Thursday, March 28, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - জুন-জুলাই ২০১৬শূন্যে নেমেও পথেই আছে এসইউসি — গৌতম রায়

শূন্যে নেমেও পথেই আছে এসইউসি — গৌতম রায়

সম্প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হয়ে গেলো। সেখানে বামপন্থী বলে পরিচিত সিপিআইএম ডানপন্থী কংগ্রেসের সাথে জোট গঠন করে নির্বাচনে অংশ নেয়। বামপন্থার মর্যাদা রক্ষায় ভারতের এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) পার্টি একক ভাবে এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। এই নির্বাচনে তারা কোন আসন পায়নি, যেখানে গত নির্বাচনেও তাদের একজন এম.এল.এ ছিলো। একটি বিপ্লবী দলের মূল লক্ষ্য নির্বাচনে জেতা নয়, বিপ্লব করা। আদর্শের গৌরববোধ কেমন থাকলে নির্বাচনে হেরে গিয়েও রাস্তায় মাথা ঊঁচু করে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে পারে- কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক আজকাল’ পত্রিকার ৬ জুনের এ রিপোর্টটি পড়লে বোঝা যাবে। কর্পোরেট হাউজের পত্রিকাও এ বিষয়টি না উল্লেখ করে পারেনি, কারণ পশ্চিমবঙ্গের লাখো-কোটি জনগণের চোখের সামনে এ একটি জ্বলজ্বলে সত্য ঘটনা। এ নির্বাচনে এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) সাড়ে তিনলক্ষ ভোট পেয়েছে। কোন ব্যাকিং ছাড়া, মানি পাওয়ার ছাড়া, পেশী শক্তির ব্যবহার ছাড়া সবরকম বাধা ও প্রলোভন অতিক্রম করে একজন একজন মানুষের দেয়া ভোট মিলে এ সংখ্যা। আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে আমাদের দলের কর্মী-সংগঠক-নেতা সর্বোপরি দেশের বামপন্থী মনোভাবাপন্ন মানুষের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে ভেবে আমরা এ রিপোর্টটি প্রকাশ করলাম।

973ba696xa3dex4

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৫২ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচনেও যে এসইউসি দলের জন্য বিধানসভার দরজা খুলে গিয়েছিল, জয়নগর কেন্দ্র থেকে জিতে ছিলেন সুবোধ ব্যানার্জি। ৭২-এও সিদ্ধার্থ রায়ের রিগিং নির্বাচনে মুর্শিদাবাদের হরিহর পাড়া থেকে জিতে বিধান সভার পাস পেয়েছিলেন দলের প্রার্থী। একবার তো তাদের সাতজন বিধায়ক ছিলেন। কিন্তু এবার ষোড়শ বিধানসভার দরজা একেবারে বন্ধ হয়ে গেলেও, কিছুমাত্র টলেনি এসইউসি’র মন। দুর্জয় ঘাঁটি কুলতলি, জয়নগরে হার হওয়ার পরে থমকে গিয়ে নিষ্কর্ম দুঃখশোক পালনের বদলে দলের নেতা কর্মীরা মেতে আছেন চিরাচরিত পার্টি কর্মসূচিতে। শ্যামবাজারে, হেদোরমোড়ে, ধর্মতলায়, গড়িয়াহাটে শিবদাস ঘোষের কোটেশন প্রদর্শন এবং কৌটো কালেকশন। গড়িয়া হাটলেকের সম্বৎসর নিস্ত রঙ্গ, মাপা ঢেউয়ের মতো সময় মেপে লেকে চলছে তরুণ বলশেভিক বিপ্লবী কমসোমলের রুটমার্চ। দিব্যি চলছে পার্টি কমিউনগুলিতে বহু এসইউসি দম্পতির সংসার। নিত্যদিন কর্মসূচিতে দুঃখশোকের সময় কোথা আবহমানকালের এসইউসি সমাজে। এবারের নির্বাচনে শেষ গড়েও শূন্য হয়ে গেছে জানার পর মুহূর্তের জন্যও কি দুঃখ পেয়েছিলেন প্রশ্নে অবাক হয়ে গত ২০১১ সাল পর্যন্ত জয়নগরের বিধায়ক দেবপ্রসাদ সরকারের জবাব, বিধানসভায় কোনও সিট পেল না জেনে বিপ্লবীর দুঃখ হবে কেন? তিনি তো জানেন লেনিন পার্লামেন্টকে কী নামে ডেকেছেন । ৯৯ বছর আগে লেনিন পার্লামেন্টকে যে ননপার্লামেন্টারিয়ান শব্দেই ডেকে থাকুন না কেন, সাত সাতবার সেই পার্লামেন্ট তথা বিধানসভার বিধায়ক দেবব্রতবাবুকে বিধান সভা কভার করা সাংবাদিক রাবি লক্ষণ জানেন মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পরা হার জিরজিরে, ঊনবিংশ শতকের ফ্যাক্টরি চারটিস্টদের মতো আজ কোন্ কোন্ দপ্তরে দাবি তথা স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন তার কপি এনে হাজির করতেন। এখন ৮২ বছর বয়স্ক, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা সম্পাদক, পার্টি অফিসবাসী দেব প্রসাদ বাবু জানান, শূন্য হওয়ার খবর শুনে দুঃখের সময় কোথায়, এত আনন্দের খবর আসতে লাগল, প্রচুর নতুন ভোট আর দক্ষিণ চব্বিশ পরগনাতেই দেড়হাজারের মতো নতুন কনট্যাক্ট, প্রায় সবটা সংশোধনবাদী দল সিপিএম, আরএসপি থেকে বিপ্লবী দল এসইউসিতে। বিধান সভায় শূন্য হয়ে গিয়ে এসইউসি’র কিন্তু এমন কোনও শপথ নেই যে সামনের নির্বাচনে এই দু’টি আসন পুনরুদ্ধার করে সাত আসনের রেকর্ড ভেঙে চোদ্দো হবে। তারপর ক্রমে ক্রমে পশ্চিমবঙ্গে এসইউসি সরকার হবে। দলের দিকটির দিকে দেখিয়ে রাজ্য সম্পাদক সৌমেন বসুও জানান, যতক্ষণ শাসকশ্রেণী নির্বাচন প্রক্রিয়া চালু রাখবে এসইউসি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে যাবে। কিন্তু তার উদ্দেশ্য অন্য পাতি বুর্জোয়া দলগুলোর মতো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল নয়। বরং নির্বাচনী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে এসইউসি’র বার্তা ছড়িয়ে দিয়ে বিপ্লবীদের দলে টেনে আনা। বিষয়টি আরও পরিষ্কার করে দিয়ে সৌমেন বাবু জানান, বিধায়কের সংখ্যা দিয়ে বিপ্লবী দলের বিচার হয় না। সিপিএম তো নিজেকে বিপ্লবী দল বলে, এতদিনে এত বিধায়ক পেল, বিপ্লব করতে পারল! বরং দিন দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে। আর এসইউসি বৈপ্লবিক এলিমেন্টের দিক থেকে বড় হচ্ছে, আমরা এই নির্বাচনে সিপিএম কংগ্রেসের দোসর হওয়ায় সেদল ছেড়ে চলে আসা প্রচুর নতুন কনট্যাক্ট পেয়েছি। এখন রাত দিন খেটে এঁদেরই বিপ্লবী দল এসইউসিতে টেনে আনাই প্রধান কাজ। তাঁদের খুঁজে বাড়ি গিয়ে আলাপ করে রাজ্য কমিটিতে রিপোর্ট করতে হবে। যে তৃণমূলের কাছে নির্বাচনে হেরে এসইউসি শূন্য হয়ে গেল তার ওপর কিন্তু রাগ খুব নেই। যত রাগ সিপিএমের ওপর? মিডিয়ার সঙ্গে মিলে সিপিএম যে আবার আসছি বলল সেই ভয়েতেই তৃণমূলের পালে হাওয়া লেগে গেল। এসইউসি তো সিপিএমকে ঠেকাতে পারবে না। জানান রাজ্য সম্পাদক সৌমেনবাবু।

ওই অঞ্চলেই সিপিএমের হাতে ১৬০ জন এসইউসি কর্মী খুন হয়েছেন, মিথ্যা মামলায় বিধায়কের জেল হয়েছে, এখনও ২৫ জন লাইফার (যাবজ্জীবন) খাটছেন। আর গত পাঁচবছরে তৃণমূলের সঙ্গে সংঘর্ষ? না তেমন সংঘর্ষ কিছু হয়নি। বিধায়ক সংখ্যা শূন্য হয়ে যাওয়ায় দুঃখের খোঁজ কিছু পাওয়া গেল উত্তর কলকাতার গণেন্দ্র মিত্র লেনের এসইউসি কমিউনে। সেখানকার আবাসিকদের মধ্যে যুব সংগঠন ডিওয়াইওর রাজ্য সম্পাদক নিরঞ্জন নস্কর ছিলেন কুলতলির দায়িত্বে। হারের পরদিনই ভোরবেলা তিনি রওনা দেন। হাজির হয়ে দেখেন সাধারণ সমর্থক ভোটার, মানে অপরীক্ষিত কমরেডরা একটু ভেঙে পড়েছেন। কিন্তু এসইউসি’র মতো বিপ্লবী পার্টির ভোটারদের হারে ভেঙে পড়তে নেই বোঝানোয় তাঁরা বুকে বল ফিরে পান। শূন্য আসনেও যে কত মনোবল তা বোঝাতে আর একজনের কথা বলছিলেন কমিউনের সবাই। সঞ্জিতবিশ্বাস, বিদ্যুৎ গ্রাহক সংগঠনের সংগ্রামী নেতা। রোগে ন্যুব্জ, হাসপাতালই যাঁর ঘরবাড়ি। অথচ আপনার বিদ্যুতের বিল যাতে আর না বাড়ে তার জন্য পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতি লড়া একজন স্ট্রিট ফাইটার। সংবাদপত্রের পাঠকমাত্রই তাঁকে সেভাবেই চেনেন। দলের অমন হারেও ভেঙে না পড়ে ফল প্রকাশের পরদিনই হবু মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে স্মারকলিপি দিয়ে এসেছেন।

সাম্যবাদ জুন-জুলাই ২০১৬

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments