Friday, April 19, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - এপ্রিল ২০১৮যাদের হাত চললে পেট চলে

যাদের হাত চললে পেট চলে

may-day-2
আজকের চাষী কালকের দিনমজুর-ক্ষেতমজুর। ফসল ফলিয়ে উৎপাদন খরচ তুলতে না পারা আবার কিনতে গিয়ে বেশি দামে কেনা। একবার বিক্রি করতে গিয়ে ঠকে আরেকবার কিনতে গিয়ে ঠকে। দুইবার ফসল ফলানোর পরে জমি চলে যায়। এই যে নিয়ম চলছে তারই ফল — একসময়ের চাষী আর একদিন সব হারিয়ে ক্ষেতমজুর ও দিনমজুর। তারপরও বিয়ে, অসুখ, নদী ভাঙ্গন, মামলা ইত্যাদিতেও জমি যায়। ফলে এদের হাত চললে পেট চলে; হাত না চললে পেট চলে না। এই যে পেটের জন্য হাত চলা, তার যোগারও নেই। বছরে তিন মাসের কাজ থাকে, নয় মাসের কোনো কাজ নেই। কাজের সন্ধানে দেশের এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে ভেসে ভেড়ায়। অনেকের ঠিকানা থাকে, অনেকের তাও নেই। স্কুল-কলেজের বারান্দা, বাস টার্মিনাল, প্ল্যাটফর্ম, পার্কের বেঞ্চ, ফুটপাত — এইসবই ঠিকানা। নাম-ঠিকানা জিজ্ঞাসা করলে উত্তর মেলে — দেশের কোনো এক জেলায় বাড়ি ছিল, এখন নেই। যাদের বাড়ির ঠিকানা আছে, তারা প্রিয় বউ-বাচ্চার সাথে থাকতে পারে না। বছরের অধিকাংশ সময়ে কাজের জন্য বাইরে থাকে। মাঝে মাঝে আত্মীয়ের মতো নিজ বাড়িতে আসে, ৬/৭ দিন থাকে। আবার চলে যায়। যে টাকা নিয়ে আসে দু-একদিন বউ-বাচ্চা নিয়ে ভালো খায়; নিয়ে যাওয়া সুদের টাকা শোধ করে। যাবার সময় আবার মহাজনের কাছে সুদে টাকা নেয়। কিছু স্ত্রীকে চলার জন্য দেয়, যাবার ভাড়া বাবদ নিজে কিছু নিয়ে যায়। এনজিও, মহাজনী সুদের কিস্তির জালে আটকে থাকে প্রত্যেকের জীবন। কিস্তির কারণে কারও ঘর ভাঙ্গে, স্বামী-স্ত্রীর তালাক হয়। কেউবা পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে রাতের অন্ধকারে গ্রাম ছাড়ে। আর ফিরে আসতে পারে না। অনেকে পাগল সাজে, যাদের একটু আত্মসম্মান বোধ আছে তাদের অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। ইট ভাটার মৌসুমে ভাটা মালিকের দালালদের কাছে অনেকেই ৬ মাসের জন্য দাদন নিয়ে বিক্রি হয়। মৌসুম শেষ না হওয়া পর্যন্ত ছুটি নেই। অমানুষিক খাটুনিতে পালাতে পারে সন্দেহে অনেককে ভাটায় শিকল দিয়ে বেধে রাখে। কাজের ক্ষেত্র যত লম্বা, শিকলও তত লম্বা হয়। যাকে বলা যায়, দাস যুগের নতুন সংস্করণ।

দিন মজুরের একটা বড় অংশ বাইরে যায়। রিক্সা, ভ্যান, ঠেলা গাড়ি চালায়। গৃহকর্মসহ নানা স্বকর্মে নিয়োজিত থাকে। বস্তিতে গাদাগাদি করে থাকে। তাদের প্রতিদিনের যে কষ্টকর জীবনযুদ্ধ তা বর্ণনা করতে ভুক্তভোগীদের চোখে জল গড়ায়। পরিবহনে এদের উপহাস করে ডাকা হয় ‘মফিজ’। সিটে এক ভাড়া, দাঁড়িয়ে আরেক ভাড়া, ছাদে আরেক ভাড়া। ছাদে ঘুমের ঝোঁকে যেন না পড়ে যায়, সেজন্য অনেকে পশুর মতো দড়ি দিয়ে বেধে নেয়। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে এদের লাশ বাড়িতে পৌঁছায় না, পরিবার-পরিজন অনেকে খবরও জানতে পারে না। অসুখে চিকিৎসা নেই। ঝাড়-ফুঁক, দোয়া-তাবিজই ভরসা। ফলাফল অকালেই কুকুর শেয়ালের মতো মৃত্যু। সন্তানদের লেখাপড়া, খেলাধুলা, আনন্দ এদের জীবনে দুঃস্বপ্নের মতো। থাকার ঘরটাকে ঘর বলা যায় না। ঝড়-বৃষ্টির দিনে সৃষ্টিকর্তাকে তাদের জপতে হয়।

শখ থাকলেও নতুন কাপড় পরনে জোটে না। বয়স্ক, শিশু যারা তাদের অনেকেই মোটা কাপড়ের অভাবে শীতে মারা যায়। অর্ধাহার, অপুষ্টিজনিত কারণে অল্প বয়সেই এরা বৃদ্ধ হয়। শরীর অচল হলে ভিক্ষাবৃত্তি এদের যেন নিয়তি। কেউ এদের দায়িত্ব নেয় না। না রাষ্ট্র, না সমাজ। এদের ছেলেমেয়েদের একশ জনের মধ্যে প্রায় সবাই রোগাক্রান্ত। পরিবার বলে বন্ধন নেই। স্ত্রী এক জায়গায় কাজ করে, মেয়েটা হয়তো কারও গৃহকর্মী, ছেলেটা চায়ের দোকানে আর নিজে হয়তো কোনো শহরে কাজ করে। সবাই বিচ্ছিন্ন। ঈদ-পূজা-পার্বনে তারা এক হতে পারে।

এই মানুষদের সংখ্যায় আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি। এদের শরীর-ঘামে-রক্তে দেশ, সমাজ, সভ্যতা টিকে থাকে। অথচ এদের কথা কেউ মনে করে না। এদের জীবনকে মানুষের জীবন বলা চলে না। অনিরাপদ, অনিশ্চিত অন্ধকারে ঢাকা। এদের সংখ্যা দেশে কত তার কোনো তালিকা নেই। নারী-পুরুষ মিলে এরাই দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী। দেশের বিদ্যমান ধনীর স্বার্থরক্ষাকারী ব্যবস্থা এদেরকে প্রতিদিন ছোবরা বানাচ্ছে।

সাম্যবাদ এপ্রিল ২০১৮

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments