Thursday, April 18, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ চলতি সংখ্যাহাওরবাসীকে রক্ষায় অবিলম্বে দুর্গত অঞ্চল ঘোষণা কর — গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা

হাওরবাসীকে রক্ষায় অবিলম্বে দুর্গত অঞ্চল ঘোষণা কর — গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা

বিপর্যস্ত হাওর অঞ্চল পরিদর্শন পরবর্তী গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার সংবাদ সম্মেলনে
জলমহাল ইজারা বাতিল, ঋণ মওকুফ, বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি-গাফিলতির জন্য দায়ীদের শাস্তি দাবি

Screenshot 2017-05-16 20.01.03
গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ গত ১৪ মে সুনামগঞ্জের তাহেরপুর এলাকায় শনির হাওর অঞ্চল পরিদর্শন করে দুর্গত হাওরবাসীর সাথে কথা বলেন এবং পরে সুনামগঞ্জে স্থানীয় রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মী-গণমাধ্যম কর্মী ও বিশিষ্ট নাগরিকদের সাথে মতবিনিময় করেন। সরেজমিন পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা ও গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার বক্তব্য তুলে ধরতে ১৬ মে সকাল সাড়ে এগারটায় তোপখানা রোডস্থ নির্মল সেন মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন মোর্চার সমন্বয়ক ফিরোজ আহমেদ। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী)-র কেন্দ্রীয় নেতা শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনয়েদ সাকি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আহ্বায়ক হামিদুল হক, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ নেতা নজরুল ইসলাম, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির আকবর খান প্রমুখ।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী বলেন, কোন এলাকার উৎপাদনব্যবস্থা বিপর্যস্ত হলে তাকে দুর্গত অঞ্চল ঘোষণা করা যায়। দুর্গত অঞ্চল ঘোষিত হলে ওই অঞ্চলের অভাবী মানুষের খাদ্য সংস্থান সরকারী দায়িত্বে করতে হবে। পাশাপাশি জলমহাল ইজারা চুক্তি বাতিল করে সর্বসাধারণকে মাছ ধরার অধিকার দিয়ে বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে। সরকার বন্যার আগাম সতর্কীকরণ ও প্রতিরোধের মাধ্যমে হাওরের ফসল রক্ষার দায়িত্ব পালন করেনি।

আরেক প্রশ্নের জবাবে জোনায়েদ সাকী বলেন, সরকার হাওরবাসীর দুর্দশার প্রকৃত চিত্র ও মাত্রা আড়াল করছে। ত্রাণ সাহায্য অপ্রতুল, যেটুকু করা হচ্ছে তা নিয়েও সরকারদলীয়দের দুর্নীতি-লুটপাট চলছে। দুর্গত মানুষদের জন্য আগামী অন্ততঃ ৬ মাস রেশনিং-এর ব্যবস্থা করা দরকার। পর্যাপ্ত সহযোগিতা না পেলে হাওরে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি সৃষ্টির আশংকা আছে। পাশাপাশি, বছর বছর ভারী বর্ষণ বা অকাল বন্যায় হাওরে ফসলহানি স্থায়ীভাবে রোধ করতে নদীখনন ও মজবুত বাঁধ নির্মাণ করা দরকার।
মোশরেফা মিশু বলেন, প্রতিবছর অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য সরকারী বরাদ্দ জনপ্রতিনিধি, শাসক দলের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা, দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদার এরা মিলে লুটপাট করে। এদের দুর্নীতি ও গাফিলতির কারণে সময়মত ও মজবুতভাবে হাওর রক্ষা বাঁধগুলো পুনঃনির্মাণ-সংস্কার না হওয়াতে অকাল বন্যায় এবার প্রায় সম্পূর্ণ ফসলহানি হয়েছে। এদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে ভবিষ্যতে একই ঘটনা ঘটবে।

সংবাদ সম্মেলনে দাবি জানানো হয় — হাওর অঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করে আগামী ফসল না আসা পর্যন্ত প্রতিটি পরিবারকে প্রয়োজনীয় খাদ্য সহায়তা প্রদান, হাওরের সকল প্রকার ইজারা অন্তত দুবছরের জন্য বাতিল করে ভাসান পানিতে মাছ ধরার অধিকার সকলের জন্য উন্মুক্ত করা, কৃষিঋণ-এনজিও-মহাজনী ঋণ আদায় স্থগিত ও সুদ মওকুফ, হাওরের পানিতে দূষণ বা বিষক্রিয়ার সম্ভাব্য কারণ উদঘাটন করতে আস্থাভাজন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে।

হাওর ও হাওরবাসীকে রক্ষায় এ সকল দাবিতে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার উদ্যোগে আগামী ১৮ মে বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনের লিখিত পূর্ণ বক্তব্য —

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুরা,
গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার ডাকে আজকের এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হবার জন্য আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। গত ১৪ মে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ সুনামগঞ্জের তাহেরপুর এলাকায় শনির হাওর অঞ্চল পরিদর্শন করে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি দুর্গত হাওরবাসীর বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের সাথে কথা বলেন, তাদের দাবি দাওয়া ও মতামত শোনেন এবং হাওর ও হাওরবাসীকে রক্ষায় বিশ্বম্ভরপুরে একটি স্থানীয় উদ্যোগে ত্রাণ কার্যক্রমে দুর্নীতির প্রতিবাদে আয়োজিত একটি মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করেন; নেতৃবৃন্দ তাহেরপুর বাজারেও গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার উদ্যোগে একটি সমাবেশে অংশগ্রহণ করেন। সবশেষে তারা সুনামগঞ্জে একটি সংবাদ সম্মেলনে গণমাধ্যমের সামনে কথা বলেন। সেখানে সংবাদকর্মীদের বাইরে স্থানীয় রাজনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী ও বিশিষ্ট নাগরিকদের অনেকেই উপস্থিত হন এবং গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময় করেন। হাওরের বিপর্যস্ত মানুষরা, স্থানীয় সচেতন ও উদ্বিগ্ন নাগরিকরা যে চিত্রটি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন, তা সাথে সরকারের বক্তব্য ও প্রতিশ্রুতির পার্থক্য ও গরমিল বিশাল। গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার এই কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দলে অন্যান্যদের মাঝে ছিলেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় নেতা শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনয়েদ সাকি ও গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার সমন্বয়ক ফিরোজ আহমেদ, তাদের সাথে ছিলেন সিলেট জেলা বাসদ-মার্কসবাদী আহবায়ক উজ্বল রায়সহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ।

সাংবাদিক বন্ধুরা,
এর আগে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার নেতৃবৃন্দ কিশোরগঞ্জের নিকলিতে হাওর এলাকা পরিদর্শন করেছেন, কর্মসূচি পালন করেছেন নেত্রকোনায়। সর্বত্র সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করে আমাদের এই প্রত্যয়টিই দৃঢ় হয়েছে যে, প্রায় সব প্রসঙ্গে সরকারের দাবি, বক্তব্য ও চিত্রের সাথে বাস্তব অবস্থার মিল সামান্যই। আমরা নিশ্চিত যে, সরকার যা প্রচার করছে, প্রকৃত অবস্থা তার তুলনায় অনেক বেশি বিপর্যয়কর। যতই সময় যাচ্ছে হাওর এলাকায় আরও ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা তত বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা শেষ পর্যন্ত হাওর ও হাওরবাসী উভয়ের জন্যই শুধু ভয়াবহ হবে না, গোটা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নৈরাজ্যকে আরও ঘনীভূত করবে। আজকেই আপনারা দেশের একটি শীর্ষ দৈনিকের প্রধান খবর দেখতে পাবেন, চালমালিকেরা সরকারকে চাল সরবরাহ বন্ধ করেছে, চালের দাম বিপুল হারে বাড়বে বলে তারা অনুমান করছে। এর সাথে হাওরের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুরা,
প্রথমেই সংক্ষেপে হাওরে এই বিপর্যয়ের দায় কার, সে বিষয়ে খানিকটা আলাপ করে নেয়া দরকার। হাওরের প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল হাওরবাসী এ বছরের ঢল শুরুর আগেই গত ১৬ মার্চ সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুরে বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতের কাজ শেষ করে হাওর ও হাওরবাসীকে রক্ষার দাবিতে কর্মসূচি পালন করেছেন, এর আগেই তারা ধর্ণা দিয়েছেন স্থানীয় প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে। ফলে এই ঢলকে আকস্মিক বলা যায় না কিছুতেই, স্থানীয় মানুষ এর বিপদ সম্পর্কে সচেতন ও উদ্বিগ্ন ছিলেন, তারা যথোপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে সেটা সম্পন্ন করার জন্য তাগাদাও দিয়েছেন। এই বাঁধ আরও আগেই মেরামত হয়ে যাবার কথা ছিল। বরং ঠিকাদার ও কর্তৃপক্ষের গাফিলতি, দুর্নীতি ও অবহেলাই পাহাড়ী ঢলে এত বিপুল ফসল ধ্বংসের কারণ হতে পেরেছে। এ প্রসঙ্গে স্থানীয় বহু মানুষ আমাদের বলেছেন, ঠিকাদার ও সরকারী প্রকৌশলীরা প্রতি বছরই বাঁধ নির্মাণের নামে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি করে থাকেন। হাওরবাসীরা এর প্রতিবাদ করলেও ঢল থেকে অবশিষ্ট ফসল রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন বলে বড় কোন আন্দোলন হয় না। এই সুযোগটিই কাজে লাগান ক্ষমতাসীন দল ও ঠিকাদাররা।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুরা,
সরকারী নানান হিসেব ও পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী আমরা জানি যে, প্রায় ২২-২৫ লক্ষ পরিবার হাওরের ধান নষ্ট হয়ে যাওয়াতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মৎস্য সম্পদ বিপুল পরিমানে নষ্ট হয়ে যাওয়া ছাড়াও বিপুল পরিমান খড় নষ্ট হওয়াতে গবাদি পশুর খাদ্যেরও মারাত্মক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। অথচ সরকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের এক তৃতীয়াংশকেও ত্রাণের আওতায় আনেননি। সেই ত্রাণ নিয়েও যে দুর্নীতি হয়েছে তা সীমাহীন। লন্ডন প্রবাসীর নাম যেমন ত্রাণের তালিকাতে আছে, তেমনি আছে শিশুদের নাম। এমন উদাহরণ অজস্র। অথচ দুর্গত এবং বিশেষ করে দুর্গম অঞ্চলের অধিকাংশ পরিবার কোন ত্রাণ পায়নি। নিকলী এবং তাহেরপুরের অধিকাংশ মানুষ জানিয়েছেন, মাথাপিছু ৩৮ কেজি চাল থেকে ৩ বা ততোধিক কেজি চাল কেটে রাখা হয় শ্রমিক খরচা বাবদ, যা পরিমানের দিক দিয়ে বিশাল।

কাজের খোঁজে হাওর এলাকায় বিপুল পরিমাণ বাইরের মানুষ আসেন এই সময়ে। ধান তোলা, মাড়াই করা, পরিবহন এবং বিক্রির উদ্দেশ্যে। অথচ এ বছর এই ভরা মওসুমে হাওর থেকে বিপুল পরিমান মানুষ বাইরে চলে গেছেন কাজের সন্ধানে। আমরা গোপীনাথের নয়াগাঁও গ্রামটিতে দেখেছি পাশাপাশি চারটি বাড়িতে তালা দেয়া, পরিবারের সবাই অন্যত্র চলে গিয়েছেন জীবন বাঁচাবার তাগিদে।

ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম ও দুর্নীতির পাশাপাশি চরম গাফিলতি ও দায়িত্বহীনতাও আছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। হাওর নয় এমন অঞ্চলেই হাওরবাসীদের নামে বরাদ্দকৃত চালের বড় অংশটা চলে গিয়েছে প্রশাসনের গাফিলতি ও অজ্ঞতার কারণে, এমনটা জানিয়েছেন সুনামগঞ্জের বেশ কয়েকজন নাগরিক।

সাংবাদিক বন্ধুরা,
বিপুল ফসল, হাঁস ও গবাদিপশুর মৃত্যুর ফলে কর্মসংস্থানহীনতা এবং ত্রাণ বন্টনে অনিয়ম ও দুর্নীতির পরও হাওরবাসী পরিস্থিতি সামলে উঠতে পারতেন যদি হাওরের প্রধান সম্পদ মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করার মুক্ত অধিকার তারা পেতেন। নতুন ঢলের সাথে হাওরে মাছের সরবরাহ বাড়ে, তাকে স্থানীয় পরিভাষায় বলা হয় ‘ভাসান পানির মাছ’। এই মাছ ধরাই হাওরবাসীর ঐতিহ্যবাহী জীবিকা। সরকারের বিপর্যয়কর জলমহাল নীতির কারণে এই হাওরগুলোর অধিকাংশ বিলের দখল ইজারাদারদের হাতে। এই ইজারাদাররা সামান্য পরিমাণ জমি ইজারা নিয়ে বিশাল এলাকার ওপর নিেেজদের কর্তৃত্ব কায়েম করে পুলিশ, রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং ভাড়াটে বাহিনী দিয়ে। এর ফলে হাওরবাসী তাদের জীবিকা হারান, মাছ ধরার একক কর্তৃত্ব চলে যায় ইজারাদারদের হাতে।
এর ফলে যে শুধু হাওরবাসী জীবিকাও হারাচ্ছেন তাই নয়, হাওরে মাছের উৎপাদনও বছর বছর হ্রাস পাচ্ছে। ইজারাদাররা বিশাল আকৃতির, কারেন্ট জালের চেয়েও সূক্ষ্ম জাল দিয়ে পোনা মাছ শুদ্ধ তুলে ফেলে, এর ফলে মাছের ডিমও রক্ষা পায় না। হাওরের মৎস্য সম্পদ এর ফলে ধ্বংস হচ্ছে, স্থানীয় প্রজাতিগুলো বিলুপ্ত হচ্ছে। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে অচিরেই হয়তো হাওরে মাছ আবাদের পুরোটাই কৃত্রিমভাবে পোনা ছেড়ে করতে হবে। হাওরবাসী প্রতিটি মানুষের মুখে যে দাবিটি আমরা শুনেছি, সেটি হলো হাওরের বিলগুলোকে ইজারাদারদের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে হাওরের মাছকে বিলুপ্তির হাত থেকে উদ্ধার করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা আমাদের জানিয়েছেন, জলমহাল ইজারা বাতিল করে জেলেদের মাছ ধরতে দিলে মাছের উৎপাদন বহুগুণ বেশি বৃদ্ধি পাবে, আরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে। হাওরবাসী দুর্যোগ আক্রান্ত কর্মহীন মানুষকে রক্ষার জন্য অন্তত আগামী দুই বছরের জন্য হাওরে সকল জলমহাল ইজারা বাতিল ঘোষণা করতে হবে।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
হাওরবাসীর কাছ থেকে এর বাইরেও বেশ কিছু দাবি আমরা জানতে পেরেছি। সংক্ষেপে তাদের দাবিগুলো আমরা যথাসাধ্য তুলে ধরছি:

  1. অবিলম্বে বাংলাদেশের আইন অনুযায়ীই হাওর অঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করে আগামী ফসল না আসা পর্যন্ত প্রতিটি পরিবারকে প্রয়োজনীয় খাদ্য সহায়তা দিতে হবে।
  2. হাওরের সকল প্রকার ইজারা অন্তত দুবছরের জন্য বাতিল করতে হবে এবং ভাসান পানিতে মাছ ধরার অধিকার সকলের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে।
  3. কৃষিব্যাংঙ্কের ঋণের সুদ অর্ধেক নয়, পুরোপুরি মওকুফ করতে হবে। দুর্যোগ না কাটা পর্যন্ত এনজিও ও মহাজনী ঋণ আদায় স্থগিত ও সুদ বাতিল করতে হবে। আগামী বছরের ফসল ও গবাদি পালনের জন্য জরুরি ভিত্তিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষি ঋণ প্রদান করতে হবে।
  4. কাজের সন্ধানে পুরুষশূন্য হাওর অঞ্চলে ডাকাতি ও অন্যান্য তৎপরতা রোধে বন্দোবস্ত নিতে হবে, নারীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।
  5. হাওরে বিদ্যালয়গুলোতে ঝরে পড়ার হার বেড়েছে, হাওরে বাল্যবিবাহও বিপুল হারে বাড়বে বলে জানিয়েছেন হাওরবাসী। হাওরের বিদ্যালয়গুলোতে উপস্থিতির বিনিময়ে জরুরি ভিত্তিতে খাদ্য সহায়তা প্রদান ও বাল্যবিবাহ রোধে কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
  6. দুর্নীতিবাজ ও দায়িত্ব পালনে অবহেলা দেখানো সরকারী কর্মকর্তাদের কাজের খতিয়ান নিয়ে প্রয়োজনবোধে যথোপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে যাতে ভবিষ্যতে হাওরে এমন বিপর্যয় আর না আসে।
  7. সরকারী ওএমএস চালের দাম কম হলেও তা মাত্র মাথাপিছু ৫ কেজি কেনা যায়। হাওরের একমাত্র পরিবহন নৌকাতে ৫০ থেকে ৮০ টাকা পরিবহন ভাড়া দিয়ে এই চাল কেনা অলাভজনক হয়ে যায়। প্রতিটি গ্রাম ও নিকটবর্তী হাটে এই চাল বিক্রির বন্দোবস্ত করতে হবে।
  8. হাওরে এত বিপুল পরিমান মাছ ও হাঁসসহ অন্যান্য প্রাণির মৃত্যুর কারণ বিষয়ে সরকার কোন গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা প্রদান করেনি। এই সংবাদ সম্মেলন থেকে আমরা দাবি করছি, আস্থাভাজন ব্যক্তি ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে পানি, মৃত প্রাণী ও খনিজ নমুণা সংগ্রহ দূষণ বা বিষক্রিয়ার সম্ভাব্য কারণ উদঘাটন করতে হবে। আমরা উদ্বেগের সাথে এই বিষয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই যে, কেবলমাত্র মেঘালয় সীমান্তের হাওরেই মাছ ও হাঁসমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। মেঘালয় থেকে দূরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নেত্রকোনার নিকলির হাওড়ে এই ধরনের ঘটনা ঘটেনি। মেঘালয়ের খাসিয়া আদিবাসীরা বহু বছর ধরেই ভারত সরকারের কাছে ইউরেনিয়াম খনিজাত পারদ ও অন্যান্য দূষণ বিষয়ে বারবার উদ্বেগ উত্থাপন করে আসছে। বাংলাদেশ সরকারের কাছেও আমরা সেই দাবি জানাচ্ছি।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুরা,
হাওরের যতগুলো অঞ্চলে আমরা পরিদর্শনে গিয়েছি, দেখেছি তাদের টিকে থাকার লড়াই। পরের কাছে যথাসম্ভব হাত না পেতে গলা পানিতে, কিংবা কখনো তারও গভীর পানিতে ডুবে ডুবে তারা এখনও সংগ্রহ করে চলেছেন ডুবে যাওয়া ধান। বিপুল পরিশ্রমে পাওয়া এই ধানের এক মণে খুব বেশি হলে হয়তো দশ কেজি চাল মিলবে, তাও দুর্গন্ধযুক্ত এবং অপুষ্ট। তারা চেষ্টা করছেন সামান্য খড়ও যদি বাঁচানো যায় গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবে। জলমহাল ইজারাপ্রথা না থাকলে এবং দুর্নীতিবাজ আমলা ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের কবলে তারা নিজেরা যেমনি বিপর্যস্ত হয়েছেন, তেমনি গোটা বাংলাদেশও একটা ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। হাওরের বিপর্যয় তাই কেবল কয়েকটি জেলাতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং মাছ ও ধান উৎপাদন, হাঁস ও হাঁসের ডিম ও গবাদি পশুর উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের দিক দিয়ে চিন্তা করলে হাওরের এই বিপর্যয়কে একটি জাতীয় বিপর্যয় হিসেবেই বিবেচনা করা প্রয়োজন।

সংগ্রামী বন্ধুগণ,
আগামী ১৮ মে বৃহস্পতিবার গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা হাওর ও হাওরবাসীকে রক্ষায় এই কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নের দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ ও বিক্ষোভ কর্মসূচির আয়োজন করেছে। এছাড়া, গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার অন্তর্ভূক্ত দল ও সংগঠনসমূহের উদ্যোগে ত্রাণ তৎপরতাও অব্যাহত থাকবে। আমাদের এই কর্মসূচির সংবাদ ও হাওরের মানুষের কথা আপনারা গণমাধ্যমের সাহায্যে পৌঁছে দেবেন দেশবাসীর কাছে, এই আমাদের প্রত্যাশা।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments