“এই (প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী) পরীক্ষা হলো একটা উৎসবের মতো। ছোট ছোট বাচ্চারা সেজেগুজে হাত ধরাধরি করে পকেটে কলম গুজে হাসতে হাসতে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে। এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কি আছে? আমরা সেই দৃশ্য দেখি আর আনন্দে বুকটা ভরে যায়।” এমনি আনন্দে বিহ্বল হয়ে ২০০৯-১০ সালের দিকে দেশের শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবী-সামাজিক-সাংস্কৃতিক মহলের একটা বড় অংশ একযোগে পিএসসি (পরবর্তীতে পিইসি) ও জেএসসি পরীক্ষার মাহাত্ম বর্ণনায় ব্রতী হয়ে উঠলেন। প্রচারের এই বাঁধভাঙ্গা জোয়ারে কেউ কেউ ভাবলেন এবার একটা বিরাট কিছু হবে! কিন্তু যে কোমলমতি শিশুদের নিয়ে এতো আয়োজন তাদের দিকে নজর পড়লো সামান্যই।
ইতোমধ্যেই অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে প্রায় অর্ধযুগের বেশি সময়, বাস্তবের নিদারুন অভিজ্ঞতায় মানুষের কাছে রাষ্ট্রীয় প্রচারের ‘সুমহান’ কীর্তি আজ মুখ থুবরে পড়েছে। এখন জোর দাবি উঠেছে এই পরীক্ষা দু’টি বাতিলের, জনমতের প্রবল চাপে গত বছরের জুন মাসে সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান বলতে বাধ্য হলেন, ‘আমরা কোন বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বাস করি না। বাংলাদেশের মানুষের, সমগ্র জনগোষ্ঠির আবেগ,অনুভূতি আমাদের স্পর্শ করে। সামগ্রিকভাবে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত হবে।” “এ বছর থেকেই পঞ্চম শ্রেণীর প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা হচ্ছে না।” আবার তার কিছু দিন পর সরকার ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে ঘোষণা করল পিইসি-জেএসসিসহ সকল পরীক্ষাই থাকবে। হঠাৎ করে কোন অদৃশ্য কারণে বা শক্তি বলে সরকার এই অবস্থান গ্রহণ করলো তা কেউ জানে না। জনগণের সাথে এ এক নির্লজ্জ প্রতারণা ছাড়া আর কি হতে পারে? তাই আজ নতুন করে মূল্যায়নের সময় এসেছে, এই মূল্যায়নের দু’টি দিক; প্রথমত দেখতে হবে এই পরীক্ষা পদ্ধতি আসলেই প্রয়োজনীয় কি না, আর দ্বিতীয়ত বুঝতে হবে সরকার কী চায়। আমাদের সংগঠন শুরু থেকেই সুস্পষ্ট যুক্তি তুলে ধরে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনা করেছে, আজ আবারো আমরা সকলের সামনে আমাদের বক্তব্য তুলে ধরছি।
শুরুর কথা :
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এই দু’টি পরীক্ষা পদ্ধতির ধারণা নীতিগতভাবে আসে কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে ২০০৯ সালে গঠিত ‘জাতীয় শিক্ষানীতি প্রনয়ণ কমিটি’র সুপারিশে। ২০০৯ সাল থেকে পিএসসি এবং পরের বছর থেকে জেএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, ২০০২ সালে এসএসসি পরীক্ষার ফল বিপর্যয়ের (৩৫.৯১%পাস) কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় যে, অনেক শিক্ষক অভিযোগ করেন, মাধ্যমিক স্তরে অর্থাৎ ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের বাংলা এবং ইংরেজি হরফ শেখাতে হচ্ছে। তখন থেকেই দাবি উঠে প্রাথমিক স্তরের পরীক্ষা কেন্দ্রীয়ভাবে নেয়ার। এ জন্য ২০০৩/০৪ সালে ‘প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা জামালপুর মডেল’ হাজির করা হয়। একই ভাবে ২০০৭ সাল থেকে ঢাকা জেলায় এই পরীক্ষা পদ্ধতি ‘পরীক্ষামূলক’ প্রয়োগ শুরু হয়। এই প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের মান উন্নয়ন, ঝরে পড়ার হার রোধ এবং মেধার বিকাশের স্লোগান তুলে পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা চালু করা হয়।
১৯৯০ সালে বাংলাদেশ সরকার ‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচি’ ঘোষণা করে, আবার একই সময়ে রাষ্ট্রীয় ভাবে এম.ডি.জি বা ‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ ঘোষিত হয়। এই এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০১৫ সালের মধ্যে সকল শিশুকে প্রাথমিক সমাপনীর আওতায় নিয়ে আসার অঙ্গিকার করা হয়। বাস্তব অবস্থানের দিকে নজর দিলেই সরকারের এই কর্মসূচির মর্মকথা ধরা পড়বে। সরকারের এই জনকল্যাণমুখী মুখোশের আড়ালে প্রকৃতপক্ষে গোটা প্রাথমিক শিক্ষাকে তুলে দেওয়া হয় ব্যবসায়ীদের হাতে। বেনবেইস এর ২০১৫ সালের তথ্যমতে, ২০১২ সালে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৩৩৩টি, এর মধ্যে ১৯৯১ থেকে ২০১২ সাল এই ২১ বছরে গড়ে উঠেছে মাত্র ১২ টি বিদ্যালয়, বিপরীতে একই সময়ে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠে ৭৭৭৫ টি বিদ্যালয়, গড়ে উঠার এই হার যথাক্রমে ৩.৬০ শতাংশ এবং ৪০.৬৪ শতাংশ। অপর দিকে প্রাথমিক বিদ্যালয় সম্পর্কেও একই তথ্য দিচ্ছে বেনবেইস, ২০১৫ সালে মোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ৩১.৩৫% ছিল সরকারি, আর ২০.৬৬% বিদ্যালয়কে নতুন করে জাতীয়করণ করা হয়। জাতীয়করণকৃত এই স্কুলগুলোর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সরকারি সমস্ত আয়োজন এখনও নিশ্চিত করা হয়নি। সাথে সাথে ব্যাপক প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে এমন একটি মনন কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে, যেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সন্তানকে পড়াতে না পারলে জীবনে একটা অপূর্ণতা থেকে যাবে। ফলে এ কথা স্পষ্ট যে, ৯০ পরবর্তীতে শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে বাণিজ্যিকীকরণের প্রক্রিয়া বহুগুণ বেড়েছে। একই সাথে আরও একটি বিষয়ে নজর দেয়া দরকার, ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সরকার গ্যাটস চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, যার মূলকথা হলো শিক্ষাসহ ১৬১টি পরিসেবা খাতকে ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দেয়া। এই নীতি মেনেই ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে স্কুলে চালু হয়েছে আরেক সর্বনাশা প্রজেক্ট ‘সেক্যাপ’। শিক্ষাঙ্গনের সামগ্রিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় পিইসি-জেএসসি পরীক্ষা দুটি সরকারের বেসরকারিকরণ বাণ্যিজিকীকরণ নীতির নতুন সংযোজন মাত্র।
পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষার পক্ষে কিছু যুক্তি ও আমাদের বক্তব্য
পিইসি এবং জেএসসি পরীক্ষার পক্ষে সরকারসহ বিভিন্ন মহলের উথাপিত যুক্তিগুলো মোটামুটি এ রকম; এটা একটা উৎসবের মতো, এতে শিক্ষার্থীরা অনেক নতুন বন্ধু ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের সাথে মেশা ও জানার সুযোগ পাচ্ছে, ফলে একটা উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দেয়ায় মানসিক শক্তি ও সাহস বাড়ে যা ভবিষ্যতে যেকোন সমস্যা মোকাবেলার মানসিকতা তৈরি করবে। মেধার যথার্থ মূল্যায়ন এবং সময় ও অর্থের অপচয় রোধ হবে। শিক্ষকদের জবাবদিহিতা ও অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে, শিক্ষার্থীদের অলসতা দূর হবে। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীরা অন্তত একটি সার্টিফিকেট পাবে। বৈষম্য কমবে, মান বাড়বে ইত্যাদি। বাস্তবেই এই বিষয়গুলো কতটুকু যৌক্তিক?
অপার বিষ্ময়, অসীম আনন্দ, অফুরন্ত প্রাণশক্তি ও সীমাহীন কৌতুহল এ সকল ক্ষমতাই শিশুর অন্তর্নিহিত স্বাভাবিক বৈশিষ্ট। একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কতটুকু নির্ভীক ও স্বাধীনভাবে শিশুর ঐ বৈশিষ্ট্যগুলোকে বিকশিত করছে, তার উপর নির্ভর করে দেশের সামগ্রিক বিকাশের প্রশ্নটি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় মাত্র ১২ ক্লাসের মধ্যেই শিক্ষার্থীদের চার চারটি পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়, যা শুধু নজিরবিহীনই নয়, চূড়ান্ত অবৈজ্ঞানিকও বটে। ১১ বছর বয়সের একটি শিশু যখন জিজ্ঞাসু মন নিয়ে হেসে খেলে বেড়ে উঠার কথা, ঠিক তখনই তাকে নামতে হচ্ছে পিইসি পরীক্ষা নামক প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌঁড়ে। কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই তাকে শেখানো হচ্ছে ‘এ+’ পেতে হবে। পাশের বন্ধুটির সাথে বসে একটু খেলা, একটু ঝগড়া, একটু মান অভিমানের মাধ্যমে সামাজিক ও মানবিক গুণ গড়ে উঠার সময়টুকু হারিয়ে যাচ্ছে কোচিং, গাইড বই আর স্যারের বাসায় প্রশ্ন মুখস্ত করতে করতে। কোনো রকমে যদি পিইসি শেষ হলো, তো এবার জোর কদমে তৈরি হও জেএসসি’র জন্যে। এ বিষয়ে সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদ আবুল মোমেন বর্তমান শিক্ষাঙ্গনের বাস্তব অথচ মর্মান্তিক চিত্র তুলে ধরে দেখান- ‘নিরন্তন পরীক্ষার ড্রিলের ভেতর দিয়ে দিয়ে জীবনের প্রস্তুতিপর্ব পার করে একজন তরুণ শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলে। সে শৈশব থেকে একজন পরীক্ষার্থী, শিক্ষার্থী নয়।… চাপের মধ্যে সে মুখস্ত বা বারবার অভ্যাস করে যে বিদ্যা আয়ত্ত করেছে, তার সঙ্গে আত্মবিকাশ-আত্মপ্রকাশের তেমন সম্পর্ক না হওয়ায় পরীক্ষার পর শেখা বিষয়গুলো তাদের কিছুই মনে থাকে না।’ ফলে পাশের ছাত্রটি এখন আর বন্ধু নয়, সে প্রতিযোগী, প্রতিদ্বন্দ্ধী। তারা পরস্পর পরস্পরকে জানা বোঝা তো দূরের কথা খুব সূক্ষ্মভাবে তৈরি হচ্ছে জিঘাংসা, স্বার্থপরতা। আর একে উস্কে দিয়ে ছোট ছোট বাচ্চাদের মধ্যে তৈরি করা হচ্ছে একটা কৃত্রিম উত্তেজনা, যা জায়েজও করা হচ্ছে শিশুদের মানসিক শক্তি ও সাহস বাড়ছে বলে। অথচ এই তীব্র প্রতিযোগিতার ঘূর্ণাবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের দুটি মূল্যবান সম্পদ মৌলিকতা ও সৃজনশীলতা। যার অনিবার্য পরিণতিতে শৈশব-কৈশোরের স্বাভাবিক কোমলতা হারিয়ে একদিকে তৈরি হচ্ছে ‘কিশোর গ্যাং’ সংস্কৃতির উন্মাদনা অপরদিকে বাড়ছে নিস্পৃহতা, উদাসীনতা। ফলে যুক্তি-বুদ্ধি, গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে একটি মননশীল প্রজন্ম গড়ে উঠার পরিবর্তে সৃষ্টি হচ্ছে একদল যান্ত্রিক মানুষ। এর সাথে ত্রুটিপূর্ণ মূল্যায়ন প্রক্রিয়া (অনুশীলন, এপ্রিল’১৫ সংখ্যায় বিস্তারিত আলোচনা আছে) ও পরিপূর্ণ আয়োজন না করে ইতিমধ্যে চালু হওয়া সৃজনশীল প্রশ্নপত্র শিক্ষার প্রাথমিক স্তরের তৈরি করেছে এক অসহনীয় পরিস্থিতি। তাই এই সামগ্রিক পরিস্থিতিতে মেধার বিকাশ তো দূরের কথা বরং তৈরি হচ্ছে মানবিক বোধ বিবর্জিত আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর, নিঃস্প্রাণ একটি যান্ত্রিক প্রজন্ম। আমরা কি আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে এই ভয়ংকর রূপে গড়ে তুলব?
এতো গেল একটি দিক। আমাদের দেশে ধনবৈষম্য চূড়ান্ত, এ নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে এই চিত্র দিন দিন প্রকট হচ্ছে। পরীক্ষা নির্ভরতার কারণে শিক্ষার মূল কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে কোচিং সেন্টার, গাইড বই আর প্রাইভেট টিউটর। এগুলো ছাড়া এক পাও অগ্রসর হওয়া যাচ্ছে না। কারণ বেশির ভাগ স্কুলের পরিপূর্ণ অবকাঠামো ও শিক্ষকদের দক্ষতার অভাব আছে, আবার পরীক্ষায় ভাল করতে হলে সেই শিক্ষককের কাছে যেতে হবে, যেন যে প্রশ্নগুলো আসতে পারে তা সংক্ষিপ্ত ও সুনির্দিষ্ট করে নেয়া যায়। তাই শিক্ষাথীরা যেমন প্রবল চাপের মধ্যে পড়ছে, সাথে সাথে অভিভাবকদের বেড়েছে দুর্ভোগ, মানসিক দুঃচিন্তা ও আর্থিক অনটন। এ বিষয়ে প্রাবন্ধিক রাখাল রাহা দেখান, “২০১৫ সালে প্রায় ৩০-৩৫ লক্ষ শিশু প্রাথমিক স্তরের পরীক্ষা দিয়েছে। এদের অধিকাংশই একাধিক গাইড বই কিনেছে। গড়ে যদি ১টা গাইডও সবাই কিনে থাকে আর তার দাম যদি গড়ে ৫০০ টাকা হয় তবে শুধু এই খাত থেকেই বাণিজ্য সৃষ্টি হচ্ছে প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা। আবার প্রায় প্রতিটি শিক্ষার্থী স্কুলের বাইরে কোচিং করেছে, করতে বাধ্য হয়েছে। মাসে ৫০০ টাকা করে হলেও ১০ মাসে প্রতিটি শিক্ষার্থী ৫০০০ টাকা খরচ করেছে। তাহলে কোচিং খাতে বাণিজ্য হয়েছে প্রায় ১৭৫০ কোটি টাকা। এগুলো কোন নিশ্চিত অঙ্ক না হলেও এমন বহু বহু বাণিজ্য খাত তৈরি হচ্ছে শিক্ষার এ ধরনের উন্নয়নের (!) ফলে।” এদিকে এডুকেশন ওয়াচের একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে নানা অনিয়মের চিত্র -পরীক্ষাহলে আসন বিন্যাসে অনিয়ম, নকল, শিক্ষকের দ্বারা প্রশ্নের উত্তর মুখে ও ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে দেয়া, পরিদর্শকের সহায়তায় একজনের সাথে অন্যজনের উত্তর মেলানো, উদারভাবে খাতা দেখা, অর্থের বিনিময়ে উত্তরপত্রের গোপন কোড নম্বর ফাঁস করে দেয়া, গাইড ও সাজেশনের নামে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা ইত্যাদি। ফলে একদিকে যেমন দেশের বেশিরভাগ শ্রমজীবি, মেহনতি নিম্ন আয়ের মানুষের জন্যে স্কুলের দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে অনৈতিকতার পঙ্কে নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছে গোটা প্রাথমিক শিক্ষা।
ঠিক এই সময়ে যখন শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশের অনেকেই পঞ্চম শ্রেণি বা অষ্টম শ্রেণির পর আর পড়ালেখা করে না। কাজেই পঞ্চম শ্রেণি বা অষ্টম শ্রেণি পাসের একটা সার্টিফিকেট তাদের কাজে লাগবে।’ তখন প্রশ্ন জাগে শিক্ষামন্ত্রীর এই বক্তব্য কি ঝরে পড়ার হার রোধ করতে না তাকে উৎসাহিত করতে? একই সাথে গ্রাম-শহরের পার্থক্য, দক্ষ শিক্ষক ও অবকাঠামোর অপর্যাপ্ততা এবং ‘টাকা যার, শিক্ষা তার’ এই নীতি বহাল রেখে একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষার মাধ্যমে মেধার মূল্যায়ন, ঝরে পড়ার হার রোধ তো সম্ভবই নয় বরং বৈষম্যই বাড়ছে। তাই যারা পিইসি-জেএসসি পরীক্ষার মাহাত্ম বর্ণনা করে তারৎস্বরে চিৎকার করছেন ‘বৈষম্য কমবে, মান বাড়বে’ কিংবা ‘সময় ও অর্থের অপচয় রোধ’ হবে তাদেরকে বলবো এ নিছক আত্মপ্রতারণা, এ জেনে বুঝে নিজের সন্তানকে অন্ধকূপে ঠেলে দেয়া। আমরা কি তাই করবো?
শিক্ষার্থীদের মেধার মূল্যায়ন, বৈষম্য রোধ এবং পরীক্ষার একটা উৎসব তৈরির কথা বলে চালু করা পিইসি-জেএসসি পরীক্ষার অকার্যকারিতা আজ সকলের কাছে পরিস্কার। কিন্তু সরকার কোনো মতামতের তোয়াক্কা না করে নিজের অবস্থানে অনড়। তারা শিক্ষা ব্যবসায়ীদের সুযোগ দিচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে তুমুল ব্যবসা করার। আমরা যেমন এই বিষয়গুলো বলছি আপনিও নিশ্চয় আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছেন। তাহলে আসুন অবিলম্বে পিইসি-জেএসসি পরীক্ষা বন্ধের দবিতে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলি।
তথ্যসূত্রঃ
দৈনিক শিক্ষা, ১৫ ও ২১জুন’ ১৬ এর আপডেট।
রাখাল রাহা : ‘যে কারণে পিইসি পরীক্ষা বাতিল করা যাচ্ছে না’।
আবুল মোমেন : ‘শিশুর জন্য আমাদের প্রস্তুতি’ ও ‘শিক্ষাকে বলি দিয়ে শিক্ষা বিস্তার’।
মুনির হাসান : ‘সবার উপরে পরীক্ষা সত্য!’ ২০ আগস্ট’১৩।