Thursday, April 25, 2024
Homeফিচারবাম ঐক্য প্রসঙ্গে যথার্থ দৃষ্টিভঙ্গি চাই

বাম ঐক্য প্রসঙ্গে যথার্থ দৃষ্টিভঙ্গি চাই

Hartal 30 Nov copy

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হয়ে উঠছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়াই ক্ষমতা দখলে রেখেছে। এর মাধ্যমে তারা আপাত অর্থে গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তরের বুর্জোয়া নির্বাচনী ব্যবস্থাকেও অকার্যকর করে ফেলেছে। আওয়ামী লীগ শাসনামলে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতেও সুষ্ঠু ভোট হয়নি। ফলে আগামীতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও জনগণ ভোট দিতে পারবে কি’না — তা নিয়ে সংশয় আছে। আওয়ামী লীগ সরকারের গণবিরোধী নীতি, মূল্যবৃদ্ধি, দমনমূলক শাসন, চূড়ান্ত লুটপাট-দুর্নীতি, দখলদারিত্ব, দলীয়করণ সবকিছু মিলে মানুষ অতিষ্ঠ। অন্যদিকে, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অতীতে একই কায়দায় দেশ চালিয়েছে। বর্তমানেও জনস্বার্থ নিয়ে জনগণকে সংগঠিত করে আন্দোলনের রাস্তায় তারা নেই। আওয়ামী লীগের ওপর ক্ষুব্ধ মানুষ অন্য উপায় না পেয়ে তাদের ভোট দেবে — এই আশায় তারা আছে। কিন্তু ভোটের রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে মহাজোট সরকার। তাই সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের হুমকি দিয়ে দরকষাকষির চেষ্টা করছে তারা। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগ সরকারি ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে প্রহসনের নির্বাচন করে জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আবারো সরকার গঠন করতে চাইবে। কোনো কারণে তারা যদি সেটা করতে ব্যর্থ হয় এবং জাতীয়-আন্তর্জাতিক নানা শক্তির চাপে যদি কিছুটা অবাধ নির্বাচন হয়ও বা তাতে যে-ই জিতুক তাতে জনগণের অবস্থার বিশেষ কোনো পরিবর্তন হবে না।

অতীত অভিজ্ঞতায় এ কথা পরিষ্কার, এদেশের প্রধান দুই বুর্জোয়া দল এবং তাদের সহযোগী পার্টিগুলো কেউই আজ আর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধারণ করে না। কারণ, তাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দর্শন হচ্ছে পুঁজিবাদী — যার মূলকথা উৎপাদন যন্ত্রের উপর ব্যক্তি মালিকানা এবং মালিকদের মুনাফার লক্ষ্যেই উৎপাদন ব্যবস্থা বা অর্থনীতি পরিচালিত হওয়া। ফলে, সমাজে সবাই মিলে সম্পদ তৈরি করলেও তার প্রধান অংশ জমা হয় মালিকের হাতে, শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ পায় ছিটেফোঁটা ভাগ।

এর সাথে যুক্ত হয়েছে সামন্ততান্ত্রিক পরিবারতন্ত্র এবং বেপরোয়া লুটপাট। পারিবারিক উত্তরাধিকারভিত্তিক দুই বুর্জোয়া দলের পালাক্রমে দুঃশাসন দেশবাসীকে জিম্মি করে রেখেছে। মানুষ এ থেকে মুক্তি চায়। কিন্তু বিকল্প কোথায়? বিকল্প না পেয়ে জনগণ এক দলের শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে আরেক দলকে ভোট দেয়। বাস্তবে অলৌকিকভাবে কোনো বিকল্প শক্তি হাজির হবে না। বিকল্প শক্তি হতে হলে জনস্বার্থে বিভিন্ন দাবিতে ধারাবাহিকভাবে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। কেবল এই পথেই বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি নির্মাণ সম্ভব হবে। আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে কিছু শক্তিকে একত্র করলেই বিকল্প গড়ে উঠবে Ñ বিষয়টি অত সহজ নয়। জনগণকে সংগঠিত করতে দরকার দীর্ঘমেয়াদী সংগ্রাম, দরকার বিকল্প কর্মসূচি। পুঁজিবাদ বিরোধী কর্মসূচিকে কেন্দ্রে রেখে জনগণের আশু গণতান্ত্রিক দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলনের পথেই সত্যিকার বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে উঠতে পারে।

এই কাজটি করার দায়িত্ব দেশের বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর। তাদের সাংগঠনিক শক্তি খুব সীমিত। কিন্তু তারা শ্রমিক-কৃষকসহ সাধারণ মানুষের স্বার্থে রাজনীতি করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। গণতান্ত্রিক অধিকার, জাতীয় সম্পদ রক্ষা, শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি, কৃষকের ফসলের দাম, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ গণমুখী ইস্যুতে এবং দলীয়করণ-দখলদারিত্ব-লুণ্ঠন-মূল্যবৃদ্ধিসহ দুঃশাসনের প্রতিবাদে তারাই সাধ্যমত কর্মসূচি পালন করেন। সঠিক কর্মপন্থা অনুসরণ করলে তারাই দেশের অবস্থা পরিবর্তনের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে।

সম্প্রতি দেশের বাম-গণতান্ত্রিক দলগুলোর ঐক্য প্রচেষ্টা প্রগতিশীল মহলে আশাবাদ তৈরি করেছে। এই বাম-গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্টের নীতি হবে দেশের সমস্ত সংকট নিয়ে ‘সর্বোচ্চ বোঝাপড়া সর্বনিম্ন কর্মসূচি’র ভিত্তিতে নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন পরিচালনা করা। জনগণের ইস্যুতে কার্যকরীভাবে ভূমিকা রাখতে পারলে তবেই এই জোট আশার সঞ্চার করতে পারবে। আন্দোলন করতে করতে নির্বাচন সন্নিকটে এলে তখন তাতে যুক্ত হওয়া-না হওয়া নিয়ে আলোচনা করে ঠিক করা যাবে। কিন্তু জোটের ক্রিয়াকলাপ যদি কেবল নির্বাচনের উদ্দেশ্যে হয়, মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য হয়, তবে তা কখনোই দেশের মেহনতী মানুষের সামনে পরিবর্তনের পথ দেখাতে পারবে না, কিছু প্রতিক্রিয়াধর্মী কর্মসূচির মধ্যেই কর্মকা- সীমাবদ্ধ থাকবে। যুক্ত আন্দোলন সম্পর্কিত আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টভাবে দেশের জনগণের সামনে আনতে হবে।

এখানে, বামপন্থী দলগুলোর অভ্যন্তরে কিছু প্রবণতা কাজ করে যা খোলামেলা আলোচিত হওয়া দরকার। তা হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদী বা কষ্টকর সংগ্রাম এড়িয়ে মিডিয়ানির্ভর কিছু কর্মসূচি পালন করে দৃশ্যমান থাকা। পাশাপাশি এর-ওর সাথে জোট বেঁধে নির্বাচনে কিছু করে ফেলার চিন্তা। আমরা আগেও বলেছি, বামপন্থীদের সাংগঠনিক শক্তি যা তাতে এই মুহুর্তে নিজেদের শক্তিতে নির্বাচনে অবস্থান প্রতিষ্ঠার কোনো বাস্তবতা নেই। তা করতে গেলে হতাশ হতে হবে। আবার শক্তি বাড়ানোর জন্য বিতর্কিত শক্তিগুলোর সাথে নির্বাচনী সমঝোতা করলে তা বামপন্থীদের নীতিগত অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। নির্বাচনে অংশগ্রহনের পরিবেশ থাকলে আন্দোলনের বক্তব্য প্রচার করতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার দরকার হবে। কিন্তু যেকোনোভাবে বুর্জোয়া সংসদীয় রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠা বামপন্থীদের প্রধান লক্ষ্য হতে পারে না। জনগণের মধ্যে সংগঠন গড়ে তোলা এবং বিপ্লবী পরিবর্তনের লক্ষ্য ছাড়া নির্বাচনী রাজনীতিতে গুরুত্ব পাওয়ার চেষ্টা সুবিধাবাদের জন্ম দিতে পারে।
বামপন্থী নেতা-কর্মী-দরদীদের প্রতি আমাদের আবেদন —নির্বাচনের লক্ষ্যে নয়, আন্দোলনের জন্য বামপন্থীদের জোট গড়ে তুলুন। ‘উদার-গণতন্ত্রী’ নাম দিয়ে সামরিক স্বৈরাচার ও বুর্জোয়া শাসনের সহযোগী বিতর্কিত ব্যক্তিবর্গ — গণআন্দোলনে যাদের দেখা যায় না —তাদের কাঁধে ভর দিয়ে নির্বাচনী রাজনীতিতে ‘দৃশ্যমান’ হওয়ার ভ্রান্ত মোহ ত্যাগ করুন।

সাম্যবাদ ডিসেম্বর ২০১৭

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments