Sunday, October 6, 2024
Homeফিচারচাল নিয়ে চালিয়াতি

চাল নিয়ে চালিয়াতি

rice_price_edit

খাবারের কষ্ট কী এদেশের মানুষের কাছে তা অজানা নয়। এই দেশে স্বাধীনতার পরে দুর্ভিক্ষ হয়েছে, খাদ্যের তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে আরও নানা সময়ে। তাই এখানে বেশিরভাগ জনগণের মধ্যে দারিদ্র আর অনাহার ক্লিষ্ট চেহারাই সাধারণভাবে দৃশ্যমান। অথচ ছোটবেলা থেকেই আমরা বইয়ে পড়ি — ‘সুজলা-সুফলা শস্য শ্যামলা আমাদের এই বাংলাদেশ।’ কথাটা মিথ্যা নয়। এদেশের কিছু অঞ্চলে এক বছরে তিনবার ফসল হয়, ধান-ভুট্টা-গম-আখসহ কত জাতের খাদ্যশস্য হয়, মাটির নীচে গ্যাস-কয়লার মজুদ আছে আর মাটির উপরে আছে সোনালী ফসল। পানির কোনো দুষ্প্রাপ্যতা নেই। প্রাকৃতিকভাবে সমৃদ্ধ এমন দেশ পৃথিবীতে কয়টা আছে? পরিসংখ্যানও বলছে, স্বাধীনতার পর জনসংখ্যা আড়াই গুণ বাড়লেও খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় সাড়ে তিনগুণ। কিন্তু তবুও এখানে মানুষের তীব্র অভাব। চারিদিকে নিরন্ন-বুভুক্ষু মানুষের সারি। তারা হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটেও প্রায়ই না খেয়ে থাকে।

প্রসঙ্গটা এলো, দেশে চালের দামের ভয়াবহ ঊর্ধগতির পরিস্থিতিতে। মোটা চালের দামই এখন ৫০ টাকা বা তার উপরে। এর চেয়ে একটু চিকন চালের দাম ৬০-৬২ টাকা। চালের এমন মূল্যবৃদ্ধি, এর তীব্র প্রভাব পড়ছে গরীব-নিম্নবিত্ত মানুষদের উপরে। উদাহরণ দেয়া যায়। যেমন ৫ জনের একটি পরিবারে দিনে ৩ কেজি চাল লাগলে মাসে লাগছে ৯০ কেজি চাল। যদি চালের কেজি ৫০ টাকা ধরি, তাহলে তাহলে মাসে কেবল চাল বাবদ খরচ হবে ৯০ x ৫০= ৪,৫০০ টাকা। একজন শ্রমজীবী মানুষের গড় আয় ৫-৬ হাজার টাকার বেশি তো নয়। তার মানে কেবল চাল কিনতেই তাদের প্রায় পুরোটা খরচ হয়ে যাচ্ছে। এর বাইরে যা থাকে তা দিয়ে কোনো রকমে অন্যান্য খাদ্যপণ্য কিনতে পারছে, কেউ পারছে না। শিক্ষা-চিকিৎসায় খরচের কথা অনেকে চিন্তাও করতে পারে না। আমাদের মতো দেশে সাধারণ নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোরও আয়ের ৭০ শতাংশ ব্যয় হয় খাবারের খরচে। ফলে অন্যান্য সমস্ত কিছু থেকে তাদের প্রয়োজনীয় ব্যয় কাটছাঁট করতে হয়। গত এক বছরেই মোটা চালের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ, গত মাসেই সেটা বেড়েছে ১৮ শতাংশ। কিন্তু সাধারণ মানুষের আয় সেই তুলনায় বাড়েনি।

যদিও চালের এমন ঊর্ধগতি এবারই প্রথম নয়। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও মোটা চালের কেজি ৪০ টাকা ও চিকন চাল ৫৬ টাকায় উঠেছিল। সেই থেকে বাড়তে থাকা চালের দাম আজও স্থিতিশীল হয়নি। চালের দাম বিএনপি শাসন আমলেও বেড়েছিল। তখন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘বেশি করে আলু খান, ভাতের উপর চাপ কমান।’ রসিকতা আর কী? রসিকতা অবশ্য এখনও চলে। চালের এমন মূল্যবৃদ্ধির পরও খাদ্যমন্ত্রী বলতে পারেন, ‘বাজার সরকারের নিয়ন্ত্রণেই আছে।’

কতটুকু যে নিয়ন্ত্রণে আছে সেটা বোঝা যায় যখন রিপোর্ট বের হয়, মাত্র ১২ জন চাল ব্যবসায়ীর হাতে গোটা চালের বাজার। তারা নির্ধারণ করে চালের মূল্য। সরকার তাদের চেনে, দেশের মানুষ তাদের জানে। কিন্তু কেউ তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারে না। ছুঁবে কেমন করে? এমন ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি বলেই তো সরকার ক্ষমতায় আছে।

এই ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে সরকারের আনুগত্য বোঝা যায়, যখন দেখি এই খাদ্য ব্যবসায়ীদের স্বার্থেই সরকার শুল্ক ২৮ থেকে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনে। এদের গুদামেই যায় আমদানিকৃত চাল। পরে তাদের বস্তায় ভরে সেগুলো আসে বাজারে। এর মধ্যে ব্যবসায়ীরা সরকারকে একটা শর্তও জুড়ে দিয়েছিল — পাটের বস্তা নয় প্লাস্টিকের বস্তাতে চাল বাজারজাত করার অনুমতি দিতে হবে। সরকার তাদের নাখোশ করেনি। এখন প্লাস্টিকের বস্তাতেই চাল বাজারে আসছে। এই সুযোগে প্লাস্টিকের ব্যাগেরও ব্যবসা করে নিচ্ছে তারা। লাভের গুড় সবই তাদের, কেবল জনগণের জীবনে হাঁসফাঁস উঠে যাবার যোগাড়।

রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের ক্ষমতায় যাবার সিঁড়ি হিসেবে এই ব্যাপারগুলোকে কাজে লাগায়। যেমন ২০০৯ সালে যখন নির্বাচন হলো তখন নির্বাচনী প্রচারণায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে ১০ টাকা কেজিতে চাল দেবে। ব্যাপারটা একটা বেদনাময় হাস্যরসের বিষয়; মানুষ চাল কিনছে ৬০ টাকা কেজিতে। কষ্টের বিষয়, জনগণের জীবন নিয়ে এমন প্রহসন করার পরও সরকার ক্ষমতায় টিকে আছে।

আমাদের দেশে বোরো ও ইরি ধান সাধারণত আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসের শেষ নাগাদ কৃষকের গোলা থেকে চলে আসে চালকলের মালিক কিংবা আড়তদারদের গুদামে। মিল মালিক ও আড়তদারেরা অতিমুনাফার লোভে তাদের মজুদ করা চাল বাজারে বিক্রি না করে অবৈধভাবে মজুদ করে রাখে। এতে বাজারে চালের কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়। ফলে দাম বাড়ে। এবার উপরি হিসাবে এসেছে বন্যা। মাস দুয়েক আগে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে এসেছে প্রায় পাঁচ লক্ষ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এই পরিস্থিতিতে চকচক করে উঠেছে এই ব্যবসায়ীদের মুনাফার চোখ। এমন সুযোগ তারা ছাড়বে কেন?

সরকার পরিচালিত ওএমএসের চালের দামও এবার গতবারের তুলনায় দ্বিগুণ নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু কতটুকু যৌক্তিক এই মূল্যবৃদ্ধি? গত কয়েক বছর ধরে তো মন্ত্রী-এমপিরা বলেই যাচ্ছেন, ‘বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।’ দেশের খাদ্য-গুদামগুলো নাকি ধান-চালে ভরা। তাহলে সেগুলো কোথায় গেল? পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে বছরে মোট ৩ কোটি ৬০ লক্ষ টন খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়। আর খাদ্য চাহিদা আছে ৩ কোটি টনের। তাহলে তো আরও ৬০ লক্ষ টন উদ্বৃত্ত থাকে। খাদ্যসংকট তো থাকার কথা না। আর অর্থনীতির নিয়মেও তো আমরা জানি, যোগান বাড়লে মূল্য কমে। কিন্তু তা হচ্ছে কি? যদি এবারের বন্যার কারণে খাদ্য ঘাটতি কিছু হয়েও থাকে তাহলে সেটার পরিমাণ আসলে কত — সেটাও কি সরকার বলতে পারছে? আগে উদ্বৃত্ত হিসেবে যে খাদ্যশস্য ছিল তা ব্যবহার করার পরও কি চাল আমদানির প্রয়োজন ছিল? এগুলোর কোনোটারই কোনো সদুত্তর সরকার দিতে পারেনি। তার মানে কোথাও সমস্যা আছে। পত্রিকার নানা রিপোর্ট বলছে চাল উদ্বৃত্ত থাকার পরও সরকার প্রতি বছরই চাল আমদানি করেছে। বেশিরভাগটা আসছে ভারত থেকে। এবার এসেছে মিয়ানমার থেকে। প্রতিবছর বাম্পার ফসল ফলার পরও চাল যখন আমদানি করা হয় তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, ইচ্ছা করেই একটা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আমদানি করার বাস্তবতা তৈরি করা হয়। এতে চাল ব্যবসায়ীদের যে বিপুল মুনাফা হয় — তা বলাই বাহুল্য। অথচ যে কৃষকরা খাদ্যের এমন ফলন ফলান, তারা কোনোবারই ন্যায্য মূল্যটা পায় না। তাদের উৎপাদন খরচও ওঠে না। যেখানে সরকারি হিসেবেই এক মণ ধান উৎপাদনের খরচ ধরা হয় ৮০০ টাকা, সেখানে প্রতি মণ ধান বিক্রি করে একজন কৃষক পায় মাত্র ৫২০-৫৫০ টাকা। যখন উৎপাদন করে তখন বেশি দামে সার, বীজ, কীটনাশক কিনতে হয়। আর যখন তা বিক্রি করতে যায় তখন বড় বড় চালব্যবসায়ীরা নামমাত্র মূল্যে কিনে নেয়। সবক্ষেত্রেই ঠকে দেশের গরীব জনগণ।

কিন্তু সরকার এই  মূল্যবৃদ্ধির দায় নিতে নারাজ। তারা দায় চাপাচ্ছে কতিপয় ব্যবসায়ীদের উপর। আবার ব্যবসায়ীরা বলছে ভিন্ন কথা। তারা বলছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণেই নাকি চালের দাম বাড়ছে। আর খুচরা ব্যবসায়ী আর ক্রেতাদের অভিযোগ, মিলারদের সিন্ডিকেট সৃষ্টিই চালের মূল্যবৃদ্ধির প্রধান কারণ। চলছে সাপ-লুডু খেলা। মাঝখানে পড়ে জনগণের চিড়েচ্যাপ্টা হবার দশা।

এই অবস্থায় আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট। জনগণের সাথে এই তামাশা বন্ধ করুন। অবিলম্বে চালের দাম কমিয়ে আনুন। চিহ্নিত মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার ও বিচার করুন। একইসাথে ওএমএস পদ্ধতিতে খোলা বাজারে চাল বিক্রির উদ্যোগ নিন। ১০ টাকা দরে রেশনে চাল বিক্রি করুন। গ্রাম-শহরে অঞ্চলে ভিজিএফ, ভিজিডি ও টিআর কর্মসূচি চালু করে শ্রমজীবী মানুষের খাদ্যের সংস্থান করুন। একইসাথে কৃষকের ধানের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিন।

সরকার বেঁচে থাকার অধিকারগুলোকে ক্রমাগত খর্ব করছে। সকল গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ভূলুণ্ঠিত করে একদলীয় শাসন পরিচালনা করছে। সকল প্রতিষ্ঠানকে পরিণত করেছে দলীয় সম্পত্তিতে। এমন পরিস্থিতিতে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় খাদ্য নিয়েও শুরু করেছে চূড়ান্ত ব্যবসা। চিন্তা আর মতপ্রকাশের অধিকার কেড়ে নিয়ে এখন হাত দিয়েছে পেটে। এ এক সর্বনাশা ব্যাপার। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে উঠলে সরকারের পুলিশ-র‍্যাব-সেনাবাহিনী কেউই তা থামাতে পারবে না। তাই সময় থাকতে উদ্যোগ নিন। জনগণের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলবেন না।

সাম্যবাদ অক্টোবর ২০১৭

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments