Thursday, March 28, 2024
Homeঅনুশীলনসর্বগ্রাসী অক্টোপাসের কবলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বগ্রাসী অক্টোপাসের কবলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

ভূমিকা

‘ধীর বিষক্রিয়ায় মৃত্যু’ আর ‘তাৎক্ষণিক মৃত্যু’র মধ্যে পার্থক্য আছে। বিশাল মহীরুহ ধীর বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হলে বাইরে থেকে তার পরিবর্তন বোঝা যায় সামান্যই। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে ভিতর থেকে তার ক্ষয় হতে থাকে। একটা সময়ের পর বোঝা যায় বিষক্রিয়ার প্রভাব কতটা ভয়াবহ ছিল।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেই ধীর বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত। ‘UGC এর ২০ বছর মেয়াদী কৌশলপত্র’র প্রয়োগ আমাদের চোখের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়কে একটু একটু করে পরিবর্তন করেছে। গত ২০০৬ সালে বিশ্বব্যাংকের সুপারিশে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ‘উচ্চশিক্ষার কৌশলপত্র : ২০০৬-২০২৬ (Strategic Plan for Higher Education: 2006-2026)’ নামে একটি মহাপরিকল্পনা হাজির করে। এর ফলাফলে গত ১০ বছরে বদলে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কিছু। শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব কিংবা শিক্ষার মর্মবস্তু — সবই পাল্টে গেছে এবং পাল্টাচ্ছে ক্রমাগত। শিক্ষাধ্বংসের এই মহাপরিকল্পনা তৎকালীন সরকার ছাত্র তথা জনগণের সামনে আনেনি। তাই অনেকে মতামতও দিতে পারেনি। আমাদের সংগঠন কৌশলপত্র প্রকাশের পরপরই এর বিরোধিতা করে এবং ছাত্রসমাজের সামনে এ সম্পর্কিত বক্তব্য তুলে ধরে। দশ বছর আগে আমরা যেসব আশঙ্কার কথা তুলে ধরেছিলাম, আজ তা অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে।

উচ্চশিক্ষা নিয়ে যেমন শাসকদের পরিকল্পনা আছে, তেমনি শিক্ষার্থীদের দিক থেকে আছে প্রতিরোধ আন্দোলন। গত দশ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলন তার প্রমাণ। তবে উচ্চশিক্ষাকে পুরোপুরি ব্যবসায় পরিণত করতে শাসকেরা যতটা পরিকল্পিত, ছাত্রসমাজ ততটা সংগঠিত নয়। তাই ছাত্রসমাজের কাছে কৌশলপত্রের নানা দিক তুলে ধরা এবং গত ১০ বছরে কৌশলপত্রের নানা পরিকল্পনার বাস্তবায়ন নিয়ে এই পুস্তিকাটি প্রকাশ করা হলো। আমরা মনে করি, এই কৌশলপত্রের পরিকল্পনা যদি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়, তবে বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ‘পাবলিক’ চরিত্র বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। দেশের সিংহভাগ মানুষের শিক্ষার অধিকার মারাত্মকভাবে সংকুচিত হবে। তাই কৌশলপত্র বাতিলের লড়াই আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইও। এই বিশাল-বিস্তৃত লড়াইয়ে প্রয়োজন দেশের বেশিরভাগ ছাত্র-জনসাধারণকে যুক্ত করা। এক্ষেত্রে পুস্তিকাটি ভূমিকা রাখবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি।

শুভেচ্ছাসহ

নাঈমা খালেদ মনিকা, সভাপতি
স্নেহাদ্রি চক্রবর্ত্তী রিন্টু, সাধারণ সম্পাদক

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ২০ বছর মেয়াদী কৌশলপত্র বাস্তবায়নের এক দশক

সর্বগ্রাসী অক্টোপাসের কবলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়
Anushilon_Cover

কিছু শব্দগুচ্ছ আমাদের মধ্য থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। মূল্যবোধের সাথে যুক্ত শব্দগুলো আগে সাধারণ মানুষের মুখে প্রায়শই শোনা যেত। যেমন ধরুন, ‘মানুষের মত মানুষ’। শুনলেই মনে পড়ে যেত ‘মানুষ’ শব্দটার সাথে মর্যাদার প্রশ্নটা কী ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। ঠিক তেমনি আরেকটি শব্দগুচ্ছ হলো, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র’। কেমন হবে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র? এর উত্তর খুঁজতে হলে তাকাতে হবে বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে। এই ছাত্ররা ’৫২-তে লড়েছে, ’৬২-তে প্রাণ দিয়েছে, ’৬৯-এ আইয়ুব খানের পতন ঘটিয়েছে, ’৭১-এ দেশ স্বাধীন করেছে এবং ’৯০-তে স্বৈরশাসক এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। সেই সময়ে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র’ শুনলেই মানসপটে ভেসে ওঠত সমাজ সচেতন প্রতিবাদী তরুণের প্রতিচ্ছবি। বছরান্তে যারা বাড়ি ফিরলে বয়স্করাও তাদের ঘিরে বসত। সবাই শুনতে চাইত, দেশে কী চলছে। জানতে চাইত সমাজের গতিমুখ নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে।

এর সাথে প্রাসঙ্গিকভাবেই যে প্রশ্নটি চলে আসে তা হলো, বিশ্ববিদ্যালয় কেমন হলে দলে দলে এমন ছাত্র তৈরি হবে। বিশ্ববিদ্যালয়েরও কেমন হওয়া চাই। এ প্রসঙ্গে সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদের ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ সম্পর্কিত ধারণা স্মরণযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, “প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় লালন করে দ্বৈত আনুগত্য; তার আনুগত্য নিজের সমাজের প্রতি ও বিশ্বমানবের প্রতি। যে সমাজ পালন করছে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে, তার প্রতি যে বিশেষ কর্তব্য আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের, তা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। আপন সমাজের প্রতি দায়িত্বপালনের সুবিধার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়কে দিতে হয় এমন বিশেষ কিছু সুযোগ সুবিধা ও অধিকার যা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে দায়িত্ব পালন অসম্ভব। এমন বিশেষ অধিকার অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় নয়, কিন্তু একান্ত প্রয়োজনীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের। তাই বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রের অর্ন্তভুক্ত হয়েও এক স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। স্বতন্ত্র রাষ্ট্রত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের দোষ নয়, গুণ। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব রয়েছে সমস্ত সভ্যতা ও মানবম-লির প্রতিও। বাঙলা ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ শব্দটির আক্ষরিক তাৎপর্য অনুধাবনযোগ্য; এটি বিশ্বের বিদ্যালয়, এখানে চর্চা হয় বিশ্বজ্ঞান। জ্ঞানের বিচিত্র রূপ ও বহুমুখি বিকাশের এলাকা বিশ্ববিদ্যালয়।” এই দুই বড় আনুগত্যই বিশ্ববিদ্যালয়কে পথ দেখায়। এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের রাষ্ট্র কি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত এই ধারণাকে মেনে নিয়েছে? কোন নীতিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে চালানোর চেষ্টা করছে? আর এই পথ ধরে হাঁটলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিণতি অদূর ভবিষ্যতে কী হতে যাচ্ছে?

মঞ্জুরি কমিশনের ২০ বছর মেয়াদী কৌশলপত্র :
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে রাষ্ট্রের মহাপরিকল্পনা
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পর থেকেই এদেশের শিল্প, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা সবকিছুই পরিচালিত হয়েছে কোনো না কোনো নীতির ভিত্তিতে, সুনির্দিষ্ট শ্রেণিস্বার্থের ভিত্তিতে। এই ব্যবস্থায় কোনো কিছু চলছে মানেই হলো তার মধ্যে একটা নীতি কার্যকর আছে। তা সে লিখিত হোক, আর না হোক। তা সে প্রকাশিত হোক, আর না হোক। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা- কোনটিই এর ব্যতিক্রম নয়। স্বাধীনতার পর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল ২ শতাংশ। এখন বেসরকারি প্রাথমিক-মাধ্যমিক স্কুলই প্রধান ধারা। বাণিজ্যিকীকরণ তীব্রতর হয়েছে শিক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্রে। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা থেকে শুরু করে সকল পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস নিয়মিত ঘটনা। হাজার-লক্ষ টাকায় প্রশ্ন কেনা-বেচা হয় সরকারের নাকের ডগায়। সরকার অপরাধীদের ধরে না। এরকম সমস্ত ঘটনাই ঘটছে কোনো না কোনো নীতির প্রতিফলন হিসাবে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরিচালনা করার জন্য সরকার ২০০৬ সালে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ‘উচ্চশিক্ষার কৌশলপত্র : ২০০৬-২০২৬ (Strategic Plan for Higher Education: 2006-2026)’ নামে একটি মহাপরিকল্পনা হাজির করে। ব্যাপারটি এমন নয় যে, এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ে সরকারের কোনো পরিকল্পনা ছিল না। বরং এই কৌশলপত্রের মাধ্যমে সরকার অতীতের সাথে সঙ্গতি রেখে সুনির্দিষ্টভাবে এবং দীর্ঘমেয়াদী একটি পরিকল্পনা তুলে ধরেছে। এখন পর্যন্ত এই পরিকল্পনা অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হচ্ছে। আমাদের আলোচ্য নিবন্ধ এই পরিকল্পনাগুলোকে নানাদিক থেকে ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্যে লিখিত হয়েছে। নীচে কৌশলপত্রের চুম্বক অংশগুলো তুলে ধরছি। কৌশলপত্র ইংরেজিতে লিখিত হলেও পাঠের সুবিধার্থে বাংলায় অনুবাদ করে দেওয়া হয়েছে।

  • ১. সরকার আগামী ২০ বছরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ব্যয়ের ক্ষেত্রে তার বরাদ্দের অংশ ৯০% থেকে কমিয়ে ৭০% এ হ্রাস করার পরিকল্পনা করতে পারে। ২.অর্থায়নের শূণ্যতা হ্রাস করার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অর্থের উৎস তৈরি করা উচিত। ৩. বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে টিউশন ও ছাত্রঋণের প্রকল্প প্রবর্তন করতে হবে। (P:3, c.1)
  • অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধির কয়েকটি খাতের মধ্যে রয়েছে- ছাত্র বেতন বৃদ্ধি, আবাসন ও ডাইনিং চার্জ বৃদ্ধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থাপনা ভাড়া দেওয়া, ক্যাফেটেরিয়া ভাড়া, কনসালটেন্সি সার্ভিস, বিশ্ববিদ্যালয় বীমা ইত্যাদি। (P: 31, B.2.8.4) ।
  • চাকুরি বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ছাত্রসংখ্যা, বিষয়বস্তু এবং সিলেবাস নির্ধারিত হবে এবং এর উপর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট নির্ভর করবে। (P 31,2,8,3)
  • ঐতিহাসিকভাবে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে মানবিক ও প্রকৃতি বিজ্ঞান পড়ানো হয় তার সঙ্গে বর্তমান চাকুরি বাজার বা বাস্তব জীবন ধারণের সম্পর্ক খুবই কম। ইতিমধ্যে গত কয়েক বছরের জ্ঞান বিজ্ঞানের শাখায় অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। (P,15 A 3.3.3.3)
  • স্থানীয় ও বৈশ্বিক চাহিদাসমূহ পূরণের লক্ষ্যে ব্যবহারিক জ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং ব্যবসায় ও বাণিজ্যের মতো বিষয়গুলিতে ছাত্র সংযোগ বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে। (P:15 A 3.3.3.)
  • প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, এ থেকে বোঝা যায় কিছু সংখ্যক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সম্ভাবনাময়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বাড়লে পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়বে, ফলে শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটবে। (P.32. B.2.10)
  • আবসিক হলের ব্যবস্থা ছাত্রদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়। (কৌশলপত্রের Executive Summary)
  • বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটের মতো বিভিন্ন প্রশাসনিক কাঠামোতে প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে ও উপাচার্য নিয়োগের ভূমিকা রাখার মধ্যে দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবে। (P.22)
  • ডীন এবং প্রভোস্ট পদমর্যাদার ব্যক্তিদের মধ্য থেকে পর্যায়ক্রমে উপাচার্য সিনেট ও সিন্ডিকেটদের মনোনয়ন দিবেন। (P.22)
  • মঞ্জুরি কমিশনকে ‘উচ্চশিক্ষা কমিশন’ নামে নামকরণ করা যেতে পারে। এটা কমিশনকে একটি ভালো ভাবমূর্তি দিবে এবং কর্তৃত্ব ও ভূমিকাকে শক্তিশালী করবে।” (P.22)

প্রথমে যে বিষয়টি বলে রাখা প্রয়োজন তা হলো, এই ২০ বছর মেয়াদী পরিকল্পনা আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষার সংকটসমূহ দূর করার প্রয়োজনে দেশের শিক্ষাবিদ-শিক্ষার্থী-অভিভাবকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজনের নিরিখে ঠিক করা হয়নি। ১৪ ডিসেম্বর ’০৪ -তে দৈনিক ইনকিলাবের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি ক্রিস্টিন আই ওয়ালিকের নেতৃত্বে ৪ সদস্যের ওয়ার্কিং গ্রুপের সাথে তৎকালীন বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট পরিচালিত সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ড. এম ওসমান ফারুক কয়েক দফা বৈঠক করেন। বৈঠকগুলোতে তিনি আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে ১০ বছরের জন্য একটি কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে প্রয়োজনীয় আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা চান। ২২ এপ্রিল ’০৫-এ ‘দৈনিক আমাদের সময়’র রিপোর্টে বলা হয়েছে, “বিশ্বব্যাংক দেশের উচ্চশিক্ষার কৌশলগত পুনর্বিন্যাসের লক্ষ্যে ১ শ’ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আর্থিক সহযোগিতা দেবার ঘোষণা দিয়েছে, যা দিয়ে কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে।”

স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যে, বিশ্বব্যাংকের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য পরামর্শ চাইবার কারণ কী? আর এই কৌশলপত্র বাস্তবায়ন হলে বিশ্বব্যাংকেরই বা লাভ কী? এই সম্পর্কে আমাদের ব্যাখ্যা পরে তুলে ধরবো। প্রথমে আমরা দেখি যে, বিগত ১০ বছরে এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন কতদূর হয়েছে এবং এর ফলাফলটা ঠিক কেমন।

কৌশলপত্র অনুসারে গত ১০ বছরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে
ছাত্র বেতন-ফি বেড়েছে বিপুল হারে
উপরের আলোচনায় আমরা দেখিয়েছিলাম, ইউজিসি’র ২০ বছর মেয়াদী কৌশলপত্রে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা নিয়ে কী কী প্রস্তাবনা আছে। আসলে এগুলো প্রস্তাবনা নয়, পরিকল্পনা। যাকে কার্যকর করেছে ২০০৬ সাল থেকে ক্ষমতায় আসা প্রতিটি সরকার। গত ১০ বছরে উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করলে সেটা বোঝা যাবে। আসুন, প্রথমেই দেখি উচ্চশিক্ষায় ছাত্রদের উপর ফি এর বোঝা কতটা বেড়েছে? দেশের প্রধান কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি-বৃদ্ধির চিত্র নিম্নরূপ—

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৪-০৫ সেশনে কলা ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, বাণিজ্য অনুষদ, বিজ্ঞান অনুষদ আইইআর-এ প্রথম বর্ষে ভর্তি ফি ছিল যথাক্রমে ৩১৮৫ টাকা, ৪১৮১ টাকা, ৩২৭০ টাকা, ২৫৫০ টাকা। এখন এসে তা দাঁড়িয়েছে বিভাগ ও হল ভেদে ১০-১১ হাজার টাকা থেকে ১৮-১৯ হাজার টাকা। এমনকি টেলিভিশন ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি বিভাগে ৪ বছরের অনার্স কোর্সের ফি নির্ধারিত হয়েছে ১ লক্ষ ৩৭ হাজার টাকা।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১১ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮২৫ টাকা। ২০১২ সালে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৬২১৪ টাকা। সেমিস্টার ফি করা হয়েছে ১২০০ টাকা। ফরম ফিলআপ ফি ৩০০ টাকা থেকে ১৭৮০ টাকা করা হয়েছে। ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি ফরমের মূল্য ৬০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০০ টাকা করা হয়েছে। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি ফি ২৫,৫০০ টাকা। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ফি ১৫,৫৬০ টাকা। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৮ সালে ভর্তি ফি ছিল ৪৫০০ টাকা। বর্তমানে ৫০০০ টাকা বৃদ্ধি করে ৯৫০০ টাকা করা হয়েছে।

কৌশলপত্র অনুসারে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বছর বছর বাড়ছে অভ্যন্তরীণ আয়ের লক্ষ্যমাত্রা। অভ্যন্তরীণ আয় কথাটার অর্থ হলো বিশ্ববিদ্যালয় যতটুকুু নিজে উপার্জন করতে পারে। প্রতি বছর অভ্যন্তরীণ আয় বাড়ানোর অর্থ হলো, রাষ্ট্র বরাদ্দ কমাবে এবং অন্য কোনো উপায়ে বিশ্ববিদ্যালয় টাকা আনবে। কৌশলপত্র অনুসারে এ উপার্জনের পথগুলো হলো ছাত্র বেতন বৃদ্ধি, আবাসন ও ডাইনিং চার্জ বৃদ্ধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থাপনা ভাড়া দেওয়া, ক্যাফেটেরিয়া ভাড়া, কনসালটেন্সি সার্ভিস, বিশ্ববিদ্যালয় বীমা ইত্যাদি (P31,2,8,3)। উদাহরণ হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছক-১ এ দেয়া হলো।

17886737_1012103382252886_932519575_o

অর্থাৎ, প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে এবং সর্বশেষ ২০১৬-১৭ তে এর পরিমাণ এসে দাঁড়িয়েছে ৪১ কোটি টাকায়।

এই অভ্যন্তরীণ আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্যই প্রতিবছর বাড়ছে ছাত্র বেতন, বাড়ছে আবাসন, পরিবহনসহ অন্যান্য ফি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থাপনা বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেয়া হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুধুমাত্র জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্রদের জন্য বিভিন্ন ফি কীভাবে বাড়ানো হয়েছে তা ছক-২ এ তুলে ধরা হলো-

17949983_1012103418919549_1156864452_o
অর্থাৎ, প্রতি বছর নতুন নতুন খাত যুক্ত হচ্ছে আর পুরানো খাতগুলোতেও টাকা নেওয়া হচ্ছে কোনটার দ্বিগুণ, কোনটার তিনগুণ।

এতো গেল শুধু আবাসন বাবদ বর্ধিত ফি-এর চিত্র। আরও আছে। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি খাতেই রয়েছে এরকম ফি বৃদ্ধির চিত্র। তারপরও শাসকগোষ্ঠীর ধ্বজাধারীরা অন্ধের মতো বলেই যাচ্ছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ২০ টাকায় পড়াশোনা করে! সর্বশেষ গত ৩০ মার্চ ’১৭ অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছে আগামী অর্থবছর থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে বেতন ৫ গুণ বাড়ানো হবে। অর্থাৎ এত ফি বৃদ্ধির পরেও তারা সন্তুষ্ট নয়, ভবিষ্যতে আরও বাড়াবে।

প্রতি বছর রাষ্ট্রের মোট বাজেটের তুলনায় উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দ আনুপাতিক হারে কমছে। এবারের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটও ইতিহাসের সর্ববৃহৎ, প্রায় ৪১৫ লাখ কোটি টাকা। তারপরও ৫ গুণ ছাত্রবেতন বাড়ানোর প্রস্তাবনা আছে, বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের নিজস্ব আয় বাড়ানোর উপদেশ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এই ফি বৃদ্ধির ফলাফল কী? সাদা চোখে দেখলেও সবাই বুঝবে, এই ফি বৃদ্ধি ছাত্রদের পক্ষে শিক্ষাগ্রহণের পথে বাধাস্বরূপ। এখন শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাওয়াটাই তো বড় কথা নয়। নিম্নবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা কোনো ছাত্র সামাজিকভাবে অপদস্থ হয়ে, ধার-দেনা করে কিংবা জমিজমা বিক্রি করে কিংবা ঋণগ্রস্ত হয়ে ভর্তি ফি-এর ধাক্কাটা হয়তো সামলে নেয়। তারপরও তার সামনে দীর্ঘ পথ বাকি থাকে। প্রতিবার সেমিস্টার ফি, পরীক্ষার ফি কীভাবে জোগাড় হবে তা অধিকাংশ ছাত্রদেরই তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। ফলে দু-তিনটা টিউশন করা নয়তো কোচিং-এ ক্লাস নেয়া অথবা খন্ডকালীন চাকুরি করতে হয়। টাকা জোগাড়ের এই মানসিক চাপের পাশাপাশি হলের নিম্নমানের খাবার খেয়ে আর গণরুমে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থেকে পড়াশুনায় মনোযোগ দেয়া কঠিন।

যারা ফি বৃদ্ধির পক্ষে যুক্তি করে, তাদের অনেকেই বলেন যে, সবকিছুর দাম বাড়ছে, তাহলে উচ্চশিক্ষার খরচ বাড়বে না কেন? প্রশ্ন হলো- শিক্ষা কি বাজারের পণ্য হওয়া উচিত? শিক্ষা মানুষের জন্মগত অধিকার। অন্য দশটা ক্ষেত্রে জীবনযাপনের ব্যয় বেড়েছে বলেই তো ছাত্রদের পড়াশুনার খরচ আরও কমানো প্রয়োজন। থাকা, খাওয়া, দৈনন্দিন খরচে যদি একজন ছাত্রের ৫০০০ টাকার উপরে চলে যায়, তাহলে আমাদের মতো দেশের কয়টি পরিবার তা দিতে সক্ষম? দেশের কর্তা-ব্যক্তিরা কি তা ভেবে দেখেছেন? আর আজ যারা ফি বৃদ্ধির পক্ষে যুক্তি করছেন, তাদের অনেকেই হয়তো উচ্চশিক্ষার দোরগোড়া পর্যন্ত আসতেই পারতেন না, যদি রাষ্ট্র সেই দায়িত্ব না নিত। আজ তারাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তারাই বড় আমলা। তারাই ছাত্রদের কাঁধে কীভাবে অতিরিক্ত ফি-এর বোঝা চাপানো যায় সেই পরিকল্পনা করছে।

কৌশলপত্র যেভাবে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ কমিয়ে দিয়ে ছাত্রদের বেতন বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে, তারই বাস্তবায়ন করছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

বাণিজ্যিক নাইট কোর্স চালু করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে
সবার এখন জানা যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এখন দিনে এক চরিত্র, রাতে আরেক চরিত্র। দিনের বেলা সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নিয়মিত’ ছাত্ররা পড়ে। আর সন্ধ্যা বেলা সেখানে বাইরের ছাত্ররা বেশি টাকা দিয়ে পড়ে একটা সার্টিফিকেটের জন্য। যেটাকে বলা হয় নাইট কোর্স বা ইভিনিং কোর্স বা উইকেন্ড কোর্স ইত্যাদি। কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করার প্রয়োজন থেকে, কেউ চাকুরিতে পদোন্নতির জন্য, কেউ স্ট্যাটাস রক্ষার জন্য এই কোর্সগুলোতে ভর্তি হয়। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রয়োজনীয় গভীর বিষয়ের পরিবর্তে আসলে এখানে পড়ানো হয় চাকুরিমুখী টেকনিক্যাল কোর্স। কৌশলপত্রের পরামর্শ অনুযায়ী, বাংলাদেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নাইটকোর্স চালু হয়েছে গত ১০ বছরে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি, সরকার ও রাজনীতি, অর্থনীতি, ভূগোল ও পরিবেশ, IBA, IIE, BBA, CSE বিভাগে উইকেন্ড কোর্স চালু আছে। সকল বিভাগেই উইকেন্ড কোর্স খোলার নীতিগত সিদ্ধান্ত একাডেমিক কাউন্সিলে পাশ হয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অনুষদ, বিবিএ, অর্থনীতি বিভাগে বাণিজ্যিক নাইটকোর্স চালু আছে। অন্যান্য বিভাগে নাইটকোর্স চালুর ব্যাপারে তৎপরতা চলছে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫টি অনুষদের ৩২টি বিভাগে ও ৬টি ইনস্টিটিউটে বাণিজ্যিক নাইটকোর্স/প্রফেশনাল কোর্স চালু রয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩টির বেশি বিভাগে বাণিজ্যিক নাইটকোর্স চালু হয়েছে। প্রথমদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এরকম কোর্স চালু যেরকম দৃষ্টিকটু ছিল এখন আর তা নেই। বরং শিক্ষকদের মধ্যে কে কীভাবে ক্লাস নিয়ে অতিরিক্ত অর্থ আয়ের পথ করবেন তার জন্য রয়েছে কাড়াকাড়ি। নাইটকোর্সের পক্ষে শিক্ষকদের মুখে যুক্তিও শোনা যায়। যুক্তিগুলো এরকম-

  • নাইটকোর্স চালুর মাধ্যমে অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবে। এর মাধ্যমে শিক্ষার প্রসার ঘটবে।
  • বিভাগ পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রীয় অর্থ বরাদ্দের ঘাটতি নাইটকোর্সের মাধ্যমে পূরণ করা যাবে। নাইটকোর্স বা ডিপ্লোমা কোর্স চালু হলে বিভাগের কিছু উন্নতি হবে। বিশেষত টাইলস লাগানো, রুম সজ্জা, এসি লাগানো যাবে।
  • শিক্ষকদের বেতন পর্যাপ্ত নয়। তাই অনেকেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেন। যদি নিজস্ব ক্যাম্পাসেই কোর্স খুলে পয়সা আয় করা যায় তাহলে তো আর শিক্ষকদের বাইরে যেতে হবে না।
  • বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল অবকাঠামো বিকেলের পর পড়ে থাকে। এটাকে কাজে লাগিয়ে বিভাগ বা শিক্ষকদের দু’পয়সা আয় হলে মন্দ কী? ইত্যাদি ইত্যাদি…

উচ্চশিক্ষায় আসনসংকট নিরসন, বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ বৃদ্ধি কিংবা শিক্ষকদের সর্বোচ্চ সামাজিক মর্যাদা ও বেতনের দাবিতে আমাদের সংগঠনসহ প্রগতিশীল সংগঠনসমূহ অতীত দিন থেকে লড়াই করেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। কিন্তু কোনটিরই সমাধান নাইটকোর্স হতে পারে না। শিক্ষাবিস্তারই যদি নাইটকোর্সের উদ্দেশ্য হয় তবে কোর্সগুলোতে এত বিপুল অংকের ফি রাখার কী প্রয়োজন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইভিনিং এমবিএ করতে এখন খরচ লাগে ২ লক্ষ ৬৪ হাজার টাকা। এত টাকা দেবার সামর্থ্য কোন স্তরের শিক্ষার্থীদের আছে তা বলাই বাহুল্য।

বিভাগের উন্নয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন থেকে পৃথক কিছু না। বিভাগের উন্নয়নের জন্য যা অর্থের প্রয়োজন, তা বিশ্ববিদ্যালয় দেবে। আর বিশ্ববিদ্যালয়কে অর্থ দেবে রাষ্ট্র। মানুষের সামষ্টিক সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান সূত্রবদ্ধ ও তত্ত্বায়িত হয়ে সংরক্ষিত হয়েছে বইয়ে। জ্ঞান গড়ে ওঠে সামাজিক প্রয়োজনে। আর সমাজের প্রয়োজন মেটানোর প্রচেষ্টাতে জ্ঞান বিকশিত হয়। তাই নিছক ব্যক্তিগত প্রয়োজনে জ্ঞানকে কাজে লাগানো নৈতিক হয় না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন তেমনটাই ঘটছে। শিক্ষকরা ডিগ্রি বিক্রি করছেন। তাছাড়া শিক্ষা ব্যয়বহুল হলে ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকলের প্রবেশের অধিকার থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয় একটি ২৪ ঘন্টার প্রতিষ্ঠান। এখানকার শিক্ষক মানে তিনি শুধু ক্লাস নিয়ে চলে যাবেন- ব্যাপারটি মোটেও তা নয়। তাঁর ক্লাসের প্রস্তুতি, গবেষণা, ছাত্রদের সাথে যুক্ত হবার জন্য সময় প্রয়োজন। সেটি না করে অর্থের পিছনে ছুটলে স্বচ্ছলতা হয়তো আসে, বিভাগও হয়তো বাহ্যিকভাবে কিছুটা দৃষ্টিনন্দন হয় কিন্তু সামগ্রিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে যায়।

একই কথা অবকাঠামো পড়ে থাকার যুক্তির ক্ষেত্রেও সত্যি। যদি এটি সত্যিকারের গবেষণা প্রতিষ্ঠান হয় তবে তা কখনও এক বেলার প্রতিষ্ঠান হতে পারে না। এর কার্যক্রম কেবল কিছু ক্লাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। এখানে প্রত্যেকটি বিভাগে বিস্তর জ্ঞান চর্চা ও অর্জনের সুযোগ থাকা প্রয়োজন। সামগ্রিকভাবে মনুষ্যত্বের বিকাশের জন্য শুধু প্রযুক্তির কিছু বিষয় নয়, বিজ্ঞান-ইতিহাস-সাহিত্য-দর্শন-চারুকলা-নাট্যকলা সমস্ত ক্ষেত্রেই সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি প্রয়োজন। আর জ্ঞান কি কেবল বই এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ? এর জন্য নানা Co-curricular activities-এরও আয়োজন থাকতে হয়। ছাত্র-শিক্ষকের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ারও খুব প্রয়োজন। এভাবে একজন শিক্ষার্থীকে আলোকিত-বিকশিত মানুষ হবার আয়োজন করতে গেলে কি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো পড়ে থাকার কোনো সুযোগ থাকে? বাংলাদেশের জাতীয় সংসদও বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে ফাঁকা পড়ে থাকে, সচিবালয়ও অফিস সময়ের পর ব্যবহার করা হয় না। ফাঁকা পড়ে থাকে বলে কি সেখানে কোনো কোম্পানির আউটসোর্সিং-এর ব্যবসা চলতে পারে?

ট্রেনিং দেয়াই যদি উদ্দেশ্য হয়, তাহলে সরকার প্রয়োজনীয় ট্রেনিং ইনস্টিটিউট খুলতে পারে। কিন্তু একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তো এই ধরনের কোর্স চলতে পারে না, তাও আবার বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে। এ ধরনের কোর্স চালু হওয়ার অর্থ হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের সুনামকে ব্যবহার করে সার্টিফিকেট বিক্রির ব্যবসা ফেঁদে বসা। উচ্চতর জ্ঞানচর্চার সাথে যার কোনধরনের সম্পর্ক নেই। আর এই বন্ধ্যা সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যখন গবেষণা নেই, সাংস্কৃতিক কোনো আলোড়ন নেই, নৈতিক অবস্থানের কোনো বহিঃপ্রকাশ নেই, চিন্তার ক্ষেত্রে নতুন কোনো সংযোজন নেই; তখন এই ধরনের কোর্স খোলার জন্য এত তৎপরতা এটাই প্রমাণ করে যে, কর্তাব্যক্তিদের চিন্তা যতটা শিক্ষা নিয়ে, তার চেয়ে ঢের বেশি অর্থযোগ নিয়ে। ফলশ্রুতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুণগত মান পড়ে যাচ্ছে।

ছাত্রদের বাস্তব কিছু অভিজ্ঞতা দেখা যাক। কথা হচ্ছিল জগন্নাথ বিশ্বদ্যিালয়ের আইন অনুষদের একজন শিক্ষার্থীর সাথে। সে তার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলল, একদিন ক্লাসে এক ম্যাডাম এসে বললেন তিনি খুবই ক্লান্ত। কারণ তাঁকে আগের দিন সকাল-বিকাল ক্লাস নিতে হয়েছে। ফলে তিনি আজ আর ক্লাস নিতে পারবেন না। শুধু ছাত্রদের হাজিরা নিয়ে তিনি ক্লাস শেষ করেন। আর একজন শিক্ষার্থী তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘একদিন ক্লাসে গরমের কারণে এসি চালিয়েছিলাম। একজন শিক্ষক এসে বললেন, এই এসি কিনতে তোমরা কত টাকা দিয়েছো যে যখন তখন এসি চালিয়ে বসে থাকো।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদে নাইট কোর্স চালু থাকায় ছাত্রদের নিয়মিত শিক্ষকদের তিরস্কার শুনতে হয় যে, তারা কম টাকায় পড়ে। এভাবে নাইটকোর্স ছাত্র-শিক্ষকদের সম্পর্কেরও ক্রমাগত অবনতি ঘটাচ্ছে।

অবকাঠামোর বাণিজ্যিক ব্যবহার ভুলিয়ে দিচ্ছে যে বিশ্ববিদ্যালয়টা আসলে কাদের
উচ্চশিক্ষার কৌশলপত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয়ের উৎস হিসেবে বিভিন্ন স্থাপনা, ক্যাফেটেরিয়া ভাড়া দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এ কয়েক বছরেই অবকাঠামোর বাণিজ্যিক ব্যবহার ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের খেলার মাঠ দিনপ্রতি এক লক্ষ টাকায় ভাড়া দেয়া হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠ, জিমনেশিয়াম, ডরমেটরি, কনফারেন্স রুম, টিএসসি ইত্যাদি ভাড়া দেয়া হয়। বিভিন্ন একাডেমিক ভবনে ও হলের ছাদে মোবাইল কোম্পানির টাওয়ার, বিভিন্ন মোড়ে বিজ্ঞাপনী কোম্পানির বিলবোর্ড, বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা ব্যক্তিমালিকানাধীন দোকানের জন্য ভাড়া দেয়া হচ্ছে। কী পণ্যের জন্য, কী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবে, তার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ- এসবের কোনো বিচার-বিবেচনা নেই, টাকা দিলেই যে কেউ এই অবকাঠামো ভাড়া পেতে পারবে। ছক ৩ এ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কী কী স্থাপনা ভাড়া পাওয়া যায় তার চিত্র তুলে ধরা হলো-

17949880_1012103458919545_355704460_o

ভাড়া দেওয়ার হিড়িক দেখলে মনে হবে যে টিএসসি, অডিটোরিয়াম, জিমনেসিয়াম কিংবা খেলার মাঠ – কোনটাই ছাত্রদের জন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। অথচ সবারই জানা আছে, ছাত্র-শিক্ষক পারস্পরিক বিনিময়ের জন্য ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র প্রয়োজন, হলগুলোর সাথে খেলাধুলার জন্য বড় মাঠ প্রয়োজন। হলের সাথে বড় পুকুর প্রয়োজন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য মঞ্চ প্রয়োজন। আলোচনা সভা, সেমিনারের জন্য হলরুম প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা, খেলাধুলা প্রভৃতি সম্পর্কের চর্চার জন্য আগত অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা করতে ডরমেটরি প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক চর্চা আর মতপ্রকাশের জন্য সভাস্থল প্রয়োজন। এর সবই প্রয়োজন ছাত্রদের জন্য, উচ্চশিক্ষার জন্য। এই প্রয়োজন খ-কালীন বা সাময়িক নয়, সার্বক্ষণিক প্রয়োজন। অধিকাংশ ছাত্ররা যদি এসব চর্চার মধ্যে থাকে তাহলে যে অবকাঠামো আছে তাই অপ্রতুল। কারণ অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু অবকাঠামো সেই তুলনায় বাড়েনি। আর তাই ছাত্রদের যথাযথ সুযোগ দিলে অবকাঠামোর বাণিজ্যিক ব্যবহারের সুযোগই নেই।

ছাত্রদের অধিকার সংকুচিত করেই অবকাঠামো ভাড়া দিচ্ছে প্রশাসন। ছাত্রদের জন্য আয়োজনগুলো প্রায় শূণ্যের কোঠায় নিয়ে এসেছে। অবকাঠামোর উপর ভাড়া বাড়িয়ে ছাত্রদের ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। আরেকটি বিষয় হলো, অবকাঠামো ভাড়া দেওয়ার কারণে ক্যাম্পাসে কোন ধরনের সাংস্কৃতিক প্রভাব তৈরি হচ্ছে? কারণ, বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলোর উদ্দেশ্য স্রেফ ব্যবসা করা। সেটা ভোগবাদকে উসকে দিয়ে হোক, নারীদেহ প্রদর্শন করে হোক কিংবা পণ্য সম্পর্কে মিথ্যাচার করে হোক! বিশ্ববিদ্যালয়ও কি সেই স্রোতে গা ভাসাতে পারে? তাহলে ক্লাসরুমে আর পাঠ্যবইতে যে বড় বড় জ্ঞানের বিষয় থাকে তার কি কোনো অর্থ থাকে? উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলীর একটি বিজ্ঞাপন শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে বোঝাবে যে ফর্সা গায়ের রংই নারীজাতির একমাত্র ব্রত হওয়া উচিত। এখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ কি বোঝায় না যে, মেয়েদের প্রকৃত মর্যাদা গায়ের রঙ এ নয়? সমাজবিজ্ঞনের অধ্যাপকেরা কি আলোচনা করেন না সমাজ বিকাশে মেয়েদের ভূমিকা কী? গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ কি বর্ণনা করে না, এই ধরনের বিজ্ঞাপন সমাজে কোনধরনের চিন্তাকে ছড়াচ্ছে? এরপরও যখন বিশ্ববিদ্যালয় এই রকমের বিজ্ঞাপনের সুযোগ করে দেয় তখন শিক্ষার প্রকৃত তাৎপর্য আর থাকে না। বরং শিক্ষার্থীরা শেখে বাজারে ভোগের জন্য কত কত পণ্য রয়েছে। এভাবেই কৌশলপত্রের বাস্তবায়ন শিক্ষা ও সংস্কৃতির অপূরণীয় ক্ষতি করছে।

ugc 2 copy
১২মে ২০০৯ এ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়

পিপিপি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধা এবং সৃজনশীলতাকে ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিচ্ছে
ইউজিসি’র কৌশলপত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অনুপ্রবেশের প্রস্তাবনা দিয়েছিল। গত ১০ বছরে তার ব্যাপক বাস্তবায়ন ঘটেছে। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) তারই একটি অংশ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাণিজ্যিক কোম্পানির অনুপ্রবেশ এখন খুবই সাধারণ ব্যাপার। রাষ্ট্র দাবি করে যে দেশের জিডিপি বেড়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাদ্দ বেড়েছে, অথচ অনেক সামান্য বিষয়ের জন্যও বিভাগগুলোর যেন কোম্পানির সহযোগিতা ছাড়া চলে না। বড় বড় সেমিনার হল, ল্যাব, ক্যান্টিন তো বটেই কোনো বিভাগের হয়তো বিশুদ্ধ পানির ফিল্টার লাগবে, কিংবা পিকনিক হবে, হলের গেইট লাগবে, গেইট এ লাইট লাগবে সেটার জন্যও কোনো না কোনো বাণিজ্যিক কোম্পানির নাম এবং লোগো ব্যবহার করতে হবে — পরিস্থিতি এখন এতটাই নাজুক। শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন কোন কোম্পনির সাথে সম্পর্ক তা এক নজরে দেখলে এটাই মনে হবে যে, এটা কি বিশ্ববিদ্যালয় নাকি বিজ্ঞাপনের বাজার!

  • COLORCON কোম্পানির আর্থিক সহায়তায় ফার্মেসি অনুষদে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ট্যাবলেট কোটিং ল্যাবরেটরি স্থাপন। অ্যারিস্টোফার্মা লিমিটেডের অর্থায়নে ৮ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ফার্মেসি অনুষদে MICROPLATE READER নির্মাণ।
  • প্রাইম ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংকের অর্থায়নে উন্নয়ন অর্থায়ন বিভাগে কম্পিউটার স্থাপন ও ইন্টারনেট সংযোগ চালু।
  • ভূতত্ত্ব বিভাগে CDMP এর অর্থায়নে ইঞ্জিনিয়ারিং জিওলজি ল্যাব ও SCHLUMBERGER অর্থায়নে জিএনজি ল্যাব স্থাপন এবং প্রিমিয়াম মিনারেলস্’র অর্থায়নে পিউম চেম্বার স্থাপন।
  • সেন্টার অব এক্সিলেন্স ভবন নির্মাণের জন্য ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ১০ কোটি টাকা অনুদান।
  • ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে ‘গ্রামীণফোন ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ল্যাব’ স্থাপন।
  • জিওলজি বিভাগের ল্যাবরেটরি নির্মাণে শেভরন কোম্পানির অর্থায়ন।
  • ফার্মেসি অনুষদে বিকন কোম্পানির অর্থায়ন।
  • ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে আকিজ গ্রুপের ফুডকোর্ট নির্মাণ।
  • ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে ‘রবি’র আর্থিক সহায়তায় ‘বিদ্যানহর’ ঝরনা এবং ‘ই-লাইব্রেরি’ স্থাপন।
  • ‘মুক্তি ও গণতন্ত্র’ তোরণ নির্মাণে এনসিসি ব্যাংকের অর্থায়ন।
  • ন্যাশনাল পলিমার ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিঃ এর সহায়তায় শামসুন নাহার হলের স্পট লাইট স্থাপন, ওয়াই-ফাই জোন, ৮টি সিসি ক্যামেরা স্থাপন, ফটো কর্নার নির্মাণ, বারান্দার সৌন্দর্যবৃদ্ধি, রিডিং রুম নির্মাণ।

সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মেঘনা গ্রুপ ২টি বাস ও ২টি মাইক্রোবাস দিয়েছে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে লাফার্জ সুরমার অর্থায়নে মুক্তমঞ্চ, ওয়াজেদ আলি ফাউন্ডেশন-এর অর্থায়নে আইআইসিটি ভবন নির্মিত হয়েছে। বাকৃবিতে আমেরিকান ডেইরি লিমিটেড (এডিএল) ও বাকৃবি’র মধ্যে এক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এডিএল বাংলাদেশের গবাদি পশুর কৌলিন মান উন্নয়নে জেনেটিক মানের কাজ শুরু করেছে। এই কাজে কারিগরি সহায়তাসহ গবেষণা কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে বাকৃবি’র বিজ্ঞানীদের সঙ্গে একত্রে কাজ করার জন্য চুক্তিটি করা হয়। [প্রথম আলো ১৫ ডিসেম্বর’ ১৬]

এখন দেখা যাক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্পোরেট পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটলে এর ফলাফলটা কী? বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনিয়োগের উদ্দেশ্য থাকে পণ্যের প্রচার এবং মুনাফা উপার্জন করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম-ডাকের সাথে কোম্পানির নাম জড়ানো একটি সুনামের ব্যাপার। পাশাপাশি রয়েছে দীর্ঘমেয়াদী লাভ। ছাত্রদের সামান্য সুবিধা দিলে তাদের সাথে কোম্পানির একাত্মতা গড়ে ওঠে। ছাত্ররা তাদের ভোক্তা এবং পণ্য বিক্রির বড় বাজার। কিছু কোম্পানি, কিছু বিভাগের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা শেষের আগেই চাকুরির সুযোগ করে দেয়। (যেমন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ, ফার্মেসি বিভাগ) ক্যাম্পাসে কোম্পানি যেমন প্রচারণা চালায়, তেমনি ছাত্রদের বিভিন্নভাবে কাজে লাগায়। যেমন : বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতা করে ব্যবসার জন্য নতুন পরিকল্পনা বের করে আনে, ছাত্রদের দিয়ে বিজ্ঞাপনের আইডিয়া খুঁজে বের করে, বিজ্ঞাপনে অভিনয় করায়, বিউটি কনটেস্ট আয়োজন করে, রিয়ালিটি শো করে ইত্যাদি। এগুলো যখন চলে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক প্রয়োজনে জ্ঞানচর্চার জায়গাটা আর থাকে না। কোম্পানির ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয় মানুষ তৈরি করাই কাজ হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় যুক্ত হয়ে যায়।

ধীরে ধীরে ব্যাপারগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের উপর হস্তক্ষেপের পর্যায়ে চলে যায়। যার স্পষ্ট ইঙ্গিত কৌশলপত্রেও বিদ্যমান। যেমন সেখানে উল্লেখ আছে, গবেষণার বিষয়বস্তু নির্ধারণ করবে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বা গবেষণাকে বাজারমুখী হতে হবে (P 31,2,8,3 এবং P,15, A 3.3.3)। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের স্বাধীনভাবে গবেষণার পথ বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কোন কোন বিভাগে কী পড়ানো হবে তার পরামর্শ দেয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহ। কৌশলপত্রে বারবার বাজারমুখী বিষয় পড়ানোর কথা বলা হয়েছে, গবেষণাকে বাজারমুখী করার কথা বলা হয়েছে। অথচ বাজারমুখী হলেই সেটা সমাজের জন্য কল্যাণকর হবে এমন কোনো কথা নেই। মাদক, নারী আর অস্ত্র ব্যবসা ব্যাপক মুনাফা তৈরি করতে পারলেও সমাজের জন্য তা কল্যাণকর কিছু নয়। উল্টোদিকে শিল্প-সাহিত্য-গান-দর্শন-ইতিহাসের চর্চা বাজারের প্রয়োজন না হলেও মানুষের মানবিক বিকাশের জন্য ভীষণ প্রয়োজন।

শুধু বাজারের প্রয়োজন দেখলে কী পরিণতি হয় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ land-grant এর অর্ন্তভুক্ত আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ। food and water watch কর্তৃক প্রকাশিত public research private gain: corporate influence over university agricultural research জার্নালে উঠে এসেছে। এখানে উল্লেখ আছে, আমেরিকাতে এই বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বীজের উন্নয়ন, গাছপালার বৈচিত্র্য, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতের কৌশল, সংরক্ষণের পদ্ধতি, চাষবাসপদ্ধতি উন্নয়নসহ নানা বিষয়ে গবেষণা হয়। পুরো আমেরিকা জুড়ে কৃষিখাতে এক ধরনের বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন ঘটতে থাকে। তখন রাষ্ট্রীয় বরাদ্দে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত কার্যক্রম পরিচালিত হত। এরপর ১৯৮০ সালে Bayh-Dole Act পাশ হয়। এই আইনের মাধ্যমে শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে বিনিয়োগের সুযোগ করে দেয়া হয়, এই গবেষণার পেটেন্ট শিল্পপ্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ কমিয়ে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ বাড়ার সাথে সাথে গবেষণার বিষয়বস্তুতে পরিবর্তন ঘটতে থাকে। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী গবেষণাকর্ম ব্যবহার হতে থাকে। এমনকি স্পন্সরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী গবেষণার ফলাফল, বিষবয়স্তু, পদ্ধতিসমূহ তৈরি হতে থাকে। যেমন, National Soft Drink Association এর সহযোগিতায় পরিচালিত গবেষণার ফলাফল এমন আসল যে, কোমল পানীয় গ্রহণের সাথে স্কুলের বাচ্চাদের স্থূলতা বৃদ্ধির কোনো সম্পর্ক নেই। Egg Nutrition Center এর অর্থায়নে পরিচালিত গবেষণা এই সিদ্ধান্তে আসল যে, অতিরিক্ত ডিম খেলে রক্তে কলেস্টরেলের পরিমাণ বাড়ে না। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগকে ‘Mars’ নামের একটি ক্যান্ডি কোম্পানি ১৫ মিলিয়নের চেয়ে বেশি ডলার দিয়ে কোকো এর পুষ্টিগুণ এবং চকোলেট খাওয়ার সুফল নিয়ে গবেষণা করিয়েছিল। এছাড়া অনেক গবেষণা শিল্প প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের পরিপূরক না হওয়ার কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।(https://www.foodandwaterwatch.org/sites/default/files/Public%20Research%20Private%20Gain%20Report%20April%202012.pdf)
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্পোরেট পুঁজির অনুপ্রবেশ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে ও গবেষককে কোথায় দাঁড় করায় – এ তারই উদাহরণ। আজ আমাদের দেশেও কোনো একটা সিমেন্ট কেম্পানির জন্য ‘বুয়েট কর্তৃক পরীক্ষিত’ কিংবা খাবারের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের স্বীকৃতি একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে উঠেছে। ফলে এই সস্তা বাজারমুখীনতার পথে হাঁটলে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমেয়!

10714588_10152918788789451_3484668078522529766_o copy
শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ সংকোচনের প্রতিবাদে লন্ডনে ছাত্রবিক্ষোভ

HEQEP : একদিকে ঋণের বোঝা আরেকদিকে গবেষণায় হস্তক্ষেপ
বাংলাদেশ সরকার এবং বিশ্বব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে HEQEP (Higher Education Quality Enhancement Project) অর্থাৎ উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প চালু করা হয়েছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে UGC কে। উচ্চশিক্ষার ২০ বছর মেয়াদী কৌশলপত্র বাস্তবায়ন করতেই HEQEP চালু করা হয়েছে। HEQEP এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে-

  1. উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠদান ও গবেষণার পরিবেশের মান ও সঙ্গতি রক্ষা করা।
  2. উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামর্থ্য বৃদ্ধি করা। ৩টি উপায়ে এ সামর্থ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে-
    ক.প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় উভয়ের জন্য তহবিল ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি গ্রহণে সহায়তা করা।
    খ. বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সামর্থ্য বৃদ্ধি করা।
    গ. বিশ্বের জ্ঞানভান্ডারে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি করা।
  3. প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং।

১৭ মার্চ ২০০৯ বিশ্বব্যাংকের এক প্রেস রিলিজে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়ন ও বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে HEQEP- এর মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের বরাদ্দ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ৬১ শতাংশ শিক্ষা ও গবেষণার মান বৃদ্ধি, ৩০ শতাংশ ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং এবং বাকি ৯ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সামর্থ্য বৃদ্ধির কাজে এবং ০.৭৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জ বাবদ ব্যয় হবে। এ প্রকল্পের অধীনে সকল কার্যক্রম বিশ্বব্যাংকের নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর গবেষণাকে কতটা প্রভাবমুক্ত রাখা দরকার তা আসলেই অনুধাবনের বিষয়। রাষ্ট্র যাতে বিশ্ববিদ্যালয়কে পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেয়। কিন্তু কোনো রকমের প্রভাব খাটাতে না পারে সে কারণেই মঞ্জুরি কমিশনের সৃষ্টি। আর সেখানে বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানকে ডেকে আনা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় ব্যাপারে নাক গলানোর জন্য। বিশ্বব্যাংক স্পষ্ট করেই বলেছে, উচ্চশিক্ষাকে এমন জায়গায় নিতে হবে যাতে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি হয়, যাতে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান এখান থেকে বিনিয়োগের মাধ্যমে লাভ তুলে নিতে পারে। শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা দুনিয়ায় বিশ্বব্যাংক এই কাজ করে। তাদের প্রধানত তিনটি লক্ষ্য- LPG (Libaralisation, Privatisation, Globalisation) অর্থাৎ উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ ও বিশ্বায়ন। বিশ্বব্যাংকের এই নীতির কারণে যেসব দেশ তাদের কাছ থেকে ঋণ নেয়, ঋণের শর্তই থাকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ কমানো। এতে লাভ হয় পুঁজিপতিদের। নয়া উদারনীতিকরণের মূল কথাই হচ্ছে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সমস্ত মৌলিক অধিকারকে বাজারের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি সমস্ত দেশে অনুপ্রবেশ করতে পারবে। নয়া উদারিকরণের এই নীতির কারণেই ১৯৯০ সালের পর থেকে এই বাণিজ্যিকীকরণ ব্যাপকতা পেয়েছে। বিশ্বব্যাংকসহ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের হস্তক্ষেপ বেড়েছে। কিন্তু এই হস্তক্ষেপ সাধারণ মানুষের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনেনি। আমাদের দেশে বিশ্বব্যাংকের সুপারিশে রাষ্ট্রীয় পাটকল আদমজী বন্ধ হয়েছে। এর ফলে বহু বেসরকারি কোম্পানি পাটজাত পণ্যের বদলে অন্যান্য পণ্য মানুষের কাছে বিক্রির সুযোগ পেয়েছে। একই ঘটনা এখন ঘটছে দেশের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে। আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, বিশ্বব্যাংক HEQEP- এর মাধ্যমে যে টাকা দিচ্ছে তা ঋণ হিসেবে পাওয়া। পুরো টাকাটাই শোধ দিতে হবে। অর্থাৎ ঋণটা দেশের সাধারণ মানুষের কাঁধেই চাপবে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, তারপরও কি এই ঋণ থেকে ভালো কিছু উঠে আসতে পারে না? কেননা গবেষণার জন্য তো রাষ্ট্র বরাদ্দ করছে না। হেকেপের টাকায় যদি ভালো কিছু হয় তো খারাপ কী? আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই যে, এভাবে ভালো কিছু হওয়া সম্ভব নয়, ভালো কিছু হচ্ছেও না। তা বিগত সময়ে প্রকল্পের অগ্রগতি দেখলেই বোঝা সম্ভব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে দুই দফায় ১৭টি প্রকল্প নিয়ে ‘HEQEP’ র যাত্রা শুরু। মোট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২৪ কোটি ৫২ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা। ইংরেজি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, উদ্ভিদবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিভাগে হেকেপ প্রকল্প চালু রয়েছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ৪ কোটি ৩৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। লক্ষ্য ছিল পুরো বিশ্ববিদ্যালয় অটোমেশন করা, একটি আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স ল্যাব চালু করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ডিজিটালাইজড করা এবং পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে বেশি গতি সম্পন্ন ইন্টারনেটের আওতায় আনা। কিন্তু এর কোনোটিই হয়নি। শুধুমাত্র কয়েকটি শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তাদের নিয়ে কিছু ওয়ার্কশপ হয়েছে, ৭ দিন ব্যাপি ফ্রি ট্রেনিংয়ের আয়োজন করা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান কিছু গবেষণার বিষয়বস্তু হচ্ছে নিম্নরূপ-

  • Modernization of class and conference rooms by using latest tools and techniques.
  • Basic campus network sub project.
  • Professional skill development of Psychology graduate.
  • DU campus television.
  • An evaluation of monetary policy in Bangladesh.
  • Digitization of handwritten manuscripts, old newspapers and rare collection of Dhaka University.

শিরোনামগুলো দেখলেই বোঝা যায়, গবেষণার বিষয়বস্তু কতটা গভীরতাসম্পন্ন! সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ এজেন্ডার সাথে মিল রেখে কারিগরি কিছু বিষয় ছাড়া এর মধ্যে মৌলিক গবেষণা বলে কিছু নেই। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, মাইক্রোবায়োলজিসহ কয়েকটি বিভাগে হেকেপ- চালু রয়েছে। উল্লেখ করার মতো যা হয়েছে তা হলো কয়েকটি সেমিনার করা, রুমে এসি লাগানো, ল্যাবের যন্ত্রপাতি কেনা, চেয়ার কেনা, পর্দা কেনা ইত্যাদি।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকগুলো ধাপে হেকেপ এর টাকা এসেছে। প্রথম ধাপে আসা টাকা ৪-৫ টি প্রজেক্টে ব্যয় হয়েছে এবং বর্তমানে কয়েকটি প্রজেক্টের কাজ হচ্ছে। প্রজেক্টগুলোর টাকা কীভাবে ব্যয় করা হচ্ছে তার হিসাব দেখলে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। উদাহরণ হিসাবে একটি প্রজেক্টের হিসাব দেয়া হলো-

Enhancement of teaching and learning
মোট বরাদ্দ : ১ কোটি।
ব্যয় : ল্যাবের কিছু কেমিক্যালস, একটা ক্লাশরুমের চেয়ার/টেবিল, একটা ক্লাশরুমের জন্য এসি, একটি ক্লাশরুম এবং অফিস রুম রং করা এবং পর্দা লাগানো, কয়েকটি সেমিনার।

এর জন্য খরচ হয়ে যাচ্ছে ১ কোটি টাকা! তা মনিটরিং এর জন্য ব্যয় হবে লাখ লাখ টাকা! এর নাম গবেষণা? উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন? সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাপার হলো, এই কাঁচা টাকা শিক্ষকদের নৈতিকতাকে ধসিয়ে দিচ্ছে। প্রজেক্ট পাওয়া না পাওয়া নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যেও রেষারেষি তৈরি হচ্ছে। একাডেমিক কাউন্সিলেও হেক্যাপ-এর টাকা কোথায় কীভাবে ব্যয় হচ্ছে তা নিয়ে আলোচনা হয়না, ফলে কোনো জবাবদিহিতা নেই। কোন বিভাগ প্রজেক্ট পাবে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলছে। কতটা নোংরামি হতে পারে তার প্রমাণ পাওয়া গেল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগে নাইটকোর্স ও হেক্যাপের টাকা ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে রেষারেষিতে বন্ধ ছিল একাডেমিক কার্যক্রম। (২২ মার্চ, বাংলানিউজ টুয়েন্টিফোর ডট কম) আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, নতুন এসি, ল্যাব বা ক্লাসরুমের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নতুন ব্যয়ের খাত তৈরি করা হচ্ছে। যা ছাত্রদের কাছ থেকেই আদায় করা হবে। এতে করে ছাত্রদের দুর্ভোগ ক্রমাগত বাড়বে।

বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে ও চাকরি বাজারের চাহিদা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নতুন বিভাগ খোলা হচ্ছে
কৌশলপত্রের প্রস্তাবনার সাথে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নতুন বিভাগ খোলা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ৭ বছরে ১৫টি বিভাগ ও ২টি ইনস্টিটিউট চালু হয়েছে, খোলার অপেক্ষায় আছে ২টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউট। এছাড়া ৩টি ভাষা শিক্ষা কোর্সসহ ৪টি বিভাগে চালু হয়েছে স্নাতক। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি বিভাগের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও এই সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৯ সাল থেকে চালু করা নতুন বিভাগগুলোর মধ্যে রয়েছে ফলিত গণিত, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র অধ্যয়ন বিভাগ, অপরাধবিজ্ঞান, যোগাযোগ বৈকল্য, মুদ্রণ ও প্রকাশনাবিদ্যা, এডুকেশন এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি, নিউক্লিয়ার প্রকৌশল, রোবোটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং, অর্গানাইজেশন স্ট্র্যাটেজি এন্ড লিটারশিপ, ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি ইনস্টিটিউট এবং লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাংকিং ও ইন্স্যুরেন্স, আইন অনুষদের অধীনে আইন ও ভূমি প্রশাসন, শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান, চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ চালু হয়েছে। এছাড়া পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান প্রযুক্তি, ব্যবসা ও বাণিজ্য আইন, আন্তর্জাতিক ও তুলনামূলক আইন, ব্যক্তি আইন ও সমাজ, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, পর্যটন ও আতিথেয়তা ব্যবস্থাপনা বিভাগ খোলার অপেক্ষায় রয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হওয়া বিভাগসমূহের মধ্যে ব্যাংকিং ও ইন্স্যুরেন্স বিভাগ, ফলিত ও পরিবেশ রসায়ন, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ, ফার্মেসি বিভাগ, ফলিত পদার্থ ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং ও ফিজিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড স্পোটর্স সায়েন্স বিভাগ চালু হয়েছে।

নতুন নতুন বিভাগ খোলার চিত্র দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না এখানে মৌলিক বিষয় উপেক্ষিত হয়েছে। প্রযুক্তিগত বিষয়বস্তুর প্রসার ঘটছে। কৌশলপত্রের মূল বক্তব্য হচ্ছে বাজার উপযোগী বিষয়বস্তু নির্ধারণ করতে হবে। কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হতে হবে (p 31,2,8,3)। সেই মতো করেই নতুন নতুন বিষয়গুলো পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আরেকটি উদ্দেশ্যও এখানে আছে। বাস্তবে শিক্ষাব্যবসায়ীরা বিশ্বব্যাপী One Window Education System গড়ে তুলতে চায়। যেখানে ব্যবসা উপযোগী বিষয়বস্তুরই কেবল পাঠ দেয়া হবে, প্রতিষ্ঠান চালানোর মতো দক্ষ একদল কর্মচারি তৈরি করা যাবে, কীভাবে মুনাফা বহুগুণ বৃদ্ধি করা যায় তারই নতুন নতুন ধারণা দেয়া হবে।

মৌলিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর গভীর জ্ঞান এবং গবেষণা ছাড়া শুধু প্রযুক্তি শিক্ষার উপর বিশেষ জোর বিষয়বস্তুর সামগ্রিক ধারণা আনবে না। এতে মানুষের কাজ চালানোর মতো দক্ষতা তৈরি হতে পারে, কিন্তু প্রযুক্তির পিছনের বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলো থেকে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হবে। এই জ্ঞান সামান্য পরিস্থিতি পাল্টে গেলে যেমন অকার্যকর হয়ে পড়ে, তেমনি ভাসাভাসা খন্ডিত দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে। শিক্ষা সম্পর্কিত এ ধারণাকে বিরোধিতা করেছেন অনেকেই। যেমন মহান বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছেন, “একজন মানুষকে কোনো বিদ্যায় বিশেষত্বের শিক্ষা দেওয়াটাই যথেষ্ট নয়। এর ফলে সে একটি প্রয়োজনীয় যন্ত্রে পরিণত হতে পারে কিন্তু কখনোই পরিপূর্ণ বিকশিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে পারে না। মূল্যবোধ সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা এবং জীবনানুগ উপলব্ধি অর্জন করা ছাত্রদের পক্ষে অপরিহার্য। যা কিছু সুন্দর এবং নৈতিক দিক থেকে শুভ সে সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট উপলদ্ধি তাকে অবশ্যই গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে তার বিশেষত্বের জ্ঞান নিয়ে সে একটি সুশিক্ষিত কুকুরের মতোই বেড়ে উঠবে, সম্পূর্ণ বিকশিত মানুষ হিসেবে নয়।

প্রসঙ্গত আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। বেশিরভাগ বিভাগে পর্যাপ্ত আয়োজন ছাড়াই খোলা হয়েছে। অধিকাংশ বিভাগেই শিক্ষাদানের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষক, বই, গবেষণাগার নেই। যেসব শিক্ষার্থী প্রবল প্রতিযোগিতার মধ্যে এই বিষয়গুলোতে সুযোগ পেয়েছে, প্রশাসনের এই দায়িত্বহীনতা শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতারণার শামিল।

Cartoon_Anushilon
শিক্ষাব্যবসার প্রবল জোয়ারে ভুলিয়ে দেয়া হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক ভূমিকা
সমাজের প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় কেমন ভূমিকা রাখতে পারে- তার কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। ছোট্ট দেশ কিউবাতে ১৯৫১ সালে বিপ্লবের পরে মার্কিন অবরোধের কারণে যখন রাসায়নিক সার আসা বন্ধ হলো তখন জৈব সার নিয়ে গবেষণার ফলাফল কিউবার কৃষিতে অভূতপূর্ব সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। সব গবেষণাই সমান ফলাফল নিয়ে আসবে ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। কিস্তু কোনো একটা গবেষণা এমন হবে যে একলাফে অনেকদূর দেশ তথা মানবসমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সর্বোপরি, শিক্ষা মানে যদি নৈতিকতা ও দক্ষতা হয়, উচ্চশিক্ষা মানে উচ্চতর নৈতিকতা ও দক্ষতা। যেকোন শিক্ষাবঞ্চিত মানুষের থেকে সমাজে তার ভূমিকা রাখার ক্ষমতা অনেকগুণ বেশি। এই উচ্চশিক্ষিত মানুষদের সমাজে ঠিক মতো কাজে লাগাতে পারলে এরাই হতে পারে সমাজ অগ্রগতির মূল চালিকা শক্তি। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায় সোভিয়েত ইউনিয়নে। বিখ্যাত আমেরিকান সাংবাদিক আনা লুই স্ট্রং তাঁর ‘স্ট্যালিন যুগ’ বইটিতে লিখেছিলেন নতুন সমাজ গড়ায় নিয়োজিত মানুষদের সংগ্রামের কথা। তাঁর বর্ণনায় উঠে এসেছে যে, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কীভাবে এই সংগ্রামের সাথে যুক্ত করা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন গবেষণা চলছিল পাহাড় থেকে ধাতু উত্তোলন এবং তার ব্যবহার নিয়ে। সেই ছাত্ররাই আবার সপ্তাহে দু’দিন চলে যেত শিক্ষাবঞ্চিত কৃষক-শ্রমিকদের মাঝে। তাদের দুঃখ-দুর্দশাকে স্বচক্ষে অবলোকন করত এবং কাটানোর উদ্যোগ নিত। সমাজের এই পিছিয়ে পড়া মানুষদের মধ্যে জমে থাকা হাজার বছরের কুসংস্কার দূর করার চেষ্টা করত। শ্রমিকদের পরিশ্রম দেখে শিক্ষার্থীরা নিজেরা অনুপ্রাণিত হত, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ হত। উল্লেখ্য যে, কী প্রকৃতি বিজ্ঞানে কী সমাজবিজ্ঞানে গবেষণাতে শীর্ষে ছিল তখন সোভেয়েত ইউনিয়ন। এই রাষ্ট্র বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পেরেছিল সর্বোচ্চভাবে।

বিশ্ববিদ্যালয়কে সমাজের কাজে লাগানোর এত সম্ভাবনা, তবুও আমাদের দেশে সর্বদা এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে পঙ্গু করে রাখার আয়োজন চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বরাদ্দ দিতে রাষ্ট্রের কত কার্পণ্য! ফি বৃদ্ধি, নাইটকোর্স, পিপিপি, হেক্যাপ ইত্যাদির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক চরিত্রকে ভূলুণ্ঠিত করছে। ধাপে ধাপে তার উচ্চশিক্ষার দায়িত্ব থেকে সরে আসছে। বরাদ্দ কমিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে হলেও টাকা উপার্জনের পথ খুঁজে নিতে বলছে। অথচ, দুনীর্তি আর লুটপাটেই ধনীদের কাছে কুক্ষিগত হচ্ছে সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত কোটি কোটি টাকা। ২০১০ সালে সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে লোপাট হলো ৩৮৬৮ কোটি টাকা। শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারিতে ক্ষতি হলো ২ লাখ কোটি টাকারও বেশি। বিসমিল্লাহ গ্রুপ লোপাট করলো ১২০০ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় খোয়া গেল ৬ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। প্রতিবছর প্রতিরক্ষা খাতের মতো অনুৎপাদনশীল খাতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। আর বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় নিজেদের আয়ে চলতে। গবেষণাখাতে অর্থ চাইলে পরামর্শ দেওয়া হয় যে, বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিয়ে দাতাদের প্রয়োজনমাফিক গবেষণায় নিয়োজিত হতে। রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি উঠলে বলা হয় অবকাঠামোকে ভাড়া দিয়ে অথবা সার্টিফিকেট বিক্রি করে চলতে। এ যেন ঠিক বিশ্ববিদ্যালয়কে বিভিন্ন ভাগে টুকরো টুকরো করে বিক্রি করার পরামর্শ!

বিশ্ববিদ্যালয়কে বরাদ্দ দিয়ে সমাজের কী লাভ? যে দেশে অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে, সেই দেশে মানুষের ট্যাক্সের টাকা জড়ো করে কেন দেওয়া হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে? এর কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় একটা সামাজিক চিন্তা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই চিন্তা সমাজকে গতি দেয়। এই চিন্তা সমাজকে সাহস দেয়, দিক-নির্দেশনা দেয়। দেশের মানুষের অগ্রবর্তী অংশ হিসেবে কাজ করে। বিশ্ববিদ্যালয় যদি বলে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙ্গতেই হবে, এর প্রভাব পড়ে সারা দেশে। আবার দখলদারিত্ব, নারী নির্যাতন, শিশুহত্যা দেখেও যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা নির্লিপ্ত থাকে, দেশব্যাপী অন্যায় মেনে নেওয়ার পরিবেশ তৈরি হয়। সমাজের অন্যান্য অংশও তখন মুখ বুজে সহ্য করে। বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের চিন্তা সামাজিক স্বার্থকে প্রতিফলিত করে বলে দেশের সাধারণ মানুষও সেই চিন্তাকে ধারণ করে। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হলে খুব বড় ক্ষতি হয়ে যাবে’ কিংবা ‘শহীদ মিনারে আল্পনা আঁকা বা ফুল দেওয়া বাদ দিয়ে কোরানখানি করার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে’- এই উপলব্ধি তৈরিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিন্তা নেতৃত্ব দিয়েছে। তাই সমাজের চিন্তার প্রবাহমানতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় খুব প্রয়োজনীয়।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে কৌশলপত্রে প্রস্তাবিত ‘Self Assessment’ প্রক্রিয়া
কৌশলপত্রের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এখন দেশের সমস্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটি বিভাগে Self Assessment এর কাজ পরিচালিত হচ্ছে। Institute of Quality Assurance Cell (IQAC) গঠন করে এই কাজটি করা হচ্ছে। Self Assessment Manual Report এর ভূমিকায় UGC’র সাবেক চেয়ারম্যান একে আজাদ বলেছেন, ‘উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানহীন কিন্তু পরিমাণে বেশি রাখা সঠিক নয়। তার চেয়ে মানসম্মত শিক্ষা ভিত্তি হিসাবে কাজ করতে পারে যার উপরে পরবর্তীতে নির্মাণ সম্ভব। তাই উচ্চশিক্ষায় সংখ্যার চেয়ে মান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’ তিনি উচ্চশিক্ষার কোন ‘মান’র কথা বলছেন তা পরেই উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, “উচ্চশিক্ষার মান বৃদ্ধি ও নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে স্টেকহোল্ডারদের প্রয়োজনের দিকে আরও বেশি সাড়া দিতে হবে। সেই ক্ষেত্রে এটা জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি স্টেকহোল্ডারদের প্রয়োজন কেমন মেটাতে পারছে এবং কীভাবে আরও ভালো মেটাতে পারবে।”

এখানে পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থা অনুযায়ী শিক্ষার মান নিশ্চিত করার কথা বলে কার্যত উচ্চশিক্ষাকে সংকুচিত ও খুপরিবদ্ধ করাকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য কী? স্টেকহোল্ডারদের প্রয়োজন মেটানো! তাহলে আর প্রতিষ্ঠানটিকে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ না বলে অন্য কিছু বলাই শ্রেয়।’

UGC’র বর্তমান চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান বলেছেন, “বাংলাদেশে স্নাতকদের চাকুরির সুযোগ অপ্রতুল। অনেককেই চাকুরির জন্য বিশ্ব ও আর্ন্তজাতিক বাজারে লড়তে হচ্ছে। তাই তাদের জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক প্রয়োজন অনুযায়ী প্রস্তুত হতে হবে।” Curriculum Content Design and Review এ বলা হয়েছে— “Self Assessment পাঠ্যক্রমকে পুনঃর্গঠন, আধুনিকীকরণ ও যুগোপযোগি করার প্রক্রিয়াকে সহজ করবে।”

এই হচ্ছে Self Assessment Manual Report এর মূল বক্তব্য। রিপোর্টের কিছু বাক্যে, শব্দে কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি করলেও মূল কথা এখানে স্পষ্ট করে আনা হয়েছে। ছত্রে ছত্রে উল্লেখ আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে আরও বেশি বাজারমুখী করার কথা, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর ব্যবসায়ীদের প্রভাব বাড়ানোর কথা।

এখন প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে বিভাগে এই জরিপ কাজ পরিচালিত হচ্ছে। ছাত্র, শিক্ষক, Academic and Non-academic Staff, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, চাকরিদাতা এদের কাছ থেকে মতামত সংগ্রহের কাজ চলছে। বিভাগের পড়াশুনার মান, গবেষণা, শিক্ষকদের পাঠদান পদ্ধতি, সিলেবাসের বিষয়বস্তু, চাকরি বাজারের সুযোগ কেমন, চাকরিতে কী ধরনের সফলতার পরিচয় দিতে পারছে, সেমিনারে বই পর্যাপ্ত কি না, সুযোগ সুবিধা পর্যাপ্ত কি না এ বিষয়গুলোর উপর মতামত সংগ্রহ চলছে। এই জরিপের ভিত্তিতে বর্তমান বিভাগের চিত্র তুলে ধরা হবে এবং ভবিষ্যৎ শিক্ষার মান উন্নয়নে করণীয় Improving Plan গ্রহণ করা হবে। জরিপ আর পরিকল্পনার জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। শুধুমাত্র পরিকল্পনা প্রণয়নের মধ্য দিয়েই শেষ নয়। সেই মতো করে প্রতিটি বিভাগকে সরকার কর্তৃক মনোনীত Accreditation Council এর মাধ্যমে Accreditation বা স্বীকৃতি পেতে হবে। যে বিভাগ Accreditation পাবে তারা চাকরির বাজার, স্কলারশিপ গবেষণাসহ সমস্ত ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে। যারা Accreditation থেকে বঞ্চিত হবে তারা এসব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। তাই Accreditation পাওয়া একটি বিভাগের বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে। ফলে বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী Accreditation পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে। Accreditation পাওয়ার জন্য সিলেবাস-কারিকুলাম পরিবর্তনসহ শিক্ষাকে বাজার উপযোগী করার সমস্ত নিয়ম বিভাগগুলোকে পালন করতে হবে। শিক্ষার মান উন্নয়নের নামে পরীক্ষা মূল্যায়ন পদ্ধতি, ক্লাসটেস্ট, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশনের অতিরিক্ত বোঝা ছাত্রদের ওপরে চাপানো হবে। একজন চিন্তাশীল শিক্ষক/ছাত্রের পক্ষে চাইলেও এই প্রক্রিয়ার বাইরে থাকাটা কঠিন হবে।

Self Assessment বাস্তবায়নে যে টাকা খরচ হবে তার কিছু অংশ ইউজিসি বরাদ্দ করলেও আসলে এটা ধীরে ধীরে ছাত্রদের কাছ থেকে আদায় করা হবে। এর মাধ্যমে চিহ্নিত সমস্যাবলীর সমাধান কখনই ছাত্রবান্ধব হবে না। ধরুন, কোন বিভাগ ক্লাসরুম সংকটে আছে, তার সমাধান আসবে ছাত্রদের অর্থায়নে ক্লাসরুম করা। যেহেতু তাদের দৃষ্টিভঙ্গিই শিক্ষাব্যবসা ও ফি বৃদ্ধির পক্ষে সেহেতু এরকম সিদ্ধান্তই নেওয়া হবে এবং তার পক্ষে মতামত তৈরির জন্য এ জরিপকে কাজে লাগানো হবে।

চাকুরিমুখী পড়াশুনা বেকার সমস্যার সমাধান করতে পারবে না
18052833_1462964103777120_1432975304_nবিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিকে যতই বাজারমুখী কিংবা চাকুরিমুখী করা হোক না কেন, এর মাধ্যমে বেকার সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সমাজের বেকার সমস্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি সৃষ্টি করেনি। বেকার সমস্যার মূল কারণ নিহিত আছে সমাজের অর্থনীতিতে। যা রাষ্ট্র সবসময় আড়াল করে। প্রচলিত পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল সংকট কী? মূলত বাজার সংকট। এখানে আর্থিক সামর্থ্য না থাকলে কেউ বাজারের কোনো পণ্য কিনতে পারে না। তাই বাজারে পণ্য থেকে যায়। এই বাজারব্যবস্থায় সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন মূল লক্ষ্য, সেখানে সমাজ বা মানুষের প্রয়োজনে নয়, মুনাফার প্রয়োজনে উৎপাদন হয়। মুনাফার জন্য বাজারে কৃত্রিম সংকট ও কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করতে হয়। খুব সামান্য পরিমাণ এবং লাভজনক ক্ষেত্রে শিল্পায়ন ঘটে। সেটাও সস্তা শ্রমকে কাজে লাগিয়ে সর্বোচ্চ মুনাফার জন্য। এ কারণে একদিকে সমাজের সব মানুষের প্রয়োজন মেটে না, অন্যদিকে উৎপাদনের বন্ধ্যাত্ব বিদ্যমান থাকে, নতুন নতুন শিল্প-কলকারখানা তৈরি হয় না। তাই এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় চাইলেও সবার চাকুরি জোটে না।

নীতিগতভাবেও আমরা এ প্রক্রিয়ার বিরোধী। কারণ,উচ্চশিক্ষা কোন খন্ডিত ধারণা নয়। বাজারের কী চাহিদা তা দিয়ে উচ্চশিক্ষার বিষয়বস্তু নির্ধারিত হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগের সৃষ্টির সাথে বিশ্বজ্ঞান সৃষ্টির গতিপথ ও ইতিহাস যুক্ত। জ্ঞান-বিজ্ঞানের কোনো শাখা বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনের একটা পর্যায়ে সেই বিষয়ে বিভাগ খোলা সম্ভব এবং তার উপর গবেষণা করা সম্ভব। বাজারের নিয়মে বিশ্ববিদ্যালয়কে চালানোর চেষ্টা বিশ্ববিদ্যালয়কে তার দর্শনগত জায়গা থেকেই সরিয়ে আনবে। এই Self Assessment এবং Accreditation Council এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়কে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ছাঁচে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়কে তারা শুধুমাত্র তাদের প্রয়োজনীয় কর্মচারীদের ট্রেনিং এর কাজে লাগাতে চায়। বিশ্বদ্যিালয়ের যে অংশটুকু জ্ঞানের, যে অংশটুকু দায়বোধের তাকে অপ্রয়োজনীয় ঘোষণা দিয়ে বন্ধ করতে চায়।

আমব্রেলা অ্যাক্ট আর উচ্চশিক্ষা কমিশন
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন হরণের পথে আরও কয়েক ধাপ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “চিত্ত যেথা ভয়শূণ্য, উচ্চ যেথা শির, জ্ঞান যেথা মুক্ত।” জ্ঞানচর্চার জন্য এমনই মুুক্ত স্বাধীন পরিবেশ প্রয়োজন। যে কেউ গায়ের জোরে রাষ্ট্র পর্যন্ত দখল করতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রের সংজ্ঞা পাল্টাতে পারে না। অর্থাৎ মানব সভ্যতার সৃষ্ট জ্ঞানকে প্রভাবিত করতে পারে না। অথচ, বিশ্ববিদ্যালয়কে ক্রমাগত সেইদিকেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

২০০৬ সালের জুলাই মাসে UGC দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রনের জন্য আমব্রেলা অ্যাক্টের প্রস্তাব করে। এই আইনের প্রধান বিষয়ই হলো মঞ্জুরি কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা খর্ব করা। আমব্রেলা অ্যাক্ট এর ৮/(ধ) ধারায় বলা হয়েছে “বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে ও তার অনুমোদন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবেচনায় উপযুক্ত পড়াশোনার এমন শাখার নির্দেশনা দেওয়া, গবেষণা এবং জ্ঞানের অগ্রগতি ও বিস্তারের জন্য বিধান তৈরি করা হবে।” সেকশন ৮/২ এ বলা হয়েছে, “এই আইন অনুসারে UGC এর নীতিমালা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে বিরোধ তৈরি হলে UGC কেই অগ্রগণ্য ধরতে হবে।”

এই আইন অনুসারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হবেন রাষ্ট্রপতি। আচার্যের নেতৃত্বে সার্চ কমিটির মাধ্যমে উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হবে। সিনেট, সিন্ডিকেট, সিলেকশন বোর্ডসহ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্সদসমূহে সরকার মনোনীত ব্যক্তিদের আধিক্য থাকবে। সাধরণভাবে আমাদের দেশে রাষ্ট্রপতি হন দলীয় কোনো ব্যক্তি এবং বিভিন্ন সময়ে সামরিক শাসকদেরও রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার নজির আছে। এই আইন অনুসারে উচ্চশিক্ষার সাথে সম্পর্কহীন কিন্তু দলীয়ভাবে ক্ষমতাধর ব্যক্তিরাই আচার্য হবেন। এবং সাথে সাথে উপাচার্যকেও দলীয় আনুগত্যের ঝা-াধারী হতে হবে। কী মর্মান্তিক! যেখানে বিদগ্ধ শিক্ষাবিদদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে থাকার কথা, সেখানে দলকানা ব্যক্তিরাই আজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ আসনগুলো দখল করে আছে!

এছাড়া, ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে ৩৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৭৮টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে একত্রে নিয়ন্ত্রণের জন্য অধিকর্তারূপে উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠনের প্রস্তাবনা হাজির করা হয়েছিল। উচ্চশিক্ষা কমিশন সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়—

  • দেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লাগামহীন অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করা এবং মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে ইউজিসিকে শক্তিশালী করার অংশ হিসেবে এই কমিশনকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
  • যেকোন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর যেকোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কমিশন নিতে পারবে।
  • সবগুলো পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য এটি হবে একটি নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান। এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপর নজরদারি চালানো হবে।
  • বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হবে এই কমিশনের মাধ্যমে।
  • রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য সদস্যবৃন্দ নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন এবং পেশাগত জবাবদিহিতা বজায় রাখবেন।
  • সরকারি-বেসরকারি উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হবে এবং উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে কাজে লাগানো হবে।
  • শিক্ষার চাহিদা নিরূপন, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও নীতি-নির্ধারণের ক্ষমতা থাকবে।
  • কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাফল্য-ব্যর্থতা নিরূপনের জন্য প্রয়োজনীয় মানদ- নির্ধারণ করবে এবং ওই মানদ-ের ভিত্তিতে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের পারস্পরিক অবস্থান বা মানক্রম নির্ধারণ করবে।
  • উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাকে বিশ্বমানে উন্নীত করার লক্ষ্যে ব্যক্তি বা সরকারি পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিতকরণ/নিরূপন সংস্থা বা অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিলকে প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও পরামর্শ প্রদান করবে।
  • পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ধরনের নিয়োগের ক্ষমতা দেয়া হবে কমিশনকে।
  • কমিশনকে বিশ্ববিদ্যালয়র জন্য নীতিমালা, বিধি, প্রবিধি ও স্ট্যাটিউটস প্রণয়ন, অনুমোদন ও বাস্তবায়নের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।

শোষণমূলক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র সবসময়ই চেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে। এমন বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রয়োজন যেটা অর্থনীতিকে চালু রাখার মতো দক্ষ মানুষের যোগান দেবে, কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে না। ফলে শিক্ষাটা দেওয়া হবে, কিন্তু নিয়ন্ত্রিত ও প্রয়োজনমাফিক। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে বাংলাদশের ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭৩’ এর মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেয়া হয়। এই অধ্যাদেশে অনেক দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতার পর এটিই ছিল তুলনামূলক অর্থে প্রগতিশীল। কিন্তু অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং পরবর্তীতে যতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার কোনটিকেই এর আওতায় আনা হয়নি। বর্তমান সময়ে এই স্বায়ত্তশাসনের ধারণাকে আরও বেশি সংকুচিত করা হয়েছে। বস্তুত এখন নিজেদের পরিকল্পনাকে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা ঢেলে সাজান চেষ্টা করা হচ্ছে। এজন্য গঠিত হচ্ছে উচ্চশিক্ষা কমিশন। পরিষ্কারভাবেই বোঝা যায়, এই কমিশন উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে ভয়ংকর বিপদ ঢেকে আনবে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের।

স্বায়ত্তশাসন ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বাধাহীন জ্ঞানচর্চা অসম্ভব
শ্বাস প্রশ্বাস না নিলে যেমন প্রাণি নয়, ঠিক তেমনি স্বায়ত্তশাসন ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় অসম্ভব। মানব সভ্যতার ইতিহাস ও এ কথাই প্রমাণ করে যে, জ্ঞানচর্চা কখনও রুদ্ধ পরিবেশে সম্ভব নয়। জ্ঞানকে সমাজপতিদের রক্তচক্ষু আর অতীতের প্রথাকে উপেক্ষা করেই বিকশিত হতে হয়। রেনেসাঁ ও শিল্পবিপ্লবের আগে গোটা ইউরোপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হত ক্যাথলিক চার্চ তথা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে নতুন আলোর দিশা নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল রেনেসাঁ আন্দোলন। সামন্তপ্রভুদের একাধিপত্য আর খ্রিস্টধর্মের পুরোহিততন্ত্রের প্রতিবন্ধকতাকে চ্যালেঞ্জ করে ইউরোপে বিজ্ঞান চিন্তার উদ্ভব হলো। ফ্রান্সিস বেকন, গ্যালিলিও, ব্রুনো, টারিসেলি প্রমুখ বিজ্ঞানীরা দেখালেন এত দিনের প্রচলিত বহু চিন্তাই ভ্রান্ত। দেখালেন, বিশ্বাসের উপর ভর করে নয়, সমস্ত কিছুই গ্রহণীয় হতে হবে যুক্তির কষ্টিপাথরে। সেই অষ্টাদশ শতাব্দীতে শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জ্ঞানচর্চার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে ধর্মীয় তথা সমাজপতিদের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার আকাক্সক্ষা তৈরি হলো। নতুন চিন্তা এলো যে, সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থাকে প্রশ্ন করতে হবে, উত্তর খুঁজতে হবে। যা কখনই সমাজের সকল কিছুর প্রতি আনুগত্য রেখে সম্ভব নয়। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়কে কিছু একাডেমিক প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা করতে হয়। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের যোগ্যতা নিরূপণ, শিক্ষক (উপাচার্য সহ)-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, শিক্ষার বিষয়বস্তু এবং ডিগ্রির মাপকাঠি নির্ধারণ, শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ ও গবেষণার মধ্যে সমন্বয় সাধন ইত্যাদি। একমাত্র স্বায়ত্তশাসন থাকলেই এই কাজগুলো বাধাহীনভাবে করা সম্ভব।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখলদারিত্ব আর আবাসন সংকটে জরাগ্রস্ত
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে হলের ধারণাটি একেবারে অবিচ্ছেদ্য বিষয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ছাত্ররা একসাথে থাকবে, একে অপরের থেকে শিখবে। হলে ছাত্রদের খাবারের ব্যবস্থার জন্য ডাইনিং থাকবে, পড়ার জন্য লাইব্রেরি থাকবে। তাহলেই সেটা পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল ছাত্রের থাকার জায়গা হলগুলোতে নেই। ছাত্র সংখ্যা বাড়লেও আবাসন সংকট নিরসনে নতুন নতুন হল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সামান্য আবাসিক সুবিধা দিতেও সরকার কার্পণ্য দেখায়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে তো ১২ বছর ধরে হল নির্মাণ নিয়ে সরকার টালবাহানা করছে। দেশের সমস্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র ৩২ ভাগ শিক্ষার্থী আবাসিক সুবিধা পায়, ৬৮ ভাগ শিক্ষার্থী সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত। হল সম্পর্কে ইউজিসির কৌশলপত্রে স্পষ্টতই উল্লেখ আছে যে, ‘আবাসিক হল ছাত্র রাজনীতির ক্ষেত্র তৈরি করছে ‘। (Executive Summary)। বলা হয়েছে. ‘আবাসিক হল সন্ত্রাসীদের আখড়া’।

বিশ্ববিদ্যালয়ে যতটুকু আবাসিক সুবিধা আছে তাও দখল করে আছে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনগুলো। প্রশাসন যেন হলগুলো ছাত্রলীগকে ছেড়ে দিয়েছে। হলে উঠতে গেলে ছাত্রলীগের ভাইদের সাথে বোঝাপড়ার মাধ্যমেই উঠতে হয়। এখানে প্রথম বর্ষের ছাত্রদের দেয়া হয় অন্যায় মেনে নেওয়ার ট্রেনিং। প্রায় রাতেই ছাত্রলীগের তথাকথিত ‘বড় ভাই’রা নেয় গেস্টরুম। সেখানে তাদের শেখানো হয় কীভাবে সালাম দিতে হবে, কীভাবে দাঁড়াতে হবে। নেতাদের সাথে হ্যান্ডশেক করতে হবে কীভাবে, হাতে কতটুকু চাপ দিতে হবে। কখনও যেতে হবে শো ডাউনে, কখনও যেতে হবে নেতাদের প্রটোকল দিতে, কখনও যেতে হবে মিছিল-সমাবেশে। কিছু ভুল হলে নেমে আসবে লাঞ্ছনা আর অপমান। এতকিছু সহ্য করে ছাত্ররা কেবল পায় শরীর রাখার মতো জায়গা। একরুমে যত বেশি জনকে ঢোকানো যায়। কারও কারও ঠাঁই হয় বারান্দায় কিংবা মসজিদে। প্রায়ই লেগে থাকে রুম দখল, টেন্ডারবাজি অথবা দোকান থেকে চাঁদা তোলা নিয়ে মারামারি। ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক কর্মসূচির যোগান হতে বাংলাদেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রদের যেতে হয় এই পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে। পাশাপাশি তাদের মাথায় আরেকটি জিনিস ভালো করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়— সেটি হলো, ক্যাম্পাস তোমাদের আর বাংলাদেশ হলো ক্ষমতাসীনদের। সংগঠনের কিছু নিয়মকানুন মেনে তুমি ছিনতাই করো, মেয়েদের বিরক্ত করো, নকল করো, বড়দের সাথে বেয়াদবি করো, সিট দখল করো, চাঁদা তোলো কোনো সমস্যা নেই। যে যত সহজে আত্মসম্মান বিকিয়ে দিতে পারে, তার এখানে ভবিষ্যৎ তত উজ্জ্বল।

ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ, নেই নূন্যতম গণতান্ত্রিক চর্চা
প্রতিদিন কত কত অন্যায় একজন শিক্ষার্থীর সাথে ঘটে চলছে। ক্লাশরুম থেকে আবাসিক হল সবখানেই চলছে আধিপত্য। ক্লাশরুমে শিক্ষকের পড়ানো, তত্ত্বাবধান নিয়ে একজন শিক্ষার্থী কোনো কথা বলতে পারে না। নাইটকোর্স, ফি বৃদ্ধি নিয়ে প্রতিবাদ করতে পারে না। কেননা শিক্ষকদের হাতে রয়েছে ‘মার্কসের’ ক্ষমতা। ক্লাশ টেস্ট, প্রেজেন্টেশন, অ্যাসাইনমেন্ট, অ্যাটেন্ডেন্স ইত্যাদি মিলে একজন শিক্ষকের হাতে আছে শতকরা ৩০ নম্বর ক্ষেত্রবিশেষে ৪০ নম্বর। ব্যক্তিগত আক্রোশে এ ক্ষমতা ব্যবহারের নজির আছে অনেক। ক্যাম্পাস এবং হলে আছে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের প্রবল দাপট। অনেক ক্যাম্পাসে কিছু সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন আছে। কিন্তু সেখানেও যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তাদের ছাত্রসংগঠন, তল্পিবাহক প্রশাসন ও শিক্ষকনেতাদের জন্য সংগঠনগুলো প্রকৃত ভূমিকা রাখতে পারে না। শিক্ষার্থীদের মিছিলে যেতে বাধ্য করা, র‌্যাগ দেয়া, অস্ত্রের মহড়া দেয়া, মাদক ব্যবসা, ছিনতাই, হয়রানি সবই ক্যাম্পাসে চলে।

এমন অগণতান্ত্রিক পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টাতো যদি ছাত্ররা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ পেত। তখন ক্ষমতাসীনরা চাইলেই এভাবে নির্বিচারে ছাত্রদের উপর দমন-পীড়ন চালাতে পারত না। ছাত্রদের নিজেদের একটা শক্তি থাকত। কিন্তু কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই গত ২৭ বছর ধরে ছাত্রসংসদ নির্বাচন নেই। ফলে নেতৃত্ব গড়ে তোলার কোনো সুস্থ প্রক্রিয়া চালু নেই। কোনো রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক নেই। সংগঠনের নেতাদের ছাত্রদের কাছে কোনো জবাবদিহিতা নেই। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সময়ে যে খেলাধুলা-সাংকৃতিক আয়োজন ছিল তারও আজ কোনো বালাই নেই। বিশ্ববিদ্যালয় যে কেবল পড়াশুনার জায়গা নয়, গণতান্ত্রিক মানুষ হিসেবে পরিপূর্ণতা নিয়ে বেড়ে ওঠা- তা যেন ভুলতে বসেছে শিক্ষার্থীরা। ছাত্র সংসদ নির্বাচন থাকলে একজন শিক্ষার্থীকে প্রত্যেকটি ছাত্র সংগঠনের শিক্ষার দাবি, দেশের পরিস্থিতি নিয়ে তাদের বক্তব্য কী- এগুলো নিয়ে ভাবতে হত, জানতে হত। কিন্তু এই প্রক্রিয়াগুলো সম্পূর্ণ অনপুস্থিত বলে রাজনীতি সচেতনতাও তাদের মধ্যে গড়ে উঠছে না। ফলে তাদের অবস্থান দাঁড়িয়ে গেছে দেশের পরিস্থিতি থেকে বিচ্ছিন্ন সীমাবদ্ধ জায়গায়। এমন বন্ধ্যা পরিবেশের সবচেয়ে বড় সুবিধা পাচ্ছে তথাকথিত ছাত্রনেতা এবং শিক্ষকনেতারা, যারা নানাভাবে দেশের কায়েমী গোষ্ঠীর সাথে জড়িত। কৌশলপত্রেও ছাত্র রাজনীতিকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করে সীমাবদ্ধ (Limit) রাখার প্রস্তাবনা রয়েছে।

নাইট কোর্স, ফি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে উত্তাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
নাইট কোর্স, ফি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে উত্তাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

শাসকদের পরিকল্পনাই শেষ কথা নয়
রয়েছে ছাত্রদের প্রতিরোধ আন্দোলন
পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেছে এবং নারী শিক্ষার্থী সে শেল কুড়িয়ে নিয়ে পুলিশের দিকে ছুঁড়ে মারছে। পুলিশ হাজার হাজার শিক্ষার্থীর উপর বেধড়ক লাঠিচার্জ করছে—ছাত্রদেরকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে। ছাত্ররা রক্ত দিয়ে বর্ধিত ফি প্রত্যাহারের দাবি দেয়ালে দেয়ালে লিখছে—এ ছিল ২০১০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্ধিত ফি বিরোধী আন্দোলনের চিত্র। নামে বেনামে নানা ধরণের ফি শিক্ষার্থীদের উপর আরোপ করা হয়। শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলন দমন করতে প্রশাসন পুলিশ লেলিয়ে দেয়। হামলা, গ্রেফতার, বহিষ্কারাদেশের পরও ছাত্রদের রুখতে পারেনি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয়ে চলার বিধান ২৭/৪ ধারা বাতিলের দাবিতে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে বিশাল ছাত্র আন্দোলন সংঘটিত হয়। ছাত্ররা জাতীয় প্রেসক্লাব এর সামনে রাস্তা বন্ধ করে দেয়। ছাত্রলীগ, পুলিশ হামলা করে। হামলা, মামলা, ছাত্রলীগ/প্রশাসনের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে ছাত্রদের এই আন্দোলন এক পর্যায়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এ আন্দোলনে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষার্থীরাও রাস্তা অবরোধ করে—তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয়ে চলার বিধান বাতিলের দাবিতে। এ আন্দোলনে ৬৯ জন ছাত্র গ্রেফতার হয়। আন্দোলনের ফলে প্রধানমন্ত্রী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয়ে চলার বিধান বাতিলের ঘোষণা দেন এবং পরবর্তীতে এই ধারা বাতিল হয়। ২০১২ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ফি ৫০০০ টাকা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করে প্রগতিশীল ছাত্রজোট। আন্দোলনের প্রথম দিনে ছাত্রলীগ হামলা করে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘটসহ নানা কর্মসূচি পালিত হয়। ৮ জন ছাত্রনেতাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত প্রশাসন নিলেও আন্দোলনের চাপে তা বাস্তবায়িত করতে পারেনি। পরবর্তীতে ৪০০০ টাকা উন্নয়ন ফি বাতিল করতে বাধ্য হয়। এছাড়া আবাসিক হল নির্মাণের দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই আন্দোলন করে আসছে। এ আন্দোলনে হামলা, মামলা, গ্রেফতার, শিক্ষককে গুলি করার ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু আজও এই দাবি পূরণ হয়নি। ২০১৬ সালে টানা ৩৩ দিন আন্দোলনের পর প্রধানমন্ত্রী আবাসিক হল নির্মাণের ঘোষণা দেন। যদিও তার বাস্তবায়ন এখনও ঘটেনি।

একজন প্রক্টর ছাত্রীর দিকে ঘুষি উঁচিয়ে মারতে আসছে—এ ছবি সারাদেশের বিবেকবান মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছিল। ঘটনাটি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ধিত ফি বিরোধী আন্দোলনের। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১২ সালে বর্ধিত ফি বিরোধী এই আন্দোলনে ছাত্রলীগ, প্রশাসন একযোগে এ হামলা পরিচালনা করে। প্রশাসন ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে এবং ৯ জনকে ৬ মাসের জন্য বহিষ্কার করে।

চারদিকে ঘন কুয়াশা, খুব কাছের মানুষকে চিনতে হলে পুনরায় ফিরে তাকাতে হয়। রোকেয়া হলের সামনে বিশাল মিছিল। মিছিলের সবাই নারী। স্লোগান ভেসে আসছে ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাইভেট করা চলবে না, বন্ধ কর। বাণিজ্যিক নাইটকোর্স চালু করা চলবে না।’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৪ সালের নাইটকোর্সবিরোধী আন্দোলনের ফেব্রুয়ারির একটি সকালের চিত্র। হাজার হাজার ছেলেমেয়েরা নাইটকোর্সবিরোধী আন্দোলন করেছে। পুলিশ এবং ছাত্রলীগ একযোগে শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে হামলা চালিয়েছিল। অনেক শিক্ষার্থী আহত হয়েছিল, গ্রেফতার করা হয়েছিল ছাত্র নেতাদের, মামলা দেয়া হয়েছিল অজ্ঞাতনামা হাজার শিক্ষার্থীর ওপর। আন্দোলন থামাতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে প্রশাসন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্যিক নাইটকোর্স ও ফি বিরোধী আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে। বাংলা, ইংরেজি, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল, ফার্মেসি প্রভৃতি বিভাগে নাইটকোর্স চালুর সিদ্ধান্ত নিলেও আন্দোলনের মুখে তা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল। ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন স্টাডিজ বিভাগে ১ লক্ষ ৩৭ হাজার টাকা চার বছরের কোর্স ফি নির্ধারিত হলে এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন হয়েছে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন আগে ফি বিরোধী সফল আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফি বিরোধী আন্দোলনের মুখে প্রশাসন বিভাগ উন্নয়ন ফি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখার ঘোষণা দেন। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্যিকীকরণ, নাইটকোর্স চালুর বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে। ফলে তারা চাইলেই বাণিজ্যিকীকরণের নীতি এক ধাক্কায় বাস্তবায়িত করতে পারবে না। তাই তারা ধীরে ধীরে বাণিজ্যিকীকরণের প্রক্রিয়া চালু রেখেছে। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের বাণিজ্যিকীকরণ বিরোধী চেতনা মেরে দেওয়ার নানা চক্রান্ত চলছে—এজন্য তারা ইউজিসি’র কৌশলপত্রে ছাত্র আন্দোলন দমনের নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

কারখানা নয়, বিশ্ববিদ্যালয় চাই
প্রোডাক্ট নয়, মানুষ চাই
কথিত আছে যে, নৌকা ডোবার পরই নাকি আমরা বুঝতে পারি যে, নৌকার তলায় ফুটো ছিল। দেশে কিছুদিন পরপর শোনা যাচ্ছে, জঙ্গিবাদের উত্থানের গল্প। প্রতিদিন পত্র-পত্রিকায় আসছে সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের নানা চিত্র। রাষ্ট্র একের পর জনস্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত জনগণের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। সুন্দরবন ধ্বংসকারী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়ন করছে। গ্যাসের দাম, তেলের দাম, পানির দাম, বাড়ি ভাড়া, গাড়ি ভাড়া ক্রমাগত বাড়িয়েই চলেছে। সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে আক্রমণ করা হচ্ছে পুলিশি দমন-পীড়নের মাধ্যমে। এত এত ঘটনা! নির্বিকারভাবে দেখলে কি খালি সমাজের ক্ষতি? নিজের কি কোন ক্ষতি হয় না? আমরা নিজেরাও কি সংবেদনশীলতা হারিয়ে ক্রমেই যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি না?

সরকার প্রচার করছে নতুন তত্ত্ব। পড়াচ্ছে, ‘ছাত্রদের ভালো প্রোডাক্ট হিসাবে তৈরি করা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব’। প্রোডাক্ট হলেই কিছু কিছু মানুষের জন্য হয়তো ভালো। কারণ প্রোডাক্ট মানেই হলো তা বিক্রির জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে অর্জিত সকল দক্ষতা, যোগ্যতা সব কিছু নিয়ে ভালো মূল্যে বিক্রির জন্য প্রস্তুত হওয়া মানেই হলো ভালো প্রোডাক্ট হওয়া। কিন্তু এমন শিক্ষা কেন রাষ্ট্র আমাদের দিতে চায়? কারণ, রাষ্ট্রব্যবস্থাতেই আছে গলদ। এই রাষ্ট্র নিজেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সহায় সম্বল অল্প কিছু মানুষের হাতে কুক্ষিগত হবার বৈধতা দেয়; সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদী চিন্তাকে উস্কে দিয়ে মানুষে মানুষে বিভক্তি আনে; জোর-জুলুম চালিয়ে মানুষের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করে; জাতীয় সম্পদ লুটপাট আর হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেয়না; শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পানি সবকিছুকেই বাজারের পণ্য বানায়। এমন রাষ্ট্রের শাসকরা চায় না, তাদের শিক্ষা পেয়ে সমাজে কেউ প্রশ্ন করতে শিখুক, প্রতিবাদী হয়ে উঠুক, মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে উঠুক। তারা কেবল বাজারের প্রয়োজনীয়তার কথা ভাবে, আর পরিকল্পনা করে কীভাবে একদল আত্মস্বার্থসর্বস্ব-পরাক্সমুখ মানুষ তৈরি করা যায়। রাষ্ট্রের এই দর্শনের নাম পুঁজিবাদী দর্শন। এই দর্শন মানুষকে মানুষ থেকে আলাদা করে। ফলে আজ যখন আমরা শিক্ষার অধিকার আদায়ের জন্য লড়াইয়ের কথা বলছি তখন তা বিস্তৃত হয়েছে জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে। শিক্ষার লড়াইটাও পরিণত হয়েছে পুঁজিবাদবিরোধী লড়াইয়ে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ধূলিকণায় লেখা আছে মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার ইতিহাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য যেকোন বইয়ের দু’পাতা জ্ঞান, পূর্বসূরীদের অক্লান্ত সংগ্রামের ফসল। এর উপর কোনো ব্যক্তির লাভালাভ যুক্ত করা তাঁদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো তৈরি করেছে যে শ্রমিকেরা, তাঁদের সন্তানেরা কখনও হয়তো এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশাধিকার পাবে না। আর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করার প্রতি মুহূর্তের ব্যয়? তাও আসে দেশের শ্রমিক-কৃষকসহ সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকা থেকে। সমগ্র মানবসভ্যতার অবদানকে সংযুক্ত করে সর্ববৃহৎ সামাজিক প্রতিষ্ঠান হলো এই বিশ্ববিদ্যালয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের হতে হবে সবচেয়ে দায়বদ্ধ মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব ফিরিয়ে আনার দায়িত্বও তাই প্রধানত ছাত্রদের।

সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানায়, আপনার লড়াই নির্ধারণ করবে যে ভবিষ্যতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব থাকবে কি না। সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েরা অদূর ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় প্রবেশ করতে পারবে কি না। সবচেয়ে বড় বিষয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতেই মানুষ নিজের মনুষ্যত্বকে বাঁচিয়ে রাখে। প্রতিবাদ ব্যাতিত মনুষ্যত্ব নিয়ে বাঁচার দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা নেই। তাই, উচ্চশিক্ষা রক্ষার এই আন্দোলনে আপনার সক্রিয় ভূমিকাই কেবল রক্ষা করতে পারে আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষাকে এবং আপনাকে।

কৌশলপত্র বাতিলের দাবিতে ইউজিসি ঘেরও কর্মসূচিতে পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙ্গছে শিক্ষর্থীরা (১৮ জুলাই ২০১২)
কৌশলপত্র বাতিলের দাবিতে ইউজিসি ঘেরও কর্মসূচিতে পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙ্গছে শিক্ষর্থীরা (১৮ জুলাই ২০১২)

 

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments