Monday, March 18, 2024
Homeসংবাদ ও প্রেস বিজ্ঞপ্তিপার্টি সংবাদপার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২০ বছর পূর্তি — প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২০ বছর পূর্তি — প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

1693645_orig

বিশ বছর পূর্তি হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির। বড় বড় হরফে শিরোনাম করেছে দৈনিক পত্রিকাগুলো — ‘পাহাড় জুড়ে উৎসব শুরু হয়েছে।’ সরকারি উদ্যোগে তিন পার্বত্য জেলায় অনুষ্ঠিত হয়েছে র‌্যালি-শোভাযাত্রা-সভা-সেমিনার। কোথাও কোথাও আয়োজন করা হয়েছে কনসার্টের। সরকারি উদ্যোগে সাফল্যের বিরামহীন ঢাক পাহাড়ের গায়ে গায়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

কিন্তু যাদের জন্য এ চুক্তি সেই পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা কী? নিজের দেশে প্রতিদিন টিকে থাকার জন্য লড়াই করা তাদের জীবনের কী পরিবর্তন হলো এ চুক্তি দিয়ে? বাস্তবে কিছুই হয়নি। তাদের চোখে মুখে এখনও আতঙ্ক, এখনও অবিশ্বাসের ছায়া। দেশের কাউকে তাদের বিশ্বাস করার উপায় নেই। কয়েক মাস আগেও লংগদুতে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর বসত বাড়িতে সেটেলার বাঙালিদের আগুন লাগানোর দৃশ্য তাদের চোখে লেগে আছে। নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে নিরুদ্দেশ যাত্রা করা অথবা রাঙামাটিতে ১৭ বছরের যুবক রোমেল চাকমাকে রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা নৃশংস হত্যা — সবই বলে দেয় আজ পাহাড়ের কী অবস্থা। এ অবস্থায় উৎসব চলে না।

সরকার বলছে, ‘চুক্তির প্রায় সবটুকুই বাস্তবায়িত হয়েছে’। অন্যদিকে জনসংহতি সমিতির (জেএসএস- সন্তু লারমা) সভাপতি সন্তু লারমা সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘সরকার মিথ্যাচার করছে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ পার্বত্য চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি সম্পন্ন, ১৫টি আংশিক ও ৯টি ধারার বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান আছে বলে মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। আসলে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। তবে এর মধ্যে মৌলিক ধারাগুলোর একটিও বাস্তবায়িত হয়নি।’ (সূত্র : প্রথম আলো ২ ডিসেম্বর ২০১৭) এমন আস্থাহীন অবিশ্বাসের মধ্য দিয়ে যখন সরকার বর্ষপূর্তির আয়োজন করছে তখন এই চুক্তি ভবিষ্যতে কতটুকু বাস্তবায়িত হবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়। চুক্তির কয়েকটি ধারার উপর আলোকপাত করলে তার অসঙ্গতিগুলো ধরা পড়বে। এবং সরকারের মনোভাবও পরিষ্কার হবে।

চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারা হলো ‘ভূমি সংক্রান্ত বিশেষ বিধান’, যেখানে স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে ‘ভূমি কমিশন গঠন’ করা হবে। বাস্তবে ভূমি সংক্রান্ত সমস্যা নিরসনের জন্য যে কমিশন গঠন করা হয়েছে তার কার্যকারিতা নেই। বরং ভূমি সমস্যা পাবর্ত্য অঞ্চলে সমাধান না করে চুক্তির পর সরকার হাজার হাজার একর জমি নানা সংস্থার কাছে লিজ দিয়ে, নানান অবকাঠামো নির্মাণ করেছে। এখনও পর্যন্ত অব্যাহতভাবে পাহাড়ীদের ভূমি দখল করা হচ্ছে। পার্বত্য অঞ্চলে সংঘাতের কারণে‘৮০ ও ‘৯০ এর দশকের শুরুতে ভারতে চলে যায় হাজার হাজার পাহাড়ী জনগোষ্ঠী। বিভিন্ন সময় হামলা, অগ্নি সংযোগের মতো ঘটনায় অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হয় হাজার হাজার পাহাড়ী পরিবার। এদের পুনর্বাসন নিয়ে সরকারের ভূমিকা নেই। এর মধ্যে যারা ভারত থেকে ফেরত এসে পুনর্বাসিত হয়েছে, তারা এখনও পর্যন্ত জমির দখল পায়নি।

চুক্তিতে উল্লেখ ছিল, ধারাবাহিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্পগুলো প্রত্যাহার করা হবে। বাস্তবে প্রত্যাহার তো দূরে থাক, দ্বৈত শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখানকার পাহাড়ী জনগোষ্ঠীকে প্রতি মুহূর্তে নজরদারিতে থাকতে হচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাহাড়ী-বাঙালি বিরোধকে মদত দিয়ে যাচ্ছে এবং প্রতি মুহূর্তে অপ্রীতিকর ঘটনার আশঙ্কা জাগিয়ে তুলছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড়ি-বাঙালি বিরোধ দীর্ঘদিনের। স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি প্রত্যেক শাসক সমতলের নদীভাঙ্গা অসহায় গরীব মানুষদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থার কথা বলে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। যার ফলে প্রতিনিয়ত সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে শাসকদের মদতে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ‘বাঙালি ছাত্র পরিষদ’ ব্যানারসহ নানা ব্যানারকে ব্যবহার করছে।

আমাদের বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর যে আশা-আকাক্সক্ষা তা ধারণ করার পরিবর্তে তাদের উপর নির্যাতন নিপীড়ন অব্যাহত রেখেছে। পাহাড় ও সমতলের গরীব মানুষদের মধ্যে বিভেদের দেয়াল তৈরি করেছে। আমাদের সংবিধানেও পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র জাতিসত্তার কোনো স্বীকৃতি নেই। বাংলাদেশে ৪৫টি আদিবাসী গোষ্ঠীর অবস্থান রয়েছে পাহাড়ে ও সমতলে। তাদের ভাষার সংখ্যা ৩২টি। তাদের ভাষা-সংস্কৃতি আজ হুমকির সম্মুখীন। তাদের অস্তিত্ব ক্রমশ বিপন্ন।

আজ দেশে দেশে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্র ছোট ছোট জাতিসত্তার উপর জাতিগত নিপীড়ন নামিয়ে এনেছে। আমাদের এই রাষ্ট্র তার ব্যতিক্রম নয়। প্রতিমুহূর্তে শাসকগোষ্ঠী কখনও চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বলে, কখনো পাহাড়ী-বাঙালি বিরোধকে উস্কে দিয়ে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীকে বিভক্ত করে তার ফ্যাসিবাদী শাসন পাহাড়ে কায়েম করেছে। এর বিরুদ্ধে পাহাড় ও সমতলের গরীব মানুষের ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলন জরুরি।

সাম্যবাদ ডিসেম্বর ২০১৭

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments