সঙ্কট সমাধানে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ করতে হবে
কেস স্টাডি – ০১
আরকান (ছদ্মনাম) ২০১৫-২০১৬ শিক্ষাবর্ষের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী। ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে তাদের ক্লাশ শুরু হয়, সেপ্টেম্বরে নির্বাচনী পরীক্ষার মাধ্যমে ক্লাশ শেষ হয়ে যায়। এই ৯ মাসে ক্লাশ হয় সর্বোচ্চ ৬০ দিন। (চট্টগ্রাম কলেজ)
২০১৪-২০১৫ শিক্ষাবর্ষের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী দিবাকর (ছদ্মনাম)। ২০১৬ সালের এপ্রিলে ২য় বর্ষের ক্লাশ শুরু হয়ে আগস্টে নির্বাচনী পরীক্ষার মাধ্যমে ক্লাশ শেষ হয়। এই ৫ মাসে ক্লাশ হয় সর্বোচ্চ ২০ দিন। (মহসিন কলেজ)
কেস স্টাডি – ০২
একটি স্বনামধন্য কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জামিল হায়দার (ছদ্মনাম) ১টি ক্লাশ নেয়ার ১৫ দিন পর আবার একই ক্লাশে যাওয়ার সুযোগ পান। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, ‘উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে আমরা শিক্ষক আছি ৪ জন। বিপরীতে উচ্চ মাধ্যমিকে ২টি বর্ষ, অনার্স ৪টি, মাস্টার্স, পাস কোর্সসহ ১০টি বর্ষের প্রায় ২৫০০ এরও বেশি শিক্ষার্থীদের পূর্ণ ক্লাশ নেয়ার সামর্থ আমাদের নেই। তার উপর সারা বছরই কোনো না কোনো কোর্সের পরীক্ষা থাকে। আমরা পরীক্ষা নেব নাকি ক্লাশ? এই অবস্থায় ক্লাশে সিলেবাস শেষ করা সম্ভব কিনা আপনারাই বলুন।’
উপযুক্ত উদাহরণ শুধু ঐ কলেজগুলোরই নয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশজুড়ে ১৮০০টিরও বেশি কলেজের চিত্র এটি। ২৫ বছর পূর্ণ করলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। দীর্ঘ দুই যুগের অর্জন — উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে সবচেয়ে সঙ্কট জর্জরিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত। গবেষণা দূরে থাক, ঠিকমত ক্লাশ নেয়া ও পর্যাপ্ত শিক্ষকের ব্যবস্থাও করতে পারেনি এই অথর্ব প্রশাসন।
আমাদের সংগঠনের উদ্যোগে তথ্য সংগ্রহ করে দেখা যায়, ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে ৩২০০০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক আছেন মাত্র ২০৭ জন। আনুপাতিক হারে ১৪৮ জন শিক্ষার্থীর জন্য ১ জন শিক্ষক। চট্টগ্রাম কলেজে ১৭০০০ শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ১৫৪ জন। ঢাকার তিতুমীর কলেজে ৫০০০০ শিক্ষার্থীর জন্য ২০৩ জন শিক্ষক এবং মাত্র ৪৩টি শ্রেণিকক্ষ আছে। খুলনার সরকারি ব্রজলাল কলেজে শিক্ষকের পদ আছে ১৯৭টি, শিক্ষক আছেন ১৬৭ জন। তার বিপরীতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩২০০০। এই হিসেবে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:২৪৬। এই হচ্ছে দেশের কয়েকটি প্রধান কলেজের চিত্র। এছাড়াও প্রায় সমস্ত কলেজে ক্লাশরুম ও আবাসন সঙ্কট তীব্র। বেশিরভাগ কলেজেই নেই পরিবহন ব্যবস্থা।
এই অবস্থায় সার্কুলারে নতুন প্রশ্নপদ্ধতি কার্যকর করার জন্য ২১০ দিন পাঠদানের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেখানে কলেজগুলোর বাস্তবতার কোনো উল্লেখ নেই। কলেজসমূহ সাপ্তাহিক ও অন্যান্য সরকারি ছুটির কারণে বছরে ১৩৭ দিন বন্ধ থাকে। উচ্চমাধ্যমিক, ডিগ্রি, অনার্স, মাস্টার্সসহ বিভিন্ন বর্ষের পরীক্ষা অনুষ্ঠানের কারণে বছরে গড়ে আরো প্রায় ১৪০ দিন বন্ধ থাকে। ফলে দেখা যাচ্ছে, বছরে ৩ মাসের বেশি ক্লাশ হওয়ার সুযোগ কোনো কলেজেই নেই।
শিক্ষক ও ক্লাশরুমের তীব্র সঙ্কট, অকার্যকর লাইব্রেরি-সেমিনার, নামমাত্র আবাসন ব্যবস্থা, প্রায় সারাবছর ক্লাশ না হওয়া ইত্যাদি সঙ্কটে কলেজসমূহের শিক্ষার মান ক্রমাগত নিম্নমুখী। শিক্ষার্থীদেরকে বাধ্য হয়েই হাজার হাজার টাকা খরচ করে প্রাইভেট পড়ে সিলেবাস শেষ করতে হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে কারিকুলাম, সিলেবাস ও পরীক্ষাপদ্ধতি পরিবর্তন, পরিবর্ধন করা হলেও তাতে শিক্ষার মানের উন্নতি তো ঘটেই নি সঙ্কটসমূহ দূর করার কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে পরীক্ষাগারে গিনিপিগের মতো শিক্ষার্থীদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয় একের পর এক নিয়ম কানুন। সর্বশেষ সেশনজট নিরসনের নামে চালু করেছে ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’। এর আওতায় নির্ধারিত সময়ের কিছু আগেই তড়িঘড়ি করে পরীক্ষা নেয়ার ফলে ছাত্র-শিক্ষকের ভোগান্তি বেড়েছে বৈ কমেনি। কলেজে এখন আর শিক্ষার্থী বলে কিছু নেই। সবাই পরীক্ষার্থী। সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে বেশিরভাগ কলেজে স্বতন্ত্র পরীক্ষাহল নির্মাণ হলেও কলেজগুলোতে ক্লাশ নেয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় এই হলগুলো। এ থেকেই বোঝা যায় ক্লাশরুমের সঙ্কট কতটা তীব্র!
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানে শুধু জ্ঞান বিতরণ নয়, একই সাথে নতুন জ্ঞান উৎপাদনেরও ক্ষেত্র। এজন্য দরকার পর্যাপ্ত গবেষণার সুযোগ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজসমূহে গবেষণা তো দূরের কথা, সংরক্ষিত জ্ঞান বিতরণের কাজটিও ঠিকমত হয় না। দেহ মনে বিকশিত পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠার জন্য ক্লাশের পাশাপাশি খেলাধুলা, ব্যয়ামাগারসহ নানা সাংস্কৃতিক আয়োজনের ব্যবস্থা থাকা অপরিহার্য। কলেজগুলোতে এইসকল আয়োজন করা না হলেও পুরাতন ঐতিহ্যবাহী কলেজগুলোতে প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে যতটুকুওবা আয়োজন ছিলো তা ধ্বংস করা হচ্ছে সুপরিকল্পিতভাবে। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মননশীল করে তোলার সুযোগ কলেজগুলোতে ছিটেফোঁটাও নেই। শুধুমাত্র গৎবাঁধা — দিবসভিত্তিক কিছু কর্মসূচি পালন করা হয়। ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে ক্যাম্পাসগুলো ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। তাদের নিজেদের গ্রুপিং, টেন্ডারবাজি, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বাধা ইত্যাদি ছাত্রসমাজকে করে তুলছে রাজনীতিবিমুখ, শঙ্কাগ্রস্ত। অন্যদিকে পরিকল্পিতভাবে অশ্লীলতা-অপসংস্কৃতির করাল গ্রাসে নিমজ্জিত করা হচ্ছে তরুণ সমাজকে।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রণীত শিক্ষা আইনেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাহাড় সমান সঙ্কট নিরসনে কোনো নির্দেশনা নেই। তাহলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮ লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ কী? পর্যাপ্ত আয়োজন ছাড়া শুধু পরীক্ষা দিয়ে সার্টিফিকেট অর্জনই কি আধুনিক শিক্ষা? এর দ্বারা শিক্ষার মান কতটুকু অর্জিত হচ্ছে? আমরা মনে করি, শুধু ‘নতুন নতুন পরীক্ষাপদ্ধতি প্রণয়ন’ কিংবা ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’ এই সঙ্কটের সমাধান নয়। কলেজগুলোতে পর্যাপ্ত সংখ্যক ক্লাশরুম নির্মাণ ও শিক্ষক নিয়োগ করে সারাবছর ক্লাশ চালু করাই একমাত্র সমাধান। আর এর জন্য দরকার বাজেটে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিশেষ বরাদ্দ। সরকার বলবে, টাকা নেই। টাকা কোথায়? এর উত্তরে আমরা বলতে চাই যে, হলমার্ক ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, শেয়ার বাজার লুট, শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানিসহ, নানা সরকারি কাজে দুর্নীতি— লুটপাটের মাধ্যমে তো হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে। ২০১০ সালে সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে লোপাট হলো ৩৮৬৮ কোটি টাকা। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে ক্ষতি হলো ২ লাখ কোটি টাকারও বেশি। বিসমিল্লাহ গ্রুপ লোপাট করলো ১২০০ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় খোয়া গেল ৬ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। তার কিয়দংশ যদি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় তবে এই সঙ্কটের সিংহভাগই কাটিয়ে উঠা যাবে। ইতিহাসের শিক্ষা থেকে আমরা জানি শাসকগোষ্ঠী এই দাবি সহজে মেনে নেবে না। তাই দাবি আদায়ের জন্য প্রয়োজন সংগঠিত আন্দোলন।
অনুশীলন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের মুখপত্র, ফেব্রুয়ারি ২০১৭
সূচিপত্র :
পাঠ্যপুস্তকে ভুল, বিষয়বস্তুর পরিবর্তন নিছক দুর্ঘটনা নয়
সরকারি অপপ্রচারের পরও মানুষ সুন্দরবনের পক্ষে
বিশ্ববিদ্যালয় কেমন মানুষ তৈরি করছে
মহান স্ট্যালিনকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে
‘ভালোবাসা দিবস’র আড়ালে যে রক্তস্নাত লড়াইয়ের ইতিহাস আমরা ভুলতে বসেছি
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কি এভাবেই চলবে?
ফিদেল ক্যাস্ত্রো ও কিউবা
সংগঠন সংবাদ