Tuesday, April 23, 2024
Homeফিচারসোভিয়েত সমাজতন্ত্র নারীকে যথার্থ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছিল

সোভিয়েত সমাজতন্ত্র নারীকে যথার্থ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছিল

(এবছর মহান সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের শতবর্ষ। ১৯১৭ সালের বিপ্লবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নারীমুক্তির ক্ষেত্রে কী অবদান রেখেছিলো তা তুলে ধরা হয়েছে এ লেখায়।)

mother-russiaরুশ বিপ্লব পৃথিবীর বুকে শোষণমুক্তির নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। সকল শোষিত মানুষ মুক্তির স্বাদ পেয়েছিল। শোষিত মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শোষণের শিকার নারী। শোষিত নারীসমাজের বিকাশের রাস্তা অবাধ করেছিল সোভিয়েত সমাজতন্ত্র। সকল ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ছিল বাধাহীন। আর যে দর্শনের ভিত্তিতে রাশিয়া এই অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেছিল তার দার্শনিক ভিত্তি করেছিলেন মহামতি কার্ল মার্কস। মার্কসের আজীবন সহযোদ্ধা ছিলেন ফ্রেডরিক এঙ্গেলস। মার্কস-এঙ্গেলস ‘কমিউনিস্ট ইশতেহারে’ পুঁজিবাদ ও প্রাক পুঁজিবাদী সমাজে নারীর অধস্তন-নিপীড়িত-অপমানজনক অবস্থান এবং সমাজ গঠনের সঙ্গে নারীর অধস্তনতার সঙ্গে সম্পর্কিত বিধি-ব্যবস্থা, আইন-কানুনের ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র দেখিয়ে যে সূত্রায়ন করেছিলেন তা নারীপ্রশ্ন সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উম্মোচিত করেছিল। ১৮৭৯ সালে অগাস্ট বেবেলের লেখা ‘নারী ও সমাজতন্ত্র’ গ্রন্থ এবং ১৮৮৪ সালে ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের ‘পরিবার ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ গ্রন্থ সামগ্রিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ও নারীমুক্ত আন্দোলনকে অবিচ্ছেদ্য হিসেবে দেখার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছে।

রুশ বিপ্লব শিল্পে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর তুলনায় পশ্চাদপদ রাশিয়ায় নারীর আইনগত, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল যা তৎকালীন বিশ্বে ছিল অভাবনীয়। ফরাসী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সামাজিকভাবে নারীর অগ্রযাত্রা হলেও সেই ফ্রান্সে ১৯৪৪ সালে নারীরা প্রথম পূর্ণ ভোটাধিকার লাভ করে। ‘গণতন্ত্রের পীঠস্থান’ বলে কথিত যুক্তরাজ্যে মেয়েরা ছেলেদের সমান বয়সে ভোটাধিকার লাভ করে ১৯২৮ সালে। ইতালিতে মেয়েরা ভোটাধিকার পায় ১৯৪৭ সালে। ১৯৭০ সালের পূর্ব পর্যন্ত ইতালিতে বিয়ে-বিচ্ছেদ আইনগত স্বীকৃতি পায়নি। নারী-পুরুষ সমান মজুরির বিধান পাশ হয় অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশগুলোতে ৬০ ও ৭০ এর দশকে। মাতৃত্বকালীন ছুটি, শিশুযতœবিষয়ক সুবিধাদির ক্ষেত্রেও একথা আরো বেশি প্রযোজ্য [বারবারা, ১৯৮৩, ২০৫-২২১]। তবে রাশিয়ায় ১৯১৭ সালের মহান নভেম্বর বিপ্লব তথাকথিত ঐ গণতান্ত্রিক বিশ্বকে দেখিয়েছিল কিভাবে সর্বক্ষেত্রে নারীর সমমর্যাদা-সমঅধিকার-সমঅংশগ্রহণ প্রতিষ্ঠা করা যায়। একটি রাজনৈতিক পরিবর্তনই পারে সত্যিকার অর্থে নারীমুক্তি আনতে Ñ রুশ বিপ্লব আমাদের সামনে সেই শিক্ষাই রেখে গেছে।

বিপ্লবপূর্ব রাশিয়ার সামাজিক প্রেক্ষাপট ও নারীসমাজ
ইউরোপের সাথে সংযোগ থাকলেও রাশিয়া ছিল একটি পিছিয়ে পড়া দেশ। জমিদারি প্রথা আর জারতন্ত্রের শাসনে মধ্যযুগীয় পশ্চাৎপদতা, সামন্তীয় সংস্কৃতি বিস্তৃত ছিল গোটা দেশ জুড়ে। দেশের অধিকাংশ মানুষই ছিল কৃষিজীবী। ইউরোপের বহু দেশে যখন শিল্প বিপ্লব হয়েছে, তখন ১৮৬১ সালে রাশিয়া থেকে ভূমিদাস প্রথা বিলোপ হয়। ধীরে ধীরে শিল্প কারখানা গড়ে উঠে মূলত রাশিয়ার পশ্চিম অংশে। জারের অত্যাচারী শাসন ও তীব্র শোষণে দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। রাশিয়ার শাসকরা দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধবিগ্রহে অভ্যস্ত ছিল।

সামন্তীয় অর্থনীতির পরিপূরক সামন্তীয় সংস্কৃতির নিগড়ে বাঁধা ছিল রাশিয়ার সমাজ তথা পারিবারিক জীবন। পরিবারের কর্তা ছিলেন সর্বময় প্রধান। পরিবার পরিচালনায় নারীর কাজ ছিল মূলত নির্দেশ পালন করা। সারাদিন খেটেখুটে গৃহস্থালীর কাজ, সন্তান লালন-পালন করাই ছিল নারীদের কাজ। উচ্চবিত্ত ঘরের কিছু নারী খানিকটা স্বাধীনতা উপভোগ করলেও তা সীমাবদ্ধ ছিল মূলত আড্ডা, হৈহুল্লোড় বল-নাচের আসরে অংশগ্রহণের মধ্যে।

বিপ্লবপূর্ব রাশিয়ায় একটি কথা ছিল প্রবাদের মত-স্ত্রীরা তাদের স্বামীদের মানতে বাধ্য। বিবাহিতা নারীদের কোনও স্বতন্ত্র অস্তিত্বকেই স্বীকার করা হত না। এমনকি একাকী বাড়ির বাইরে পা রাখলে পুলিশের চোখে সে অপরাধী গন্য হত এবং তাকে গ্রেফতার করা হত। দুশচরিত্র স্বামীক্রে ত্যাগ করার অধিকার নারীর ছিল না। অধিকাংশ নারী ছিল শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। এমনকি কোনও নারীর নামে পাসপোর্ট পর্যন্ত ইস্যু হত না। শুধুমাত্র স্বামীর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে স্ত্রীর নাম উল্লেখ করা হত।

বিপ্লবপূর্ব রাশিয়ায় গণিকাবৃত্তি ছিল অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপার, সে সময় মনে করা হত পুরুষের মঙ্গলের জন্য সমাজে গণিকাবৃত্তি টিকিয়ে রাখা প্রয়োজন । তাই সমাজে নারীর এই ক্লেদাক্ত অবস্থানকে আইনসঙ্গত করা হয়েছিল। সরকারী আইনের দ্বারা একাজ পরিচালিত হত। গণিকা নারীদের কোনও নাগরিক অধিকার ছিল না। পাসপোর্টের পরিবর্তে তাদেরকে গ্রহণ করতে হত কুখ্যাত হলুদ কার্ড। কোন কারণে কেউ যদি একবার এই হলুদ কার্ড গ্রহণ করতে বাধ্য হত তাহলে সারা জীবন তাকে এই কলঙ্কময় জীবনের বোঝা বহন করতে হত। এর থেকে বেরিয়ে আসার কোন পথ ছিল না। জারের আমলে মাতৃত্ব ছিল বোঝা। মাতৃত্বের উপর চলতো সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিপীড়ন। তাই বিপ্লবপূর্ব রাশিয়ায় গর্ভপাত করাতে গিয়ে বছরে প্রায় ২৫ হাজার নারীর মৃত্যু হয়। আর বিবাহকে ব্যবহার করে নারীকে দাসীতে পরিণত করা হত। সৃষ্টি করা হত পারিবারিক অসাম্য। সমাজের চোখে সে ছিল নিকৃষ্ট শ্রেণীর প্রাণী মাত্র।

কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে পেট্রোগ্রাড, মস্কো প্রভৃতি পশ্চিমের শহরগুলোয় বহু কারখানা গড়ে উঠলে সামাজিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়। শিল্প-কারখানা গড়ে উঠার সাথে আবির্ভাব হয় শ্রমিকশ্রেণীর। জমি থেকে মুক্ত হয়ে দলে দলে শহরে আসে শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে। দশ-বারোঘন্টা করে কারখানায় হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে মদের আসরে আর ফূর্তির নাচে টাকা উড়িয়ে ক্লান্ত অবসন্ন দেহে ঘরে ফেরে তাদের এক বড় অংশ। নারীদের জীবন হয়ে উঠে আগের থেকে আরও কঠিন আর জটিল। অল্প আয়ের অধিকাংশই যখন মদের আসরে চলে যায়, তখন সংসার চালানোই হয়ে যায় আরো কঠিন। সেই কঠিন দায়িত্বটিই চাপে নারীর কাঁধে। সংসার চালাতে ধীরে ধীরে অনেক নারীই কারখানায় কাজ করতে শুরু করে। মূলত বস্ত্র বয়ন, খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ বা ঐ জাতীয় হাল্কা কাজের শিল্পেই তারা নিযুক্ত হয় বেশি সংখ্যায়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিভিন্ন কারখানায় এরকম অনেক নারীশ্রমিকেরই দেখা মেলে রাশিয়ায়। শিল্প কারখানায় নারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নারীশ্রমিকরা হয়ে পড়ে রাশিয়ার শ্রমিকশ্রেণীর এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

সংখ্যায় কম মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের অবস্থাটা ছিল খানিকটা আলাদা। যেসব পরিবারের পুরুষেরা মূলত সরকারি দপ্তরে বা সৈন্যবিভাগে গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করত বা ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল, সেইসব ঘরের মেয়েদের অনেকেরই পড়াশোনার সুযোগ ছিল। পড়াশোনা করে দেশ-বিদেশের জ্ঞান অর্জন করার সুযোগ পেয়েছিল তারা। এর মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক ধ্যানধারণার সংস্পর্শে আসে তাদের অনেকে। রুশবিপ্লবে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বকারী অনেক বিপ্লবী নারীই এই ধরনের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ঘর থেকে এসেছিলেন।

বিপ্লবের প্রস্তুতিপর্বে নারীদের ভূমিকা
রাশিয়ার জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রথম চরমপন্থী আন্দোলনের বিকাশ ঘটে নারদনিকদের মাধ্যমে। এরা ছিলেন নৈরাজ্যবাদী। বাকুনিন ছিলেন এদের নেতা। সোফিয়া পেরোভস্কায়া ছিলেন রাশিয়ার জারতন্ত্র বিরোধী আন্দোলনের প্রথম নারী শহীদ। এরপর প্লেখানভের মাধ্যমে উনবিংশ শতাব্দীর আটের দশকে মার্কসবাদী আন্দোলনের সূচনা ঘটে। ১৮৮৩ সালে গঠিত হয় রাশিয়ার প্রথম সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সংগঠন ’শ্রমিক মুক্তি সংঘ’। এই সংগঠনের উল্লেখযোগ্য নারী বিপ্লবী ছিলেন ভেরা ইভানোভনা। ‘শ্রমিক মুক্তি সংঘ’ এর উদ্যোগে বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট মার্কসবাদী পাঠচক্র অনুষ্ঠিত হয়। এই সমস্ত পাঠচক্রে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও যোগ দিত। তাদের অধিকাংশই অল্পবয়সী। পেট্রোগ্রাড শহরে এরকম বেশ কিছু পাঠচক্র গড়ে উঠেছিল যার মাধ্যমে যুক্ত হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নারী। এদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ছিলেন আলেকজান্দ্রা কোলনতাই, নাদেজদা ক্রপস্কায়া, এলেনা স্থাসোভা প্রমুখ।

সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতে নারীর অবস্থান
৩ নং প্রবাসীর পত্রে লেনিন বলেছিলেন,“আমরা যদি নারীদের জনহিতকর কাজে, মিলিশিয়ায়, রাজনৈতিক জীবনে টেনে না নামাই, আমরা যদি মেয়েদের গৃহকাজ ও ঘরকন্নার মারাত্মক আবহাওয়া থেকে টেনে না আনি, তাহলে সত্যিকারের স্বাধীনতা লাভ অসম্ভব, এমন কি, গণতন্ত্র কায়েম করাও অসম্ভব, সমাজতন্ত্র তো দূরের কথা।” তাই বিপ্লবের পর ১৯১৮ সালে রুশ বিপ্লবী সরকার প্রথম যে পারিবারিক আইন ঘোষণা করেন তা ছিল তৎকালীন বিশ্বে সবচেয়ে অগ্রসর পারিবারিক আইন। নারীর সমঅধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে তৎকালীন কোনো ইউরোপীয় দেশে বিবাহ, বিয়ে-বিচ্ছেদ, গণিকাবৃত্তি সংক্রান্ত এ রকম কোনো আইন প্রণীত হয়নি। এরপর গর্ভপাত বৈধকরণ ও রোধ, জন্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ইত্যাদি আইনও রাশিয়ায় প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু এই আইন বাস্তবায়ন করা সহজ সাধ্য ছিল না। এর বাস্তবায়নের জন্য নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল।

এই পদক্ষেপের কারণে লক্ষ লক্ষ চাষী, শ্রমিক পরিবারের নারীরা স্বাধীন হয়েছিল। জমিদার, পুঁজিপতিদের অর্থনৈতিক শোষণ, স্বামী কিংবা পিতার প্রভুত্ব থেকেও নারী মুক্তি পেয়েছিল। সর্বক্ষেত্রে নারী, পুরুষের সাথে সমমর্যাদার অধিকারী হয়ে উঠেছিল। এক কথায় বলা যায় রুশ বিপ্লব নারীকে প্রথম প্রকৃত মানুষের মতো বাঁচতে শিখিয়েছিল। ১৮৬৬ সালে জেনেভায় অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে মার্কস বলেছিলেন, ‘পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রাম ব্যর্থ হবে যদি না নারীদের নানা অর্থনেতিক দাসত্ব থেকে মুক্ত করা যায়।’ রাশিয়ায় বলশেভিক পার্টিও নারী স্বাধীনতাকে মৌলিক নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিল, পুরুষের মতো নারীদের গড়ে তোলার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিল। অনুভব করেছিল মানবসভ্যতার পুনর্গঠনের জন্য প্রথম প্রয়োজন যথার্থ স্বাধীনতা। আর তাই লেনিন প্রথম থেকে পার্টির মধ্যে নারী সমিতি গড়ে তোলার উপর বেশি গুরুত্ব দেন।

সোভিয়েতের দৃষ্টিতে পরিবার ও পারিবারিক সম্পর্ক
সোভিয়েত নেতৃত্ব বুঝেছিলেন সুস্থ ও সবল জাতি গঠনের জন্য প্রয়োজন পরিবার ও বিবাহিত জীবনের নতুনবিন্যাস। সে কারণে বিপ্লবের কিছুদিন পর ১৯১৮ সালে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ ‘জন্ম, বিবাহ ও মৃত্যু’ এবং বিবাহ, পরিবার অভিভাবকত্ব সম্বন্ধে বিস্তারিত আইনকানুন জারি করেছিল। তারপরেও ১৯৩৬ ও ১৯৪৪ সালে আরো কিছু ছোটখাট বিধান কার্যকর করেছিল। এই বিধানসমূহ গৃহিত হওয়ার পূর্বে সোভিয়েত সরকার সেগুলি সারা দেশবাসীর সামনে উপস্থিত করেছিল এবং জনসাধারণের মতামত ও সংশোধনীগুলি বিচার করার পর তা সর্বসম্মতভাবে গৃহিত হয়েছিল।

সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ বিবাহের ক্ষেত্রে সকল অসাম্য দূর করার লক্ষে বিবাহ সম্পর্কিত নতুন আইন পাশ করেছিল। এটি ছিল সিভিল ম্যারেজ বা লৌকিক বিবাহ। দুইপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে বিয়ে রেজিস্ট্রি হত এখানে তৃতীয় পক্ষের কোন প্রয়োজন হত না।
সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান ছিল ব্যক্তির ইচ্ছানির্ভর। রাশিয়ার প্রখ্যাত আইনবিদ জেনিয়া বেলোশোভার ভাষ্য থেকে এই আইন কিরূপ ছিল তা বুঝা যায় — “মানুষের প্রতি মানুষের সব ধরণের অসাম্য ও নির্যাতন বন্ধ করাই ছিল অক্টোবর বিপ্লবের উদ্দেশ্য। স্বাভাবিকভাবেই পরিবারের মত মানব সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে এই বিপ্লব হাত না দিয়ে পারেনি, ১৯১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে জারি হওয়া সোভিয়েত বিবাহ আইন, পরিবার সম্পর্কে নতুন বিধি প্রণয়ন করলো। তা হলো, পছন্দ করার স্বাধীন অধিকার এবং সোভিয়েত পরিবারের ভিত্তি হবে প্রীতি, পারিবারিক শ্রদ্ধা ও সমানাধিকার।”

একই সাথে সোভিয়েত সরকার বিবাহ-বিচ্ছেদের ক্ষেত্রেও সব বাধানিষেধ দূর করল। ১৯১৭ সালের বিবাহ আইন অনুযায়ী – স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই যদি বিবাহ বাতিল করতে চায় তাহলে সেই বৈবাহিক সম্পর্ক বাতিল বলে গণ্য হবে। সোভিয়েত সমাজতন্ত্র বিবাহ-বিচ্ছেদের ব্যাপারে নারী-পুরুষের মতামতের উপর সমান গুরুত্ব আরোপ করেছিল। পারস্পারিক শ্রদ্ধা ভালোবাসার ভিত্তিতে যে দাম্পত্য সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারেনি তা বিচ্ছিন্ন হওয়ার ক্ষেত্রে সোভিয়েত আইন সহানুভূতির সাথেই সহযোগিতা করেছে।

সোভিয়েতের দৃষ্টিতে গর্ভপাত
গর্ভপাত — একটি সামাজিক অপরাধ ও অনৈতিক বলে বিবেচ্য ছিল। সোভিয়েত সমাজও এটিকে অপরাধ মনে করত। কিন্তু কেন সোভিয়েত সমাজতন্ত্র এই অভিনব আইনটি করেছিল! গর্ভপাত বন্ধে আইন করে কোন দেশই এই অপরাধকে বন্ধ করতে পারেনি। বরং তা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা প্রথম অনুধাবন করলেন আইন করে এই সমস্যা দূর করা যাবে না। এর বীজ নিহিত আছে অর্থনৈতিক ও নৈতিক সমস্যার গভীরে। তাই এই অপরাধকে সমূলে উৎপাট করার লক্ষ্যে সাময়িকভাবে এই আইন করেছিল। সোভিয়েতে গর্ভপাতকে আইনসিদ্ধ করে কিছু বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেল গর্ভবতী নারী শারীরিকভাবে অসমর্থ হয়ে পড়ায় কাজ হারানোর ভয়ে গর্ভপাত করত । ফলে স্বামী-সন্তানসহ গোটা পরিবারে একটা সংকটে পড়ত। গর্ভাবস্থায় অর্থনৈতিক সংকটের কারণেই ভবিষ্যৎ সন্তানের যত্ন নেয়া দুঃসাধ্য মনে করেই অনেক নারী গর্ভপাত করতে বাধ্য হত। কিন্তু সোভিয়েত সরকার এই অবস্থা থেকে মেয়েদের মুক্তি দিয়েছিল। দিয়েছিল কাজের নিশ্চয়তা। ২০ বছর পরে সোভিয়েত সরকার আইনি গর্ভপাতকে বাতিল করে দিয়েছিল। গর্ভপাতের সমস্যা দূর করতে রাষ্ট্র মাতৃত্বের গৌরব প্রতিষ্ঠা করল। ফলে ১৯৪৪ সালে রাশিয়া হল গর্ভপাত মুক্ত।

সোভিয়েতের চোখে মাতৃত্ব
সোভিয়েত রাষ্ট্রে মাতৃত্ব ছিল গৌরবের। এই গৌরবকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাষ্ট্র বিভিন্ন পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল। এই পদক্ষেপগুলি হলো গর্ভকালীন অবস্থায় সব নারীই নিশ্চিত চিকিৎসা সেবা পেত। ভবিষ্যৎ মায়ের জন্য ৬-১২ সপ্তাহ ছুটি বরাদ্দ করা হয়েছিল। কর্মক্ষেত্রেই গড়ে উঠেছিল নার্সারি, সেখানে নবজাত সন্তানের জন্য ২ মাস থেকে ৫ বছর পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে সন্তান প্রতিপালনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যাতে কর্মক্ষেত্রে কোন মা অসুবিধায় না পড়ে। প্রতি সাড়ে ৩ ঘন্টা অন্তর শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য মায়েদের কর্মস্থল থেকে ছুটি দেয়া হত। অর্থাৎ শিশুর লালন-পালনের জন্য রাষ্ট্র সব দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। আর আইন করে এইসব ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা হল। এইসব ব্যবস্থার ফলে একজন নারী মাতৃত্বের দায়িত্ব পালনে সক্ষম হল, পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে একজন শ্রমজীবী নাগরিক হিসেবে তার মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানও রক্ষা পেত।

বিপ্লবের কয়েক বছর আগেও রাশিয়ায় গর্ভবতী নারী ও শিশু মৃত্যুতে প্রথম সারিতে ছিল। একের পর এক পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলে সেখানে মা ও শিশু মৃত্যুর হার সবচেয়ে কমে গেল। নতুন আইনের প্রণয়নের পরে সোভিয়েত মায়েরা ৩৪ লক্ষ ডলার আর্থিক অনুদান পেয়েছিল। রাষ্ট্র সমস্ত গর্ভবতী নারীকে নিয়মিত বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিসেবা দিত। সোভিয়েতের সমস্ত শহর জুড়েই ছিল মাতৃত্বকালীন হাসপাতাল, গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র।

ব্রিটিশ ও আমেরিকার একটি রিপোর্ট এইসব উৎকর্ষতাকে স্বীকার করেছিল। স্যার অর্থার নিউজ হোলম্স এবং ডঃ জে এ কিংসবারি ১৯৩৩ সালের এক সমীক্ষায় স্বীকার করেন- “সোভিয়েত মায়েদের এবং সন্তানদের চিকিৎসা, স্বাস্থ্যজনিত সেবা, উন্নত কর্মপদ্ধতি, বিজ্ঞা ভিত্তিক কাজ, অর্থনৈতিক সুবিধাপ্রদান আমাদের বিস্মিত করেছে, মাতৃত্ব এবং শিশু পরিচর্যার প্রতিষ্ঠান এবং তাদের কাজকর্মের প্রভাব আর কোথাও এমন হয় কিনা সন্দেহ।”

গণিকাবৃত্তি ও সোভিয়েত দৃষ্টিভঙ্গি
পুঁজিবাদ গণিকাবৃত্তির দায় নারীর উপর চাপিয়ে দেয়। ফলে সকল ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা করে নারীর জন্য। কিন্তু কেন একজন নারী এই বৃত্তি গ্রহণ করে তার কারণ অনুসন্ধান করে না। এই গণিকা বৃত্তি প্রশ্নে সোভিয়েত দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। “রাশিয়ার মানুষকে ভেঙেচুরে নতুন করে তৈরি করতে গিয়ে লেনিন ও তাঁর অনুগামীরা শুরু করলেন নারীকে দিয়ে, পুরুষকে দিয়ে নয়।—- শুধু নারীদের জন্যই সেখানে নারীমুক্তির কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়নে নারীমুক্তির কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে সমগ্র মানবজাতির জন্য। ”

বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, যতদিন নরনারীর মধ্যে অসাম্য থাকবে ততদিন মানবজাতির পূনর্গঠন অসম্ভব। ব্যভিচার ও গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের শুরুতেই তাঁরা ঘোষণা করলেন, মানবজাতি অবিভাজ্য।

১৯২৩ সাল থেকে সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা এই গণিকাবৃত্তি বিরুদ্ধে অভিযানের প্রস্তুতি শুরু করলেন। প্রথম আঘাত একটা সোরগোল ফেলে দিল। এই ধরণের চেষ্টা কখনও হয়নি। একটা প্রশ্নপত্র ছাপানো হল এবং তা গোপনে হাজার হাজার নারীর মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হল। প্রশ্নপত্র তৈরি করেছিলেন নারী-পুরুষ ডাক্তার, মনোবিদ, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা।

নারী কেন এই জীবন গ্রহণে বাধ্য হয় সে প্রসঙ্গে এই হল প্রথম গণনিরীক্ষা। — কয়েকজনকে প্রশ্ন করে নয়, সিদ্ধান্ত করা হয়েছে নানা সামাজিক স্তরের, বিভিন্ন বয়সের অসংখ্য নারীকে সোজাসুজি প্রশ্ন করে। সমস্ত জবাব ছিল লিখিত এবং জমা দেওয়া হয়েছিল চূড়ান্ত গোপনীয়তার মধ্যে।

সেই অভূতপূর্ব প্রশ্নগুলো বহু যুগ সঞ্চিত বিশ্বাসের ভিত্তিমূলে আঘাত দিয়েছিল। সোভিয়েত অনুসন্ধানকারীদের যা অবাক করল, তা হল প্রায় প্রতিটি জবাবের খোলাখুলি ভাব। কারণ, ওঁরা নিশ্চিত ছিল, জবাব গোপন থাকবে।

এই নিরীক্ষা থেকে যে সিদ্ধান্ত পাওয়া গেল, সাধারণ মানুষের কাছে তার বিস্ময়কর দিক হল- পেশাদার গণিকা ও সাধারণ নারীর মধ্যে সুনির্দিষ্ট কোন বিভেদ রেখা বাস্তবে নেই।…যারা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তাদের মধ্যে একটা বড় অংশই বলেছেন যে, পরিবারের সামান্য আয়ে জীবন ধারণ অসম্ভব। তাই পরিবার ও সন্তান সন্ততিদের বাঁচানোর জন্য এই পথ গ্রহণে তাঁরা বাধ্য হয়েছিলেন।

জীবন ধারণের জন্য নারী কেন গণিকাবৃত্তি গ্রহণ করে? সোভিয়েত প্রশ্নাবলীর যে উত্তর পাওয়া গেল তা প্রায় সর্বসম্মত দারিদ্রের চাপে, অর্থনৈতিক নিষ্পেষণে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে মেয়েরা এই জীবন গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। সোভিয়েত নারীরা জোরের সাথে আর একটা উত্তর লিখলেন। এই পথে তাঁরা পা দিয়েছেন কারও না কারও প্ররোচনাতেই। প্ররোচনা দিয়েছে সেই নারী বা পুরুষ যারা গণিকাবৃত্তিকে মুনাফা অর্জনের কাজে ব্যবহার করছে অর্থাৎ গণিকালয়ের পরিচালকেরা। প্রশ্নোত্তর পত্রে অধিকাংশ মেয়েই বলেছিল, যদি মর্যাদাপূর্ণ কাজ পাওয়ার সামান্যতম সম্ভাবনাও থাকে তবে তাঁরা তাঁদের জীবনকে নতুনভাবে তৈরি করার চেষ্টা করবে।

এই গণিকাবৃত্তি রোধে সোভিয়েত সরকার ধাপে ধাপে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। ১৯২৫ সালে “গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের কর্মসূচী” এই শিরোনামে আদেশ জারী হল। এই ধাপে সমস্ত নারীদের জন্য কাজের নিশ্চয়তা, স্কুল ও ট্রেনিং সেন্টারগুলিতে মেয়েদের অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা, আবাসনের ব্যবস্থা করা, গৃহহীন নারী ও শিশুদের নিরাপত্তার জন্য সব ধরণের ব্যবস্থা করা ও সচেতনতামূলক কমসূচি বাস্তবায়নের জন্য সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান, ট্রেডইউনিয়ন, কো-অপারেটিভ, গণসংগঠনকে আহ্বান জানান হল।

এরপর সোভিয়েত সরকার একটি বিস্ময়কর ডিক্রী জারী করল। এরপর যখনই কোন অফিসার বাড়ী, পানশালা বা অন্ধকার রাস্তায় পতিতাদের খোঁজে অভিযান চালাত, তখন উপস্থিত সমস্ত পুরুষদের নাম, ঠিকানা ও কোথায় সে কাজ করে ইত্যাদি লিখে নিতে হতো। খদ্দেরকে গ্রেফতার করা হত না। কিন্তু পরদিন, একটা জনবহুল এলাকায় তাদের নাম-ধাম পরিচয় জানিয়ে বড় বড় অক্ষরে লিখে দেওয়া হত – “নারী দেহের ক্রেতা”। আর এটা লেখা থাকত বেশ কয়েকদিন ধরে। কারখানার বুলেটিন বোর্ডে বড় বড় আবাসনের গায়ে নামের তালিকা চোখে পড়ার মত করে টাঙানো থাকত। আর নাটকের মাধ্যমে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করতেও সরকার উদ্যোগ নিয়েছিল।

সোভিয়েত ডিক্রী এই শক্তিশালী গোপন সামাজিক বিবেককে গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে বিধ্বংসী অস্ত্রে পরিণত করল। এক ধাক্কায় ব্যক্তি বিবেক গণনিরাপত্তার হাতিয়ারে পরিণত হল।… বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, এই ব্যবস্থায় নৈতিকতার কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না, কোন শাস্তির ব্যবস্থা ছিল না। এর পরিবর্তে বলা হল, নতুন এই রাষ্ট্র গণিকাবৃত্তিকে অনৈতিক মনে করে – কারণ, এর ফলে মানুষ ঘৃণ্যতম শোষণের শিকার হয়। ১৯২৬ সাল থেকে যৌনরোগ বিরোধী সোভিয়েত অভিযান কিন্তু কার্যকরভাবে সংগঠিত হয়েছে। ১৯৩১ সালের শেষ দিকে এই পরিকল্পনা এতটাই সফল হল যে, রোগীর অভাবে বহু ক্লিনিক বন্ধ করে দিতে হল। ১৯৩৮ সালে লালফৌজ ও নৌবাহিনী সিফিলিস ও গণরিয়া মুক্ত হল। নাগরিক জীবনে এই রোগের খুব একটা গুরুত্ব রইল না। বাস্তবে গণিকাবৃত্তি চিরতরে অদৃশ্য হল।

কর্মময় জীবনে সোভিয়েত নারীর অগ্রগতি
প্রথম দিকে নারী শ্রমিকদের অর্ধেকের বেশি ছিল নিরক্ষর। কিন্তু পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রথম বছরেই ১৯৩০ সালে তা কমে গেল আশাতীতভাবে। ১০০ জনের মধ্যে ৮৪.২ ভাগ মেয়ে লেখাপড়ায় পারদর্শী হয়ে উঠল। দলে দলে বিভিন্ন শিল্প-শিক্ষালয়ে গিয়ে ভর্তি হলো তারা। সাধারণ শ্রমিক হয়ে থাকলে চলবে না। দেশের খাতিরে, তাদের আধুনিক বৈজ্ঞানিক শিল্প-শিক্ষায় সুদক্ষ হয়ে উঠতে হবে। ফলস্বরূপ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার দিনগুলিতে দেখা গেল লক্ষ লক্ষ নারী কলকারখানা, ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের নানা ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রত। ১৯৩৭ সালের হিসাব থেকে দেখা যায় যে ৯৪ লক্ষ নারী সোভিয়েট দেশের নানা কাজে-কর্মে নিযুক্ত আছে। ১৯৩৫ সালের একটি হিসাবে মেয়েদের কাজের সংখ্যাগুলি পাওয়া যায়। বড় বড় কলকারখানায় নারীর সংখ্যা ২৬ লক্ষ ২৭ হাজার, নির্মাণকাজে ৪ লক্ষ ৫০ হাজার, যানবহনে ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার, বাণিজ্য ও সাধারণ ভোজনাগারে ৮ লক্ষ ২২ হাজার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও রাষ্ট্রপরিচালনায় ১৯ লক্ষ ৭৮ হাজার এবং কৃষিকাজে ৬ লক্ষ ৮৫ হাজার নারী নিযুক্ত ছিল।

১৯৩৩-৩৪ সালে মেয়েরা মাঠে মাঠে ট্রাক্টর, কমবাইন চালাতে শুরু করেছে। এমনকি ১৯৩৪ সালে একদল মেয়ে ট্রাক্টর — চালক একদল পুরুষদেরকে কাজে হারিয়ে দেয় এবং পরে সেই পুরুষরা মেয়েদের কাছে শিক্ষাগ্রহণ করে। ১৯৩৫ সালে কম্বাইন পিছু ৪০০-৪৫০ একর জমি চাষ করা যেত। সে জায়গায় আমেরিকায় একজন চাষী ৫৫৭.৫ একর জমি তৈরি করতে পারত। ১৯৩৫ সালেই সোভিয়েতের বীর মেয়েরা আমেরিকার রেকর্ড ভঙ্গ করে ১৩৬০ একর জমি প্রস্ততি করেছে।

১৯৩৮ সালের একটা হিসাব থেকে পরিষ্কারভাবে জানা যায় সোভিয়েত সমাজে মেয়েরা কত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছে- বড় বড় শ্রমশিল্পে ৩৯.৮% নারী, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ৩৪%, বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৩.১, চিকিৎসা-শাস্ত্রে ৫০.৬% , শিক্ষাজগতে ৬৪.৮%। পৃথিবীর মধ্যে সর্বপ্রথম নারী রাষ্ট্রদূত হলেন একজন রুশ নারী, ম্যাদাম কোলনতাই। সর্বোচ্চ শাসন পরিষদের সভাপতির মধ্যে দুজন হলেন সভানেত্রী। ১৯৪০ সালের তথ্য থেকে জানা যায়, সে সময়ে যৌথ খামারের সভানেত্রী-সহসভানেত্রীর সংখ্যা হল ১৪ হাজার ২শত এবং খামারের প্রাণীপালন বিভাগের প্রধান পরিচালিকার সংখ্যা হলো ৪০ হাজার।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতায় সোভিয়েত নারী
জারের আমলে ৭০% লোক এক অক্ষর লিখতে পড়তে জানত না। গ্রামের কৃষক মেয়ে ও কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে শিক্ষার অবস্থা ছিল আরো করুণ। ১৯২০ সালে মোট জনসংখ্যার ৬৭% ছিল অশিক্ষিত। মেয়েদের ক্ষেত্রে ছিল ৭৫% । ১৯২৯ সালে ৫৮% মানুষ শিক্ষিত হয়ে উঠেছিল। ১৯৩২ সালের মধ্যে ৯০% মানুষ অক্ষর চিনতে শিখল, নিজের মাতৃভাষাকে ভালবাসতে শিখল। মাত্র ১২ বছরের মধ্যে অশিক্ষিত জনসংখ্যার ৬০% কে শিক্ষিত করে তোলা হল যা ছিল বিস্ময়কর।

শিশু-শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি শিল্পাঞ্চলে, যৌথখামারে, শহরে জনসংখ্যার প্রয়োজন অনুসারে হাজার হাজার ক্লাব গড়ে তোলা হয়েছে। কোথাও সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি কেন্দ্র, কোথাও শ্রমিক সংঘ ক্লাব, অবার কোথাও যৌথ খামার ক্লাব। একই সাথে সজ্জিত পাঠাগার ছিল। এখানে এসে সকলে মনোযোগের সঙ্গে পড়াশোনা করত। নিজেদের দেশের নাান খবর, দেশ-বিদেশের খবর, জ্ঞানবিজ্ঞানের খবর আহরণ করে পারস্পরিক আলোচনার মধ্যে দিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করত। একই সাথে বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হত। এই চক্রগুলি সোভিয়েত সংস্কৃতির জগতে গুরুত্বপূণৃ ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯৩৩ সালের হিসাব থেকে দেখা যায় মোট চক্র সভ্য ছিল ২১ লক্ষ ৭৯ হাজার, তার মধ্যে মেয়েরা ছিল ৯৭ হাজার। এ তথ্য থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে সৃজনীশক্তি, কল্পনাশক্তি ও বৃদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে চক্রের মেয়েরা পুরুষদের প্রায় সমান সমান ছিল।

উল্লেখিত কর্মসূচি নারীকে নতুন জীবন দিয়েছিল। দুনিয়ার সামনে নারীসমাজ ও নারী আন্দোলন নতুনভাবে গড়ে উঠেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের মেয়েরা সবচেয়ে বেশি অধিকারসম্পন্ন শিক্ষিত সুস্থ মানুষ হিসেবে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভূক্ত মুসলিম প্রজাতন্ত্রের মেয়েরা সমগ্র মুসলিম বিশ্বের মধ্যে বৈষয়িক ও মানসিক উভয় দিক থেকে সবচেয়ে স্বাধীন ও অগ্রসর নারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। [আইজাজ, ১৯৯৩]

তথ্যসূত্র:
১. জীবনের সন্ধানে: ডাইসন কার্টার
২. মেয়েদের অধিকার-কল্যাণী রায়, পথিকৃৎ, বিশেষ শারদ সংখ্যা অক্টোবর ২০০০
৩. শতবর্ষে নভেম্বর বিপ্লব: সাংস্কৃতিক ত্রৈমাসিক, প্রমিথিউসের পথে, আগস্ট-অক্টোবর ২০১৬
৪. নারীমুক্তির প্রশ্নে: মার্কস-এঙ্গেলেস- লেনিন-স্তালিন: অনুবাদ-কনক মুখোপাধ্যায়
৫. নারী, পুরুষ ও সমাজ: আনু মুহাম্মদ

সাম্যবাদ মার্চ ২০১৭

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments