে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের দৃষ্টিভঙ্গি
সমাজ শ্রেণিবিভক্ত হওয়ার পর ব্যক্তিগত সম্পত্তি সৃষ্টির ফলে সামাজিকভাবে উৎপাদনের প্রয়োজনীয় উপায়গুলোর উপর পুরুষের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলো। ফলে সামাজিক শ্রমের যে গৌরব তা চলে গেল পুরুষের অধীনে। আর মেয়েদের কাজ হলো নেহাতই ঘর-সংসারের কাজ, সামাজিক শ্রমের সঙ্গে তাদের কোনও যোগসূত্র থাকল না। ১৯২০ সালে লেনিন ক্লারা জেটকিনের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “কেমন করে নারীরা ক্ষুদ্র একঘেয়ে ঘরকন্নার কাজে জরাজীর্ণ হয়ে যায়, তাদের শক্তি এবং সময় বিক্ষিপ্ত ও বিনষ্ট হয়, তাদের মন সংকীর্ণ ও বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে, তাদের নিঃশ্বাস মন্থর হয়ে আসে, ইচ্ছাশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে, তা দেখেও পুরুষরা নারীদের নীরব আত্মদান ভোগ করে আসছে। এর চেয়ে সংকীর্ণ মনের বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে।” …“সুতারাং অতি অল্প লোকই এমনকি সর্বহারাদের মধ্যেও খুব কম লোকই বোঝে যে, যদি তারা ‘নারীদের কাজে’ একটু সাহায্য করে তবে কতখানি কষ্ট কমাতে, এমন কি অনেকটা দূর করতেও পারে। কিন্তু না, তা হলো ‘পুরুষের অধিকার ও মর্যাদার’ প্রতিকূল। তারা তাদের শান্তি ও আরাম চায়। নারীদের ঘরোয়া জীবন হলো হাজার রকমের সামান্য বিষয় নিয়ে প্রতিদিনের আত্মত্যাগ।”

বিপ্লবের পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন নারীদেরকে ঘরকন্নার একঘেয়ে কাজ থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে যেসব উদ্যোগ নিয়েছিল তা লেনিনের বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি উল্লেখ করেছেন, “আমরা নারীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, আইন প্রণয়ন ও রাষ্টীয় কাজ কর্মের মধ্যে নিয়ে আসছি। সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দ্বার তাদের জন্য উম্মুক্ত — যাতে তারা তাদের জীবিকা অর্জনের যোগ্যতা ও সামাজিক যোগ্যতা বৃদ্ধি করতে পারে। আমরা যৌথরন্ধনশালা, সাধারণ খাবারঘর, ধোপাখানা ও মেরামতের দোকান, শিশুদের রাখবার জায়গা, শিশুদের জন্য বিদ্যালয়, শিশুদের খেলাঘরসহ সমস্ত রকম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করছি। সংক্ষেপে, আলাদা আলাদা ঘরকন্নার অর্থনৈতিক ও শিক্ষামূলক কাজকর্মগুলিকে সামাজিক দায়িত্বে পরিণত করার কর্মসূচি আমরা গুরুত্বের সাথে কাজে পরিণত করছি। তার অর্থ দাঁড়াবে সাবেকি ঘরকন্নার একঘেয়েমি থেকে ও পুরুষের উপর নির্ভরশীলতা থেকে নারীদের মুক্তিলাভ। তার দ্বারা নারীরা সম্পূর্ণরূপে তাদের নিজেদের প্রতিভা, ক্ষমতা ও আগ্রহ কাজে ব্যবহার করতে সমর্থ হবে। শিশুরাও বাড়ি অপেক্ষা অনেক ভালো অবস্থায় মানুষ হবে। আমাদের নারী শ্রমিকদের জন্য যে রক্ষামূলক আইন আছে তা পৃথিবীর অন্যসব দেশের আইনের চেয়ে বেশি অগ্রগামী এবং সংগঠিত শ্রমিকরা ও সরকারি কর্মচারীরা সেগুলো কার্যকর করে। আমরা প্রসূতি হাসপাতাল খুলছি, মা ও শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠান খুলছি, মাতৃ-শিক্ষাসদন খুলছি, শিশুপালন সম্বন্ধে বক্তৃতার ব্যবস্থা করছি, মা ও শিশুর যত্ন কী করে নিতে হয় সে সম্বন্ধে প্রদর্শনী এবং এই রকম অনেক কিছুর ব্যবস্থা করছি। যেসব নারীদের উপযুক্ত কাজ দেয়া সম্ভব হয়নি, সেসব নারীদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা অত্যন্ত যত্নের সাথে করছি।”

পুঁজিবাদী দেশগুলোর সাথে এখানেই সমাজতন্ত্রের পার্থক্য। পুঁজিবাদী দেশেও নারীরা অফিস-আদালত ও কারখানায় কাজ করে। একই সাথে রান্না-বান্না, সন্তান লালন-পালন, কাপড়-কাচা, সেলাই-বোনা-মেরামত, আতœীয়স্বজন ও রোগীর সেবা করা ইত্যাদি সাংসারিক দায়িত্বও সামলাতে হয়। সংসারের এসব কাজ পুঁজিবাদী সমাজে যেহেতু ব্যক্তিগত ব্যাপার, ব্যক্তিকেই তার দায়িত্ব পালন করতে হয়। কিন্তু প্রতিমুহূর্তে সামাজিক শ্রমের সাথে সংসারের এ শ্রমের দ্বন্দ্ব থাকে। সোভিয়েত সমাজতন্ত্র সেই দ্বন্দ্বের অবসান করেছিল। ১৯৩৪-৩৫ সালের এক হিসেব থেকে জানা যায়, সাধারণ ভোজনাগার থাকার কারণে ৮০-৮৫ ভাগ মেয়েরা খামারের কাজে অংশগ্রহণ করেছিল।

মাতৃত্ব ও শিশু পরিচর্যায় সোভিয়েতের দৃষ্টিভঙ্গি

826772477

জার আমলে রাশিয়া গর্ভবতী নারী ও শিশু মৃত্যুতে প্রথম সারিতে ছিল। বিপ্লবের পর শিশু মৃত্যুর হার ৫০ শতাংশ কমে গিয়েছিল। কারণ, সোভিয়েত রাশিয়া মাতৃত্বের সুরক্ষার প্রশ্নটিকে মৌলিক সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম বলে গণ্য করেছিল। দেশের উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ, উৎপাদন বৃদ্ধি ও সংরক্ষণ — এই তিনটি বিষয়কে তারা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিল। কাজ তিনটি সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য অনুৎপাদনশীল শ্রমে নিযুক্ত বিপুল শ্রমশক্তিকে টেনে আনা এবং সমস্ত প্রাপ্ত সম্পদের যথাযথ ব্যবহার ও জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন মাতৃত্বকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিল। ফলে মাতৃত্ব ছিল গৌরবের। এখানে মাতৃত্ব সম্পর্কে সমাজে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছিল। মাতৃত্বের সুরক্ষা এবং বন্দোবস্ত কেবলমাত্র নারীর নিজের স্বার্থেই নয়, বরং সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য নারীর কর্মক্ষমতাকে সমষ্টির স্বার্থে কাজে লাগাতে মাতৃত্ব ও শিশু পরিচর্যার সবরকম দায়ভার রাষ্ট্র গ্রহণ করেছিল। মাতৃগর্ভে সন্তান একমাস প্রাণলাভ করার সঙ্গে সঙ্গে মায়ের যত্নের সীমা থাকতো না। তখন থেকেই রাষ্টীয় খরচে ডাক্তার, ওষুধ ও পথ্যের ব্যবস্থা করা হতো। এক মাসের মধ্যে ডাক্তার দেখানো হলেই মায়েরা একটি কার্ড পেত। এই কার্ড দেখালেই—
১. ট্রামে, গাড়িতে তাদের সবার আগে ভালো জায়গায় বসতে দিত।
২. কোনো দোকানে গেলে সবার আগে তাদের প্রয়োজন মেটাত।
৩. তাদের জন্য বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করত।
৪. অফিসে বা কারখানায় হালকা কাজ দিত।
৫. বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে বেদনাহীন প্রসবের ব্যবস্থা করে সোভিয়েত রাশিয়া বিরল দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছিল। ডাক্তারদের মতে, বেদনার মূল কারণ অজ্ঞতা, ভয় এবং তা থেকে স্নায়বিক উত্তেজনা। তাই সন্তান জন্মের কয়েক মাস আগে থেকে মা’কে ডাক্তার সন্তান প্রসবের গোটা বিষয়টি বুঝিয়ে বলতেন। শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম ও উদ্বেগমুক্ত থাকার কয়েকটি পদ্ধতি শিখিয়ে দিতেন। এতে ভাবী মায়েদের মধ্যে সাহস, স্বাভাবিকতা ও উদ্বেগহীনতা সৃষ্টি করত।
৬. শহর ও গ্রাম অঞ্চলের প্রত্যেকটি স্থানে ছিল মাতৃত্বকালীন হাসপাতাল ও গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র, যার কাজ ছিল গর্ভবতী নারীকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ, চিকিৎসা সেবা প্রদান করা এবং প্রয়োজনে প্রসূতি হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করা। বিপ্লবের মাত্র কয়েক বছর পরেই অর্থাৎ ১৯২১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে বিশেষ বিশেষ স্থানে ৩৫টি ‘প্রসূতিভবন’ গড়ে তোলা হয়েছিল । বাড়ি, পরিবার এবং গৃহস্থালির দৈনন্দিন কাজ থেকে মুক্ত হয়ে যেন শিশুর প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারে এবং নিজের স্বাস্থ্যের পুনরুদ্ধার করতে পারে সেজন্যই—এই প্রসূতিভবনগুলো গড়ে তোলা হয়েছিল।
৭. চাকুরি থেকে পুরো বেতনে ৭৭ দিন ছুটি—প্রসবের আগে ৩৫ দিন আর প্রসবের পর ছিল ৪২ দিন। যেসব ক্ষেত্রে প্রসবের সময় জটিলতা সৃষ্টি হতো, সেইসব ক্ষেত্রে প্রসবের পর ৫৬ দিন ছুটি ভোগ করতে পারত। এখানেই শেষ নয়, শিশু ভূমিষ্ঠ হলেই তার সমস্ত ব্যয় রাষ্ট্রই বহন করত। এক হিসেবে দেখা গেছে, তখন সোভিয়েত দেশে প্রতি বছর ৬০ লক্ষ শিশু জন্মগ্রহণ করে। এইসব শিশুর দায়িত্ব রাষ্ট্রই নিয়েছিল। হাসপাতাল থেকে শিশু বাড়ি ফিরলে হাসপাতালে শিশুর নাম লেখাতে হতো। সপ্তাহে সপ্তাহে শিশুদের ডাক্তারী পরীক্ষা হতো।
৮. প্রসবের পর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ছাড়পত্রে মা যখন কাজে যোগ দেবার উপযুক্ত হতেন, তখনই তার পক্ষে পুরোনো কাজে যোগ দেয়ার অধিকার থাকত এবং পদোন্নতিসহ সকল সুযোগ নিশ্চিত থাকত।
৯. অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় চতুর্থ মাস থেকে কোনো মেয়েকে ওভার টাইমে নিযুক্ত করা হতো না এবং প্রসবের পর শিশু যতদিন স্তন্যপান করত ততদিন পর্যন্ত নিম্নোক্ত সুযোগগুলো অব্যাহত থাকত —

ক. প্রত্যেক মা কাজের সময় প্রতি সাড়ে তিনঘণ্টা অন্তর শিশুকে স্তন্যদান করার জন্য আধঘণ্টা ছুটি পেত। এজন্য কর্মক্ষেত্রেই গড়ে তোলা হয়েছিল ক্রেশ বা নার্সারি। ২ মাস থেকে ৫ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতিটি সোভিয়েত মা শিশুকে লালন-পালন করার জন্য নার্সারিতে ভর্তির অধিকার পেত। এইসব নার্সারিতে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে সন্তান প্রতিপালনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যাতে কর্মক্ষেত্রে কোনো মা অসুবিধায় না পড়ে।
খ. কোনো মা’কেই রাত্রিকালীন কাজে নিযুক্ত করা হতো না।

১০. অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ষষ্ঠ মাস থেকে এবং প্রসবের পর চার মাস পর্যন্ত প্রত্যেক মেয়েকে সাধারণ রেশনের তুলনায় দ্বিগুণ পরিমাণ রেশন দেয়া হতো।
১১. শিশুর পোশাক বাবদ প্রত্যেক মা সরকারের কাছ থেকে নগদ অর্থ পেত এবং শিশুর বয়স যতদিন না এক বছর হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত তার খাওয়া-দাওয়ার জন্যে প্রত্যেক মা আর্থিক সহযোগিতা পেত।
কারখানা, স্কুল, কলেজ, যৌথ খামার, রেল, স্টিমার, অফিস-আদালত, বাজারসহ সর্বত্রই শিশুদের জন্য ক্রেশ বা নার্সারি এবং কিন্ডারগার্টেনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। গ্রামীণ মায়েদের সাহায্যার্থে ‘গ্রীষ্মকালীন ক্রেশ’ সংগঠিত করা হয়েছিল। বিপ্লবের পূর্বে ১৯১৩ সালে জার সরকারের আমলে মাত্র ১৯টি ক্রেশ ছিল। কিন্তু ১৯২১ সালের মধ্যে ৩২ হাজার ১৮০ জন শিশুর জন্য ব্যবস্থাপনা করতে পারে এমন ৬৭৯টি ক্রেশ বা নার্সারি উন্মুক্ত করা হয়েছিল। এসব ক্রেশের সংখ্যা দিন দিন বেড়েছে। ১৯৩৬ সালে ক্রেশগুলোতে মোট ৩১ লক্ষ ৬৪ হাজার ৫৮৪ জন শিশু নেয়ার ব্যবস্থা ছিল।

প্রতিটি ক্রেশের সঙ্গে ডাক্তার ও অসংখ্য নার্সরা নিযুক্ত ছিল। শিশুরা যখন প্রথম আসে তখনই ডাক্তার বা নার্স একবার পরীক্ষা করে দেখেন তার স্বাস্থ্য ঠিক আছে কিনা। যদি কেউ অসুস্থ হয় তাহলে তাকে আলাদা ঘরে রাখার ব্যবস্থা হতো। প্রথমেই তাদের স্নান করে পরিষ্কার কাপড় পরিয়ে খেলার ঘরে পাঠানো হতো। বয়স অনুযায়ী খেলার দল ভাগ করা হতো। সাধারণত সাড়ে তিন বছর বয়স পর্যন্ত ক্রেশে নেয়া হতো এবং তারপর আট বছর পর্যন্ত কিন্ডারগার্টেনে রাখা হতো। দিনের মধ্যে দু’বার বাইরে নেয়ার ব্যবস্থা ছিল। গান, বাজনা, নাচ, গল্প এবং বাইরে ঝুলবার, লাফ দেয়ার, গড়িয়ে পড়া, নানা আয়োজন এবং ঘর-বাড়ি বা সেতু গড়ার ছোট ছোট খেলনার কোনো অভাব ছিল না। এমন এমন খেলার আয়োজন ছিল, যা একা একা খেলা সম্ভব নয়। দশজনে মিলে তবে খেলা হতো। ফলে শিশুকাল থেকে দশে মিলে কাজ করার বিশেষ আগ্রহ জেগে উঠেছিল। সোভিয়েতে ট্রেনগুলোতেও ক্রেশের ব্যবস্থা ছিল এবং ক্রেশগুলো সুন্দর করে সাজানোর জন্য ট্রেনের গার্ডদের মধ্যে ভীষণ প্রতিযোগিতা চলতো। এই ক্রেশগুলোতে ছেলেমেয়েদের চিকিৎসা, খাদ্য, খেলাধুলার সরঞ্জাম ও পোশাকসহ সব কিছুর ব্যয় রাষ্ট্রই বহন করত।

ক্রেশ ও কিন্ডারগার্টেন শেষ করে ছেলেমেয়েদের স্কুলে যেতে হতো। ৮ বছর থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত শিক্ষাগ্রহণ বাধ্যতামূলক ছিল। শিক্ষার যাবতীয় খরচ রাষ্ট্রই বহন করত। এইসময় ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্য গড়ে তোলার দিকে বিশেষ নজর দেয়া হতো। ছাত্র ও শিক্ষকের সম্পর্ক ছিল অপূর্ব। কোনো দোষ-ক্রটি থাকলে ছাত্র ও শিক্ষক সম্মিলিতভাবে সভায় মিলিত হয়ে দোষ-ক্রটি শুধরে নিত। এসব কিছু সম্ভব হয়েছে ক্লাসের ভেতরে পাইওনিয়ার দল গড়ে তোলার ফলে। স্কুল জীবনকে সুন্দর এবং স্কুলের নিয়ম-শৃঙ্খলা পালন করার জন্য এই পাইওনিয়ার দলই ভূমিকা পালন করত। ‘পাইওনিয়ার দল’ এমনভাবে গড়ে উঠেছিল যে শুধু নিজেদের ক্রটি শোধরানোর ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত থাকত না, বাবা-মায়েদেরও এ বিষয়ে যুক্ত করেছিল। সমস্ত রকম বদ অভ্যাস থেকে নিজেদের যেমন মুক্ত করার সংগ্রাম করেছে তেমনি বাবা-মায়েদেরও মুক্ত করার সংগ্রাম করেছিল এই পাইওনিয়ার দল।

পাইওনিয়ারদের ক্লাব ঘর ছিল, যেখানে প্রচুর বই-পুস্তক ও খেলার সরঞ্জাম ছিল। স্কুলে সপ্তাহে একদিন ব্যায়ামের ব্যবস্থা ছিল। প্রতিটি স্কুলে একজন করে ডাক্তার ছিলেন, তিনিই নির্ধারণ করতেন কার জন্য কোন ব্যায়াম প্রয়োজন। সাঁতার, স্পোর্টস, স্কি, স্কেট প্রভৃতি খেলার ব্যবস্থা ছিল। গ্রীষ্মকালে ফুটবল খেলার ধুম পড়ত। খেলার আয়োজনের পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের জন্য বিশাল বিশাল পার্ক গড়ে তোলা হয়েছিল। পার্কে রেলগাড়ি চালানোর জন্য ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাই সব দায়িত্ব ও নিয়মকানুন পালন করতো। জাহাজ চালানো শেখার জন্য ছেলেমেয়েদের জন্য বন্দর তৈরি করা হয়েছিল। এছাড়া প্রতিটি পার্কে ‘ছোটদের গ্রাম’ বলে একটি পৃথক অংশ করা হয়েছিল যেখানে ছেলেমেয়েরা মোটর চালাত।

এই পাইওনিয়ারদের জন্য গ্রীষ্মকালীন শিবির চালু ছিল। এই শিবির জীবনের অধিকাংশ কাজকর্ম নিজেদের করতে হতো। ঘর পরিষ্কার, থালাবাসন ধোয়া, ফুলের বাগানের যত্ন নেয়া ইত্যাদি। এছাড়া সকালে ও বিকালে নির্দিষ্ট কয়েক ঘন্টা নিজেদের পছন্দ মতো তারা নানা খেলা করতো – ফুলের বাগান তৈরি, উড়োজাহাজের মডেল তৈরি, ফানুস ওড়ানোর জন্য লাল-নীল কাগজ কেটে চলা ইত্যাদি। এই শিবির জীবনেও দলনেতা ছিল, যার নির্দেশে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে ব্যায়াম এবং নিজেদের কাজকর্মের ক্রটি-বিচ্যুতি নিয়ে আলোচনা হতো। শিবির জীবন ছিল ছেলেমেয়েদের কাছে সবচেয়ে আনন্দের।

স্বাস্থ্যনিবাসের উপরও সোভিয়েত সরকার জোর দিয়েছিল। বিপ্লবের পর বড় বড় রাজপ্রাসাদ ও মনোরম বাড়িগুলোকে শিশুদের স্বাস্থ্যনিবাসে পরিণত করা হয়েছিল।

পনেরো বছর শিক্ষাজীবন শেষে প্রায় সকলেই দুই বছর উচ্চশিক্ষা গ্রহন করতো। এখানেই শেষ নয়, এর পরের জীবন গড়ে তোলার জন্য ‘কমসোমল’ নামে তরুণ সাম্যবাদী সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছিল। ১৯৩৫ সালে এর সদস্য সংখ্যা ছিল ৫০ লক্ষ, যাদের বয়স ছিল ১৭-২৫ বছর। কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতীরা এই দলের সদস্য হতে পারত। এই ‘কমসোমল’-এর সদস্যরাই পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছে।

স্যার আর্থার নিউজ হোলম্স এবং ড. জে এ কিংসবারি ১৯৩৩ সালের এক সমীক্ষায় স্বীকার করেন—“সোভিয়েত মায়েদের এবং সন্তানদের চিকিৎসা, স্বাস্থ্য সেবা, উন্নত কর্মপদ্ধতি, বিজ্ঞানভিত্তিক কাজ, অর্থনৈতিক সুবিধাপ্রদান আমাদের বিস্মিত করেছে, মাতৃত্ব এবং শিশু পরিচর্যার প্রতিষ্ঠান এবং তাদের কাজকর্মের প্রভাব আর কোথাও এমন হয় কিনা সন্দেহ।”

গর্ভপাত প্রশ্নে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের দৃষ্টিভঙ্গি
গর্ভপাত একটি সামাজিক অপরাধ ও অনৈতিক কর্ম হিসেবে বিবেচ্য ছিল। সোভিয়েত সমাজও এটিকে অপরাধ মনে করত। সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা প্রথম অনুধাবন করেছিলেন, আইন করে এই সমস্যা দূর করা যাবে না। এর বীজ নিহিত আছে অর্থনৈতিক ও নৈতিক সমস্যার গভীরে। তাই এই অপরাধকে সমূলে উৎপাটন করার লক্ষ্যে সোভিয়েত সরকার ১৯২০ সালে সাময়িকভাবে গর্ভপাতকে আইনসিদ্ধ করেছিল। পৃথিবীর আর কোনো দেশে এই ধরনের আইন ছিল না। এর ফলে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে নানা অপ্রচারও ছিল। কিন্তু ১৯৩৮ সালের মধ্যে রাশিয়াকে গর্ভপাত মুক্ত করে পৃথিবীর মধ্যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। পুঁজিবাদ গর্ভপাতকে নিষিদ্ধ করে আইন করেছে। কিন্তু কেন নারীরা গর্ভপাতে বাধ্য হয় তার কারণ অনুসন্ধান করেনি। সোভিয়েত ইউনিয়ন মনে করত, গর্ভপাত নিষিদ্ধ করতে হলে কয়েকটি শর্ত অবশ্যই পূরণ করতে হবে। তার মধ্যে প্রধান কয়েকটি শর্ত হলো—(ক) জনসাধারণের আর্থিক উন্নতি (খ) নারীদের অর্থনৈতিক মুক্তি (গ) শিশু পালনের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ (ঘ) গর্ভনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পর্কে উপযুক্ত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রচার। এসব ব্যবস্থার বাস্তবায়ন ছাড়া ভ্রুণহত্যা বা গর্ভপাত বন্ধ হবে না। ১৯৪১ সালে মার্কিনীদের হিসেব মতে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ৬ লক্ষ ৮০ হাজার ভ্রুণ হত্যা হতো, প্রতিবছর প্রায় ৮ হাজার নারী মারা যেত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানিতে প্রতিবছর অন্তত ১০ হাজার নারী হাতুড়ে ডাক্তারদের হাতে গর্ভপাত করতে গিয়ে মৃত্যবরণ করত। জার আমলে গর্ভপাতে রাশিয়া ছিল প্রথম সারির দেশ। জারের আমলে মেয়েরা গর্ভপাত করত, কারণ গর্ভবতী হলে শারীরিকভাবে তারা অসমর্থ হয়ে পড়তো এবং কাজ হারাত। ফলে স্বামী-সন্তানসহ গোটা পরিবার সংকটে পড়ত। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ভবিষ্যৎ সন্তানের যতœ নেয়া দুঃসাধ্য মনে করেই জার আমলে নারীরা গর্ভপাত করতে বাধ্য হতো।

বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত সরকার এই অবস্থা থেকে মেয়েদের মুক্তি দিয়েছিল। দিয়েছিল কাজের নিশ্চয়তা। এছাড়া গর্ভপাতকে আইনসিদ্ধ করে কিছু বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। এই পদক্ষেপগুলোর মধ্যে প্রথমটি ছিল, গর্ভপাতের জন্য উন্নত পরিষেবা। সোভিয়েত দেশের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য বিশেষ ধরনের আধুনিক হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়েছিল। সেখানে ছিল দক্ষ চিকিৎসক, যোগ্য পরামর্শদাতা এবং উপযুক্ত পরিকাঠামো। গর্ভসঞ্চারের পর কোনো মেয়ে যদি সন্তান প্রসবে অনিচ্ছুক হয়, তাহলে সে নিকটবর্তী হাসপাতালে গিয়ে নাম-ঠিকানা নার্সের কাছে জানিয়ে আসত। নার্স সমস্ত কথা লিখে নিতেন। ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শের জন্য মেয়েটির সুবিধা অনুসারে দিন-তারিখ নির্ধারণ করতেন। এর পূর্র্বে ঐ মেয়েটির বাড়িতে গিয়ে আর্থিক-পারিবারিক অবস্থা জেনে আসতেন। ডাক্তার পূর্বেই জানতেন এবং নির্দিষ্ট দিনে ঐ মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতেন। নার্স-চিকিৎসক অত্যন্ত সহানুভূতির সাথে গোপনে তাদের সমস্যাগুলি অনুধাবনের চেষ্টা করতেন। প্রকৃতপক্ষে ভীত সন্ত্রস্ত অসহায় নারীরা এসব হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের বন্ধুর মতো পাশে পেয়েছিল। চিকিৎসকরা প্রথমে তাদেরকে গর্ভপাতে নিরুৎসাহিত করত। সর্বোচ্চভাবে বুঝানোর চেষ্টার পর, যদি কাউকে রাজি করানো যেত, তখন চিকিৎসক গর্ভপাত করাতে বাধ্য ছিল। গর্ভপাতের পর পুরো তিনদিন হাসপাতালেই থাকতে হতো। এভাবে নিরন্তর চেষ্টার ফলে ১২ বছরে প্রায় ৩ লক্ষ নারীর জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিনামূল্যে এই উন্নত সেবা পরিচালনা করেছিল। হাতুড়ে ডাক্তারদের হাতে গর্ভপাতকে কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছিল।

চিকিৎসকদের আন্তরিক চেষ্টার কারণে ১৯২৫ সালে মস্কো হাসপাতালে ১১ হাজার মেয়ের মধ্যে একটি মেয়েরও মৃত্যু ঘটেনি; সারাটভ-এ ২৩,৩৬৬ জনের গর্ভপাতের মধ্যে একটিরও ফলাফল মারাত্মক হয়নি। কিন্তু গর্ভপাতের জন্য এই দু’টি শহরে দরখাস্ত পড়েছিল প্রায় দ্বিগুণ। বিপ্লবের পরবর্তী বছরগুলিতে রাশিয়ায় চুড়ান্ত কষ্ট ও দারিদ্র্য থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসকদের আন্তরিক চেষ্টার ফলে প্রায় ৫০ ভাগ গর্ভপাত কমেছিল। বাস্তব শর্ত পূরণ হওয়ার ফলে ১৯৩৯ সালে পুরোনো আইনকে সংশোধন করের সোভিয়েত দেশে নুতন আইন হলো—নেহাতই স্বাস্থ্যভঙ্গের ভয় ছাড়া ভ্রুণহত্যা হবে বেআইনি। ১৯৪৪ সাল নাগাদ এই দু’টি শর্ত পূর্ণমাত্রা পেয়েছিল। এ বছরেই রাশিয়া গর্ভপাত মুক্ত দেশে পরিণত হলো।

সোভিয়েত যেভাবে গণিকাবৃত্তি বন্ধ করেছিল
পুঁজিবাদ গণিকাবৃত্তির দায় নারীর উপর চাপিয়ে দেয়। কিন্তু কেন একজন নারী এই বৃত্তি গ্রহণ করে তার কারণ অনুসন্ধান করে না। ১৯২৩ সাল থেকে সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা এই গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে অভিযানের প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন। প্রথম উদ্যোগ একটা শোরগোল ফেলে দিয়েছিল। একটা প্রশ্নপত্র ছাপানো হয়েছিল এবং তা গোপনে হাজার হাজার নারীর মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। প্রশ্নপত্র তৈরি করেছিলেন নারী-পুরুষ ডাক্তার, মনোবিদ, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা।
নারী কেন এই জীবন গ্রহণে বাধ্য হয়, সে প্রসঙ্গে এই ছিল প্রথম গণনিরীক্ষা। কয়েক জনকে প্রশ্ন করে নয়, সিদ্ধান্ত হয়েছিল নানা সামাজিক স্তরের বিভিন্ন বয়সের অসংখ্য নারীকে সোজাসুজি প্রশ্ন করে এর উত্তর খুঁজে বের করতে হবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন তা বাস্তবায়ন করেছিল। সমস্ত জবাব ছিল লিখিত এবং জমা দেয়া হয়েছিল চূড়ান্ত গোপনীয়তার মধ্যে। সেই অভূতপূর্ব প্রশ্নগুলো বহু যুগ ধরে সঞ্চিত বিশ্বাসের ভিত্তিমূলে আঘাত করেছিল। সোভিয়েত অনুসন্ধানকারীদের যা অবাক করেছিল, তা হলো প্রায় প্রতিটি জবাবের খোলাখুলি ভাব। কারণ, উত্তরদাতারা গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল।

এই নিরীক্ষা থেকে যে সিদ্ধান্ত পাওয়া গিয়েছিল, সাধারণ মানুষের কাছে তার বিস্ময়কর দিক ছিল—পেশাদার গণিকা ও সাধারণ নারীর মধ্যে সুনির্দিষ্ট কোনো বিভেদ রেখা বাস্তবে ছিল না। যারা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে একটা বড় অংশই বলেছিলেন যে, পরিবারের সামান্য আয়ে জীবন ধারণ অসম্ভব। তাই পরিবার ও সন্তান-সন্তÍতিদের বাঁচানোর জন্য এই পথ গ্রহণে তারা বাধ্য হয়েছিলেন।

জীবন ধারণের জন্য নারী কেন গণিকাবৃত্তি গ্রহণ করে? উত্তর ছিল— দারিদ্র্যে ও অর্থনৈতিক নিষ্পেষণের ফলে তারা স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে এই জীবন গ্রহণ করতে বাধ্য হতো। তারা জোরের সাথে আর একটা উত্তর লিখেছিলেন—‘এই পথে তাঁরা পা দিয়েছেন কারও না কারও প্ররোচনাতেই।’ প্ররোচনা দিয়েছিল সেইসব নারী বা পুরুষ যারা ছিলেন গণিকালয়ের পরিচালক। প্রশ্নোত্তরপত্রে অধিকাংশ মেয়েই বলেছিল, যদি মর্যাদাপূর্ণ কাজ পাওয়ার সামান্যতম সম্ভাবনাও থাকে, তবে তাঁরা জীবনকে নতুনভাবে তৈরি করার চেষ্টা করবে।

এই কর্মপন্থার নৈতিক ভিত্তি সুন্দরভাবে বর্ণনা করে ম্যাক্সিম গোর্কি বলেছেন—“যখন একজনও ক্রীতদাস থাকবে না, তখন মানুষ সবচেয়ে সুন্দর। কিন্তু যদি দেখতে হয়, একজনও শোষিত বা দাস থাকবে না, তবে যাঁরা দাসেদের শ্রমের উপর বেঁচে থাকে, তাঁদের বিরুদ্ধে নির্মম সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে।”

১৯২৫ সালে গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের কর্মসূচী’ এই শিরোনামে আদেশ জারি করা হয়েছিল। এই ধাপে ছিল — সমস্ত নারীদের জন্য কাজের নিশ্চয়তা, স্কুল ও ট্রেনিং সেন্টারগুলিতে মেয়েদের অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা, আবাসনের ব্যবস্থা করা, গৃহহীন নারী ও শিশুদের নিরাপত্তার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা করা ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান, ট্রেডইউনিয়ন, কো-অপারেটিভ, গণসংগঠনকে আহ্বান।
এছাড়া অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের জন্য তিনটি কেন্দ্রীয় ডিক্রি জারি করা হয়েছিল। ডিক্রি তিনটি ছিল —

১. গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে জার শাসন আমলের সমস্ত দমনমূলক আইন বাতিল করা।
২. গণিকাবৃত্তি থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যারা মুনাফা লুঠছিল, সেই সমস্ত পরগাছাদের নির্মূল করার জন্য ক্ষমাহীন যুদ্ধ ঘোষণা।
৩. যৌনরোগগ্রস্ত সমস্ত মানুষের কাছে বিনা পয়সায় চিকিৎসার সুযোগ পৌঁছে দেয়া।

এই ডিক্রি বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল জনস্বাস্থ্য বিভাগের উপর। কিন্ত শুরুর কয়েক মাসের মধ্যেই মারাত্মক অসুবিধা দেখা দিয়েছিল। কারণ কোথাও সংগঠিত গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে প্রকৃত সংগ্রাম ছিল না। তাই ১৯২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিচার বিভাগের গণকমিশনার, এর উপর এই আইন পরিবর্তনের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছিল। পরিবর্তিত আইন ছিলÑ ব্যক্তিগত স্বার্থে বা অন্য কারণে যারা গণিকাবৃত্তিকে সাহায্য করবে, প্রথম অপরাধের ক্ষেত্রে তাদের সাজা হবে কমপক্ষে তিন বছর কারাবাস। তার সমস্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি অধিগ্রহণ করা হবে। গণিকা যদি অপরাধীর অধীনে বা তার রক্ষণাবেক্ষণে থাকে এবং ঐ গণিকার বয়স যদি একুশ বছরের কম হয়, তবে সাজা বেড়ে কারাবাসের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর। ….”

এই আইন ইতিহাসে প্রথম কানুনী ব্যবস্থা যা সংগঠিত গণিকাবৃত্তির ভিত্তিকে ধ্বংস করেছিল। দুই ধাপে ভাগ করে কাজ শুরু করা হয়েছিল —
১. মিলিশিয়াদের কাজ ছিল গণিকালয়গুলোকে খুঁজে বের করা । এই ধরনের বাড়ির যারা মালিক বা ভাড়াটে, যারা এই ব্যবসার সাথে যুক্ত বা যারা এই ব্যবসার জন্য মেয়ে ও খদ্দের জোগাড় করে, তাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করে আইন অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা করা।
২. মিলিশিয়া এবং জনগণকে সতর্ক করে বলা হয়েছিল, গণিকাদের উপর যেন কোন দমনপীড়ন চালানো না হয়। একটা ধারায় গণিকাদের গ্রেপ্তার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এটা সত্যিই আশ্চর্যজনক ছিল। মূলত তাদের যারা শোষণ করত, সেইসব লোকদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ার জন্যই কেবল তাদের কোর্টে ডাকা হতো। গণিকালয়ে অভিযান চালাবার সময় মিলিশিয়া কেমন আচরণ করবে, আইনে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেয়া ছিল। অনুসন্ধানী দলে যাঁরা ছিলেন, তাদের বলা হয়েছিলÑ‘তোমাদের মনে রাখতে হবে এরা মুনাফাখোরদের অসহায় শিকার। গণিকারা যত খারাপ আচরণ করুক, তাদের সাথে কথা বলতে হবে ভদ্রভাষায় এবং কোনোরকম ব্যক্তিগত অপমান করা যাবে না।’ এমনকি অফিসারদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, গণিকাদের নাম-ঠিকানা পর্যন্ত নেয়া চলবে না।

গণিকাবৃত্তি প্রতিরোধে এই ছিল সোভিয়েত দৃষ্টিভঙ্গি। গণিকাদের বিরুদ্ধে নয়, বরং যে ব্যবস্থার কারণে তারা শোষণের শিকার, তার বিরুদ্ধেই শাস্তিমূলক নিতে হবে। এ প্রসঙ্গে যৌনরোগবিরোধী সংগ্রামের দ্বিতীয় কংগ্রেসে অধ্যাপক এলিসস্ট্রাটভ বলেছিলেন, “…মানুষের উপর মানুষের শোষণ অবলুপ্ত করার নীতির উপরই দাঁড়িয়ে আছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। যে ব্যক্তিগত স্বার্থে ঘৃণ্যভাবে নারীকে শোষণ করে ; সে এই সমাজের নাগরিক হিসাবে নিজেকে দাবি করতে পারে না। ”
এরপর সোভিয়েত সরকার আর একটি বিস্ময়কর ডিক্রী জারী করেছিল। সেটি ছিল—যখনই কোনো অফিসার বাড়ি, পানশালা বা অন্ধকার রাস্তায় গণিকাদের খোঁজে অভিযান চালাত, তখন সেখানে উপস্থিত পুরুষদের নাম, ঠিকানা ও কোথায় সে কাজ করে ইত্যাদি লিখে নিতে হতো। খদ্দেরকে গ্রেফতার করা হতো না। কিন্তু পরদিন, একটা জনবহুল এলাকায় তাদের নাম, পরিচয় জানিয়ে বড় বড় অক্ষরে লিখে দেওয়া হত—‘নারী দেহের ক্রেতা’। এটা লেখা থাকত বেশ কয়েকদিন ধরে। কারখানার বুলেটিন বোর্ডে বড় বড় আবাসনের গাঁয়ে নামের তালিকা চোখে পড়ার মতো করে টাঙানো থাকত। নাটকের মাধ্যমেও এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।

১৯২৬ সাল থেকে যৌনরোগবিরোধী সোভিয়েত অভিযান এমন কার্যকরভাবে পরিচালিত হয়েছিল যে, ১৯৩১ সালের শেষ দিকে রোগীর অভাবে বহু ক্লিনিক বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। ১৯৩৮ সালে লালফৌজ ও নৌবাহিনী সিফিলিস ও গণরিয়া মুক্ত হয়েছিল।

কর্মক্ষেত্রে সোভিয়েত নারীর অগ্রগতি
Drive_to_the_Collective_Farm
শহরে নারীরা গৃহপরিচারিকা ও গ্রামে কৃষি শ্রমিক হিসেবেই যুক্ত ছিল। প্রথম দিকে নারী শ্রমিকদের অর্ধেকের বেশি ছিল নিরক্ষর। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রথম বছরেই তা আশাতীতভাবে কমেছিল। ১৯৩৪ সালে ১০০ জনের মধ্যে ৯০ ভাগ মেয়ে লিখতে ও পড়তে জানত। দলে দলে মেয়েরা বিভিন্ন শিল্প-শিক্ষালয়ে ভর্তি হলো । কারণ সাধারণ শ্রমিক হয়ে থাকলে চলবে না; দেশের খাতিরে আধুনিক বৈজ্ঞানিক শিল্প-শিক্ষায় সুদক্ষ হয়ে উঠতে হবে। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ফলস্বরূপ শুধুমাত্র অফিস এবং হালকা শিল্পে নয়, কৃষি এবং ভারী শিল্পেও বহু নারী শ্রমিক যোগ দিয়েছিল। এছাড়া প্রশাসনিক কাজে, সৈন্যদলে, বাণিজ্যিক জাহাজসহ বিভিন্ন পেশায় নারীদের উপস্থিতি ছিল বিশেষ লক্ষণীয়।

১৯২৬ সালের এক হিসাবে দেখা যায়, সোভিয়েত রাষ্ট্র পরিচালনা ও টেকনিক্যাল কাজে মেয়েরা একটি বিশেষ স্থান দখল করেছিল। রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে ১৬ হাজার জন, টেকনিক্যাল কাজকর্মে ৭ হাজার জন, কৃষিবিদ পদে ৭’শ জন এবং আইনজ্ঞের কাজে ৮’শ জন মেয়ে কাজ করত। প্রথম পঞ্চবাষির্কী পরিকল্পনার পাঁচ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৩৩ সালের হিসাবে দেখা গেল, মেয়ে ইঞ্জিনিয়ার ও অন্যান্য সুদক্ষ কর্মী ৩ লাখ ৭৫ হাজার, শিক্ষয়িত্রী ৩ লাখ ৮৭ হাজার ২’শ, নারী চিকিৎসক ২ লাখ ১১ হাজার জন।

১৯৩৩-৩৪ সালে মেয়েরা মাঠে মাঠে ট্রাক্টর, কম্বাইন চালাতে শুরু করেছিলো। ১৯৩৫ সালে কম্বাইন পিছু ৪০০-৪৫০ একর জমি চাষ করা যেত। সে জায়গায় আমেরিকায় একজন চাষী ৫৫৭.৫ একর জমি তৈরি করতে পারত। ১৯৩৫ সালেই সোভিয়েতের বীর মেয়েরা আমেরিকার রেকর্ড ভঙ্গ করে ১৩৬০ একর জমি প্রস্তÍত করেছে। সর্বোচ্চ রেকর্ড গড়েছিল সারাটভ জেলার সুখিনা, সে প্রস্তুত করেছে ১৮২০ একর জমি।

১৯৩৪ সালে স্তালিন কর্র্তৃক সপ্তদশ পার্টি কংগ্রেসে প্রদত্ত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে— সামাজিক ও গঠনমূলক কাজে যৌথ নারী-চাষীদের কার্যকলাপ বৃদ্ধি, পল্লি অঞ্চলের সাংস্কৃতিক অগ্রগতির পরিচায়ক বলেই আমরা আনন্দ প্রকাশ করছি। উদাহরণস্বরূপ আমরা জানি যে, প্রায় ৬ হাজার যৌথ কিষাণ নারী যৌথ কৃষিক্ষেত্রসমূহের চেয়ারম্যান পদে, ৬০ হাজারের অধিক নারী পরিচালক বোর্ডের সদস্য পদে, ২৮ হাজার নারী কর্মী দলসমূহের নেতৃত্বপদে, ১ লক্ষ নারী অর্গানাইজার পদে, ৯ হাজার নারী ডেয়ারিসমূহের ম্যানেজার পদে আসীন রয়েছে এবং ৭ হাজার নারী ট্রাক্টরের ড্রাইভাররূপে কাজ করছে।
১৯৩৫ সালের আর একটি হিসাবে দেখা যায়, বড় বড় কলকারখানায় নারীর সংখ্যা ২৬ লক্ষ ২৭ হাজার, নির্মাণকাজে ৪ লক্ষ ৫০ হাজার, যানবাহনে ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার, বাণিজ্য ও সাধারণ ভোজনাগারে ৮ লক্ষ ২২ হাজার, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও রাষ্ট্রপরিচালনায় ১৯ লক্ষ ৭৮ হাজার এবং কৃষিকাজে ৬ লক্ষ ৮৫ হাজার নারী নিযুক্ত ছিল।

১৯৪০ সালের তথ্য থেকে জানা যায়, সে সময়ে যৌথ খামারের সভানেত্রী-সহসভানেত্রীর সংখ্যা ছিল ১৪ হাজার ২’শ এবং খামারের প্রাণীপালন বিভাগের প্রধান পরিচালিকার সংখ্যা ছিল ৪০ হাজার।

১৯৪৬ সালের হিসাব মতে, শিক্ষিকা ৭ লক্ষ ৫০ হাজার, ১ লক্ষ নারী ডাক্তার, ২ লক্ষ ৫০ হাজার নারী-ইঞ্জিনিয়ার এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর অর্ধেকই নারী। ৩৩ হাজারেরও বেশি নারী কাজ করছেন বিভিন্ন ল্যাবরেটরি এবং গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানে। ২৫ হাজারের বেশি মেয়েদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ডিগ্রি ও উপাধি রয়েছে এবং ১৬৬ জন বিজ্ঞান এবং কাজের ক্ষেত্রে তাদের বিশেষ অবদানের জন্য জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছেন।

১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে বলশেভিক পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে সমাজতান্ত্রিক সংগঠনের কাজে নারীদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, “সমাজতন্ত্রিক শিল্প প্রচেষ্টা, যৌথ কৃষিক্ষেত্র ও সমাজতান্ত্রিক কৃষ্টি রচনাকারী সোভিয়েত নারীদের কীর্তি চিরদিনের জন্য ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে। প্রত্যেক বৎসর, সোভিয়েত সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর কীর্তিকলাপ বেড়ে চলেছে। দেশ শাসন ও রাষ্ট্রগঠনেও সোভিয়েত নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিলো। এতে সোভিয়েট রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অকৃত্রিম গণতান্ত্রিকতারই জ্বলন্ত পরিচয় পাওয়া যায়। ২৭৭ জন নারী সুপ্রিম সোভিয়েতের ডেপুটি নির্বাচিত হয়েছে। ১৭০০ জনেরও বেশি নারী ইউনিয়ন ও স্বায়ত্তশাসনপ্রাপ্ত রিপাবলিকসমূহের সুপ্রিম সোভিয়েটসমূহে এবং প্রায় ৫ লক্ষ নারী স্থানীয় সোভিয়েতসমূহের ডেপুটি নির্বাচিত হয়েছেন।

সমাজতান্ত্রিক শিল্প প্রচেষ্টাতেও মেয়েরা ক্রমশ বেশি পরিমাণে যোগ দিতে আরম্ভ করেছে। লক্ষ লক্ষ নারী নিপুণ কারিগরে পরিণত হয়েছে, অবিশ্রান্তভাবে তাদের যোগ্যতা ও নৈপূণ্য বর্ধিত ও পূর্ণাঙ্গ করে চলেছে। ২ লক্ষ ৮০ হাজার নারী ইঞ্জিনিয়ার, টেকনিশিয়ান ও কারখানার নিপুণ কারিগর হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে, লক্ষ লক্ষ নারী মেডেল ও অর্ডারে ভূষিত হয়েছে।”

মেয়েদের শিক্ষিত হয়ে ওঠা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন এনেছিল
জারের আমলে ৭০% লোক এক অক্ষরও লিখতে পড়তে জানত না। গ্রামের কৃষক মেয়ে ও কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে অশিক্ষা ছিল আরো গভীর। ১৯২০ সালে মোট জনসংখ্যার ৬৭% ছিল অশিক্ষিত। মেয়েদের ক্ষেত্রে ছিল ৭৫%। ১৯২৯ সালে ৫৮% মানুষ শিক্ষিত হয়ে উঠেছিল। ১৯৩২ সালের মধ্যে ৯০% মানুষ অক্ষর চিনতে শিখল, নিজের মাতৃভাষাকে ভালবাসতে শিখেছিল। মাত্র ১২ বছরের মধ্যে অশিক্ষিত জনসংখ্যার ৬০% কে শিক্ষিত করে তোলা হলো, যা ছিল বিস্ময়কর।

শিশু-শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি শিল্পাঞ্চলে, যৌথখামারে, শহরে জনসংখ্যার প্রয়োজন অনুসারে হাজার হাজার ক্লাব গড়ে তোলা হয়েছে। কোথাও সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি কেন্দ্র, কোথাও শ্রমিক সংঘ ক্লাব, আবার কোথাও যৌথ খামার ক্লাব। একই সাথে সজ্জিত পাঠাগার ছিল। এখানে এসে সকলে মনোযোগের সঙ্গে পড়াশোনা করত। নিজেদের দেশের নানা খবর, দেশ-বিদেশের খবর, জ্ঞানবিজ্ঞানের খবর আহরণ করে পারস্পরিক আলোচনার মধ্য দিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করত। একই সাথে বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলোচনা চক্র অনুষ্ঠিত হতো। এই চক্রগুলি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯৩৩ সালের হিসাব থেকে দেখা যায়, মোট চক্র সভ্য ছিল ২১ লক্ষ ৭৯ হাজার, এর মধ্যে মেয়েরা ছিল ৯৭ হাজার।

খেলাধুলায় অগ্রগতি

0_b2147_6a9cb754_XL

বিপ্লবপূর্ব রাশিয়াতে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জন্য মুষ্টিমেয় কয়েকটি খেলাধুলার ক্লাব ছিল। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার পরে নভেম্বরেই লেনিন এবং ‘পিপলস্ কমিশার ফর এডুকেশন’-এর প্রধান আনাতলি লুনাচারস্কি ‘স্টেট কমিটি ফর পিপলস্ এডুকেশন’ গঠন করেন। এই কমিটি শিশুদের সার্বিক বিকাশের জন্য সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে এবং স্কুলে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য জিমন্যাস্টিক্স, ক্রীড়া, সাঁতার কাটা এবং ব্যায়ামের ব্যবস্থা রাখা হয়। ১৯১৮ সালে সর্বত্র ‘ইউনিফর্ম সিস্টেম অব ভোকেশনাল এডুকেশন’ চালু করা হয় এবং শরীর চর্চা ও ক্রীড়াকে মূল কর্মসূচি হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ংকর দিনগুলিতে ফ্যাসিবাদের নৃশংসতা থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে যুদ্ধ জয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল এই খেলাধুলা ও শরীরচর্চা। সোভিয়েতে বিভিন্ন ক্লাব ও খেলার সদস্য সংখ্যা ১৯৩৭ সালেই ছিল ৩ কোটি। কিন্তু তারা কেউ টাকার বিনিময়ে খেলতো না। এমন একটি শহর ছিল না যেখানে স্টেডিয়াম ছিল না। মস্কোতে যে স্টেডিয়াম ছিল সেখানে এক সাথে ১ লক্ষ ৪০ হাজার দর্শক বসে খেলা দেখতে পারত। খেলাধুলাকে সোভিয়েত ইউনিয়ন গণআন্দোলনে পরিণত করেছিল। দৌড়, লাফ, স্কেটিং, স্কিয়িং, নৌকা বাইচ, সাইকেল দৌড়, শারীরিক কসরৎ, ফুটবল, বাস্কেট বল, টেনিস, বেসবল, দলবেধে নাচ, ড্রিল, রাইফেল শ্যুটিং প্রভৃতি খেলা সর্বত্রই ছিল। প্রায় সব খেলায় সোভিয়েত নারীর অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। যেমন একজন রুশ নারী শ্রমিক মস্কো থেকে তোবলস্ক পর্যন্ত ১২৪০ মাইল স্কি করে গিয়েছিল। ১৯৫২ সালে এফআইভিবি এর আয়োজনে সোভিয়েত, পোল্যান্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া, রুমানিয়া, ফ্রান্স, ভারত, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরির নারী খেলোয়াড়দের ভলিবল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এই প্রতিযোগিতায় সোভিয়েতের মেয়েরা চ্যাম্পিয়ন হয়। লিডিয়া প্যাভলোভনা স্কোবলিকোভা ‘স্পিড স্কাটার’ হিসেবে ১৯৬০ ও ১৯৬৪ সালের শীতকালীন অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করে ৬টি স্বর্ণ পদক অর্জন করেন যা এখনো রেকর্ড হয়ে আছে। এছাড়া তিনি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে ২৫টি স্বর্ণ পদক এবং ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ান হয়ে ১৫টি স্বর্ণ পদক অর্জন করেছেন। তিনিই প্রথম সেরা অ্যাথলেট যিনি শীতকালীন অলিম্পিকে ৬টি এবং এককভাবে ৪টি স্বর্ণ পদক পেয়েছিলেন। ১৯৬০ ও ১৯৬৪ সালের অলিম্পিকে তিনি সবচেয়ে সফল অ্যাথল্যটস হিসেবে সোভিয়েতের খ্যাতি এনেছিলেন। ১৯৫৬ ও ১৯৬৪ সালে গ্রীস্মকালীন অলিম্পিকে অ্যাথলেট হিসেবে অংশগ্রহণ করে লারিসা লাটিনিনা ৬টি স্বর্ণ পদক অর্জন করেন। এছাড়া নাটালি পেট্রোসোভা ছিলেন সফল স্কাটার। তিনি ১৯৮০ সালে ‘অর্ডার অফ ফেন্ডশিপ অফ পিপলস’ সম্মান অর্জন করেন।

মহাশূন্যচারী প্রথম নারী ভ্যালেন্তিনা তেরেশ্কোভা
Valentina-Tereshkova-1962পৃথিবীর প্রথম মহাশূন্যচারী ভ্যালেন্তিনার কথা না বললেই নয়। ভ্যালেন্তিনা সভ্যতার এক প্রতীক। তিনিই মহাশূন্যচারী প্রথম নারী। এর আগে পৃথিবীর কোনো দেশ মহাশূন্যে নারীরা যেতে পারে তা ভাবতেই পারত না। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশেষ উদ্যোগ নারীর চিন্তাকে অববারিত করেছিল। ফলে পশ্চিম রাশিয়ার একটি কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও ভ্যালেন্তিনা এই অসাধ্য কাজকে সাধ্যে পরিণত করতে পেরেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি মাত্র ১৮ বছর বয়সে টেক্সটাইল মিলে কাজ শুরু করেন। ২২ বছর বয়সে স্থানীয় একটি এভিয়েশন ক্লাবে প্রথম প্যারাস্যুট জাম্প করেন। কারখানার কাজের সাথে সাথে তিনি প্যারাসুট জাম্প করতেন। কারণ এটা ছিল তাঁর শখ। তাঁর এই দক্ষতা সোভিয়েত স্পেস প্রোগ্রামের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ফলে ১৯৬২ সালে সোভিয়েত স্পেস প্রোগ্রাম অন্য ৩জন নারীর সঙ্গে কসমোনাট হিসেবে তাকে নির্বাচিত করে এবং অধিক গুরুত্ব দিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণের পর সর্বশেষ ১৯৬২ সালের মার্চে তেরেশ্কোভাকে প্রথম নারী মহাশূন্যচারী হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬৩ সালের ১৬ জুন ‘ভস্টক ৬’-এ কসমোনাট ভ্যাল্নেতিনা তেরেশ্কোভা প্রথম মহাশূন্যে যান। ৭১ ঘন্টায় ৪৮ চক্রের পর ১৯ জুন তিনি পৃথিবীতে অবতরণ করেন। ঐতিহাসিক এই কাজের জন্য তিনি ‘অর্ডার অফ লেনিন’ এবং ‘হিরো অফ দি সোভিয়েত’ সম্মানে ভূষিত হন। ১৯৬৮ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সমাবেশে তিনি বলেছিলেন, মেয়েরা ইচ্ছে করলে সব পারে, মহাশূন্যে বিচরণ এমন কিছুই কঠিন নয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত নারীদের বীরত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ
১৯৩৯ সাল থেকে শুরু হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার একের পর এক দেশ আক্রমণ করে দখলে নিয়েছিল। ১৯৪১ সালের ২২শে জুন ভোরবেলায় হিটলারের উন্মত্তবাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে। এতদিন পর্যন্ত যে দেশই হিটলার আক্রমণ করছিল, সে দেশই তার পদানত হচ্ছিল। হিটলারের দুর্ধর্ষ বাহিনী প্রথম হোঁচট খেল সোভিয়েত ইউনিয়নে এসে। হিটলারের ফ্যাসিস্ট বাহিনীর বিরুদ্ধে সোভিয়েত নারী-পুরুষ-তরুণ-যুবক নির্বিশেষে সকলেই মরণপণ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল। এই সংগ্রামেও সোভিয়েত নারীরা পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে।
যুদ্ধচলাকালে প্রায় ৮ লক্ষ নারী সোভিয়েত সামরিক বাহিনীতে কাজ করত, যা ছিল পুরো সামরিক বাহিনীর প্রায় ৩ শতাংশ। প্রায় ২ লক্ষ নারীকে সামরিক বাহিনীতে সজ্জিত করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে ৮৯ জনকে সোভিয়েতের সর্বোচ্চ পদক ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের নায়ক বা বীর’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। এই বীর নারীদের মধ্যে কেউ ছিল বৈমানিক, স্পাইনার, মেশিনগান চালক, ট্যাঙ্ক দলের সদস্য এবং গেরিলা বাহিনীর সদস্য। অনেকে আবার যুদ্ধে সহায়তাকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করেছিলেন

hero_night_w itches02মারিনা রাস্কভা ছিলেন সোভিয়েতের বিখ্যাত বৈমানিক, যাকে রাশিয়ার ‘এমেলিয়া এয়ারহার্ত ’ বলা হতো । ১৯৩০ সালে রাস্কভা বৈমানিক ও নাবিক দুই ক্ষেত্রে বিখ্যাত হয়ে উঠেন । তার নেতৃত্বে সেনাবাহিনীতে ৩টি নারী সৈন্যদল গঠন করা হয়েছিল। তিনটি দলই বিশেষভাবে নারীদের জন্য তৈরি হয়েছিল। এই দলগুলোর মধ্যে শুধু বৈমানিকরাই নারী ছিলেন না, এদের সহযোগী ও প্রকৌশলী সকলেই নারী ছিলেন । সোভিয়েত ইউনিয়নই একমাত্র রাষ্ট্র, যারা নারী বৈমানিকদের যুদ্ধে বিমান চালনার অনুমতি দিয়েছিল। প্রায় শত নারী বৈমানিক দিয়ে এই রেজিমেন্ট শক্তিশালী করা হয়েছিল, এই বৈমানিকরা ৩০ হাজারের বেশি লড়াই সংঘটিত করেছিল, প্রায় ২০ জন নারী বৈমানিককে ‘সোভিয়েত বীর’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল এবং ২ জনকে সর্বোচ্চ পদবী প্রদান করা হয়েছিল। যখন তিনবাহিনী একত্রে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল তখন এই সামরিক বাহিনী সাময়িকভাবে ‘এভিয়েশন গ্রুপ ১২২’ নামে পরিচিত ছিল। ৫৮৬ তম ফাইটার এভিয়েশন রেজিমেন্ট ১৬ এপ্রিল, ১৯৪২ সালে প্রথম যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল এবং পরবর্তীতে তারা ৪,৮১৯টি যুদ্ধ মিশনে অংশ নিয়েছিল। লিদিয়া লিটভ্যাক ও ইয়েকাতেরিনা বুদানভাকে এই দলে যুক্ত করা হয়েছিল। স্তালিনগ্রাদে ৪৩৭ তম আইএপিতে যোগ দেয়ার পূর্বে এই দুই নারী হয়ে ওঠেন বিশ্বের একমাত্র নারী বিমান যোদ্ধা, যারা ক্রমানুসারে ১২ টি ও ১১ টি যুদ্ধক্ষেত্রে জয় এনেছিল এবং দু’জনেই চালিয়েছিলেন ইয়ক-১ যুদ্ধ বিমান । ৪৬তম তামান গার্ড নাইট বোমারু বিমান এভিয়েশন রেজিমেন্ট ছিল সবচেয়ে পরিচিত ও শ্রেষ্ঠ রেজিমেন্ট এবং এর নেতৃত্বে ছিলেন ইয়েভদোকিয়া। যুদ্ধের শেষের দিকে এই বিমান এভিয়েশন ২৪ হাজার যুদ্ধ মিশন অজর্নের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। এই মিশনের বিমানগুলো ছিল পুরনো এবং রাতের বেলায় মিশন পরিচালনা করতো। যারা এই রেজিমেন্টে দায়িত্ব পালন করতো জার্মানরা তাদের ‘রাতের ডাইনি’ বলতো। যুদ্ধ ক্ষেত্রে এই নামে তারা সর্বাধিক পরিচিত ছিল ।

স্থল বাহিনীর ক্ষেত্রে নারীদের স্নাইপারের কাজে যুক্ত করেছিল এবং তার সুফল পেয়েছিল। স্নাইপারদের মধ্যে ছিলেন নিনা আলেক্সেইয়েভনা লুবকোভাস্কায়া এবং ইউক্রেনীয় লুডমিলা পাভলিচেনকো, যারা ৩ শতাধিক জার্মান সৈন্যকে হত্যা করেছিলেন।

Nights withchesসোভিয়েত গেরিলা বাহিনীতেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী ছিলেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে একনিষ্ঠ ও সাহসী ছিলেন জয়া কসমোদেমিয়ানস্কায়া। ১৯৪১ সালের অক্টোবরে, ১৮ বছর বয়সী জয়া মস্কোর স্কুল শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় সোভিয়েত গেরিলা বাহিনীতে স্বেচ্ছাসেবিকা হিসেবে কাজ শুরু করেন । নভেম্বর ১৯৪১ এর শেষের দিকে পেত্রিশ্চেভো গ্রামের কাছে একটা যুদ্ধ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গিয়ে নাৎসিদের হাতে ধরা পড়েন। নাৎসি জার্মানরা তার উপর বর্বর অত্যাচার চালিয়েছিল। পাঁজরে ঘুষি মারা, ফূর্তি করা, জলন্ত দেশলাইয়ের কাঠি চিবুকের নীচে এনে ধরা, করাত পিঠের উপর দিয়ে টেনে নেয়া, নগ্ন শরীরে ৪ ঘন্টা বরফের উপর দিয়ে হাঁটানো সহ অকথ্য নির্যাতন করেছিল। এতো অত্যাচার সত্ত্বেও দৃঢ় চরিত্র সম্পন্ন ও দায়িত্বশীল জয়া তার সঙ্গীদের নাম কিছুতেই নাৎসিদের জানায়নি।

পরবর্তীতে নাৎসী জার্মানরা তার বুকের উপর ‘গৃহদাহকারী’ লেখা কাঠের প্লাকার্ড ঝুলিয়ে দিয়ে ঐ গ্রামের মাঝখান দিয়ে হাঁটিয়েছিল এবং গ্রামের মাঝখানে ফাঁসির মঞ্চ তৈরি করে তাকে ফাঁসি দিয়েছিল। ফাঁসির পূর্বে জয়া দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বলেছিল, “আমি মরতে ভয় পাই না, বন্ধুরা, দেশের লোকের জন্য মরতে পারায় গৌরব।” আর জার্মান সৈন্যদের উদ্দেশে বলেছিল, “আজ তোমরা আমাকে ফাঁসি দিবে, কিন্তু আমি একা নই, আমরা ২০ কোটি লোক ; সবাইকে তোমরা কিন্তু ফাঁসি দিতে পারবে না ! আমার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবে সবাই। সময় আছে এখনো, আত্মসমর্পণ কর, জয় আমাদেরই হবে।” কসমোদেমিয়ানস্কায়া ছিলেন যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের নায়ক/ বীর’ খেতাব পাওয়া প্রথম নারী ( ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪২ )। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জয়া একটি প্রতীকে পরিণত হয়েছিল। রাশিয়া বিশেষজ্ঞ মার্কিন লেখক ও সাংবাদিক মাইরুস হিন্ডাস তাঁর রচিত ‘মাদার রাশিয়া’ গ্রন্থে লিখেছেন, “এই মেয়েটিকে নিয়ে অসংখ্য বই, লেখা হবেÑজীবনী, উপন্যাস, নাটক, কবিতা। এর মধ্যেই চিত্রকরেরা তার ছবি আঁকছে যাদুঘরে সাজিয়ে রাখবার জন্য। রাশিয়ার নাট্যকার কনস্তান্তিন সিমোনভ …তাকে নিয়ে নাটক লিখেছেন। সঙ্গীত রচয়িতা কোভালেভস্কি তাকে নিয়ে তৈরি করেছেন অপেরা। ভাস্কর জেলিনস্কি ও লেবেদেভা তার মূর্তি বানাতে ব্যস্ত। রাশিয়ার হলিউডে আলমা আটায় এক প্রধান পরিচালক জয়ার বিষয়ে এক চলচ্চিত্র করবেন। এ তো কেবল শুরু। যুগে যুগে লেখক ও শিল্পীরা তাকে দেবে শ্রদ্ধাঞ্জলি।”

zoya-anatolyevna-kosmodemyanskaya_1257593_mশুধু তাই নয় জয়ার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তার সমবয়সী অসংখ্য মেয়েরা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। জয়া ছিল সমস্ত সোভিয়েত জনগণের প্রেরণাদায়ী, শক্তি ও সাহস দানকারী। সাইবেরিয়া, বাল্টিক, উরাল তিবলিস থেকে অসংখ্য চিঠি, কবিতা আসত যা ছিল অকপট দরদে ভরা। বিদেশ থেকেই চিঠি আসত, ভারতবর্ষ, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা থেকে চিঠি আসত। তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে রাশিয়ায় অনেক ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে।

জয়া কসমোদেমিয়ানস্কায়া ছাড়াও তার সমবয়সী জিনান্দা পোর্টনোভা গেরিলা বাহিনীতে যুক্ত হয়েছিলেন। কনিষ্ঠতম নারী যোদ্ধা হিসেবে তিনি সোভিয়েতের বীর খেতাব পান। ১৯৪২ সালে, মাত্র ১৫ বছর বয়সে বন্দি এলাকায় হিংস্রতা দেখে পোর্টনোভা বেলারুশিয়ান ইউ এস এস আর গেরিলা বাহিনীতে যোগ দেয়। দলের সভ্য হয়ে সে অস্ত্র লুকিয়ে রাখত, লিফলেট বিলি করত , হরতাল-অবরোধ পরিচালনা করত । জানুয়ারি ১৯৪৪ সালে জার্মান ফ্যাসিস্টদের হাতে ধরা পড়ে এবং তাদের হাতেই খুন হয়। ১৯৫৮ সালে পোর্টনোভাকে ‘সোভিয়েতের নায়ক’ ঘোষণা করা হয়, তার স্মরণে মিনস্ক শহরে একটি সৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয় এবং ‘যুব পাইওনিয়ার’দের আন্দোলন তার নামে নামকরণ করা হয় । এভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযদ্ধে দেশপ্রেম ও দেশাত্ববোধ জাগ্রত করে অসংখ্য মানুষের শহীদী আত্মত্যাগ ও লালফৌজের প্রতিরোধের মুখে জার্মান বাহিনী পরাজিত হয়, সমগ্র পৃথিবী ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়।

সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর নারীদের মর্যাদা ক্ষুন্ন হল
সমাজতন্ত্র পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদে পৌঁছার একটি অন্তবর্তীকালীন ব্যবস্থা। সচেতন আদর্শিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক লড়াই গড়ে তোলার পর্বের সূত্রপাত ঘটে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়াতেও এর সূত্রপাত ঘটেছিল। কিন্তু বৈষয়িক উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নে এই লড়াই গড়ে না উঠার কারণে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন ঘটেছে। ফলে ’৯০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পুঁজির যে নতুন বিকাশ শুরু হয়, এর ফলে জনগণের অন্যান্য অংশের চেয়েও নারী তার অবস্থান হারাতে শুরু করে। ১৯৯৬ সালের রাশিয়াতে ‘সোভিয়েত নারীদের কংগ্রেস’ নামে একটি সংগঠন গঠিত হয়েছিল। সমাজতন্ত্র পতনের পর সোভিয়েত নারী ও শিশুদের অবস্থা বুঝবার জন্য ঐ সংগঠনের প্রথম সাধারণ সম্পাদক নাতালিয়া অ্যান্ডোয়েভারের বক্তব্য উল্লেখযোগ্য। তিনি তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন, ‘এখন নারী-পুরুষ উভয়ের প্রকৃত মজুরি আগের তুলনায় অনেক কম। শিশু পরিচর্যায় নারীরা বিশেষভাবে আক্রান্ত। সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকাকালে আমাদের সন্তানেরা অবৈতনিক নার্সারি, কিন্ডারগার্টেন ও ডে কেয়ার কেন্দ্রগুলিতে যেত। আমরা কর্মরত অবস্থায় নিশ্চিত থাকতাম এই ভেবে যে, তারা এই সময়টুকুতে নিরাপদেই থাকবে। বর্তমান অবস্থায় যে নারী শ্রমিকটির শিশু সন্তান আছে, সে জানে না যে সে কী করবে। সোভিয়েত ইউনিয়নে সারা দেশজুড়ে তিনমাসব্যাপী ছুটিতে শিশুরা পাইওনিয়ার ক্যাম্পে অবস্থান করত। এখন এই ক্যাম্পগুলো তুলে দেয়া হয়েছে। শিশুদের জন্য সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের ব্যবস্থা ছিল। বহুসংখ্যক শিশু পাঠাগারও ছিল যা এখন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ক্রীড়া কর্মসূচি, সাংস্কৃতিক কর্মসূচি, নৃত্য, শিল্পকলা,সঙ্গীত ও দাবা প্রতিষ্ঠান এসবই ছিল অবৈতনিক। এখন এসবই তুলে দেয়া হয়েছে কিংবা ব্যয়বহুল করা হয়েছে। … সোভিয়েত আমলে প্রণীত আইন অনুযায়ী, রাশিয়াতে নারীরা এখনো পর্যন্ত পুরুষের সমান মজুরি পায়। কিন্তু এখন মেয়েরা গর্ভবতী হলে কিংবা শিশুর পরিচর্যার জন্য বাড়িতে অবস্থান করলে দারুণভাবে তিরস্কৃত হয়; সমাজতান্ত্রিক যুগে তা কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। সোভিয়েত আইন একজন নারীর পূর্ণ বেতনসহ চার মাসের প্রসবকালীন ছুটি ভোগের ব্যবস্থা করতো এবং তারপরও সে আরো এক বছর আংশিক বেতনসহ নিজ গৃহে অবস্থান করতে পারত। সে তিন বছর ছুটি নিলেও তার চাকরি তার জন্য সংরক্ষিত থাকতো। ঐ সমস্ত আইন কাগজে-কলমে এখনও লিপিবদ্ধ রয়েছে। কিন্তু দিন দিন অধিক থেকে অধিকতর সংখ্যায় মেয়েরা চাকরি হারানোর হুমকির শিকার হচ্ছে। …হয়তো আমাদের নিজেদের ইউনিয়নকে নিজেদেরই গড়ে তুলতে হবে, কারণ যেসব ইউনিয়ন আছে সেগুলো নারীদের অধিকারের পক্ষে দাঁড়ায় না। …সোভিয়েত সময়ে সরকারে নারী প্রতিনিধিত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও অনেক বেশি মাত্রায় ছিল, কিন্তু এটা প্রয়োজনের তুলনায় ছিল অনেক কম। নারীদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের জন্য সংগ্রাম এখন আমাদের জন্য অধিকতর জরুরি হয়ে পড়ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রয়োজনকে অকৃত্রিমভাবে প্রতিনিধিত্ব করবে শুধু নারীরাই। …’৮০-এর দশকের শেষদিক থেকে মাদকাসক্তি একটি গণসমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দেশে খাদ্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে, কিন্তু মদ সস্তায় বিক্রি হচ্ছে। ধনতান্ত্রিক ‘পুনর্গঠন’ জনগণের কাছ থেকে খুব কমই প্রতিরোধের সম্মুখীন হওয়ার এটাও একটা কারণ (দি ওয়ার্কার্স ওয়াল্ড, ১৯৯৬)।”

২০১৪ সালে www.oecd.org-এর প্রকাশিত তথ্যমতে, ৬৪.৮ শতাংশ নারী বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। কিন্তু ৪৫৬ টি পেশায় এবং কারখানার ৩৮টি শাখায় নারীদের কাজ করা নিষেধ। নারীরা কর্মক্ষেত্রে নিযুক্ত থাকলেও বিভিন্ন ধরনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকার তথ্য মতে, বর্তমানে প্রতি ৪০ মিনিটে একজন নারী পারিবারিক নির্যাতনের কারণে মৃত্যবরণ করে। উল্লেখিত বর্ণনা থেকে পুঁজিবাদী রাশিয়ার যে চিত্র তা ফুটে উঠেছে।

আমাদের দেশের মেয়েরা কেমন আছে?
একবিংশ শতকের এ যুগে যখন উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের আওয়াজ চারদিকে তখনও আমাদের দেশের মেযেরা এক ভয়াবহ ও দুর্বিষহ সময় অতিক্রম করছে। সমাজের সর্বস্তরের নারীরা প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বাড়ছে ধর্ষণ-গণধর্ষণ, হত্যা-নির্যাতন নিপীড়ন-সহিংসতা। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, ২০১৭ সালের প্রথম ছয় মাসে প্রায় ২৮০ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে ১৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এ সকল ঘটনার একটিরও সুষ্ঠু বিচার হয়নি। অন্যদিকে ১০ সেপ্টেম্বর ’১৭ প্রথম আলোয় প্রকাশিত তথ্যমতে, ২০০১- ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৮টি জেলায় সরকারের ‘ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার’ গুলোতে ৪ হাজার ৫৪১টি নারী ও শিশু ধর্ষণের মামলা হয়েছে। কিন্তু নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ১ হাজার ২২৯টি মামলা, মাত্র ৬০টি মামলাতে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি হয়েছে। ৭৩ শতাংশ মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। সরকার দলীয় ব্যক্তিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও মদদদানের কারণে এসব মামলা নিষ্পত্তি হয় না।

ঘরে-বাইরে-কর্মক্ষেত্র কোথাও নারী নিরাপদ নয়। সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৫ সালের তথ্যানুযায়ী, দেশে বিবাহিত নারীদের শতকরা ৮০ জনই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হন। সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয় স্বামীর দ্বারা। যৌতুকের দাবি মেটাতে না পারার কারণে ২০১৬ সালে ২৩৯ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। চরম নিরাপত্তাহীনতার এ পরিস্থিতিতে সরকার সংবিধান, আইন, আন্তর্জাতিক সনদ সব কিছুকে তুচ্ছ করে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭‘পাশ করেছে, যা নারী নির্যাতনের মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে তুলবে। এর মাধ্যমে কার্যত শিশু বিবাহকে বৈধতা দেয়া হয়েছে।

৮০ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী গার্মেন্ট শ্রমিকদের সিংহভাগই নারী। দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও জীবনধারণের জন্য নন্যূতম মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, মাতৃত্বকালীন ছুটি কোনো কিছুরই নিশ্চয়তা নেই। মাতৃত্ব নারীর জন্য বোঝা। সরকারি উদ্যোগে শ্রমজীবী-কর্মজীবী নারীদের জন্য নেই শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র। প্রায় ২০ লাখেরও বেশি নারী-কিশোরী-শিশু গৃহকর্মে ১২-১৬ ঘণ্টা শ্রম দেয়। অথচ শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি, শ্রম ঘণ্টা বা নিরাপত্তা ও সাপ্তাহিক ছুটিও তাদের নেই। কৃষি, চা ও নির্মাণ শ্রমিক হিসাবে যে নারীরা কাজ করে তারাও মজুরি বৈষম্যের শিকার। গার্হস্থ্য শ্রম এখনো পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত নয়।

বাংলাদেশের পারিবারিক আইন বৈষম্যমূলক। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) পাশ হলেও তার কার্যকর বাস্তবায়ন নেই। বাংলাদেশ সরকার ‘নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ’-এর ২ ও ১৬ (১)(গ)-কে সংরক্ষণ রেখে তা অনুস্বাক্ষর করেছে। এই অনুচ্ছেদসমূহ এই সনদের প্রাণ এবং নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপে কার্যকর অনুচ্ছেদ। নারী উন্নয়ন নীতিমালায় ‘সম্পত্তি’তে সমঅধিকার নিশ্চিত করা হয়নি।

নাটক-বিজ্ঞাপন-সিনেমা-ইন্টারনেটসহ সর্বত্র চলছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। পুঁজিবাদ তার শোষণমূলক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ভোগবাদ-অপসংস্কৃতি ছড়িয়ে দিচ্ছে সমাজের সর্বত্র, যার ফলে আক্রান্ত হচ্ছে নারী। অন্যদিকে মৌলবাদী শক্তি সামন্তীয় কূপম-ুকতা-কুসংস্কারের বেড়াজালে নারীকে ঘরে আটকে রাখতে চায়। পুঁজিবাদ তার স্বার্থে এই মৌলবাদী সংস্কৃতিকে পৃষ্ঠপোষকতা করে, নারীর অগ্রযাত্রাকে করে ব্যাহত।

পুঁজিবাদী শোষণ ও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাÑএই দু’ধরনের শোষণের হাত থেকে নারীকে মুক্ত করার জন্য সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়া আমাদের সামনে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। আবার সমাজতন্ত্রের পথ থেকে দূরে সরে পুঁজিবাদে প্রত্যাবর্তন মেয়েদের পুনরায় অমর্যাদার জীবনে ঠেলে দিয়েছে। এই দুই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে একদিকে পুঁজিবাদী শোষণ, অপরদিকে দীর্ঘদিন ধরে নারীর উপর পুরুষের যে কর্তৃত্ব-আধিপত্য তার বিরুদ্ধে লড়তে হবে। কারণ শোষণমুক্তির সাথেই নারীমুক্তি অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। তাই নারীমুক্তি একমাত্র সমাজতন্ত্রের পথে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মাধ্যমেই সম্ভব। আসুন, এ পথেই নারী আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হই।

সহায়ক গ্রন্থ ও পত্রিকা

  • জীবনের সন্ধানে – ডাইসন কার্টার
  • নিষিদ্ধ কথা আর নিষিদ্ধ দেশ – দেবী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
  • নারী, পুরুষ ও সমাজ – আনু মুহাম্মদ
  • মার্কসীয় বীক্ষায় নারীমুক্তি  – সম্পাদনঃ রূপা আইচ
  • নারীমুক্তির প্রশ্নে : মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-স্তালিন – অনুবাদঃ কনক মুখোপাধ্যায়
  • নারী ও সমাজ: ভি.আই. লেনিন – কনক মুখোপাধ্যায়
  • নারী ও কমিউনিজম: মার্কস্ থেকে মাও – সংকলকঃ হ্যারি পোলিট, অনুবাদকঃতপন কুমার বন্দোপাধ্যায়
  • মেয়েদের অধিকার – কল্যাণী রায়, পথিকৃৎ, বিশেষ শারদ সংখ্যা অক্টোবর ২০০০
  • ছোটদের সোভিয়েত –  কমসোমল
  • শতবর্ষে নভেম্বর বিপ্লব: সাংস্কৃতিক ত্রৈমাসিক, প্রমিথিউসের পথে, আগস্ট-অক্টোবর ২০১৬
  • ইন্টারনেট
RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments