Tuesday, April 23, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - মার্চ ২০১৮৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস ইতিহাসের এক উজ্জ্বল দিন

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস ইতিহাসের এক উজ্জ্বল দিন

28660895_2050962415160230_3389448267268607027_n

১৮৫৭ সালে নিউইয়র্কের সেলাই কারখানার নারী শ্রমিকদের আন্দোলন থেকে ঐতিহাসিক ৮ মার্চের উদ্ভব। বর্তমানে বাংলাদেশে যেমন গার্মেন্টসে নারীরা শ্রম দেয় তেমনি নিউইয়র্কের বস্ত্র কারখানায় তখন নারী শ্রমিকরা কাজ করত। তাদের দৈনিক ১৫ ঘন্টার বেশি পরিশ্রম করতে হতো। কিন্তু, সে অনুপাতে মজুরি দেয়া হতো না। সুঁচ, সুতা, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক যেসব জিনিসপত্র নারীরা ব্যবহার করত, মালিকরা তার মূল্য বেতন থেকে কেটে রাখত। বিলম্বে ফ্যাক্টরিতে যাওয়া, কাজের তি করা অথবা টয়লেটে বেশি সময় নেয়ার জন্য শ্রমিকদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হতো। মালিকদের এ অমানবিক শোষণের বিরুদ্ধে ১৮৫৭-এর ৮ মার্চ নিউইয়র্কের সেলাই কারখানায় নারী শ্রমিকরা উপযুক্ত বেতন, উন্নত কর্মপরিবেশ ও দশ ঘন্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে নামে। আন্দোলন দমনে পুলিশ সেদিন হাজার হাজার নারী শ্রমিকের মিছিলে গুলি চালায়। এতে আহত ও গ্রেফতার হয় অসংখ্য নারী। ধারণা করা হয়, নারী আন্দোলনের ইতিহাসে এটি ছিল প্রথম গুলি চালানোর ঘটনা। ফলে আন্দোলন আরো জোরদার হয়। পরবর্তীতে, নারীর ভোটাধিকারের বিষয়টি আন্দোলনের অন্যতম কর্মসূচি হিসেবে সামনে আসে। এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আসে ১৮৮৬ সালের মে দিবস। রচিত হয় শ্রমিক দিবসের ইতিহাস। কারণ ঊনবিংশ শতাব্দিতে আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলন ও সর্বহারা শ্রেণির মুক্তি আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিল। একই সাথে বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবী নারীদের অধিকার ও দাবি-দাওয়ার জন্য আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল। এসব আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে থাকা নারীরা এবং তাদের নেতৃত্বে এ আন্দোলনসমূহ গতি পেয়েছিল। জার্মান কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেত্রী ক্লারা জেটকিন ছিলেন তাঁদের অন্যতম।

কে এই ক্লারা জেটকিন? ১৮৫৭ সালের ১৫ জুলাই জার্মানির ছোট্ট একটি গ্রামে ক্লারা জেটকিনের জন্ম। তার মা জেসেফিন ফিটেল আইসনার ছিলেন একজন শিক্ষিত  নারী। তিনি ফরাসি বিপ্লবের অবাধ স্বাধীনতা ও ভ্রাতৃত্বের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। মায়ের আদর্শে প্রভাবিত হয়ে তিনি মার্কসবাদী রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত হন। মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি শ্রমিক আন্দোলন ও নারী আন্দোলনকে বিচার করেছেন। ১৮৭৮ সাল থেকে জার্মানিতে তিনি নারীদের উপর শোষণ ও নিপীড়নের কারণ, তার তত্ত্বগত ভিত্তি নির্মাণ ও শ্রমিক শ্রেণির মুক্তি আন্দোলন তথা নারী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, অগাস্ট বেবেল, মার্কসের কন্যা লারা লাফার্গ, কার্ল লিবনেখ, রোজা লুক্সেমবার্গসহ বহু বিশ্ব নেতৃত্বের সাথে তার গভীর হৃদ্যতা ছিল। মহামতি লেনিন ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পূর্বে ও পরে নারীদের প্রশ্নে নানা বিষয় নিয়ে লেনিনের সাথে তর্ক-বিতর্ক করেছেন। ‘নারীদের প্রশ্নে লেনিন’ বইটি ছিল ক্লারা জেটকিনের সাথে লেনিনের সাক্ষাৎকার, যা ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে আজও আমাদের পাঠ্য। ক্লারা জেটকিন ১৮৮৯ সালে প্যারিসে ফ্রেডরিখ এঙ্গেলেসের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের প্রশ্ন উত্থাপন করে বক্তৃতা দেন। তাঁর এ বক্তব্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নারীদের মধ্যে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করে।

১৯০৮ সালের ৮ মার্চ আমেরিকার নিউইয়র্কে শ্রমঘন্টা কমানো, মজুরি ব”দ্ধি ও ভোটাধিকারের দাবিতে প্রায় ১৫,০০০ নারী ও অভিবাসী শ্রমিকদের অংশগ্রহণে মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। তাদের শ্লোগান ছিল ‘Bread and Roses’। ‘Bread’ ছিল তাদের অর্থনেতিক নিশ্চয়তার প্রতীক এবং Roses’ ছিল তাদের জীবনমান উন্নয়নের প্রতীক। এই সমাবেশ বিভিন্ন দেশের সমাজতান্ত্রিক নারী আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছিল। ওই দিবসের স্মরণে ‘সোসালিস্ট পার্টি অব আমেরিকা’ ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আমেরিকাব্যাপী ‘জাতীয় নারী দিবস’ পালনের ঘোষণা দিয়েছিল। ওই বছরেই নভেম্বর মাসে ট্রায়াঙ্গেল শার্টওয়েস্ট কারখানায় শ্রমিকরা ধর্মঘট শুরু করেছিল। ধর্মঘটরত শ্রমিকদের ৮০ শতাংশই ছিল নারী। তাদের এ ধর্মঘট ১৯১০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলতে থাকে। ওই একই সালে ‘মে দিবসে’ ৬০ হাজার শ্রমিক এর প্রতিবাদে সমাবেশ করে। সমস্ত দিক থেকে এ আন্দোলনের প্রভাব ছিল বিশাল। একদিকে শ্রমিক আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ যেমন বৃদ্ধি পেয়েছিল, অন্যদিকে নারী-পুরুষের ভোটাধিকারের দাবিও জোরালো হয়ে উঠেছিল।

এই উত্তাল পরিস্থিতিতে ১৯১০ সালের আগস্ট মাসে কোপেনহেগেনে কমিউনিস্টদের ‘দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ পালনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। একই বছরে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারীদের দ্বিতীয় সম্মেলন’ও কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয়। এতে ১৭টি দেশের ১০০ জন নারী প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। এই সম্মেলনে ক্লারা জেটকিন সম্পাদক হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হন। এই সম্মেলনে নিউইয়র্কের নারী শ্রমিকদের আন্দোলনকে স্বীকৃতি দিয়ে ক্লারা জেটকিন প্রতিবছর ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ পালনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। মহামতি লেনিনের সমর্থনে অপরাপর সদস্যবৃন্দ সেই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন। এ সম্মেলনে স্থির হয় মার্চ মাসের যেকোনো দিন এই দিবসটি পালন করা হবে। পরের বছর অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড এবং জার্মানিতে প্রথমবারের মতো নারী দিবস পালিত হয়। ১৯১৩ ও ১৯১৪ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবস প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতিবাদ হিসেবে পালিত হয়। উল্লেখ্য, ১৯১০ থেকে ১৯১৩ পর্যন্ত মার্চের যেকোনো দিন বিভিন্ন দেশে নারী দিবস পালন করা হতো। কিন্তু, ১৯১৪ থেকে সুনির্দিষ্টভাবে ৮ মার্চ নারী দিবস পালিত হচ্ছে।

এ বছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ১০৮তম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে। মানুষ হিসেবে একজন নারী সামাজিক কর্মকান্ডের বিভিন্ন ধারায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ফ্রান্সের প্যারি কমিউন, ফরাসি বিপ্লব, যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক আন্দোলনসহ ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম , ’৫২-র ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে নারীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে। কিন্তু, কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য নারীসমাজ আজও অর্জন করতে পারেনি। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সর্বত্র নারীরা ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ও মজুরি পুরুষের চেয়ে কম। বিশ্বব্যাংকের ২০১৭ সালের লেবার ফোর্স সার্ভের রিপোর্ট অনুযায়ী, সারা পৃথিবীতে মাত্র ৩৯ শতাংশ নারী উৎপাদনমূলক বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ করছে যেখানে বাংলাদেশে নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ২৯ শতাংশ। পৃথিবীতে নারী-পুরুষের সংখ্যানুপাত প্রায় সমান। অথচ, পৃথিবীর মোট সম্পদের একশ ভাগের মাত্র এক অংশের মালিক নারী। বাংলাদেশের সংবিধানে, আইনে ও সম্পদে নারীর সমঅধিকার নেই। পৃথিবীর সর্বত্র নারী যেমন সহিংসতার শিকার, বাংলাদেশেও নারী সহিংসতার শিকার। ২০১৫ সালের দি ওয়ার্ল্ড উইমেন-এর রিপোর্ট অনুসারে, পৃথিবীতে প্রতি তিনজন নারীর একজন কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার, অন্যদিকে বাংলাদেশে প্রায় ৮০ ভাগ নারী ঘরেই নিকটাত্মীয় দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়। ঘরে-বাইরে-কর্মক্ষেত্রে সর্বত্রই নারী নির্যাতিত, নিপীড়িত। নারীর ন্যায্য অধিকার আদায়ের প্রতীক হিসেবে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেমন তাৎপর্যপূর্ণ তেমনি বাংলাদেশে নারীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামেও এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বিশ্বজুড়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকলেই এ দিবসকে উদযাপন করছে। কিন্তু যে সংগ্রামের ধারাবাহিকতা এই দিবস, তার যথার্থ মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সঠিক ধারার নারী আন্দোলনের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আসুন, সেই সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় নারীমুক্তির আন্দোলনকে বেগবান করি।

সাম্যবাদ মার্চ ২০১৮

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments