Friday, April 19, 2024
Homeঅনুশীলনষাটের দশকের এক অপরাজেয় তারুণ্যের কথা

ষাটের দশকের এক অপরাজেয় তারুণ্যের কথা

Pic 2শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা বলেছিলেন, যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জাতির চরিত্র নির্মিত হয়। বাস্তবিক পক্ষেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে শুধু একটি জাতির অভ্যুদয়ই হয়নি, আমাদের জাতীয় জীবনেও তৈরি হয়েছিল কিছু অনুসরণীয় চরিত্রের। যে কোনও বড় মানুষ, বড় চরিত্রের আবির্ভাব কোনো দিন এমনিতে হয়নি। যে যুগে তারা জন্মগ্রহণ করেন, সেই সময়ে সেই সমাজের মানুষের কল্যাণের প্রয়োজনে যা করণীয়, কর্তব্যের সেই মহান ব্রত পালন করতে গিয়েই তাদের আবির্ভাব ঘটে। আবার এই যে প্রয়োজন, তা সমাজের সকল শ্রেণীর জন্য অভিন্ন নয়। সমাজ শ্রেণীবিভক্ত হবার পর থেকেই যে শ্রেণী সমাজের অধিপতি আর যে শ্রেণী শাসিত তাদের উদ্দেশ্য ও স্বার্থ সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রচলিত সামাজিক নিয়মকানুন বিধিব্যবস্থা মুষ্টিমেয় মানুষের স্বার্থই রক্ষা করে। তাদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে মূল্যবোধেরও যে মানদণ্ড তারা নির্ধারণ করে তাও একই উদ্দেশ্যকে প্রতিফলিত করে। আর প্রতিহত করে সমাজের বেশির ভাগ মানুষের বিকাশের গতিধারাকে। তাই প্রয়োজন হয় নতুন সমাজব্যবস্থার, নতুন মূল্যবোধের। মানুষের অভাব-দারিদ্র-লাঞ্ছনার ব্যথা বুকে বহন করে সেই সমাজকে ভেঙে নতুন করে গড়ে তুলতে যাঁরা অগ্রণী হন, তাঁরা তাঁদের অনেক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মনুষ্যত্ব-মানবিকতার এক উচ্চতর স্তর নির্মাণ করেন। পরবর্তী প্রজন্ম যদি সেই পাথেয়কে ধারণ করে তাদের সময়ে প্রয়োজনীয় কর্তব্য সম্পাদন করতে পারে, তবেই সমাজ এগিয়ে চলে। না হলে বিকাশ হয়ে পড়ে স্থবির। মূল্যবোধ হয় অবক্ষয়িত। বর্তমানে আমরা এরকম এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। সমাজের যত সমস্যাই থাকুক, মানবিকতা যতই পদদলিত হোক সে দিকে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। সবাই নিজের আখের গোছাতেই যেন ব্যস্ত। এরকম সময়ে তাই তাকাতে হয় অতীত যুগে, যাদের জীবন ত্যাগের দৃষ্টান্তে ভাস্বর, যারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে একটি মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য। এরকমই এক মহৎ চরিত্রের নাম শহীদ শাফী ইমাম রুমী। শহীদ রুমী নামেই সমধিক পরিচিত।

পারস্যের কবি জালালুদ্দিন রুমী ছিলেন বিরাট পণ্ডিত, জ্ঞানী ও দার্শনিক। মা জাহানারা ইমাম চেয়েছিলেন তাঁর সন্তান হবে কবি জালালুদ্দিনের মতই। তাই তাঁর নামের সাথে মিল রেখে সন্তানের নাম রেখেছিলেন রুমী। ছেলেবেলা থেকেই রুমী ছিল প্রাণোচ্ছল, সমবয়সী আর আট দশ জনের চেয়ে মানসিক বিকাশও ছিল বেশি। আজিমপুর কিন্ডারগার্টেন স্কুলে রুমীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনের শুরু। পরবর্তীতে সেন্ট গ্রেগরীজ স্কুল হয়ে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল এন্ড কলেজ থেকে স্টার মার্কস পেয়ে এস.এস.সি তে উর্ত্তীণ। প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার ক্ষেত্রে মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন ঠিকই কিন্তু এক্ষেত্রে অন্য আর দশজনের মতো বিদ্যালয়ের চৌহদ্দি তথা পাঠ্যপুস্তকের গুটিকতক পৃষ্ঠার মধ্যেই তার পড়ার জগত সীমিত ছিল না। চারপাশে যা কিছু চোখে পড়ত সমস্ত বিষয়ে তার কৌতূহল ছিল অদম্য। বাড়িতে অ্যাকুরিয়াম আনা হয়েছে – অ্যাকুরিয়ামের রঙিন জলে সাঁতার কাটছে মাছ। তাই দেখে মাছ সম্পর্কিত বই কিনে ও পড়ে মাছের জাতি ও জন্মবৃত্তান্ত জেনেছে । একবার বাবা শরীফ ইমামকে পায়ে ব্যথা পেয়ে দীর্ঘদিন বিশ্রাম নিতে হয়েছিল। সেই সময় অসুস্থ বাবাকে সঙ্গ দিতে মায়ের অনুরোধে তাস ও দাবা খেলতে শুরু করে। এসময় তাস ও দাবা খেলার ইতিবৃত্তও জেনে নিয়েছিল। এইভাবে ছেলেবেলা থেকেই যা কিছুই করত সমস্ত মন প্রাণ ঢেলে নিষ্ঠার সাথে করত। কোন কিছুতে এতটুকু খুঁত, এতটুকু ফাঁকি থাকত না। রুমীর চরিত্রে এই একটি বিশেষ দিক ছেলেবেলা থেকেই গড়ে ওঠেছিল। পড়ার প্রতি এই আগ্রহ বয়সের সাথে সাথে আরও বেড়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় রুমী “রিডার্স ডাইজেস্ট” কিনে পড়া শুরু করে। পড়ার প্রতি তার এই আগ্রহ দেখে মা জাহানারা ইমাম তাকে রিডার্স ডাইজেস্ট/ জিওগ্রাফিক্যাল ম্যাগাজিন এর গ্রাহক করে দেন। ক্রমেই তার পাঠের পরিধি বাড়তে থাকে। দর্শন, সাহিত্য, মার্কসীয় সাহিত্য ইত্যাদি জটিল বিষয়ও তার অধ্যয়নের বাইরে ছিল না। শুধু পড়াশোনা নয়, কিশোর বয়স থেকেই শরীর গঠনেও মনোযোগী ছিল রুমী। ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিসে যেমন পারদর্শী ছিল সে, তেমনি জুডো, কারাতেও ছিল সমান দক্ষ। বিশেষত জুডোতে  নৈপুণ্যের জন্য ব্রাউন বেল্ট ধারী হয়েছিল। এইভাবে প্রচুর পড়াশোনা ও ব্যায়ামের মাধ্যমে যুগপৎ রুমীর শরীর ও মন বিকশিত হতে থাকে।

finial coverরুমীর মানসিক ধাঁচাটি গড়ে উঠতে বিশেষভাবে সহায়ক হয়েছিল তার পারিবারিক পরিবেশ। বাবা শরীফ ইমাম ছিলেন উচ্চশিক্ষিত মার্জিত রুচিসম্পন্ন ইঞ্জিনিয়ার। পেশায় স্কুল শিক্ষক মা জাহানারা ইমামও উচ্চশিক্ষিত, উন্নত মূল্যবোধসম্পন্ন। মা-বাবা দু’জনেই ছিলেন সমাজ সচেতন, রাজনীতি সচেতন। স্বাভাবিকভাবেই দেশের ওই সময়ের রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্ত থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারেন নি। সময়টা তখন ষাটের দশক। দেশের অগ্নিগর্ভ অবস্থা। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের যাঁতাকলে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। প্রবল অর্থনৈতিক বৈষম্য মানুষকে দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত করে তুলছে। শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। কেড়ে নিচ্ছে একের পর এক রাজনৈতিক অধিকার। বাঙালি জাতিসত্ত্বা দমনের নানা চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র চলছে। দুর্বিসহ সেই পরিস্থিতিতে বাঙালির স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রাম উত্তুঙ্গ আকার ধারণ করে। ঘটনার গতি প্রবাহ কোনদিকে যাচ্ছে, যেভাবে পাকিস্তানিদের শোষণ-নিপীড়ন পূর্ববাংলার মানুষের বুকে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে। মুক্তির পথ কী? আন্দোলন-সংগ্রামের গতিধারা বাঙালিদের সামনে কী কর্তব্য নির্দেশ করছে? ঔৎসুক্য ও উদ্বিগ্নতা নিয়ে শরীফ ইমাম ও জাহানারা ইমাম ঘরোয়া পরিবেশে সন্তানের সামনেই ইত্যাকার বিষয়ে অনেক আলোচনা করতেন। এইসব আলোচনাতেই রুমী বাইরের পরিবেশের, দেশের উত্তপ্ত পরিবেশের আঁচ পেত।

অগ্নিঝরা সেই সব দিনে, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের প্রাক-কালে অর্থাৎ ১৯৬৮ সালে রুমী ভর্তি হয় ঢাকা কলেজে। পাশেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মুক্তি সংগ্রামের পীঠস্থান। প্রতিদিনই সেখানে চলে মিছিল, মিটিং, প্রতিবাদ সভা। এইসব প্রতিবাদের ঢেউ এসে লাগে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও। মুক্তির নেশা তরুণ রক্তে শিহরণ জাগিয়ে তুলে। চিত্ত চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। অনেকেই ছুটে যায় অকুস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে – রুমীও বন্ধুদের সাথে নিয়ে যোগ দেয় সেইসব প্রতিবাদ সভায়, বজ্রমুষ্ঠি শপথ, দৃপ্তকণ্ঠ উচ্চকিত সেইসব মিছিলে। এইসময়েই বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের একজন কর্মী হিসেবে রুমী সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ শুরু করে। সেই সময়ের রুমীকে অত্যন্ত সন্নিকট থেকে দেখেছেন এরকম একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হায়দার আকবর খান রনো রুমীকে নিয়ে তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, “রুমী ছিল মেধাবী ছাত্র এবং একই সঙ্গে সাহসী রাজনৈতিক কর্মী। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন ছিল তার চোখে মুখে। স্বভাবজাতভাবে ভদ্র ও অমায়িক রুমী ছিল বিপ্লবী আবেগে পরিপূর্ণ। নিষ্ঠাবান, সচেতন রাজনৈতিক কর্মী। শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতাই নয়, শ্রেণী শোষণ মুক্তির আকাক্সক্ষাও পোষণ করতো। কমিউনিজমের দীক্ষাও তার ছিল।” মিছিল-মিটিং, পড়াশোনা, বন্ধুদের সাথে দল বেঁধ ঘুরে বেড়ানো – এভাবেই গড়াতে থাকে সময়। তারপরেই ১৯৭০ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়। বিধ্বস্ত উপকূল অঞ্চল। লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুভিটা চ্যূত। রাজনৈতিক দুর্যোগের সাথে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ আক্রান্ত এলাকার মানুষকে চূড়ান্ত অসহায়ত্বের মধ্যে ঠেলে দেয়। সরকারি কোনো সাহায্য নেই। কিন্তু দেশের অগণিত মানুষ তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। সেই সময় মহিলা সমিতির উদ্যোগে কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে ত্রাণ বিতরণের জন্য একটি টিম বরিশাল, পটুয়াখালী যায়। রুমীর দরদী মন, ঘরে বসে থাকতে পারে না। গৃহহীন সহায় সম্বলহীন মানুষের প্রতি পরম দরদবোধ থেকে সেও এই টিমের সহযাত্রী হয়। অসহায় আর্ত মানুষের প্রতি এই যে মমতাবোধ, অশেষ ভালবাসা – এ থেকেই সেদিন ১৯৭১ সালে, বুয়েটের ছাত্র রুমী আমেরিকার ইলিনয়-এ আই.আই.টি তে পড়ে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ সুবর্ণ সুযোগ প্রত্যাখ্যান করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

মা-সহ পরিবারের অনেকেই চেয়েছিলেন এই ঘোর বিপদের দিনে, অনিশ্চিত জীবন ছেড়ে রুমী আমেরিকাতেই যাক। কিন্তু রুমী সেদিন এইসব লাঞ্ছিত ভাগ্য মানুষের জীবন দিয়ে জীবনের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারেনি। আবার সবাইকে ফাঁকি দিয়ে লুকিয়েও কিছু করেনি। সবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যুক্তি তর্ক করেছে। মা জাহানারা ইমামের প্রতি রুমীর ছিল অশেষ শ্রদ্ধা ও ভক্তি। মাকে না জানিয়ে কোনও কাজ সে কোনদিন করেনি। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে মা প্রথমে সম্মতি না দিলেও যুক্তি-তর্ক করে স্বীকৃতি আদায় করে ছেড়েছিল। রুমী সেদিন বলেছিল “আম্মা শোন, ছাত্রজীবন লেখাপড়া করার সময় এসবই চিরকালীন সত্য; কিন্তু ১৯৭১ সালের এই এপ্রিল মাসে এই চিরকালীন সত্যটা কি মিথ্যে হয়ে যায় নি? হাত আর চোখ বেঁধে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে, কটকট করে কতকগুলো গুলি ছুটে যাচ্ছে, মুহূর্তে লোকগুলো মরে যাচ্ছে। এইরকম অবস্থার মধ্য থেকে লেখাপড়া করে মানুষ হবার প্রক্রিয়াটা খুব বেশী সেকেলে বলে মনে হচ্ছে না কি? আম্মা, দেশের এই রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও, আমি হয়তো যাব শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মত অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়ত বড় ডিগ্রী নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হবো; কিন্তু বিবেকের ভ্রুকুটির সামনে কোনদিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না। তুমি কি তাই চাও আম্মা?”

জাহানারা ইমাম সেদিন ছেলের যুক্তির কাছে নতি স্বীকার করে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দিয়েছিলেন। মে মাসের শেষের দিকে প্রশিক্ষণ গ্রহণের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েও প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে যেতে পারে নি। অবশেষে জুন মাসের মাঝামাঝি মেলাঘর ট্রেনিং ক্যাম্পে পৌঁছায় কয়েকজন বন্ধুসহ। সেখানে ২নং সেক্টরে ক্যাপ্টেন হায়দার-এর অধীনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। যুদ্ধক্ষেত্রে কঠিন দিনগুলোতে, প্রশিক্ষণশিবিরে নানা অসুবিধার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের দিন অতিবাহিত করতে হত। রাতে ঘুমানোর কোনো ব্যবস্থা নেই,  কোনো বেলা খাবার জোটে তো জোটে না। এরকম সমস্যার মধ্যেও একবার রুমীর সামনে সুযোগ এসেছিল কিছুটা আরামে থাকা খাওয়ার। রুমীর পূর্ব পরিচিত এক ডাক্তার তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল অফিসার্স মেসে থাকা খাওয়ার। রুমী সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিল – ‘না ডক ভাই, আমার সঙ্গের ছেলেদের নিয়ে একসাথেই খাব।’ নিজের সুবিধা-অসুবিধা, পাওয়া না পাওয়ার হিসাব মেলাতেই আজকাল সবাই সবসময় ব্যস্ত। সুযোগ এলে অনায়াসে তা গ্রহণ করতে কোনো দ্বিধাবোধ নেই। কিন্তু রুমী পারেনি। অন্য আর দশজন যা পাবে না নিজের জন্য সেটা গ্রহণ ছিল রুমির কাছে অনৈতিক। এটা রুমীর চরিত্রের একটি বড় দিক। যুদ্ধের সময়েও সাথীদের ভাল-মন্দ চিন্তায় উদ্বিগ্ন। সবার প্রতি এই ভালবাসা-আন্তরিকতা দিয়েই মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু, কমান্ডার, ক্যাপ্টেন সবার হৃদয় জয় করেছিল রুমী। সাধারণ ট্রেনিং শেষে আরবান গেরিলা যুদ্ধের উপর বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে সে। তারপর ক্র্যাক প্লাটুন এর সদস্য হিসাবে ঢাকা শহরে গেরিলা অভিযানে অংশ নেয়। এই ক্র্যাক প্লাটুন সেদিন ঢাকা শহরে পাকিস্তানি সৈনিকদের বিরুদ্ধে দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করে। রুমী ছিল তার অগ্রভাগে। একদিন এক অপারেশন শেষে ফেরার সময় পাকিস্তানিদের একটি মিলিটারি জিপ টের পেয়ে যায়, পেছন থেকে ধাওয়া করে তাদের। রুমী ত্বরিৎ গাড়ির পেছনের গ্লাস ভেঙে ড্রাইভারকে গুলিবিদ্ধ করলে গাড়ি উল্টে সবাই নিহত হয়। এইভাবে তার প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে সেদিন সবাই জীবন নিয়ে ফিরেছিল।

এই গেরিলা দল একের পর এক সফল অপারেশন করে হয়ে উঠেছিল পাকিস্তানি সেনাদের ত্রাস। যে কারণে পাকিস্তানি হানাদাররাও তত্ত্ব তালাশ শুরু করে রুমীসহ তার দলের সবাইকে ধরতে। ২৯ আগস্ট ভোররাতে রুমী নিজ বাসায় পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ে। সেই সাথে রুমীর বাবা শরীফ ইমাম, ছোট ভাই জামী, চাচাতো ভাই মাসুমকে ধরে নিয়ে যায়। তৎকালীন এম.পি.এ হোস্টেলে পাকিস্তানি সেনারা রুমীর উপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। কিন্তু তাতে রুমীর মনোবলে এতটুকুও চিড় ধরেনি। সম্মুখে মৃত্যুর আনাগোনা নিশ্চিত জেনেও বাবা-ভাইসহ সাথীদের বাঁচাতে সমস্ত দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। প্রচ- নির্যাতনের মধ্যেও একটি তথ্যও তার মুখ থেকে বার করতে পারে নি। বরং বাবাকে সে বলেছে, “তোমরা সব চেপে যাবে। কিচ্ছু জানো না তোমরা। তোমরা তিনজনই তোমাদের রিপোর্টে একই কথা লিখবে। তোমরা কিছু জানো না। আমি মুক্তিযোদ্ধা রুমী কি করি না করি, তোমরা কিছুই জানো না।” স্টেটমেন্ট নেয়ার পর রুমীকে রেখে বাকি সবাইকে ছেড়ে দেয়া হয়। শরীফ ইমাম ছেলে রুমীর কথা জানতে চাইলে এক অফিসার বলেছিল তাকে কাল ছাড়া হবে। সেই কাল আর আসেনি। রুমীর আর ফিরে আসা হয়নি।

রুমীর ২০ তম জন্মদিনে মা-বাবা তাকে একটা চিঠি লিখেছিল । চিঠিতে রুমীকে উদ্দেশ্য করে তাঁরা বলেছিলেন, “…বজ্রের মত হও, দীপ্ত শক্তিতে জেগে ওঠ, দেশের অপমান দূর কর, দেশবাসীকে তার যোগ্য সম্মানের আসনে বসাবার দুুরূহ ব্রতে জীবন উৎসর্গ করো।” বাবা-মায়ের আজ্ঞাই পালন করেছে রুমী। দেশের অপমান দূর করতে প্রাণ উৎসর্গ করেছে স্বাধীনতার বেদীমূলে। স্বাধীনতা এসেছে কিন্তু দেশের অপমান, মানুষের লাঞ্ছনা, মনুষ্যত্ব-মানবিকতার ক্ষয় দূর হয়েছে কি? ঘরে ঘরে আজও আর্ত মানুষের হাহাকার। পত্রিকায় খবর এসেছে পেটের দায়ে কোলের শিশুকে বিক্রি করে দিয়েছেন এক মা। এই অপমান কার? এর শেষ কোথায়? লক্ষ কোটি মানুষকে শোষণ বঞ্চনার নিগড় থেকে মুক্ত করতে আজ হাজার হাজার রুমীর জেগে ওঠা প্রয়োজন। রুমীর মত বজ্রের দীপ্ত শক্তিতে জেগে ওঠবার কি কেউ নেই?

অনুশীলন : অক্টোবর ২০১৪ || সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments