Thursday, April 18, 2024
Homeফিচার৮ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি মালিকের দয়া-দাক্ষিণ্যের বিষয় নয়

৮ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি মালিকের দয়া-দাক্ষিণ্যের বিষয় নয়

৮০০০ টাকা মজুরীর দাবীতে মিছিল ১০ ১০ ১৩গত কয়েকদিন আগে একটি খবর দেশের সচেতন মহলে যথেষ্ট আলোড়ন তোলে। বিবিসি’র এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশের গার্মেন্ট সেক্টরে শ্রমিকদের ওপর কি নির্মম শোষণ চালানো হয়। বিবিসিতে প্রচারিত ‘ডায়িং ফর অ্যা বারগেইন’ শীর্ষক এই ডকুমেন্টারিতে দেখানো হয়েছে, হামীম স্পোর্টসওয়্যার নামে একটি কারখানার শ্রমিকদের রাতে তালা দিয়ে রাখা হয় এবং এক নাগাড়ে (এক শিফট) জোরপূর্বক প্রায় ২১ ঘণ্টা কাজ করানো হয়। গোপনে ধারণ করা ভিডিও থেকে প্রমাণ পাওয়া গেছে যে কারখানা কর্তৃপক্ষ দুই ধরনের হাজিরা খাতা ব্যবহার করছে, একটি শ্রমিকদের জন্য, অন্যটি বিদেশী ক্রেতাদের জন্য। গার্মেন্ট সেক্টরে শ্রমিকদের জোর করে অতিরিক্ত খাটানো, নিয়োগপত্র না দেয়া, হাজিরা খাতা ও বেতন-বোনাস খাতা নিয়ে প্রতারণা – এসব বহু পুরনো অভিযোগ। বাম দল, বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, এমনকি অনেক সাংবাদিকও এসব অভিযোগ জানিয়ে আসছিলেন। মালিকপক্ষ কখনো সত্য-মিথ্যায় মিলিয়ে, কখনো আমতা আমতা করে, কখনো নরমে-গরমে এসব অভিযোগ পাশ কাটানো বা অস্বীকার করে আসছেন। কিন্তু বিবিসির ওই প্রতিবেদন নগদ প্রমাণ হাজির করেছে।

বিবিসির এই তথ্যচিত্রটি এমন একটি সময়ে প্রচারিত হয়েছে যখন গার্মেন্ট শ্রমিকরা আট হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরির জন্য লড়াই করছে। টানা আট দিন ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরের বিভিন্ন স্থানে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছে। গার্মেন্ট মালিকরা এই আন্দোলনের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, ষড়যন্ত্র ইত্যাদি খুঁজে পেয়েছেন। মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ দাবি করেছে, এই কয়দিনে তাদের প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ জন্য তারা ছুটে গেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে, তিনিও বেশ কড়া ভাষায় হুংকার দিয়েছেন। এবং শেষ পর্যন্ত, পুলিশ – RAB’র পাশাপাশি আধাসামরিক বাহিনী-বিজিবি নামিয়ে শ্রমিকদের বাধ্য করা হয়েছে কারখানায় ফিরে যেতে। শ্রমিকদের ‘ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা’ করা হয়েছে।

শ্রমিকের শ্রমে-ঘামে-জীবনের বিনিময়ে আসে মালিকের মুনাফা, আসে বৈদেশিক মুদ্রা। বাংলাদেশ প্রতিবছর গড়ে ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের গার্মেন্ট পণ্য রপ্তানি করে। বাংলাদেশের গার্মেন্ট ও প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা এ দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে। গার্মেন্ট মালিকরা লক্ষপতি থেকে কোটিপতি, কোটিপতি থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়। বছর বছর উচ্চমূল্যের বিলাসি গাড়ি কিনতেও মালিকদের কোনো অসুবিধা হয় না। মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর-ব্যাংককে না গেলে তাদের ঈদের কেনাকাটা হয় না। গার্মেন্ট শিল্পের কল্যাণে মালিকদের উন্নতি হচ্ছে, দেশের অর্থনীতি গতিশীল থাকছে, কিন্তু শ্রমিকদের অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছে কি?

বাংলাদেশের গার্মেন্টসহ সকল সেক্টরের শ্রমিক-কর্মচারীরা সীমাহীন সংকটে নিপতিত। গার্মেন্ট শ্রমিকরা সারাদিন হাড়ভাঙ্গা কাজ করে বেঁচে থাকার ন্যূনতম মজুরি পায় না। যে বেতন দেয়া হয় তাতে শ্রমিক বাড়িভাড়া দিলে দোকানের বাকি পরিশোধ করতে পারে না, দোকানের বাকি পরিশোধ করলে বাড়িভাড়া দিতে পারে না। নিজের এবং পরিবারের শিক্ষা -চিকিৎসার সংস্থান করতে পারে না। এমনকি ঈদে-পূজায়-উৎসবে ছেলে-মেয়েকে একটা নতুন জামা পর্যন্ত কিনে দিতে পারে না। চাল-ডাল-তেল-পেঁয়াজ-কাঁচামরিচের যে দাম, তাতে বেতন দিয়ে তিন বেলা পেট ভরে ডাল-ভাত খাওয়াও অসম্ভব। এমন কোনো দিন নেই যে কোনো না কোনো জিনিসের দাম বাড়ছে না। ঈদে-রোজায়-উৎসবে তো ব্যবসায়ীদের আরো রমরমা। গার্মেন্ট শ্রমিকরা বাজার থেকে সবচেয়ে কমদামি, পঁচা, খাদ্যমানহীন খাবার কিনে খায়। তারা যেসব ঘরে থাকে, সেগুলো বস্তির একটু উন্নত সংস্করণ। এক ঘরে চার-পাঁচজন গাদাগাদি করে বসবাস সাধারণ চিত্র। এসব খুপরি ঘরের ভাড়াও বছরে দুই-তিনবার বাড়ে। এত কষ্ট করে থেকেও ধার-কর্জ না করলে অধিকাংশ শ্রমিকের জীবন চলে না। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) তথ্য সংগ্রহ করে দেখিয়েছে, মাস শেষে শ্রমিকরা গড়ে ৭৭০ থেকে এক হাজার ৮৩০ টাকা ধার করে। মালিকের মুনাফার লোভের আগুনে পুড়ে, বিল্ডিং ধসে মরতে হয় শ্রমিককেই। অনেক কারখানায় দিনের পর দিন বোনাস-ওভারটাইমের টাকা, এমনকি বেতনের টাকাও আটকে রাখে। অথচ তার প্রতিবাদ করা যায় না। প্রতিবাদ করলে চাকুরি থাকে না। মালিকের সন্ত্রাসী এসে নির্যাতন করে, পুলিশ লেলিয়ে দেয়া হয়।

বাংলাদেশের প্রায় ৩৫ লাখ গার্মেন্ট শ্রমিকের সিংহভাগের দিন কেমন করে কাটে? ভোর ৫টা/সাড়ে ৫টার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে সকালের নাশতা ও দুপুরের খাবার তৈরি করতে হয়। গোসল, প্রাতঃকৃত্যাদি সারতে হয়। এ কাজগুলো করতে হয় অন্য আরো অনেক শ্রমিকের সাথে গোসলখানা-বাথরম্নম-রান্নাঘর ভাগাভাগি করে। এরপর খাওয়া-দাওয়া সেরে কারখানায় যেতে হয় ঘড়ির কাঁটা ৮টার ঘর ছোঁয়ার আগেই। কারখানা থেকে তারা ছাড়া পায় কখনো রাত ৮টা, কখনো রাত ১০টা-১১টায়। বহু কারখানায় ছুটির কোনো বালাই নেই। কোথাও কোথাও ঈদে ছুটি দেয়া হবে বলে ঈদের আগের মাসে শ্রমিকদের কোনো ছুটিই দেয়া হয় না। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, ভাষা শহীদ দিবস ইত্যাদি জাতীয় দিবসগুলোতেও শ্রমিকরা ছুটি পায় না। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে আধাবেলা কাজ করতে হয়। আর শিপমেন্টের আগে অর্থাৎ পোশাকের চালান রপ্তানি হওয়ার আগের কয়েক দিন তাদের কাজ করতে হয় গভীর রাত পর্যন্ত; কখনো কখনো সারা রাত। একজন শ্রমিককে দিয়ে সপ্তাহে ৬০ ঘণ্টার বেশি কাজ করানোর নিয়ম না থাকলেও বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতে এ নিয়মের তোয়াক্কা কেউ করে না। অত্যধিক কাজের চাপে শ্রমিকদের জীবনীশক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। সোয়েটার কারখানার শ্রমিকরা কয়েক বছর কাজ করার পর কাজ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। অনেক ক্ষেত্রে মালিকরাও একটু বেশি বয়সের শ্রমিকদের কাজ দিতে চায় না।

‘ডক্টরস ফর হেলথ এন্ড এনভায়রনমেন্ট’ নামে চিকিৎসদের একটি সংগঠনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও অর্থোপেডিক সার্জন ডা. শাকিল আখতার একটি দৈনিক সংবাদপত্রে জানিয়েছেন, ‘দীর্ঘ সময় গার্মেন্ট কারখানায় কাজ করার পর শ্রমিকদের মেরুদণ্ডে সমস্যা দেখা দেয়। কয়েক ঘণ্টা কাজ করলেই তাদের মেরুদণ্ডে ব্যথা হয়। এছাড়া গার্মেন্ট শ্রমিকরা বেশি সময় কাজের কারণে রুগ্ন হয়ে যায়। অল্প বয়সে কর্মক্ষমতা হারায়।’ প্রচুর পরিশ্রমের ফলে শ্রমিকদের বেশি বেশি ও ভালো খাবারের প্রয়োজন। কিন্তু আর্থিক সামর্থ্যের অভাবে মাছ-মাংস-দুধ-ডিম ইত্যাদি আমিষজাতীয় ভালো খাবার তারা কমই খেতে পারে। এ কারণে শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি তারা পায় না।

মিরপুর - পল্লবীতে সমাবেশ
মিরপুর – পল্লবীতে বাসদ আয়োজিত শ্রমিক সমাবেশ

গার্মেন্ট মালিকরা এমন ব্যবস্থা করেছে যাতে শ্রমিক স্বেচ্ছায় ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে রাজি হয়, প্রকারান্তরে জীবনের দায়ে সে বাধ্য হয়। এখনো শ্রমিকরা ‘অতিরিক্ত’ সময় (ওভার টাইম) কাজ করতে না পারলে সে কারখানায় কাজ করতে চায় না। কারণ আট ঘণ্টা কাজ করে তাদের যে আয় হয়, তা দিয়ে কোনোভাবেই জীবন চলে না। এমন একটি পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েই আমরা গার্মেন্ট শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিয়ে কথা বলছি। শ্রমিকরা যখন ৮ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবি নিয়ে লড়ছে তখন মালিকপক্ষ বলছেন, ৬০০ টাকার বেশি বেতন বাড়ানো তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। মালিকপক্ষের প্রস্তাবে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি হয় ৩৬০০ টাকা। এ প্রস্তাব শ্রমিকদের জীবনের সাথে উপহাস ছাড়া আর কিছু নয়।

মজুরি বৃদ্ধির কথা শুনলেই মালিকদের চোখে জল আসে। তারা বলেন যে মজুরি বাড়ালে তাদের মুনাফা থাকবে না, রপ্তানি কমে যাবে, গার্মেন্ট খাত টিকবে না। কিন্তু তাদের এই মায়াকান্নার আসল কারণ অতি মুনাফার দুর্দমনীয় লোভ ছাড়া আর কিছুই নয়। বিজিএমইএ’র একজন সদস্য এক কেস স্টাডিতে দেখিয়েছেন, ২০০ সেলাই মেশিনের একটি শার্ট তৈরির কারখানায় ৫০০ শ্রমিক এক বছরে মোট ৩ লাখ ১০ হাজার ডলার মজুরি পায়। ওই কারখানার মালিক বছর শেষে মুনাফা করেন ১ লাখ ৫৪ হাজার ডলার। অর্থাৎ ২৫০ জন শ্রমিকের ১ বছরের মজুরির সমান একজন মালিকের মুনাফা।” (সংকটে পোশাক খাত-৩; আবুল কাশেম, কালের কণ্ঠ, ২০.০৭.১০) একজন শ্রমিকের গড় মজুরি ৩ হাজার ৫৬৫ টাকা ধরে এ হিসাবটি করা হয়েছে। অর্থাৎ একজন মালিক ৫০০ শ্রমিকের একটি কারখানা থেকে বছরে ১ কোটি ৬ লাখ ৯৫ হাজার টাকা নিট মুনাফা করছে। বিজিএমই-এর এক পরিচালক জানিয়েছেন, বিশ্বমন্দা, জ্বালানি সংকট সত্ত্বেও তারা লোকসান গুনছেন না। লাভের হার হয়ত কিছু কমেছে। আগে যেখানে হয়ত প্রতি পিসে ২০ টাকা লাভ হত, এখন সেখানে হয়ত ১৫ টাকা লাভ হচ্ছে।” (কালের কণ্ঠ, পূর্বোক্ত)

গার্মেন্ট শিল্পে বিভিন্ন দেশের মালিকদের মুনাফার হার তুলনা করলেও মালিকদের মিথ্যাচারের মুখোশ উন্মোচিত হয়। অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ দেখিয়েছেন, বাংলাদেশে মালিকদের মুনাফার হার ৪৩.১০ শতাংশ, যেখানে কম্বোডিয়ায় ৩১.০%, ভারতে ১১.৮%, ইন্দোনেশিয়ায় ১০%, ভিয়েতনামে ৬.৫%, নেপালে ৪.৪% এবং সবচেয়ে কম চীনে, ৩.২%। অর্থাৎ বাংলাদেশের মালিকরা বিশ্বের সবচেয়ে কম মজুরি দিয়ে, সরকারের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা নিয়ে সবচেয়ে বেশি মুনাফা করছে। এই মালিকরা বিশ্বমন্দা, বিদ্যুৎ সংকট, শ্রমিক অসন্তোষসহ নানান কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, ব্যবসায় মন্দা চলছে ইত্যাদি নানা অজুহাত তুলে রাষ্ট্রের কাছ থেকে অনৈতিকভাবে প্রনোদনা প্যাকেজসহ নানা আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করছে। কিন্তু তাদের নিজেদের জীবনের ভোগ-বিলাসের কোনো কমতি হচ্ছে না।

গত ৩০ বছর ধরে গার্মেন্ট শিল্প রাষ্ট্রের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা ভোগ করছে যার নাম হচ্ছে ‘ইনকিউবেটর’। এর অর্থ, জন্মের পর নবজাতক শিশুকে যে বিশেষ পরিচর্যা দেওয়া হয়। আমাদের গার্মেন্ট শিল্পও এখন পর্যন্ত্ম মায়ের কোলের নবজাতক শিশু রয়ে গেছে! এই ইনকিউবেটর-এর আওতায় গার্মেন্ট শিল্প গত ৩০ বছর ধরে যে সুবিধাগুলো পাচ্ছে তা হলো :- ১. বিদেশে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা, ২. সরকারের নগদ সুবিধা, ৩. ব্যাক টু ব্যাক এলসি পদ্ধতিতে শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধা, ৪. করমুক্ত রপ্তানি আয়, ৫. স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ, ৬. সস্তা জ্বালানি। এই ছয়টি সুবিধা গত ৩০ বছর ধরে মালিকরা সরাসরি পাচ্ছে। এই ছয় সুবিধার সাথে মালিকরা আরো কিছু সুবিধা পাচ্ছে তা হলো :- ১. পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা মজুরি, ২. শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করতে না দেয়া, ৩. শ্রমঘণ্টা না মানা, ৪. পুলিশ ও মাস্তানের সার্বক্ষণিক সহযোগিতা, ৫. শ্রমিকদের আবাসনের দায়িত্ব না নেয়া, এবং ৬. শ্রমিকদের সন্তানের শিক্ষা ও শ্রমিকদের চিকিৎসার দায়িত্ব না নেয়া। এ ধরনের অসংখ্য প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সুবিধার কথা বলা যাবে যা আমাদের গার্মেন্টস মালিকরা ভোগ করছে।

শুধু প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ আইনি সুবিধা ভোগই নয়, এর বাইরে নানা আইন-বহির্ভূত কর্মকাণ্ডেও গার্মেন্ট মালিকরা ওস্তাদ। গত ২ অক্টোবর ‘১৩ দৈনিক আমাদের সময়ে প্রকাশিত এক খবরে দেখা যাচ্ছে, শুল্ক ও ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগে ৩৩ জন গার্মেন্ট মালিকের ব্যাংক একাউন্ট জব্দ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর মধ্যে মাত্র ১২ জন গার্মেন্ট মালিকের কাছে শুল্ক ও ভ্যাট বাবদ এনবিআরের পাওনা ৯৪ লক্ষ ৭৭ হাজার টাকা। এছাড়া বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন সম্পন্ন না করা ও অসহযোগিতার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন ১১ জন মালিক এবং বন্ডের বিভিন্ন শর্ত ভঙ্গ করেছেন ১০ জন মালিক।

একজন শ্রমিক নির্দিষ্ট সময় কাজ করার পর কাজের বিনিময়ে যে অর্থ পায় তাকে মজুরি বলে। মজুরি সাধারণত মাসিক ভিত্তিতে হয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাপ্তাহিক, দৈনিক, পিস রেট ইত্যাদি রূপেও হতে পারে। আই.এল.ও-এর ১৩১ নং কনভেনশনে বলা হয়েছে, “সর্বনিম্ন মজুরি অবশ্যই আইন দ্বারা নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিক ও তার পরিবারের প্রয়োজন, জীবন যাত্রার ব্যয়, সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা ইত্যাদিকে বিবেচনায় নিয়ে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করতে হবে।” বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণায় বলা হয়েছে – ‘প্রত্যেক কর্মীর নিজের ও পরিবারের মানবিক মর্যাদা রক্ষায় সক্ষম এমন ন্যায্য পারিশ্রমিক পাওয়ার অধিকার রয়েছে।’ বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫নং অনুচ্ছেদে নাগরিকদের যুক্তিসঙ্গত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার বিষয়টি রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে বলা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, যুক্তিসঙ্গত অথবা মানবিক মর্যাদা রক্ষা করার মতো মজুরি নির্ধারণ করা হবে কিভাবে? একটি শ্রমিক পরিবারে কি কি দরকার হয়? অন্তত তিন বেলা খাবার, পোষাক, মাথা গোঁজার ঠাঁই, অসুস্থ হলে চিকিৎসা, সন্তানের শিক্ষা, অতিথি আপ্যায়ন ও বিনোদন ছাড়া মানবিক জীবন কিভাবে হয়? এসব বিবেচনায় নিয়ে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়।

গার্মেন্টস শ্রমিক সমর্থনে মিছিলরাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র অনুযায়ী, মজুরি হচ্ছে শ্রমিকের শ্রমের ফলে সৃষ্ট অংশমাত্র। শ্রমিকের শ্রমের ফলেই মূল্য তৈরি হয়। ওই মূল্যের প্রায় ৯০ ভাগই মালিক আইনের বলে, নিয়ম-কানুনের বলে মুনাফা হিসাবে আত্মসাৎ করে। আর শ্রমিক যাতে টিকে থাকতে পারে, কোনোরকমে খেয়ে-পরে বাঁচতে পারে, সে জন্য তাকে একটা মজুরি দেয়। নিজের তৈরি মূল্যের যে সামান্য ভাগ শ্রমিক পায়, সেটাই আরেকটু বাড়ানোর জন্য, নিজের দুঃসহ জীবনকে আরেকটু সহনীয় করার জন্য শ্রমিকরা লড়াই করছে। গার্মেন্ট শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির আন্দোলন আসলে এর বেশি কিছু নয়। ন্যূনতম মজুরি মালিকের দয়া-দাক্ষিণ্যের বিষয়ও নয়।

ন্যূনতম মজুরি নিয়ে শ্রমিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শোনা গেল, মালিক ও সরকারের প্রতিনিধরা বিভিন্ন দেশে গিয়ে ওইসব দেশের গার্মেন্ট শ্রমিকদের মজুরি হার যাচাই করবেন। ইন্টারনেট-মোবাইলের যুগেও মজুরি সংক্রান্ত্ম তথ্য যাচাইয়ের জন্য বিদেশ পাড়ি দিতে হবে, এটা সম্ভবত এ সময়ের সবচেয়ে বড় কৌতুক। ইতোমধ্যে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তা থেকে দেখা যাচ্ছে, গার্মেন্ট খাতে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মজুরি পায় পাকিস্ত্মানের গার্মেন্ট শ্রমিকরা। প্রতি মাসে তারা পাচ্ছে ১১৫.২ মার্কিন ডলার, বাংলাদেশি টাকায় ৯ হাজার ২১৬ টাকা। এরপর ভিয়েতনামে ১১০.২৪ ডলার (৮,৮১৯.২০ টাকা), ভারতে ১০৬.০৮ ডলার (৮,৪৮৬.৪০ টাকা), শ্রীলঙ্কায় ৯১.৫২ ডলার (৭,৩২১.৬০ টাকা), ইন্দোনেশিয়ায় ৯১.৫২ ডলার (৭,৩২১.৬০ টাকা), নেপালে ৮৩.২ ডলার (৬,৬৫৬ টাকা), কম্বোডিয়ায় ৮০ ডলার (৬,৪০০ টাকা)। আর একজন বাংলাদেশি গার্মেন্ট শ্রমিক মাসে ন্যূনতম মজুরি পাচ্ছে ৩৭.৪৯ মার্কিন ডলার বা তিন হাজার টাকা। চীন গার্মেন্ট পণ্য রপ্তানিতে আমাদের চেয়ে এগিয়ে, সেখানে গার্মেন্ট শ্রমিকরা মজুরি পান ২২১ ডলার।

ফলে, এ কথা অত্যন্ত স্পষ্ট যে মজুরি বাড়ালে বাংলাদেশ থেকে ক্রেতারা অন্য দেশে চলে যাবে, আমাদের গার্মেন্ট শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে – এসব ডাহা মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়। মজুরি বাড়ালে মালিকের মুনাফা কমবে, তাও পরিমাণে খুবই সামান্য। কিন্তু এই সামান্য মুনাফা কমাতেও মালিকগোষ্ঠী রাজি নয়। এখানে, আইনের দিক থেকে সরকারের ভূমিকা হওয়া উচিত ছিল মালিক এবং শ্রমিকের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তির নিরপেক্ষ সংস্থা। কিন্তু বাস্তবে সরকার মালিকগোষ্ঠীরই সরকার। তাছাড়া আমাদের সরকারের মন্ত্রী-এমপি, সরকারদলীয় নেতা-নেত্রীরাই তো গার্মেন্ট মালিক। ফলে সরকার তার ভূমিকা পালন করছে মালিকের পক্ষ হয়েই।

কিন্তু এবার আমরা একটা ভিন্ন নাটক দেখতে পেলাম। সরকারের একজন মন্ত্রী, যিনি আবার শ্রমিক নেতা, তার নেতৃত্বে গার্মেন্ট শ্রমিকদের একটি সমাবেশ হল। সেখানে সরকারদলীয় এবং বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। ‘বাঁচার মত মজুরি ঘোষণা, গার্মেন্টসে ভাঙ্গচুর বন্ধ, জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল এবং নারী শ্রমিকদের গৃহবন্দি করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে’ ডাকা এই সমাবেশ থেকে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি করা হল। একজন বামপন্থী(!) শ্রমিক নেতা সেখানে এমন বক্তব্যও দিলেন যে, “পোশাক শ্রমিকদের দায়িত্ব নিয়ে শাজাহান খান পরিবহন শ্রমিকদের মতো এদের সব সুবিধা নিশ্চিত করতে পারবেন”। এ ঘটনা থেকে কেউ কেউ মনে করছেন, এটা এক ধরনের নির্বাচনী স্টান্টবাজী। আবার অনেকের মনে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে, একি শ্রমিকদের বিভ্রান্ত করার নতুন কায়দা? গার্মেন্ট শ্রমিকদের মধ্যে সরকারের দালাল, তাঁবেদার নেতৃত্ব ঢুকিয়ে দিয়ে ভেতর থেকে শ্রমিক আন্দোলন দমন করার নতুন কৌশল? এ কৌশল নতুন নয়। আমাদের দেশের জুট-সুগার-টেক্সটাইল-ব্যাংক-রেলওয়ে-বিআরটিসি-পরিবহন নানা ক্ষেত্রে এ কাণ্ড দেখা গেছে। মালিক এবং সরকারের দালাল শ্রমিক নেতা নামধারীরা শ্রমিকদের আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করতে, বিপথগামী করতে, আন্দোলনকে পেছন থেকে ছুরি মারতে বরাবরই সুচতুর ভূমিকা পালন করছে। এর মাধ্যমে তথাকথিত শ্রমিক নেতারা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে, শ্রমিকরা প্রতারিত হয়েছে। আমাদের আশঙ্কা, গার্মেন্ট সেক্টরেও সেই পুরনো খেলা শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে শ্রমিকদের হুঁশিয়ার থেকে কার্যকর শ্রমিক সংগঠন ও আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আমরা মনে করি, বিপ্লবী ধারার ট্রেডইউনিয়ন গড়ে তোলার মাধ্যমে শ্রমিক আন্দোলনকে শোষণমুক্ত সমাজপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামের দিকে এগিয়ে নিতে হবে।

বাংলাদেশ শ্রমিক-কর্মচারী ফেডারেশনের মিছিল

৮ হাজার টাকা মজুরির দাবিতে শ্রমিক ফেডারেশনের বিক্ষোভ

বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে গার্মেন্ট শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকা ঘোষণা, ঈদের আগে সকল বকেয়া বেতন-বোনাস পরিশোধ, ঈদে শ্রমিকদের বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছেন। নেতৃবৃন্দ একই সাথে শ্রমিকদের উপর পুলিশি নির্যাতন বন্ধের জোর দাবি জানিয়েছেন। বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন ঢাকা নগর শাখার উদ্যোগে ৩০ সেপ্টেম্বর বিকেলে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মিছিল-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি জহিরুল ইসলাম, নগর নেতা সাইফুল ইসলাম কিরণ এবং তাসলিমা নাজনিন সুরভী। সমাবেশ শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল হাইকোর্ট মোড়, পল্টন এলাকা প্রদক্ষিণ করে।

সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন, ঈদ দেশের গরিব শ্রমজীবী মানুষের জীবনে আনন্দ নিয়ে আসে না। নিয়ে আসে দুঃশ্চিন্তা, উদ্বেগ। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা কাজ করে গার্মেন্ট শ্রমিকরা মানুষের মত বাঁচার উপযুক্ত মজুরি পায় না। যে বেতন দেয়া হয় তাতে বাড়িভাড়া, খাবার খরচ চালানো দায়। শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদন তো দূরের কথা। এমনকি ঈদে ছেলে-মেয়েকে একটা নতুন জামা পর্যন্ত কিনে দেয়া যায় না। অথচ ফি বছর উচ্চমূল্যের লেক্সাস-বিএমডাবলিউ গাড়ি কিনতে মালিকের কোনো অসুবিধা হয় না। মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর-ব্যাংককে না গেলে তাদের ঈদের কেনাকাটা হয় না। পেটের ক্ষুধার জ্বালায় শ্রমিকরা যখন রাস্তায় নামে, তখন সরকার-মালিক শ্রমিকদের মধ্যে বহিরাগত খোঁজে, ষড়যন্ত্র খোঁজে, নাশকতা খোঁজে। শুধু মানবেতর জীবনের অর্থ খোঁজেন না, অভাবের অর্থ বোঝেন না।

মিরপুর-পল্লবী : গত ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন মিরপুর-পল্লবী আঞ্চলিক শাখার উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। মিরপুর ১২ নম্বর বাসস্ট্যান্ড থেকে মিছিল শুরু হয়ে পূরবী সিনেমা হলের সামনে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি জহিরুল ইসলাম, সাইফুল ইসলাম কিরণ, কল্যাণ দত্ত, আব্দুল কাদের।

সাম্যবাদ, অক্টোবর ২০১৩

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments