Tuesday, April 23, 2024
Homeফিচাররোহিঙ্গা সংকট : জাতিগত নিপীড়ন, ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ ও গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি

রোহিঙ্গা সংকট : জাতিগত নিপীড়ন, ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ ও গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি

রোহিঙ্গা শরণার্থী

রোহিঙ্গা গণহত্যা ও তা থেকে উদ্ভূত সংকট নিয়ে আমাদের দেশে বিভিন্ন দিক থেকে আলোচনা চলছে। এত বিরাট সংখ্যার শরণার্থীর চাপে আমাদের দেশকে এর আগে পড়তে হয়নি। জাতিসংঘের হিসেবে এ পর্যন্ত পাঁচ লক্ষেরও বেশি রোহিঙ্গা এদেশে প্রবেশ করেছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা তাদের অভিজ্ঞতার যে ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছে, সেটা দেশ-বিদেশের পত্রপত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। ধারণা করা হয় মিয়ানমারে প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। পালিয়ে আসতে গিয়ে ট্রলার ও নৌকা ডুবে মারা গেছে প্রায় দেড়শত মানুষ। নাফ নদী দিয়ে এখনও ভেসে আসছে লাশ। স্বাভাবিকভাবেই রোহিঙ্গা সংকটের কারণ, এই জনগোষ্ঠীর ইতিহাস- এসব নিয়ে ব্যাপক মাত্রায় আলোচনা চলছে। টিভি ও প্রিন্ট মিডিয়ায় এসেছে অনেক রিপোর্ট। অনেক কথাই এখন শিক্ষিত-সচেতন মানুষের আজ জানা, তা নিয়ে তর্ক-বিতর্কও হচ্ছে ব্যাপক মাত্রায়।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
রোহিঙ্গারা বসবাস করে মিয়ানমারের পশ্চিম দিকে রাখাইন রাজ্যে। এর পূর্ব নাম ছিল আরাকান। দুটো বড় জনগোষ্ঠী এই রাজ্যে বাস করে — রাখাইন ও রোহিঙ্গা। আরও কিছু ছোট জনগোষ্ঠীও আছে, তবে খুব অল্প সংখ্যায়। বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন রাখাইন রাজ্যের উত্তরাংশে প্রধানত রোহিঙ্গারা বসবাস করে।

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদে রাখাইন জনগোষ্ঠীর লোকেরাও জড়িত। তবে মিয়ানমারের মূল জনগোষ্ঠী কিন্তু রাখাইন নয়। মূল জনগোষ্ঠীর নাম বর্মী বা বার্মান — এরা মূল জনসংখ্যার আশি শতাংশ। এরা ছাড়াও শান, কাচিন, কারেন, কায়ান প্রভৃতি জনগোষ্ঠী এখানে আছে। তাদের সবার সাথেই বর্মীদের একটা বিরোধ আছে। সেটার একটা কারণ আছে। সে বিষয়ে আমরা পরে আসব।

পুরো মিয়ানমার জুড়েই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এই মনোভাব আছে যে, তারা বাংলাদেশের লোক, মিয়ানমারের নাগরিক নয়। ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের সামরিক সরকার যে নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন করেছিল তাতে রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। সেই সংবিধানে নাগরিকের মানদন্ড নির্ধারণ করা হয়েছিল এইভাবে যে, যারা ১৮২৩ সালের আগে থেকে মিয়ানমারে বসবাস করে তারাই সে দেশের নাগরিক বলে গণ্য হবে। এরপরে যারা এসেছে তারা সে দেশের নাগরিক নয়। ১৮২৩ সালকে সীমা ধরার কারণ হলো ১৮২৪ সালে বৃটিশরা চট্টগ্রাম থেকে গিয়ে মিয়ানমারের একটি অংশ দখল করে। এই প্রবেশটা দু’দিক দিয়ে ঘটেছে। একদিকে চট্টগ্রাম দিয়ে সে এলাকার লোকেরা রাখাইনে গেছে। কারণ রাখাইন একটি সম্পদশালী রাজ্য। চাষের জমিও সেখানে সে সময় অনেক ছিল। স্থানীয় রাখাইনদের তুলনায় চট্টগ্রামের লোকেদের কৃষিকাজে দক্ষতাও ছিল বেশি। আবার কলকাতা থেকে সরাসরিও রেঙ্গুনে এসেছে অনেক লোক। তাদের মধ্যে শিক্ষিত লোকও ছিল। তারা সেখানে অফিস-আদালতে কাজ করত, ব্যবসা-বাণিজ্যও করত। শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে কলকাতা থেকে রেঙ্গুনে জাহাজ ভ্রমণের এক উপভোগ্য বর্ণনা আছে।

এখন একথা ঠিক যে, রোহিঙ্গারা চট্টগ্রামেরই লোক। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে চট্টগ্রামের মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতির সামঞ্জস্যও আছে। তবে এই যাওয়াটা ১৮২৩ সালের পরই ঘটেছে — একথাটা ঠিক নয়। এর আগেও অনেকেই এদিক থেকে গেছে। বসতি গড়েছে। ১৪৩০ সালের দিকে আরাকানের রাজা ছিলেন নারা মিখলা মিন স মন। তিনি পাশের রাজ্যের এক রাজা দ¦ারা উৎখাত হয়ে পালিয়ে চট্টগ্রামে আসেন। তখন বাংলার সুলতান ছিলেন জালালুদ্দিন মুহাম্মদ শাহ। তিনি মিখলাকে আশ্রয় দেন। পরে জালালুদ্দিনের সহায়তায় মিখলা তার রাজ্য ফিরে পান। শর্ত ছিল — আরাকান বাংলার করদ রাজ্য হিসেবে থাকবে। সেই সময় জালালুদ্দিনের অনেক সৈন্য, কর্মচারী ও বিভিন্ন পেশার লোক আরাকানে স্থায়ী হন। সরকারি বিভিন্ন কাজেও মিখলা কিছু লোককে যুক্ত করেন।

ফলে বোঝা যায়, যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। ১৭৯৯ সালে ইংরেজ গবেষক ফ্রান্সিস বুকাননের প্রতিবেদনেও আরাকানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির উপস্থিতির উল্লেখ আছে। আর যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেই সেটা ১৮২৩ সালের পর থেকে শুরু হয়েছে তাহলেও তো প্রায় দু’শ বছর হতে চলল। এতদিন ধরে কোন গোষ্ঠী একটা স্থানে বসবাস করলে তাকে হঠাৎ করে অভিবাসী আখ্যা দেয়া যায়না। নাগরিকত্ব আইনে এরকম ধারা আনা একেবারেই অবৈজ্ঞানিক। আধুনিক রাষ্ট্র ও তার সংবিধানে এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

রাখাইন ও বর্মীদের সাথে রোহিঙ্গাদের দ্বন্দ্বের আরও কিছু বাস্তবসম্মত ফ্যাক্টর আছে। প্রথমত, ১৮২৪ সালে ব্রিটিশরা মিয়ানমার দখল করার পর তারা ওই এলাকার বিভিন্ন কাজে রাখাইনদের থেকে রোহিঙ্গাদের গুরুত্ব বেশি দিত। সেটা স্থানীয় রাখাইনদের মনে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। রাখাইনরা রোহিঙ্গাদের ব্রিটিশদের অনুগত মনে করতো। আবার ব্রিটিশদের হাত থেকে জাপান ১৯৪২ সালে মিয়ানমার দখল করে নেয়। তখন জাপানের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ব্রিটিশরা রোহিঙ্গাদের মধ্যে সশস্ত্র গ্রুপ তৈরি করে। এরা জাপানীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। অথচ এদিকে দেশের স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জাপানিদের সাহায্য নিয়ে লড়াই করেছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অং সান সুকির বাবা অং সান। তিনি ছিলেন মিয়ানমারের জাতীয়তাবাদী নেতা। ফলে একদিকে অংসান আর অন্যদিকে রোহিঙ্গারা দাঁড়িয়ে গেল। কিন্তু কিছুদিন পর অং সান বুঝলেন যে, জাপানিরা মিয়ানমারের স্বাধীনতা দেবে না। তখন তিনি ব্রিটিশদের সাথে সমঝোতা চুক্তিতে আসেন। এদিকে রোহিঙ্গারা তো ব্রিটিশদের পক্ষেই ছিল। ১৯৪৫ সালে মিয়ানমার আবার ব্রিটিশদের হাতে আসে। ১৯৪৮ সালে স্বাধীন হয়।

দ্বিতীয়ত, ১৯৪৮ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ১৯৪৭ সালে যখন ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের কথাবার্তা চলছিল, তখন রোহিঙ্গা নেতারা ‘আরাকান মুসলিম লীগ’ গঠন করে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য চেষ্টা করেন। তারা তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্র সাথে দেখাও করেন। কিন্তু জিন্নাহ্ এ বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেননি। আর এও ঠিক দেশভাগের পরিকল্পনা হচ্ছিল অবিভক্ত ভারতবর্ষকে নিয়ে। সেখানে মিয়ানমার ছিল না। তাই হয়তো তাদের এ দাবি ততটা গুরুত্ব পায়নি মুসলিম লীগ নেতাদের কাছে।

তৃতীয়ত, মিয়ানমার স্বাধীন হওয়ার পর রোহিঙ্গাদের দেশের নাগরিক হিসেবে থাকতে কোনো বাধা ছিল না। পার্লামেন্টে তাদের প্রতিনিধিও ছিল। সব রকম অধিকারই তাদের ছিল। ১৯৫০ সালের দিকে কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গা ‘রোহিঙ্গা মুজাহিদিন ফোর্স’ গঠন করে আরাকানকে স্বাধীন করতে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে। যদিও তাদের এই আন্দোলন শক্তিশালী ছিল না। ‘রোহিঙ্গা মুজাহিদিন ফোর্স’ কিছুদিন ক্রিয়া করে একসময় স্তিমিত হয়ে পড়ে। ১৯৬১-৬২ সালের দিকে তারা সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আন্দোলন শুধু রোহিঙ্গারাই করেনি, এইরকম বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন মিয়ানমারের বিভিন্ন রাজ্যে এখনও আছে।

চতুর্থত, ১৯৬২ সালে সামরিক সরকার মিয়ানমারের ক্ষমতায় আসে। তারা এসেই রোহিঙ্গাদের দেশের জন্য হুমকি মনে করা শুরু করল। কারণ হিসেবে দেখালো যে, রোহিঙ্গাদের বসবাস সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায়, তারা আগেই পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হতে চেয়েছিল, স্বাধীনতার পরেও তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম অব্যাহত রাখে ইত্যাদি। এর সাথে তাদের সম্পর্কিত পূর্বের দৃষ্টিভঙ্গি তো ছিলই। রাখাইনদেরও রোহিঙ্গাদের প্রতি পূর্বের ক্ষোভ ছিল। এসবই তখন একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি ক্রমশ নাজুক হতে থাকে।

এইসকল বিষয়সমূহ ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছিল। রোহিঙ্গাদের প্রতি রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ক্রমেই বাড়তে থাকল। প্রথম সামরিক অভিযান পরিচালিত হলো ১৯৭৮ সালে। তখন প্রায় আড়াই লক্ষ রোহিঙ্গা এদেশে এসে আশ্রয় নেয়। ১৯৭৯ সালে এদের ফিরিয়ে নেয়া হয়। দ্বিতীয় অভিযান পরিচালিত হয় ১৯৯১ সালে। তখনও আরেক দফায় মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়। এভাবে থেমে থেমে এই সংকট চলছেই।

ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্য
মিয়ানমারের ঘটনায় পাশের দেশ হলেও চীন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। চীন একটি সাম্রাজ্যবাদী দেশ। কমিউনিজম ত্যাগ করার পর নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তার আগের সেই দায়বদ্ধতা নেই। চীনের এই এলাকাকে নিয়ে কিছু পরিকল্পনা আছে। রাখাইন বেশ সম্পদশালী রাজ্য। রাখাইন রাজ্যের অভ্যন্তরে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলে প্রচুর গ্যাস পাওয়া গেছে। এগুলো উত্তোলনের কাজ করছে ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়া। চীন রাখাইন থেকে চীনের কুনমিং পর্যন্ত গ্যাস ও তেলের পাইপলাইন স্থাপন করেছে। চীনের তেল ও গ্যাস পরিবহনের একমাত্র পথ হলো মালাক্কা প্রণালী দিয়ে। এই পথের চারপাশে সে সকল দেশ অবস্থিত তাদের সাথে চীনের সম্পর্ক ভাল নয়। এরা আমেরিকার অনুগত। কোনো কারণে সমস্যা শুরু হলে এই পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই চীনের একটা বিকল্প পথ দরকার। সেজন্য এই পথ তারা তৈরি করেছে।

ভারতেরও অর্থনৈতিক স্বার্থ এখানে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। ভারত গ্যাস উত্তোলন করছে। এখানে তেল পাবারও সম্ভাবনা আছে। আবার ভারত একটা ট্রানজিট চালু করছে মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে। সেটাও রাখাইনের উপর দিয়ে যাচ্ছে। এর নাম ‘কালাধন প্রজেক্ট’। ভারত এতে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এতে ভারতের হলদিয়া পোর্ট থেকে রাখাইনের সিতওয়া পোর্টে কালাধন নদী এসেছে। এটা মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে ভারতের মিজোরামের কাছে একটা পোর্টে মিলিত হচ্ছে। ‘সেভেন সিস্টার্স’ নিয়ে ভারত বরাবরই উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভৈরব-আখাউড়া-ত্রিপুরা হয়ে একটা ট্রানজিট তারা ইতিমধ্যেই তৈরি করেছে। এটা কখনও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেলে বিকল্প হিসেবে তারা যাতে অন্যটা ব্যবহার করতে পারে তার জন্য হলদিয়া থেকে মিজোরাম পর্যন্ত রাখাইনের ভেতর দিয়ে এই পথের  ব্যবস্থা করে রাখছে।

এখানে আমেরিকার অবস্থান খুবই মানবিক মনে হতে পারে। কারণ তারা এই হত্যাকান্ডের ব্যাপারে খুব সরব। বাস্তবে আমেরিকার ইতিহাস তা বলেনা। তাদের স্বার্থে লক্ষ লক্ষ লোককে তারা হত্যা করতে কখনও দ্বিধা করেনি, এখনও বিশ্বব্যাপী তারা হত্যাকা- চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাদের এই প্রতিক্রিয়া মূলত এ অঞ্চলে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার হিসেব-নিকেশকে কেন্দ্র করে। যাতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হওয়ার দোহাই দিয়ে এখানে তাদের হস্তক্ষেপের একটা সুযোগ তৈরি হয়।

আরও কিছু বিষয়
মিয়ানমারে বর্মীদের সাথে অন্য জাতিগোষ্ঠীর সংঘাত নতুন কিছু নয়। আমরা আগেই বলেছিলাম, রেঙ্গুনে প্রচুর ভারতীয়রা ঢুকেছে এককালে। সেখানকার বেশিরভাগ ব্যবসাই ছিল এদের দখলে। এতে রেঙ্গুনের মূল অধিবাসীরা গুরুত্ব হারায়। আবার ইংরেজরা বিভক্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ইচ্ছে করেই চাকুরি-ব্যবসা ইত্যাদিতে ভারতীয়দের ও তার সাথে অবর্মী জাতিগোষ্ঠীকে প্রাধান্য দিয়েছে। ফলে গোটা মিয়ানমারেই বর্মীদের সাথে অবর্মী অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব আছে। বেশ কিছু দাঙ্গা ও সংঘর্ষ এ সময়কালে ঘটছে। রাখাইনে তো রোহিঙ্গাদের সাথে রাখাইনদের দ্বন্দ্ব আছেই, আবার একইসাথে জাতীয় ক্ষেত্রে বর্মীদের সাথে তাদের দ্বন্দ্ব আছে অবর্মী বলে। আর অভিবাসী হিসেবে বের করে দেয়ার কথা এলে প্রথমে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারটা আসাই স্বাভাবিক, কারণ তাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতিই নেই।

আরেকটা ব্যাপার, মিয়ানমারের দেশ পরিচালনায় সেনাবাহিনীর বেশ বড় একটা প্রভাব আছে। পার্লামেন্টের এক তৃতীয়াংশ সিট সংরক্ষিত থাকে সেনাবাহিনীর জন্য। দেশ পরিচালনায় তাদের মতের বিশেষ গুরুত্ব আছে। এই সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে খুবই আক্রমণাত্মক। সেনাবাহিনী প্রধান সম্প্রতি রাখাইনের ঘটনার ব্যাপারে যে ভাষায় কথা বলেছেন, তাতে এটা পরিষ্কার বোঝা যায় যে, তিনি রোহিঙ্গাদের একেবারে নির্মূল করে দেয়ার পক্ষে। শোনা যাচ্ছে, রাখাইনে একটা অর্থনৈতিক অঞ্চল হতে যাচ্ছে। বেসামরিক লোকদের সামনে রাখলেও পেছনে সামরিক বাহিনীর লোকেরাই মূলত জড়িত। একটা অর্থনৈতিক অঞ্চল করতে হলে বিরাট সংখ্যক লোককে উচ্ছেদ করার প্রয়োজন পড়ে। সবদিক বিবেচনা করে তারা দেখেছেন যে, সেক্ষেত্রে রোহিঙ্গা নিধনই উত্তম!

কী কী বিষয় ভেবে দেখা জরুরি 

বাসদ (মার্কসবাদী)'র ত্রাণ তৎপরতা
বাসদ (মার্কসবাদী)’র ত্রাণ তৎপরতা

রোহিঙ্গাদের এই মানবিক বিপর্যয়ে দেশের মানুষ দারুণভাবে সাড়া দিয়েছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-পেশাজীবী সংগঠন সবাই এগিয়ে এসেছেন, ত্রাণ সংগ্রহ করেছেন, বিতরণ করেছেন। চিকিৎসকরা ছুটে গেছেন মেডিকেল ক্যাম্প পরিচালনা করতে। এ ব্যাপারটি খুবই আবেদন সৃষ্টিকারি। মানবিক বিপর্যয়ে যে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ায় এ ঘটনা আবারও তা প্রমাণ করলো।

আমাদের দল বাসদ (মার্কসবাদী)’র পক্ষ থেকে আমরা রোহিঙ্গাদের ত্রাণ কর্মসূচির জন্য মানুষের কাছে অর্থ সংগ্রহ করেছি। প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের রক্ষার তৎপরতা দেখিয়ে নোবেল পেতে চাইলেও তার পুলিশ বিভিন্ন জায়গায় আমাদের ত্রাণ সংগ্রহে বাধা দিয়েছে। প্রথম দফা ত্রাণ বিতরণ আমরা শেষ করেছি। দ্বিতীয় দফায় ত্রাণ বিতরণ ও চিকিৎসা সেবা দেয়া হবে। ওই এলাকায় আমাদের অগ্রবর্তী দল ইতিমধ্যে গেছে। বাস্তব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে আমাদের কিছু মূল্যায়ন আমরা পয়েন্ট আকারে তুলে ধরছি।

১. স্থানীয় মানুষেরা বেশ চিন্তিত, আর কয়েক বছর পর কি এখানে থাকা যাবে? কারণ টেকনাফ-উখিয়ার জনসংখ্যা হলো সাড়ে পাঁচ লাখ। আর নতুন পুরোনো রোহিঙ্গার সংখ্যা হলো ১০ লাখ, যা স্থানীয়দের থেকে দ্বিগুণ। এ বিশাল জনগোষ্ঠী যদি ফেরত না যায়, স্থানীয়রা কি টিকতে পারবে? ২. সংশ্লিষ্ট এলাকায় জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। ৩. রোহিঙ্গারা পেটের দায়ে খুবই সস্তায় শ্রম বিক্রি করছে। ফলে স্থানীয় লোকেরা কাজ পাচ্ছে না। ৪. ইউনিয়ন পরিষদ থেকে স্থানীয় গরীবরা যে সাহায্য পেত, তা এখন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ৫. রামুতে দেশের সব চেয়ে বড় ফানুস উৎসব হয় প্রতি বছর। এ বছর হয়নি। এক ধরনের আতংক কাজ করছে বৌদ্ধ মন্দির ও পল্লীগুলোতে। ২০১২ সালের রামু বৌদ্ধ মন্দির হামলার স্মৃতি এখনো তাদের ভাবায়। ৬. বেশিরভাগ স্বজনহারা অসহায় রোহিঙ্গা আজ নিদারুণ অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন। পরিস্থিতি খানিকটা স্বাভাবিক হলে তা প্রচ- আক্রোশে পরিণত হতে পারে। ৭. দেশের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক শক্তি এর মধ্যেই সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেয়া শুরু করেছে। এটি এই মুহূর্তে বন্ধ না করলে তা পরবর্তীতে ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এরই মধ্যে পার্বত্য এলাকায় এই রকম উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়েছে। অনেক আদিবাসী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ আতঙ্কে চট্টগ্রাম ছেড়ে নিজ নিজ এলাকায় চলে গেছেন। ৮. এইরকম অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও ইয়াবা পাচার থেমে নেই। বরং বর্তমানের এই অবস্থা ইয়াবা পাচারের জন্য আরো অনুকূল।

মানবিক বিবেচনার বর্তমান পর্যায়ে মানুষ সাহায্যের হাতই প্রধানত বাড়িয়ে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো কেউ মানবিক কারণে, কেউ তাদের নিজেদের এজেন্ডা নিয়ে হলেও মানুষকে ত্রাণ দিচ্ছে। কিন্তু স্থায়ী সমাধানের ব্যাপারে এদের বক্তব্য পরিষ্কার নয়। অন্যদিকে এ ব্যাপারে সরকারের নীতি ও কৌশল এখনো সুস্পষ্ট নয়। বরং এ ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টাতেই তারা তৎপর। এ অবস্থায় দুটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া জরুরি Ñ এক, আশ্রয় পরবর্তী পর্যায়ে দেশের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গা সমস্যাকে কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হবে? দুই, অতীত চুক্তিভঙ্গের অভিজ্ঞতার আলোকে মায়ানমার-বাংলাদেশ সম্পর্ক ও রোহিঙ্গা সমস্যাকে দুনিয়ার সামনে সরকার কীভাবে উপস্থাপন করবে?

জাতিগত সমস্যার বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধান পুঁজিবাদে নেই। জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক, যেকোন ধরনের পুঁজিবাদী শক্তির কথাই ধরি না কেন, তারা সুযোগের সন্ধানে থাকবে। এ থেকে যতটুকু ফায়দা তোলা যায়, তা তুলবে। তাই এখন শুধু মানবিক সাহায্য নয়, দরকার রাজনৈতিক সামাজিক ঐতিহাসিক কর্তব্য নির্ধারণ। যাতে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কেউ জনগণকে বিভ্রান্ত করতে না পারে।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments