Saturday, April 20, 2024
Homeফিচারমহান দার্শনিক, সাম্যবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ কার্ল মার্কস

মহান দার্শনিক, সাম্যবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ কার্ল মার্কস

karl_marx

১৪ মার্চ মহান কার্ল মার্কসের প্রয়ান দিবস। দুনিয়ার সকল শোষিত-নিপীড়িত মানুষের সাথে আমরাও এই মহান চিন্তানায়ককে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি। মার্কস ছিলেন একজন বিপ্লবী দার্শনিক, যিনি মানব জাতির ইতিহাসকে বিচার করার দর্শনের বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটিয়েছিলেন। তিনিই প্রথম দর্শন ও ইতিহাসকে বিজ্ঞান নির্ভর করেন। তিনি ও তাঁর ঘনিষ্টতম বন্ধু ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস যে বিচারধারা বা দর্শন নির্মাণ করেন তা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ নামে পরিচিত। মার্কসই সর্বপ্রথম দেখালেন যে মানুষের চিন্তা সমাজবাস্তবতাকে নির্ধারণ করে না, বিপরীতে সমাজবাস্তবতাই চিন্তাকে নির্ধারণ করে। এভাবেই তিনি ভাববাদী চিন্তার ও দর্শনের মূলে কুঠারাঘাত করলেন। মানব ইতিহাসের বিকাশের নিয়ম মার্কসই প্রথম আবিষ্কার করেছেন।

কোথা থেকে আসে মুনাফা — এই প্রশ্নের উত্তর পেতে যখন অতীতে সকল অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিকরা অন্ধকারে হাতড়েছেন তখন মার্কসই উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্ব আবিষ্কার করে এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন — যে আবিষ্কারকে যুগান্তকারী বলা যায়।

দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী বিজ্ঞানের মানদন্ডে মার্কস দেখালেন জগতের সবকিছুরই জন্ম, বিকাশ ও মৃত্যু আছে। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থাও চিরস্থায়ী নয়। পুঁজিবাদ তার সাথেই নিয়ে এসেছে আধুনিক শিল্প এবং শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিক শ্রেণিকে। এই সর্বহারা শ্রেণি দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী বিশ্ববীক্ষার আধারে নিজেকে শিক্ষিত করবে, সর্বহারা সংস্কৃতির জন্ম দেবে, শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তুলবে এবং বুর্জোয়া শ্রেণিকে রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করে প্রতিষ্ঠা করবে সমাজতন্ত্র ও সর্বহারা একনায়কত্ব, যা সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে অন্তবর্তী স্তর। এইভাবে মহান মার্কস সমাজতন্ত্রের ধারণাকে কল্পনাবিলাসের হাত থেকে মুক্ত করে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দিলেন, ঘটল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আবিষ্কার। মার্কস দেখালেন, সাম্যবাদী ব্যবস্থা কারও শুভ ইচ্ছার ফল নয়, তা সমাজবিকাশের ঐতিহাসিক নিয়মেই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। এর অন্যথা হওয়ার কোনও উপায় নেই।

এঙ্গেলসের ভাষায় মার্কস বিজ্ঞানকে দেখেছেন এক ঐতিহাসিক, গতিশীল, বিপ্লবী শক্তি হিসেবে। বিজ্ঞানের যে কোনও তত্ত্বগত আবিষ্কারকে মার্কস গভীর আনন্দে স্বাগত জানাতেন। কিন্তু তাঁর আনন্দ বহুগুণ বেড়ে যেত যদি সেই আবিষ্কার শিল্পে ও ইতিহাসের ধারায় কোনও আশু বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসত।

সর্বোপরি মার্কস ছিলেন একজন সমাজবিপ্লবী। তাঁর জীবনের প্রধান লক্ষ্য ছিল পুঁজিবাদী সমাজকে উৎখাত করা। বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষকে তিনিই প্রথম পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন করেন এবং নিজেই শ্রমিক শ্রেণির রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার কাজে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনিই প্রথম আওয়াজ তুললেন, ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও,’ দেখালেন বিশ্বের সমস্ত নিপীড়িত শোষিত মানুষের স্বার্থ এক। ১৮৪৬ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন কমিউনিস্ট করেসপণ্ডেন্স কমিটি। এরই ধারাবাহিকতায় তৈরি হল ‘কমিউনিস্ট লিগ’। এই ‘কমিউনিস্ট লিগে’র মতাদর্শগত হাতিয়ার হিসেবে মার্কস-এঙ্গেলস রচনা করলেন কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তাহার। বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণি পেল তাদের মুক্তি সংগ্রামের দিশা। মহান মার্কসের বিজ্ঞানভিত্তিক এই পথনির্দেশ ও দ্বান্দ্বিক বিচারধারাকে প্রয়োগ করেই তাঁর সুযোগ্য উত্তরসাধক মহান লেনিন রাশিয়ায় ঐতিহাসিক নভেম্বর বিপ্লবের মাধ্যমে বিশ্বের প্রথম সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেন। সেই বিপ্লবের শতবর্ষে আজ আমরা তাই সাম্যবাদী আন্দোলনের মহান পথিকৃৎ কার্ল মার্কসকে স্মরণ করছি এবং তাঁর শিক্ষাগুলি ও বিচারধারাকে অনুশীলন করার অঙ্গীকার করছি।

এঙ্গেলস বলেছেন, সংগ্রামই ছিল মার্কসের যথার্থ পরিচয়। যে গভীর আন্তরিকতা, একাগ্রতা ও সাফল্যের সাথে তিনি সংগ্রাম করেছেন তার তুলনা মেলা ভার। কোনও বাধাকেই তিনি বাধা বলে মনে করেননি, কোনও সমস্যাই তাঁর এগিয়ে যাবার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেনি। অনাহার, প্রিয়তম সন্তানের অসহায় মৃত্যু, পাওনাদারদের নির্মম আক্রমণ — এসব তাঁকে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। শত্রুপক্ষের চরম অবজ্ঞা ও কুৎসার জাল ছিন্ন করে তিনি সবলে এগিয়ে গিয়েছেন, মেহনতি মানুষের মুক্তি আন্দোলনের দিশা দেখিয়েছেন। তাঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু মহান এঙ্গেলস নিজেকে বড়জোর ‘মেধাবী’ বলে আখ্যায়িত করে মার্কসকে বলেছেন, ‘প্রতিভাধর’ বা জিনিয়াস। মার্কস মেহনতি মানুষের অন্তরে বেঁচে আছেন, চিরদিন বেঁচে থাকবেন। বর্তমান সময়ে সমগ্র বিশ্বকে খোলা বাজার হিসেবে পেয়েও বিশ্বপুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা যে গভীর সংকটে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, তার কারণ ও সমাধানের সন্ধান একমাত্র মার্কসবাদই দিতে পারে। তাই মার্কস এই নাম আজও দুনিয়ার শোষকদের বুকে কাঁপন ধরায়। অন্য দিকে শোষিত নিপীড়িত মানুষের হৃদয়ে ‘মার্কস’ — এই নাম অনন্ত প্রেরণার উৎস হিসেবে বিরাজ করবে।

তাঁর প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে এই মহান প্রতিভার স্মৃতির প্রতি আমরা বিপ্লবী শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি ও তাঁকে লাল সেলাম জানাচ্ছি।

গণদাবী, ১০-১৬ মার্চ ২০১৭

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments