Friday, April 19, 2024
Homeঅনুশীলনপাঠ্যপুস্তকে ভুল, বিষয়বস্তুর পরিবর্তন নিছক দুর্ঘটনা নয়

পাঠ্যপুস্তকে ভুল, বিষয়বস্তুর পরিবর্তন নিছক দুর্ঘটনা নয়

ক্ষমতার স্বার্থে যুক্তি-বুদ্ধিহীন প্রজন্ম তৈরি করার সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র

SSF Rally
প্রবাদ আছে, যখন সবকিছু হারিয়ে যায় ভবিষ্যৎ তখনও বাকি থাকে। দেশের কোটি কোটি স্কুলগামী শিশু-কিশোররা আমাদের সেই ভবিষ্যৎ, যাদের দিকে তাকিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখি। অনেক অপ্রাপ্তি আর হারানোর বেদনার মাঝেও শিশু-কিশোররাই আমাদের ভরসা। মানুষের জীবনের সবচেয়ে সেরা সময়টা হলো তার শৈশব। এই সময়ে একজন শিশু কীভাবে গড়ে উঠছে, তার উপর নির্ভর করবে ভবিষ্যতে সে কেমন হবে। তাই শিশু বয়সে একজন চিন্তাশীল-বিজ্ঞানমনস্ক-যুক্তিপ্রবণ-সৃজনশীল মানুষ হিসেবে গড়ে উঠছে কিনা, ন্যায়বোধসহ মানবিক গুণাবলীর শিক্ষা ঠিকভাবে পাচ্ছে কিনা — এসব বিষয় বিবেচনায় নিতে হয়। পাশাপাশি শিক্ষার লক্ষ্য সিলেবাস, পঠন-পাঠন, শিক্ষাদান প্রক্রিয়া, অবকাঠামোগত আয়োজন, পরীক্ষাপদ্ধতি — এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে গড়ে তুলতে হয়। অথচ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এসব বিবেচনার কোনো বালাই নেই। শিশুদের মানুষ করা নিয়ে সভ্যসমাজে চেষ্টার শেষ নেই। অথচ আমাদের দেশের কথা ভাবুন। শৈশববঞ্চিত, স্কুলের চৌকাঠে পৌঁছাতে পারেনি, ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত আছে ৪৫ লক্ষ শিশু। তাদের নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই। আবার যারা স্কুলের দরজায় ঢুকতে পারে, তাদের নিয়েই বা শাসকদের ভাবনা কতটুকু? শিক্ষার এত এত সংকট, প্রতিবছরই ফি বৃদ্ধি, অব্যবস্থাপনা, আর নৈরাজ্য চলছে বছরের পর বছর ধরে। যে সরকারই আসুক, সমস্যা ক্রমেই বাড়ছে। শতভাগ পাস হচ্ছে, ডিগ্রিধারী বাড়ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাড়ছে —এসব বাগাড়ম্বরই সার। কিন্তু মান কতটুকু বাড়ছে? বহু সংখ্যক ডিগ্রিধারী- শিক্ষক, ব্যাংকার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রশাসক বেরুচ্ছে। কিন্তু সামাজিক দায়িত্ববোধ, দেশপ্রেম ও মানবিকতার প্রকাশ ক’জনের পেশাগত কর্মে থাকছে? এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। শুধু কোটি কোটি শিক্ষার্থীদের নিয়ে চলে শাসকদের ক্ষমতার গুটি চালাচালি। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে তারা শিক্ষাকে হাতিয়ার করে। তাদের শাসনের পরিপূরক ভাবমানস তৈরির কাজে হাত দেয়। কখনো তা সুন্দর বাক্যজাল তৈরি করে, কখনো নির্লজ্জভাবে আমাদের অতীত সংগ্রামের অর্জন, গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে ভূলুণ্ঠিত করে। এবারে পাঠ্যবই প্রকাশে চরম দায়িত্বহীনতা, পাঠ্যসূচি পরিবর্তনের ঘটনাটিকে এই প্রেক্ষিতে আমাদের বুঝতে হবে।

ফ্যাসিবাদী শাসনের প্রয়োজনেই যুক্তি-বুদ্ধিহীন-সাম্প্রদায়িক চিন্তার প্রসার ঘটানো হচ্ছে
মহাজোট সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১৪ সালে একতরফাভাবে ক্ষমতায় এসেছে। ব্যাপক উন্নয়নের শ্লোগান দিয়ে এবং মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক আতঙ্কের পরিবেশ জিইয়ে রেখে সরকার নির্বাচনসহ গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছে। উন্নয়নের শ্লোগান যত তোলা হচ্ছে, বন-নদী-প্রাণ-প্রকৃতি তত উজাড় হচ্ছে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যসহ পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়ছে প্রতিনিয়ত। গ্রামের চাষীরা তাদের ফসলের উৎপাদন মূল্য না পেয়ে নিঃস্ব। বাড়ি-ঘর সমস্ত কিছু হারিয়ে শহরে ছুটছে, শহরে পর্যাপ্ত কাজ নেই। চলছে ভয়াবহ বেকার সঙ্কট। কিছুদিন আগে পত্রিকায় এসেছে, উচ্চশিক্ষিতের মধ্যে শতকরা ৪৭ জনই বেকার। এ অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে শিল্পাঞ্চলগুলোতে চলছে শ্রমিকদের উপর নির্মম শোষণ। ব্যাংকের ঋণ আর সরকারি বরাদ্দ নিয়ে চলছে সীমাহীন লুটপাট-দুর্নীতি। নিঃস্ব-অসহায় হয়ে পড়ছে শ্রমজীবী গরীব মানুষ আর শোষণ-লুণ্ঠনে ফুলে ফেঁপে উঠেছে একদল পুঁজির মালিক। উন্নয়ন বলতে, এদেরই উন্নতি হচ্ছে দিন দিন।

অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ছে মানুষের। যদিও এর বিরুদ্ধে সে রকম কোনো বড় প্রতিবাদ দেখা দিচ্ছে না। ভিন্নমত বা প্রতিবাদ গড়ে উঠার যেকোনো সম্ভাবনাকে সরকার তার রাষ্ট্রযন্ত্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে অঙ্কুরে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। এভাবে একদিকে চটকদারী উন্নয়নের শ্লোগান, আবার তা দেখিয়ে সমস্ত বিরুদ্ধ মতকে দমন — এর নামই ফ্যাসিবাদী শাসন। এজন্য তাকে সকল উগ্রতারও আমদানি করতে হয়। জাতীয়তার উগ্রতা, ধর্মীয় উগ্রতাকে সে কাজে লাগায়। পুঁজিবাদী শাসন টিকিয়ে রাখার এ হলো এক জঘন্য কৌশল। সে একই নিয়মে শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিপূরকভাবে ঢেলে সাজায়। ২০১০ সালের প্রণীত শিক্ষানীতি এবং ২০১৬ সালের শিক্ষা আইন বিশ্লেষণ করে আমরা দেখিয়েছিলাম সরকার কীভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে অগণতান্ত্রিক, বৈষম্যমূলক এবং সাম্প্রদায়িক মানসিকতার প্রসার ঘটাচ্ছে। কারণ শিক্ষানীতিতে মৌলিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিষয়গুলোকে বাদ দিয়ে ক্রমাগত কারিগরি শিক্ষার উপর জোর দেয়া হয়েছিলো। বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাকে মেরে দিয়ে প্রযুক্তি শিক্ষার সাথে অদৃষ্টবাদের চিন্তা ঢুকিয়ে দেয়া হয়। যার ফলে প্রকৃতি ও সমাজের নিয়মকে বুঝতে শেখার পরিবর্তে প্রশ্নহীন মন তৈরি হতে থাকবে। এভাবে পুঁজিবাদী শিক্ষা আজ মানুষের সমস্ত গণতান্ত্রিক চেতনা, মূল্যবোধ নষ্ট করে আপোষকামী অথচ কাজ চালানোর মত একদল দক্ষ ও আত্মম্ভরী মানুষ তৈরি করছে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’, ‘উন্নয়নের বাংলাদেশ’ ইত্যাদি বাক্যসর্বস্ব শ্লোগানের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের মধ্যে ফ্যাসিবাদী মনন গড়ে তুলতে চাইছে। জনগণের প্রত্যাশার বাংলাদেশ নয়, শিক্ষার উদ্দেশ্য এখন ‘শেখ হাসিনার বাংলাদেশ’ গড়া।

প্রতি বছর ভুলে ভরা বই, দোষীদের শাস্তি হয় না
চলতি বছরের ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির অন্তত ২৫টি বই পর্যালোচনা করেছে ‘দৈনিক প্রথম আলো’। এতে বেরিয়ে আসে অযত্ন ও অবহেলার অসংখ্য নজির। ছাপার মানও খুব নিম্নমানের। অসংখ্য বানান ভুল, কবিতার লাইনের উল্টা-পাল্টা এবং ব্যাপক তথ্য বিভ্রান্তি ঘটেছে। যেমন- ষষ্ঠ শ্রেণির কৃষিশিক্ষা বইয়ে ৩৫ পৃষ্ঠায় রুই জাতীয় মাছের জন্য উৎকৃষ্ট ‘তাপমাত্রা ২৫০-৩৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস’ লেখা হয়েছে। সঠিক তাপমাত্রা হবে ২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অষ্টম শ্রেণির বাংলা প্রথম পত্রে ‘ভাব ও কাজ’ প্রবন্ধকে বলা হয়েছে কবিতা। নবম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়’ বইয়ের ৫৩ পৃষ্ঠায় জোয়ার ভাটার কারণ হিসাবে ‘মধ্যাকর্ষ’ শক্তির প্রভাব বলা হয়েছে। শুদ্ধ হবে ‘মধ্যাকর্ষণ’ শক্তির প্রভাব। এছাড়া বাংলা গদ্য ও পদ্যে যতিচিহ্ন ব্যবহারে অসংখ্য ভুল হয়েছে। কাভার পেইজে আঘাতের ইংরেজি করা হয়েছে HEART। প্রথম শ্রেণির বইয়ে ছাগল আম গাছে উঠে আম খাচ্ছে- এমন ছবি ছাপানো হচ্ছে। এ রকম অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যাবে। ‘ও’ অক্ষর চেনাতে মেয়ে শিশুর ছবি দিয়ে লেখা হয়েছে ‘ওড়না চাই’। বাচ্চা বয়সী শিশুর মাথায় এটা ঢুকিয়ে দিতে হবে যে ছেলে-মেয়ে আলাদা? তাছাড়া এ বয়সী কন্যাশিশুরা কি ওড়না পড়ে? এরকম ভুল এবারই প্রথম নয়। এবারে হয়তো মাত্রা ছাড়িয়েছে। প্রতিবছরই নিম্নমানের বই আর ভুল থাকছে। কিন্তু কোনোবারই দোষীদের শাস্তি হয় না। দলীয় নিয়োগ, দুর্নীতি, সুবিধাভোগীদের নিয়ন্ত্রণে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব থাকায় দোষীরা ছাড় পেয়ে যায়। তাই শাস্তি কখনও হয় না, সঙ্কট আরও বাড়ে। এ পর্যন্ত প্রশ্নফাঁসের দায়ে অসংখ্য তদন্ত কমিটি হয়েছে। অনেককে সাময়িকভাবে অব্যাহতিও দেয়া হয়েছে। কিন্তু হোতারা প্রতিবারই আড়ালে থেকেছে। উচ্চ পর্যায়ের সম্পৃক্ততা না থাকলে এটা কখনই সম্ভব হতো না। সর্ষের মধ্যকার ভূতের দিকে সরকার কখনোই দৃষ্টি দেয়নি।

SSF Rally1

পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তনের দায় কেউ স্বীকার করছে না
অনুসন্ধানে জানা যায়, অতীতে ছিলো এমন ১৭টি লেখা বাদ পড়েছে। পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী, ওই ১৭টি লেখা পাঠ্যবইয়ে যুক্ত করার দাবি জানায় হেফাজতসহ কিছু ধর্মীয় সংগঠন। অন্যদিকে নতুন করে ১২টি লেখা বাদ দিতে বলে তারা। ২০১৩ সালে এই ১২টি লেখা নতুন করে পাঠ্যবইয়ে যুক্ত করা হয়েছিলো। সে অনুযায়ী এবারের পরিবর্তন এসেছে। এর আগেও হেফাজতে ইসলাম নারীনীতি ও শিক্ষানীতির বিরোধিতা করেছিলো, যার কোনো যৌক্তিকতা ছিলো না। এবারের পাঠ্যপুস্তক নিয়ে তাদের দাবি কোন যুক্তিতে মানা হলো, এনসিটিবি তার কোনো পরিষ্কার ব্যাখ্যা করেনি। পাঠ্যবই পরিবর্তন ও পরিমার্জনের কাজগুলোর দায়িত্ব এনসিসি’র। মাধ্যমিক স্তরের জন্য শিক্ষা সচিবের নেতৃত্বে এবং প্রাথমিক স্তরের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে এমন কমিটি কাজ করে। অথচ এ দুই কমিটির সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজন সদস্যের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারাও পরিবর্তনের কথা জানে না। (দৈনিক প্রথম আলো, ১৬ জানুয়ারি ’১৭)। প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা বইয়ের মোট ২৩ জন সম্পাদক ও সংকলকদের মধ্যে ১০ জনই বলেছে পরিবর্তনের বিষয়টি তারা জানতেন না। সাধারণত কোনো লেখা বাদ দেয়া বা যুক্ত করার জন্য জাতীয় পাঠ্যক্রম সমন্বয় কমিটি (এনসিসি) এর অনুমোদন ও সম্পাদকদের অনুমতি নেয়া বাধ্যতামূলক। পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী, এনসিটিবি’র একাধিক সূত্র বলেছে, ‘ওপর থেকে আসা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছে তারা’। পাঠক বুঝতেই পারছেন, ক্ষমতার উপর মহলের ইশারা ছাড়া এ পরিবর্তন সম্ভব নয়। তাহলে বিএনপি-জামাত ঠেকানোর জন্য হেফাজতসহ অন্যান্য সমস্ত ধর্মীয় উগ্রবাদীদের কাছে টানার জন্য কি এটা করা? এর পরিণাম কী? মহান মুক্তিযুদ্ধসহ স্বৈরাচারবিরোধী অসংখ্য লড়াইয়ের গণতান্ত্রিক অর্জন ধ্বংস করে সরকার কোন ‘উন্নয়নের’ পথে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছে, এর জবাব দিতে হবে।

পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তু কেমন হওয়া উচিত
‘শিক্ষার একটি বড় উদ্দেশ্য হল, প্রতিটি শিক্ষার্থীকে বিচারশীল আর চিন্তাশীল করে গড়ে তোলা। আর এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে রচনা করা প্রয়োজন পাঠ্যপুস্তক’ (আহমদ ছফা রচনা সমগ্র, শিক্ষক শিক্ষার্থী পাঠ্যপুস্তক)। কিন্তু অবাক হতে হয়, যখন ধর্মের ভিত্তিতে পাঠ্য বইয়ের বিষয়বস্তু নির্ধারণের আবদার করা হয়। আর এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ যুক্তিহীনভাবে সে আবদার মেনে নেয়। আমাদের আপত্তি এখানেই। তাহলে সাহিত্য বিচার কি ধর্মের মানদন্ডের ভিত্তিতে হবে? তাহলে নন্দনতত্ত্ব, সমাজচেতনা, প্রকৃতি চেতনা, সাহিত্যরস বলে তো আর কিছুই থাকে না। যদি ধর্মের ভিত্তিতেই সাহিত্য পাঠের বিষয় বিবেচনা করা হয় তাহলে শেক্সপিয়ার, শেলি, বায়রন, কীটস, তলস্তয় এঁরা তো খ্রিস্টান। ‘সাহিত্য ও রাজনীতি’ প্রবন্ধে আহমদ ছফা আরও লিখেছেন, ‘মানুষের জন্য যে রকম ভাত, কাপড়, ঔষধ ইত্যাদির প্রয়োজন। সাহিত্য কি সে রকম কোনো প্রয়োজন মেটায়? তাহলে সাহিত্য কেন? সাহিত্যের কি দরকার?’ প্রমথ চৌধুরী এর একটা যুতসই জবাব দিয়েছিলেন- ‘সাহিত্য খোরপোষ দিতে পারে না। কিন্তু জাতিকে আত্মহত্যা থেকে রক্ষা করতে পারে। সাহিত্য মানুষের স্বাধীনতা চর্চার পথ প্রসারিত করে। মনের স্বাধীনতা আর চিন্তার স্বাধীনতার মধ্যেই মানুষের মনুষ্যসত্তার পরিচয় নিহিত। ওই স্বাধীনতার চর্চা করেছে বলেই গুহাবাসী মানুষ আধুনিক সুসভ্য মানুষ হয়ে ওঠতে পেরেছে। সে সাহিত্যকে যদি ধর্ম, শাসন বা রাষ্ট্রের মানচিত্রে বেধে রাখা যায় সেটা আত্মহত্যার শামিল।’ এছাড়া পদার্থবিজ্ঞান, জীবজ্ঞিান, চিকিৎসাবিজ্ঞান ইত্যাদি বহু ক্ষেত্রের বিজ্ঞানীরা ছিলেন সংশয়বাদী। এ কারণে তাদের আবিষ্কারগুলো যদি আমরা বাদ দিই তাহলে আধুনিক জীবনে এক মুহূর্ত চলবে না। তাছাড়া পাঠ্যবইয়ে বিষয় নির্ধারণের জ্ঞান বিকাশের ধারাবাহিকতা, রচনা শৈলি, ভাষা শৈলি শিক্ষার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
শিক্ষাবিদ আবুল মোমেন লিখেছিলেন, “আমাদের পাঠ্য বইয়ের ভাষা বড্ড গতানুগতিক, প্রাণহীন, শিশুমনকে উদ্দীপ্ত করার মত সমৃদ্ধ নয়। যাও বা সাহিত্যের বইগুলো থেকে শিশুরা উদ্দীপনা পেতে পারত, তাতেও বাধ সেধেছে। দিনে দিনে সৃজনশীল লেখার সংখ্যা কমেছে। আমাদের বিবেচনা থাকা দরকার কোন ভাষা প্রাণবন্ত, কোনটি নিষ্প্রাণ। কার ভাষা সরস, কারটি নীরস, কোনটিতে আছে কল্পনাকে মুক্তি দেবার রসদ আর কোনটি বদ্ধ ভাষা ইত্যাদি। কারও কারও ভাষা বন্ধ্যা, আড়ষ্ট, তাই শিশুর কল্পনা ও ভাবনাকে জাগাতে পারবে না। ভাষাবোধের এই সংবেদনশীলতা ছাড়া কীভাবে শিশুদের জন্য যথার্থ শৈলির লেখা নির্বাচন বা প্রণয়ন করা যাবে? যেকোনো শিক্ষার্থীর বিদ্যাচর্চার অগ্রগতির অনেকাংশ নির্ভর করে তার গদ্যের ওপর এবং এজন্য তা প্রাঞ্জল ও গতিশীল হওয়া জরুরি। এমন গদ্য লেখার যোগ্যতা অর্জন শিক্ষার একটি বড় কাজ। প্রমিত ভাষায় নিজের ভাব বক্তব্য প্রকাশের দুর্বলতা যেকোনো জাতিকে মেধা চর্চায় পিছিয়ে দেবে এটা মনে রাখা উচিত।”

হেফাজতের হিন্দুত্ববাদ ও নাস্তিক্যবাদের অভিযোগ অযৌক্তিক ও অনৈতিহাসিক
গত কয়েক বছর থেকে বেশ কিছু সাম্প্রদায়িক সংগঠন ইন্টারনেটে পাঠ্যপুস্তকের কিছু বিষয়কে ‘হিন্দুত্ববাদী’ ও ‘নাস্তিক্যবাদী’ আখ্যা দিয়ে ব্যাপক অপপ্রচার চালাতে থাকে। তারই প্রেক্ষিতে হেফাজতে ইসলামসহ কিছু ইসলামী সংগঠন পাঠ্যসূচি থেকে সুনির্দিষ্ট কিছু লেখা বাদ দেয়ার দাবিতে কর্মসূচি পালন করে। প্রথমত, আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, ২০১৩ সালে যে সব লেখা বাদ পড়েছিলো, তার বেশিরভাগের অর্ন্তভুক্তি নিয়ে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। ওই লেখাগুলোর শিল্পমান যাই থাকুক, সেগুলো পড়লে একজন ছাত্রের নৈতিক চরিত্রে কতটুকু প্রভাব পড়বে তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। যদিও হেফাজত যে লেখাগুলো পাঠ্যবই থেকে বাদ দেবার অভিযোগ তুলেছে তাও অসত্য। যেমন: ড. মোহাম্মদ আবদুল মান্নান জানান, ‘সবাই মিলে করি কাজ’ (হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনচরিত), খলিফা আবু বকর (রাঃ), খলিফা ওমর (রাঃ) শীর্ষক বিষয়গুলো বাংলা বইয়ে না থাকলেও ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বইয়ে অর্ন্তভুক্ত হয়েছিলো। ‘বিদায় হজ’ ও ‘শহীদ তিতুমির’ শীর্ষক নিবন্ধ দুটি বাংলা বই থেকে বাদ পড়লেও ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইয়ে ছিলো।

যে অভিযোগে ১২টি লেখা বাদ পড়েছে, সেগুলোতে নাস্তিক্যবাদ আর হিন্দুত্ববাদের অভিযোগ তুলেছে তারা। যেমন, নবম-দশম শ্রেণিতে ‘আমার সন্তান’ কবিতাটি বাদ দেয়া হয়েছে, এতে হিন্দু দেবী অন্নদার প্রশংসা করা হয়েছে। সপ্তম শ্রেণিতে ‘বাংলাদেশের হৃদয়’ কবিতা বাদ দেয়া হয়েছে দেবী দুর্গার প্রশংসার কারণে। অষ্টম শ্রেণিতে রামায়ণের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে যা একটি হিন্দু মিথ। নবম শ্রেণিতে ‘সাঁকোটা দুলছে’-এটা দিয়ে ’৪৭ এর দেশভাগকে হেয় করা হয়েছে ইত্যাদি।

বিগত ৪৬ বছরে রবীন্দ্রনাথের গানে-কবিতায় কেউ সাম্প্রদায়িকতার উপাদান খোঁজ করেনি। কারণ সবাই জানে এই গানগুলো রূপক অর্থে লেখা। প্রতীকী অর্থে দেশের প্রতি মমতা প্রদর্শন। ভাষা ও সাহিত্যকে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক আক্রমণ অবশ্য এবার নতুন নয়। পাকিস্তান আমলেও ‘রবীন্দ্রনাথ হিন্দু কবি’ এ অভিযোগ তুলে তাঁর কবিতা না পড়ানোর ফতোয়া জারি করে ফতোয়াবাজরা। সেদিন এর বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন তৎকালীন সাহিত্যিক ও পন্ডিতেরা। ‘সুরের মুক্তি’ (ইত্তেফাক, ২৫ শে বৈশাখ, ১৩৭৩) প্রবন্ধে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী লিখেছেন, “জন্ম থেকেই তিনি (রবীন্দ্রনাথ) ছিলেন পৌত্তলিকতা বিরোধী, ব্রাহ্ম সমাজভুক্ত। তাঁর ধর্মগুরু রামমোহন আর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন গভীরভাবে ইসলামের ধর্মীয় দর্শন দ্বারা প্রভাবিত এবং সেই হেতু নিরাকার ঈশ্বরে বিশ্বাসী; উপরন্তু দেবেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ দু’জনেই ছিলেন সুফী সাধক কবি হাফিজের পরম ভক্ত।” বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত গোলাম মোস্তফা প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ’ এ লিখেছেন- “পৌত্তলিকতা, বহুত্ববাদ, নিরীশ্বরবাদ, জন্মান্তরবাদ, সন্ন্যাসবাদ প্রভৃতি যে সমস্ত ধারণা… তাহা রবীন্দ্রনাথের লেখায় অনুপস্থিত বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।”
বিশ্বসাহিত্যে মধ্যযুগের কবিতার বৈশিষ্ট্যই হলো ঈশ্বরকেন্দ্রিকতা। বাংলাও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ‘হিন্দুয়ানি’ বা সংস্কৃত প্রভাব সম্পর্কিত অপ্রপ্রচার মোকাবেলায় সৈয়দ মুজতবা আলী প্রমুখ মনীষীরা কলম ধরেছিলেন। মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী অমুসলিম তুলনা, উপমা, অলঙ্কার বা কিসসা কাহিনী সম্পর্কে শুচিবায়ুগ্রস্ত হওয়ার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছিলেন- ‘হাতেম তায়ী, সোহরাব রুস্তম, বাদশাহ নওশেরওয়ান প্রভৃতিরা মুসলিম ছিলেন না। তারা ছিলেন পৌত্তলিক, অগ্নিপূজক বা প্রতীকের উপাসনাকারী। তাদের কিসসা কাহিনীর সাথে জড়িত তুলনা, উপমা, রূপক ইত্যাদি আমরা অগ্রহণীয় মনে করিনি। অথচ পাক-ভারতের অনুরূপ অমুসলিম কীর্তিমানদের প্রতি বিতৃষ্ণা আমরা প্রচার করছি। এও স্মরণযোগ্য যে প্রাক-ইসলামী যুগের পৌত্তলিক আরবি কবিদের অনেক রচনা পরবর্তী যুগের মুসলিম কবি-সাহিত্যিকেরা সংরক্ষণযোগ্য পদার্থ ভেবেছিলেন। কিন্তু আজ প্রাক-পাকিস্তান যুগের অমুসলিম রচনা আমরা অস্পৃশ্য ভাবতে শিখেছি। এর মানে কী? ইসলামমুখিতা আমাদের নিশ্চয় কাম্য। কিন্তু সেই অজুহাতে চিত্তের সাহিত্য ধর্ম যেন আমরা বিসর্জন না দেই।’ (মাসিক সওগত ১৩৬০ ভাদ্র)

তিনি আরও লিখেছিলেন, “সাহিত্য ও শিল্প আদর্শ বা সংস্কৃতির বাহন মাত্র। বর্তমান গ্রীস তথা পশ্চিম ভূ-খ- খ্রিষ্টান জগৎ। কিন্তু সাহিত্যের জগতে হোমার বা ভার্জিল অতি সমাদৃত। ইংরেজ কবি মিলটন ছিলেন গোঁড়া খ্রিষ্টান এবং গ্রীক দেব-দেবীর সাথে তাঁর কোনো সম্পর্ক ছিলো না। কিন্তু তিনি তাঁর ‘প্যারাডাইস লস্ট’ এ ওই সময় দেব-দেবীকে টেনে এনেছেন। এর থেকে প্রমাণিত হয় না যে মিলটন ঔ সময় দেব-দেবীর পূজারী ছিলেন। কাজী নজরুল ইসলাম অনেক শ্যামা সঙ্গীত রচনা করেছেন এবং তাঁর সাহিত্য পাকিস্তানে অতিশয় সমাদৃত। আমরা হোমার, ভার্জিল, মিলটন, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলামের সাহিত্যে প্রচুর সাহিত্যরস উপভোগ করি। কিন্তু ঐ সমস্ত নায়ক-নায়িকার কারণে পৌত্তলিক হয়ে পড়ি না।”

সেই চর্যাপদের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবারই অবদান আছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে। সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর এ ঐতিহাসিক অবদান বোঝার মতো ক্ষমতাও নেই। এ প্রসঙ্গে ‘মুহাম্মদ আবদুল হাই’- বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ধর্মীয় সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘আজ একথা জোর করেই বলবার প্রয়োজন হয়েছে বাংলা ভাষার সকল কবিই আমাদের কবি। বাংলা ভাষার সব সাহিত্যিকই আমাদের সাহিত্যিক। এঁদের কাউকে আমরা ত্যাগ করতে পারব না। বাংলা সাহিত্যের আদি যুগ থেকে আজ পর্যন্ত যত লেখকের সৃষ্টিতে এই সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে সেই বিদ্যাপতি-চন্ডীদাস-আলাওল-ভারতচন্দ্র-মধুসূদন-নবীনচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ইসলাম সকলেই আমাদের, সবার উপরে আমাদের দাবী।…. আমাদের পূর্বতন বাংলা সাহিত্যকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা চলবে না, এই কথাটাই আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই।’

হেফাজতের চিন্তা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান-সভ্যতা-সংস্কৃতি চেতনার বিরোধী
হেফাজতের নেতারা পরামর্শ দিয়েছেন, “চারু ও কারু শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের জীবিত কোন কিছুর চিত্রাঙ্কন শেখানো উচিৎ হবে না। কারণ ইসলামে এটি নিষিদ্ধ। এর পরিবর্তে লিপিবিদ্যা শেখানো উচিত।” আধুনিক সময়ে এই কথা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত? এরকম উচ্চারণ হঠাৎ প্রকাশ হওয়া কোনো দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন নয়। এর আগে ২০০৯ সালে কয়েকটি ধর্মীয় উগ্রবাদী সংগঠন কর্তৃক লালন ভাস্কর্য ভেঙ্গে দেয়া, ভাস্কর্যকে মূর্তি পূজার সাথে সমার্থক করে দেখা, নারীকে তেঁতুলের সাথে তুলনা করে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণকে অনিবার্য বিষয় হিসেবে গণ্য করা, কথায় কথায় কাউকে ‘মুরতাদ’ ঘোষণা — এসব বিষয়ই অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিজাত। তালেবানদের কথা স্মরণ করুন — গত শতাব্দীর শেষ লগ্নে ধর্মীয় জিগির তুলে আফগানিস্তানের পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বৌদ্ধমূর্তি ধ্বংস করে দিয়েছিলো। কয়েক ঘন্টার হাতুড়ি-ছেনীর আঘাতে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো সভ্যতার সুপ্রাচীন অধ্যায়। তালেবানদের দৃষ্টিভঙ্গিতে এগুলো নিছকই মূর্তি, ইসলামবিরোধী উপকরণ। কিন্তু যারা ইতিহাস জানতে চান, তাদের কাছে এগুলো ইতিহাসের অলিগলি- যাতে ভ্রমণের মধ্য দিয়ে মানুষের বহু কীর্তির মধ্য দিয়ে নির্মিত সভ্যতা-সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা যায়। এইতো কিছুদিন আগে আইএস জঙ্গিগোষ্ঠী মসুলের জাদুঘরে রক্ষিত আসিরিয় সভ্যতার নিদর্শন মূর্তি, ভাস্কর্য, কিউনিফর্ম লিপি সবকিছুকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। প্রত্মসামগ্রী বেচে আগ্নেয়াস্ত্র কেনার অর্থ সংগ্রহ করেছে। মসুলের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ২০০০ বিরল পুঁথি ও পা-ুলিপিকে ছাই করে দিয়েছে। একই যুক্তি- পৌত্তলিক সভ্যতার নিদর্শন, দেব-দেবীর মূর্তি ধ্বংস করে তারা ধর্মীয় নির্দেশ পালন করছে। এই যুক্তিতে তো পৌত্তলিক ফারাওদের কবর পিরামিডসহ সভ্যতার অতীত সব কীর্তিকেই ধ্বংস করে দিতে হবে। কারণ বেশিরভাগের সাথে ইসলামের সম্পর্ক নেই।

সেসব ইতিহাস কি আমরা ভুলে যাব — দাড়ির দৈর্ঘ্যরে কারণে আফগান যুবকদের উপর নির্যাতন, স্কুলে যাবার অপরাধে কিশোরী মেয়েকে গুলি করা কিংবা ফুটবল খেলার অপরাধে হত্যার ঘটনা? ধর্মান্ধ এসব গোষ্ঠী মানুষের সভ্যতাকে এ পর্যায়ে নিতে চায়। মানুষকে এরা হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান হিসেবে বিবেচনা করে। মানুষের কীর্তি এদের কাছে নামের বিচারে গ্রহণযোগ্য। একজন সাহিত্যিক মুজতবা আলী তাদের কাছে ‘মুসলমান’ হিসেবে। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, জীবনানন্দ তাদের কাছে সমাজদর্শী মানবিক সাহিত্যিক নন, একটাই পরিচয় তাদের- ‘হিন্দু’। নজরুল লিখেছিলেন, “মুসলমান সমাজ কেবলই ভুল করেছে Ñ আমার কবিতার সঙ্গে আমার ব্যক্তিত্বকে অর্থাৎ নজরুল ইসলামকে জড়িয়ে। আমি মুসলমান। কিন্তু আমার কবিতা সকল দেশের, সকল কালের এবং সকল জাতির। কবিকে হিন্দু-কবি, মুসলমান-কবি ইত্যাদি বলে বিচার করতে গিয়েই এত ভুলের সৃষ্টি! ….. আমি শরিয়তের বাণী বলিনি — আমি কবিতা লিখেছি। ধর্মের বা শাস্ত্রের মাপকাঠি দিয়ে মাপতে গেলে ভীষণ হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। ধর্মের কড়াকড়ির মধ্যে কবি বা কবিতা বাঁচেও না, জন্মও লাভ করতে পারে না। তার প্রমাণ- আরব দেশ। ইসলাম ধর্মের কড়াকড়ির পর থেকে আর সেথা কবি জন্মাল না। এটা সত্য। …” ধর্মান্ধদের এসব যুক্তিধারা মানলে তো মানব সভ্যতার কোনো অর্জনকে এদের ব্যবহার করার কথা না। কম্পিউটার, মোবাইলসহ যেসব আধুনিক সামগ্রীর ব্যবহার করে, কোনোটাই মুসলমান কেউ আবিষ্কার করেনি। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, রসায়ন, গণিতসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিরাট অংশই মুসলমানরা আবিষ্কার করেনি। রোগ সারানোর ওষুধ, অস্ত্রোপচারের উপকরণের বেশিরভাগই তৈরি হয় খ্রিস্টান, ইহুদি বা বৌদ্ধ অধ্যুষিত দেশে। এগুলোও কি বর্জনীয় হবে? পশ্চাৎপদ এসব মানসিকতা বা চিন্তার অনুগামী হব আমরা? নজরুল লিখেছিলেন, “বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে/ আমরা তখন পিছে/ বিবি তালাকে ফতোয়া খুঁজছি হাদিস-কোরান চষে।”

আরবে ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছে একটা বিশেষ ঐতিহাসিক সময়ে। সেই সময়ের যে খাদ্যাভাস, রীতি-নীতি, সংস্কৃতি, যুদ্ধ উপকরণ — সেগুলো বর্তমানের পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থায় গ্রহণ করা সম্ভবপর কি? যে কারণে আইএস জঙ্গি বা তাদের এদেশীয় ভাবশিষ্যরা মার্কিনীদের আগ্রাসনের প্রতিশোধ হিসেবে নিরীহ মানুষ হত্যা করে, তখন ঢাল তলোয়ার দিয়ে করে না। খ্রিস্টান, ইহুদিদের বানানো আধুনিক অস্ত্র দিয়েই করে। তৎকালীন আরবের সমাজব্যবস্থা কল-কারখানাভিত্তিক ছিলো না। মালিক-মজুর উৎপাদন সম্পর্ক তখন তৈরি হয়নি। আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা, বীমা, মুদ্রানীতি, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-হাসপাতাল, শিক্ষা-চিকিৎসা নিয়ে বাণিজ্য, সর্বোপরি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিপুল বিস্তার কোনো কিছুই সেসময় ছিলো না। সুতরাং সে সময়ের চিন্তা বা বিষয়গুলোকে ধারণ করা আজকের আধুনিক জীবন যাপনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হবে না।

ধর্মীয় নানা ব্যাখ্যার মধ্যেও পার্থক্য আছে
সাহিত্যিক ও শিক্ষা সমালোচক সৈয়দ আলী আহসান তাঁর ‘শিল্পবোধ ও শিল্প চৈতন্য’ বইতে লিখেছেন “…. রাসুলুল্লাহ করিমের বিভিন্ন সৌন্দর্য্য সমর্থনে অনেক কাহিনী পাওয়া যাচ্ছে এবং চিত্রের ক্ষেত্রে কখনো তিনি মৌনতা অবলম্বন করেছেন এমন ঘটনাও আছে…।” আবু দাঈদ বর্ণিত একটি হাদিসে আছে, রসুলের শয়নকক্ষের সজ্জার গালিচায় ঢাকনা প্রভৃতিতে পশুপাখি ও জীবজন্তুর ছবি ছিলো। রসুলের স্ত্রী বিবি আয়েশা (রাঃ) এর গৃহেও জীবজন্তুর প্রতিকৃতিযুক্ত পর্দা ছিলো। বুখারী শরীফে আছে, বিবি আয়েশা (রাঃ) রসুলকে চিত্রযুক্ত পর্দা কেটে গদি ও বালিশ তৈরি করে দিয়েছিলেন, যা ব্যবহার করতে রসুলের এতটুকু অসুবিধা হয়নি। ….. রসুলের গৃহে ফেরেশতাদের বিশেষত জিবরাইলের (আঃ) আনোগোনা সর্বদাই ছিল। কিন্তু ঘরে ছবি ও পুতুল থাকায় তার আসার ক্ষেত্রে কোনো আপত্তির কথা কোথাও লিপিবদ্ধ হয়নি। (শিল্পের স্বভাব ও আনন্দ- সৈয়দ আলী আহসান) হেফাজতীদের ফতোয়ার সঙ্গে এসব ধারণা মেলে না।

সমাজের মধ্যকার কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধেই এদের কথা নেই
আরব দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সময়কালে সামাজিক অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছিলো। কিন্তু আমাদের দেশে যারা ‘ইসলাম গেল, ইসলাম গেল’ বলে সোচ্চার, তাদেরকে মানুষের সংগ্রামের পাশে কখনোই দাঁড়াতে দেখা যায় না। তাই তো প্রাথমিক স্তর থেকে সকল প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় যখন প্রশ্নফাঁস হয়, পুরো শিক্ষাব্যবস্থা যখন মানহীন ও সার্টিফিকেটসর্বস্ব ব্যবস্থায় পরিণত হয়, তখন তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ওদের দেখা যায় না। যে কৃষকদের তারা ওয়াজ নসিহত করেন, তারা যখন ফসলের ন্যায্য মূল্য পায় না; যে শ্রমিক মালিকী শোষণের কারণে তার ‘হক’ থেকে বঞ্চিত হয়- তার বিরুদ্ধে এদের রাস্তায় নামতে দেখা যায়নি। আজ দেশের প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ বিপন্ন, সুন্দরবন হুমকির মুখে। এছাড়াও কত কত ঘটনা প্রতিনিয়ত দেশে ঘটে চলছে- শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার, দুর্নীতি, লুটপাট, নারী-শিশু নির্যাতন — এগুলোর কোনোটার বিরুদ্ধেই কি এদের প্রতিবাদ করতে দেখা যায়? তাহলে ধর্মের নৈতিকতা কোথায় থাকে? কে ‘নাস্তিক’ আর কে ‘মুরতাদ’ তা ঘোষণা করাই কি তাদের সামাজিক দায়িত্ব?

পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট শ্রেণিস্বার্থ আছে
একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, পাঠ্যপুস্তকে ভুল, মুদ্রণ প্রমাদ, বিষয়বস্তুর সাম্প্রদায়িক উপস্থাপন — এসবই ঘটে সাধারণ শিক্ষার ধারার মধ্যে। বৈষম্যমূলক বিভিন্ন ধারার শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে উচ্চবিত্তের সন্তানরা (এবং আমাদের মন্ত্রী, এমপি, শিক্ষা কর্মকর্তাদের সন্তানরা) যেখানে পড়ে, সেই ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা নিয়ে কোনো আলোচনা কখনই শোনা যাবে না। কী কী বিষয় পড়ছে, দেশের ইতিহাস পড়ছে কিনা, কোন লক্ষ্যে তৈরি করা হচ্ছে — এসব প্রশ্নে রাষ্ট্রীয় শিক্ষা বিভাগ কিংবা ধর্মীয় গোঁড়াদের কোনো উচ্চারণ নেই। ক্ষমতাসীন ধনিক শ্রেণির সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থা দরিদ্র মানুষের মানবিক চেতনা বিকশিত হবার পথ রুদ্ধ করতেই শ্রেণিস্বার্থের অবস্থান থেকে এসব সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। কারণ যারা প্রজা হবে, তারা প্রশ্ন করলে, যুক্তিবাদী হলে, প্রত্যেকটি বিষয় খুটিয়ে খুটিয়ে কার্যকারণ সম্পর্কের বিচারে পরিমাপ করলে, অন্যায় শাসন-শোষণের ভিত্তির উপর টিকে থাকা বিদ্যমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শিকড় যে উৎপাটিত হয়ে পড়বে। অতএব সাধু সাবধান!

পুঁজিবাদী আক্রমণ শিশুকিশোরদের মন কলুষিত করেছে ধর্মীয় নৈতিকার জিগির তুলে একে মোকাবিলা করা যাবে না
কিছুদিন আগে ঢাকার উত্তরায় কিশোর আদনানকে হত্যা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ভয়ংকর কিছু ক্রিমিনাল গ্যাং-এর কথা আমরা জানতে পারি, যার সদস্যরা মূলত কিশোর। তারা মটরসাইকেলে রেস করে, দল বেঁধে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে, বড় ভাইদের মারামারিতে অংশ নেয় ইত্যাদি। আবার ‘হলি আর্টিজান’ এর ঘটনা থেকে দেশবাসী জেনেছে উগ্র ধর্মীয় আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে একদল তরুণ পৈশাচিক হত্যাকা- চালিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে অভিভাবকেরা সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব চিন্তিত। পারিবারিক স্বচ্ছলতা কিংবা ধর্মীয় নৈতিকতা কোনোটাই তো ছেলে-মেয়েদের রক্ষা করতে পারছে না।

সমাজের এই চরম সঙ্কটের বীজ আসলে লুকিয়ে আছে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার অভ্যন্তরে। এই বন্ধ্যা সমাজ নৈতিক মেরুদ-কেই ভেঙ্গে দিয়েছে। সমাজপতিরা কিশোর-কিশোরীদের সামনে ভোগ করতে পারাকেই একমাত্র আনন্দ হিসাবে প্রচার করছে। উস্কে দিচ্ছে যৌন আকাক্সক্ষাকে। সমাজের অন্য কোনো সমস্যার দিকে যুবকদের চোখ যেন না যায়, সেজন্য মিডিয়াগুলোর কত চেষ্টা! এখানে ভালো-মহৎ কিছু করতে পদে পদে বাধা। শেখানো হচ্ছে- কেবল নিজেরটা দেখো। এভাবেই তো বাড়ছে নীতিহীনতা। তাই অন্যায় আছে, কিন্তু প্রতিবাদ নেই। লাঞ্ছনা আছে, কিন্তু ঐক্যবদ্ধ হবার জোর নেই। পুঁজিবাদ এভাবে আজ সাপও মারে, নিজেদের লাঠিও রক্ষা করে।

পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু পরিবর্তনসহ শিক্ষাক্ষেত্রে নানামুখী আক্রমণ চলতেই থাকবে, যদি না আমরা রুখে দাঁড়াই। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ কিংবা নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে শিক্ষার যে অধিকারের দাবি উচ্চকিত হয়েছিলো, আমাদের চোখের সামনে তাকে পদদলিত হতে দিতে পারিনা। আসুন, সক্রিয়তা নিয়ে দাঁড়াই; একটা বন্ধ্যা, অচল, পশ্চাৎপদ সমাজের দিকে ধাবমান দেশটিকে রক্ষা করি।

সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট মুখপত্র অনুশীলন ফেব্রুয়ারি ২০১৭

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments