Sunday, October 6, 2024
Homeঅনুশীলনভাষ্কর্য নিয়ে রাজনীতি — মানুষের স্বার্থ কোথায়?

ভাষ্কর্য নিয়ে রাজনীতি — মানুষের স্বার্থ কোথায়?

sculpture-blog-21

দৃষ্টিশক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গি দুটো কাছাকাছি শব্দ হলেও তাৎপর্য ভিন্ন। দৃষ্টিশক্তির মাধ্যমে মানুষ তার পারিপার্শ্বিককে অবলোকন করে। আর দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে তার ব্যাখ্যা দাঁড় করায়। দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পার্থক্য হয়। এই পার্থক্য ঘটনার বর্ণনায় যেমন তেমনি তার করণীয় সম্পর্কেও। একই কাজ তখন কারও কাছে ন্যায় আবার কারও কাছে অন্যায়। সত্য মিথ্যা তখন মানুষ ভেদে ধরা দেয়। তার মানে অবশ্য একথা সত্য নয় যে সত্য একসময়ে অনেকগুলো থাকে। সত্য একটাই থাকে। কিন্তু কোনটা সত্যি বা ন্যায়সঙ্গত তা কেউ বুঝতে পারে একমাত্র সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্ত করতে পারলে। মানুষের দৈনন্দিন দিনের চলমান ঘটনা থেকে জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বুঝতে হলে এটি আয়ত্ত করতে হয়।

উপরের আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা বাংলাদেশে চলমান একটি ঘটনা সম্পর্কে আলোকপাত করার প্রয়োজনে। অনেকেই অবগত আছেন গত কিছুদিন আগে হাইকোর্টের সামনে ন্যায় বিচারের প্রতীক হিসেবে পরিচিত গ্রীক দেবী থেমিস-এর আদলে একটি ভাস্কর্য অপসারণ নিয়ে বেশ উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। পক্ষ-বিপক্ষে নানা মত এসেছে। এই ব্যাপারটিও বুঝতে হলে দেখতে হবে কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা তাকে বিবেচনা করছি।

আলোচিত ভাস্কর্যটি হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে ছিল। ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামে কয়েকটি ইসলামী সংগঠনের একটি জোট ভাস্কর্যটি অপসারণের দাবি জানাতে থাকে। তাদের দাবি ছিল এটা একটি গ্রীক দেবীর মূর্তি। জাতীয় ঈদগাহের সামনে এমন একটি মূর্তি থাকলে তা মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানবে। ঘটনার পরম্পরায় সরকারের প্রধান শেখ হাসিনাও এই ভাস্কর্য নিয়ে তাঁর নেতিবাচক মনোভাবের কথা জানান এবং তিনি এর অপসারণের ব্যাপারে প্রধান বিচারপতির সাথে কথা বলবেন বলেও সকলকে অবগত করেন। এরই মধ্যে হঠাৎ করে গত ২৬ মে ’১৭ তারিখে গভীর রাতে ভাস্কর্যটি হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে সরিয়ে ফেলা হয়।

ঘটনার পরম্পরায় টেলিভিশন, টকশো, সংবাদপত্র, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠে। ভাস্কর্য অপসারণের সাফল্যে হেফাজতে ইসলাম ঘোষণা করে, ‘মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের এই দেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মূর্তি ছাড়া আর কোনো মূর্তি থাকতে পারবে না। সমস্ত মূর্তি অপসারণ করতে হবে।’ হেফাজত যখন দেশের সকল মূর্তি ভাঙ্গার ঘোষণা দেয় তখন দেশের শিক্ষিত-সচেতন মানুষের আতঙ্কিত হওয়া ছাড়া পথ থাকে না। কারণ এই দলগুলো শুধু নিজেরা নয়; সরকারও তাদের সহযোগী ভূমিকা রাখে। তাই আশঙ্কা জাগে, তাহলে কি বহু গর্বের-সংগ্রামের মূর্ত প্রতীকগুলো অপরাজেয় বাংলা, রাজু ভাস্কর্য, প্রাণের শহীদ মিনারও ভাঙ্গতে চাইছে এই শক্তি? ইসলামের নামে তারা যা বলবে তাই কি শেষ কথা? কেউ কেউ আবার এ কথাও বলেছেন, মৃনাল হক নামের ভাস্কর যিনি থেমিস সহ আরও কিছু ভাস্কর্য করেছেন তার বেশিরভাগই মানসম্মত নয় বরং অরুচিকর। ফলে এই মূর্তি হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপন করার মাধ্যমে বরং সৌন্দর্যের হানি হয়েছে।

ভাস্কর্যের মান নিয়ে সমালোচনা হতেই পারে। যেমন-তেমন একটা কিছুকে অবশ্যই উন্নত শিল্প হিসেবে গণ্য করা যায় না। আবার এ কথাও ঠিক, অন্যান্য অনেক কিছুর মতো বাংলাদেশে ভাস্কর্যের ক্ষেত্রেও স্বজনপ্রীতি-দুর্নীতি হয়। অভিযোগ আছে সরকারি রাজনৈতিক ব্যানার থাকলে কাজ পেতে সুবিধা হয়। ফলে ভাস্কর্যের মান সম্পর্কে বিচার করার জন্য এ সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা রাখেন এবং নৈর্ব্যক্তিকভাবে বিচার করতে পারেন এমন মানুষদের নিয়ে বরং কমিটি করা যেতে পারে। কিন্তু ভাস্কর্য মানেই মূর্তি আর মূর্তি মানেই তা গর্হিত, মুসলিম সম্প্রদায়ের অনুভূতির সাথে বিরোধাত্মক – এ কথা কতটুকু সত্য? ইসলামে কি মূর্তি নিষিদ্ধ? আসুন এ ব্যাপারগুলো নিয়ে কিছু আলাপ করা যাক।

তবে তার আগে একটি কথা বলে নেয়া আবশ্যক যে হেফাজতে ইসলামের মতো একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ, এভাবে শক্তি দেখানো, সরকারের নতজানু অবস্থান — এগুলো কোনোটাই বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে নতুন ঘটনা নয়। এর আগে ২০০৮ সালে বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন ইসলামের ভাবচেতনার সাথে বিরোধাত্মক বলে লালন ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলে, সরকার সে সময় যারা ঘটনার হোতা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বরং প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছিল। ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে শহীদ মিনার ভাঙ্গারও নজির বাংলাদেশে আছে। এমনকি শহীদ মিনারে ফুল দেয়া অনৈসলামিক, কোরান-তেলওয়াত করাটা যুক্তিসঙ্গত, এমন কথা পর্যন্ত বাংলাদেশের একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি বলেছেন। ধর্মের নানা রকম ব্যাখ্যা হাজির করে কাউকে নাস্তিক, মুরতাদ ঘোষণা করে মাথার দাম ঘোষণা করা, খুন করার প্রকাশ্য হুমকিও নানা সময়ে দেয়া হয়েছে। এগুলো নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছে কিন্তু কোনো সরকারই ব্যাপারগুলোতে ব্যবস্থা নেয়নি।

হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দ দাবি করেছেন, ‘হাইকোর্টের সামনে মূর্তি থাকলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আসবে। কেননা ইসলামে মূর্তি পূজা হারাম।’ ইসলামে মূর্তি পূজা হারাম ঠিক আছে। কিন্তু যেভাবে দুটো বিষয়কে এক করে দেখানো হয়েছে তা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? কেননা যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেই ওটা ভাস্কর্য নয়, মূর্তি তাহলেও কি দূরবর্তী অবস্থানে অবস্থিত জাতীয় ঈদগাহে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের নামাজ আদায়ে বাধা সৃষ্টি হবে? এই মূর্তিকে কি কেউ পূজা করতে যাচ্ছে? না কি এটি অন্য ধর্মীবলাম্বীদের প্রার্থনার জন্য নির্মিত হয়েছে? আর বাংলাদেশের মানুষের ধর্মানুভূতি কি এতটাই ঠুনকো যে একটি মূর্তির জন্য তাদের এবাদত নষ্ট হবে? অসাম্প্রদায়িক জাতি বলে যে বাঙালি জাতির পরিচিতি, আবহমান কাল থেকে যে দেশে মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠী একসাথে বাস করে, যেখানে দেশের বহুস্থানে মসজিদের পাশে মন্দির আছে; সেখানে একটি মূর্তির জন্য এত তুলকালাম কা-? আর অন্য ধর্মীয়গোষ্ঠী মূর্তি পূজা করা বলেই এর বিরোধিতা করতে হবে? মুসলমান ছাড়া অন্য ধর্মাবলাম্বীদের মধ্যে কেউ কেউ তো সূর্য কিংবা আগুনের পূজা করে। তাহলে কি আগুন, সূর্যকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা যাবে? ধর্ম যে নৈতিক শিক্ষা দেয়, এগুলো তার সাথেও বিরোধপূর্ণ। কাজী নজরুল ইসলাম তাই বলেছিলেন, ‘তোমার ধর্মে অবিশ্বাসীদের তুমি ঘৃণা নাহি করে/ আপন তাদের করিয়াছ সেবা ঠাঁই দিয়েছ তুমি ঘরে।/ ভিন্ন ধর্মীর পূজা মন্দির/ ভাঙতে আদেশ দাওনি, হে বীর!/ আমরা আজিকে সহ্য করিতে পারি না পর মত/ ক্ষমা করো হযরত।’
ভাস্কর্য বা মূর্তির সাথে ধর্মের বিরোধ যা হেফাজতে ইসলাম দেখাতে চাইছে তা একদিক থেকে অনৈতিহাসিক ও সমাজ বিচ্ছিন্ন ধারণা। ধর্মের ইতিহাস যেমন পুরনো তেমনি ভাস্কর্যেরও। একসময় নীল নদের তীরে মিশরে গড়ে উঠেছিল উন্নত সভ্যতা। মিশরীয় সভ্যতা। তখন মিশরের সম্রাটদের বলা হত ফেরান। মিশরীদের বিশ্বাস ছিল সম্রাটরা মৃত্যুর পর দেবতা হবেন। তাই তাদের দেহকে সংরক্ষণ করতে হবে। দেহ সংরক্ষণের জন্য পিরামিডের ধারণা এসেছে। এখানে সম্রাটদের দেহকে মমি করে রাখা হত। পিরামিড পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন পুরাকীর্তি এবং ভাস্কর্য। গ্রীকদের শ্রেষ্ঠ শিল্প নিদর্শন ছিল তাদের ভাস্কর্য। গ্রীকদের ভাস্কর্যে মানব শরীরের সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তোলা হত। গ্রীসে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় যে ক্রীড়াবিদরা অংশ নিত তারা ছিল সুঠাম দেহের অধিকারী। তখনকার চিত্রকররা পাথর কেটে কেটে এসব বলিষ্ঠ দেহ তেজস্বী মানবদেহ ফুটিয়ে তুলতেন। তারা বিশ্বাস করতেন দেবতারা র্শৌয, সৌন্দর্যের মধ্যে নিজেদের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলেন। হায়দ্রাবাদে উনিশ শতকে আবিষ্কৃত অজন্তায় দেখা যায় পাহাড় কেটে কেটে তৈরি হওয়া হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মীয় বিশ্বাসের নানা প্রকার মূর্তি। এ শিল্পকর্মগুলিতে ধর্মীয় নানা উপাখ্যানের পাশাপাশি পার্থিব জীবনের নানা ঘটনার উল্লেখ থাকত। খ্রিস্টের জন্মের পরে বাইজানটাইন আমলে মানুষের শিল্পবোধের পরিচয় পাওয়া যায় মূলত খ্রিস্টীয় ধর্মীয় বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে। এরপর রেনেসাঁর সূচনালগ্নে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মাইকেল এ্যাঞ্জেলো প্রমুখের মাধ্যমে শিল্পকলা এক নতুন পথে হাঁটতে শুরু করে। স্পেনের স্বৈরশাসক বাতিস্তা কর্তৃক জঘন্য হত্যাকন্ডের প্রতিবাদে পিকাসো এঁকেছেন তাঁর গোয়ের্নিকা। সমাজ বিকাশের ধারায় এভাবে শিল্পকর্ম সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে গড়ে উঠেছে।

লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি, মাইকেল এ্যাঞ্জেলো, রায়েল, তিসিয়েন প্রমুখ বিশ্বনন্দিত শিল্পীরা তাদের যুগে কোনো মূর্তি বা ছবি উদ্দেশ্যহীনভাবে তৈরি করেননি। সমাজের প্রতি তাঁদের একটা দায়বদ্ধতা ছিল। আর ছিল মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সর্বোপরি মানুষকে সামনে তুলে ধরা। এই নিরিখে তাঁদের শিল্পকর্মকে বিচার করতে হবে। এগুলো ইতিহাস বিচ্ছিন্ন কোনো ব্যাপার নয়। সমান্ত যুগে ধর্মচিন্তার মধ্যে, ধর্মীয় পরিচয়ের মধ্যেই মানুষের যাবতীয় চিন্তা-কর্ম গন্ডীবদ্ধ ছিল। সেটাই ছিল সে যুগের সাহিত্যিক-শিল্পীদের কাজ। কিন্তু রেনেসাঁ যুগের শিল্পীরা সেই স্থান থেকে মানুষকে ‘মানুষ’ পরিচয়ে পরিচিত করিয়েছেন। মানুষই সবার ওপরে, এই ভাবনাটা যখন এলো, মানুষের স্বাতন্ত্র্যবোধকে প্রতিষ্ঠিত করা, মানুষকে মর্যাদা দেয়া, ব্যক্তির বিকাশের পথকে প্রশস্ত করা যখন মানুষের সমাজের প্রয়োজন তখন সমস্ত শিল্পী-সাহিত্যিক একটা কাজই করে গেছেন – মানুষকে ঊর্দ্ধে তুলে ধরেছেন। লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি যে বিখ্যাত মোনালিসা আঁকলেন তা এত সমাদৃত হলো কেন? আগে নারীদের যে ছবি আঁকা হয়েছে, সেগুলিতে ঈশ্বরিক ভাবটাই ছিল প্রধান। সামাজিক ভাব নিয়ে এত সুন্দর ছবি ইতোপূর্বে হয়নি। মানুষ যে এত সুন্দর হয়, নারীর যে এত মহিমা থাকতে পারে- তা মানুষ বুঝতে পারলেও চিত্রকলায় আগে আসেনি। সেটাই দেখালেন লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি। মাইকেল এঞ্জেলো বাইবেলের গল্পকে অবলম্বন করে সিস্টাইন চ্যাপেলকে আঁকলেন। সেই স্বর্গ-নরক নিয়েই আঁকলেন। কিন্তু সমস্ত মানুষের ব্যাথা-বেদনা-সংগ্রামের কাহিনী তাতে বিধৃত হলো। অবলম্বন করেছেন বাইবেল কিন্তু মূল উপজীব্য হলো মানুষ। রাফায়েলও যীশু খৃস্ট এঁকেছেন- শৈশবের যীশু খৃষ্ট মানব শিশু।

ফলে উপরের আলোচনা থেকে এটা অন্তত পরিষ্কার হবার কথা- মানুষ তার বাঁচার প্রয়োজনেই শিল্প-সাহিত্যের জন্ম দিয়েছে। সামাজিক প্রয়োজনেই এই নন্দনতাত্ত্বিক বিষয়গুলো এসেছে। এর বাইরে মানুষ কিছু সৃষ্টি করে নি। তাই এ কথা বলা যায়Ñ মানুষ সামগ্রিকভাবে ও সম্মিলিতবাবে বাঁচার যে চেষ্টা করেছে, সেই সুদূর অতীতকাল থেকে যে সংগ্রাম করে এসেছে তার অগ্রগতির ইতিহাসই হলো শিল্পকলার ইতিহাস। এই সংগ্রাম ছাড়া শিল্পকলা নেই। মানুষের সংগ্রামকে সাহায্য করাই শিল্পকলার কাজ। মানুষ সেই অতীতে যখন গুহাবাসী ছিল, যখন তীর-ধনুক দিয়ে পশু-পাখি শিকার করতো, তখনও ছবি এঁকে এঁকে উত্তরসূরিদের কাছে সংগ্রামের ইতিহাস রেখে যেত। মানুষের বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই শিল্প-মূর্তি-ভাস্কর্য এসেছে।
সমাজের প্রয়োজনে যা কিছু এসেছে তাকে নিষিদ্ধ করার জন্য আজ ইসলামের দোহাই পাড়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে ‘ইসলামে মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ’, ‘কোনো মুসলমান মূর্তিপূজা করতে পারে না’ ইত্যাদি। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এ কথাগুলোর সত্যতা আছে। কিন্তু সবকিছুরই স্থান-কাল-পাত্র আছে। তাকে বিবেচনায় না নিলে সঠিক বিচার করা যায় না। ইসলামে পূজা করার মূর্তি আর শিল্পকর্ম হিসেবে মূর্তিকে এক করে দেখা হয়নি। কিন্তু তথাকথিত ধর্মীয় নেতারা এই পার্থক্যকে ভুলিয়ে দিয়ে দুটো করে এক করে দেখাচ্ছেন। যেমন ইসলামে বলা আছে, আল্লাহর প্রতিরূপ হিসেবে কোনো কিছু কল্পনা করা অথবা আল্লাহর সমকক্ষ বিবেচনা করে কোনো কিছুর অর্চনা করা জঘন্য অপরাধ বা শিরক। কিন্তু মানুষের নান্দনিক বোধের প্রকাশ হিসাবে মূর্তি বা ভাস্কর্য নির্মাণ অন্যায় নয়। একইভাবে ধর্মের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণও নয়। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও শিক্ষা সমালোচক সৈয়দ আলী আহসান তাঁর ‘শিল্পবোধ ও শিল্পচৈতন্য’ বইতে লিখেছেন, “কোরানে শিল্পের বিরুদ্ধে একটি শব্দও নেই এবং রাসুলে করিমের বিবিধ আচরণে সৌন্দর্য সমর্থনের অনেক কাহিনী পাওয়া যাচ্ছে এবং চিত্রের ক্ষেত্রে কখনও তিনি মৌনতা অবলম্বন করেছেন এমন ঘটনাও আছে। সুতরাং শিল্পকলার সাথে পূজা অর্চনার সম্পর্ক ইসলাম স্বীকার করে না। শিল্পকলা সংস্কৃতির অঙ্গ এবং সংস্কৃতিকে বিকাশমান, সম্ভ্রান্ত এবং সিদ্ধকাম হিসেবে গঠন করার জন্য বিভিন্ন কলা কুশলতার অঙ্গীকার প্রয়োজন।”  ইসলামের শেষ নবী ও রসুল হযরত মুহম্মদ (সা:) এর ব্যক্তিগত জীবনের অনেক ঘটনায় শিল্পকর্মের প্রতি স্পষ্ট সমর্থন পাওয়া যায়। আযরাকী বর্ণিত একটি হাদিসে আছে মক্কা বিজয়ের পর হযরত মুহম্মদ যখন কাবা গৃহে প্রবেশ করেন তখন একটি ছবির উপর হাত রেখে অন্য মূর্তিগুলো নষ্ট করে ফেলতে বলেছিলেন। যে ছবিটির উপর তিনি হাত রেখেছিলেন সেটি ছিল বিবি মরিমের কোলে শিশুপুত্র ঈসা (আ:) এর ছবি। এ চিত্রটি অনেকদিন পর্যন্ত কাবা ঘরে সংরক্ষিত ছিল।

আবু দাউদ (রা) এর বর্ণিত একটি হাদিসে আছে রাসুলের শয়ন কক্ষের গালিচার ঢাকনা প্রভৃতিতে পশুপাখি ও জীবজন্তর ছবি অঙ্কিত ছিল। রাসুলের স্ত্রী বিবি আয়েশা (রা:) এর গৃহেও জীব জন্তুর প্রতিকৃতি যুক্ত পর্দা ছিল। নামাজে বিঘœ হয় বলে তিনি সেগুলো সরিয়ে রাখতে বলেছিলেন কিন্ত ধ্বংস করতে বলেননি। বুখারী শরীফে আছে বিবি আয়েশা রসুলকে চিত্রযুক্ত পর্দা কেটে গদি ও বালিশ তৈরি করে দিয়েছিলেন। এগুলো ব্যবহার করতে রসুলের এতটুকু আপত্তি হয়নি।

৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে হযরত ওমর (রা:) জেরুজালেম জয় করেন। প্রাণীর ছবিসহ একটি ধূপদানি তাঁর হাতে আসে। তিনি সেটি মসজিদ-ই-নব্বীতে ব্যবহারের জন্য আদেশ দেন। (আব্দুল বাছির, ‘ইসলাম ও ভাস্কর্য শিল্প : বিরোধ ও সমন্বয়’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা অনুষদ পত্রিকা, জুলাই ২০০৫ জুন ২০০৬) পারস্যের কবি শেখ সাদী। যার ‘নাত’ এ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা মিলাদে সব সময় পাঠ করে থাকেন -‘বালাগাল উলা বি কামালিহি কাশাফাদ্দুজা বি জামালিহি..’। শেখ সাদীর মাজারের সামনেই তার একটি মর্মর পাথরের ভাস্কর্য আছে। ইসলামের দুজন মহান সুফিসাধক যাঁদের বাস ছিল পারস্যে (বর্তমান ইরান) এঁদের একজনের নাম জালালুদ্দিন রুমি। অন্যজন ফরিদউদ্দীন আত্তার (নিশাপুর)। তাঁর মাজারের সামনেও তাঁর আবক্ষমূতি আছে। (বরফ ও বিপ্লবের দেশে, ড. আবদুস সবুর খান, সহকারী অধ্যাপক, ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।) আরেকটি ইসলামিক দেশের নাম লিবিয়া। লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলিতে বিশাল একটি মসজিদ আছে। মসজিদের সামনেই গ্রিকদের তৈরি একটি মূর্তি স্বমহিমায় শোভা পাচ্ছে।

প্রকৃত ধার্মিকতার আধ্যত্মিকতা থাকে কিন্তু তা মানুষের প্রতি ক্ষোভ-বিক্ষোভ বা বিদ্বেষ জাগায় না। একজন প্রকৃত ধার্মিক মানুষ অন্যকে করুণা করতে পারেন, কিন্তু ঘৃণা করেন না। অন্যের উপর নিজের মত চাপাতে যান না। প্রত্যেক ধর্ম তার বিকাশের কালে মানুষকে পরমত সহিষ্ণু, পরার্থমুখী, বিলাসবিমুখ হতে প্রেরণা যুগিয়েছিল। মানুষের উপর মানুষের শোষণ-অত্যাচার বন্ধের জন্য সৃষ্টিকর্তার নামে নানা বিধান এনেছিল। ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দের মানদ- নির্ধারণ করেছিল। ধর্মীয় মূল্যবোধকে ধারণ করে জন্ম নিয়েছিল বড় বড় চরিত্রের। তাঁরা সমাজ সংস্কারকের ভূমিকাতেও অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ইসলাম ধর্মে হযরত মুহাম্মদ (স:), খ্রিস্ট ধর্মে যীশু খ্রিস্ট তেমনই বড় চরিত্র- সমাজ সংস্কারক। হিন্দু ধর্মে বর্ণ ও জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে শ্রীচৈতন্যের ভূমিকাতেও তেমনটি দেখা যায়। শিখ ধর্মের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা। তাই আমরা দেখব প্রত্যেক ধর্ম তার নিজ নিজ শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা করলেও অন্য বিশ্বাসের মানুষদের দমন-পীড়নের অনুমতি দেয়নি। কিন্তু যারা ধর্মকে ক্ষৃদ্র কায়েমী স্বার্থে ব্যবহার করে, ধর্মকে তার নৈতিক মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত করে দেখে তারা মানবিকতার চেয়ে ধর্মের পরিচয়ে সমস্ত কিছুকে বিবেচনা করে।

নজরুল বলেছিলেন, ‘অবতার-পয়গম্বর কেউ বলেননি, আমি হিন্দুর জন্য এসেছি, আমি মুসলমানের জন্য এসেছি, আমি ক্রীশ্চানের জন্য এসেছি। তাঁরা বলেছেন, আমরা মানুষের জন্য এসেছি— আলোর মত, সকলের জন্য।’ এঁদের সাথে আজকে যারা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে তাদের মধ্যে মিল আছে কী? তারা আস্তিক-নাস্তিক, মুরতাদ কিংবা মূর্তির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণাতে যতটা ব্যস্ত, দেশের এত এত সংকটে তাদের ভূমিকা কোথায়? তাদের কাছে নারী নেতৃত্ব হারাম কিন্তু আওয়ামী লীগ-বিএনপি দু’দলের প্রধান নেতৃত্ব নারী হওয়া সত্ত্বেও তাদের সাথে অনেকগুলো ইসলামী দল যুক্ত আছে। হেফাজতে ইসলামের নেতারাও মাঝেমাঝেই শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করেন, দাবি-দাওয়া জানান। সরকার প্রধানের ইঙ্গিতে (আদেশে) হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য সরে যাওয়ায় ভূয়সী প্রশংসাও তারা করেছেন। অথচ এই সরকারের আমলেই প্রতিদিন কত কত জনবিরোধী কর্মকা- নেমে আসছে, মানুষের উপর কতভাবে অত্যাচার-নির্যাতন নেমে আসছে, সে ব্যাপারে তাদের টু শব্দটি নেই। ভাস্কর্য অপসারণের দাবিতে তারা হাজার হাজার মানুষের সমাবেশ করতে পারেন, কেননা তারা মনে করেন, তাতে ইসলাম রক্ষা হবে। কিন্তু সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে যার কারণে পুরো দেশের মানুষ আক্রান্ত হবে, প্রতিদিন শত শত নারী নির্যাতন-ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, সরকারের অব্যবস্থাপনা-দুর্নীতির কারণে হাজার হাজার মানুষের ঘর-সংসার ভেসে যাচ্ছে পানিতে ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে; এসব ব্যাপারে তাদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ নেই। অশ্লীলতা-অপসংস্কৃতি-মাদকে দেশ সয়লাব হয়ে যাচ্ছে তবুও তাদের ঈমান দুর্বল হচ্ছে না। যে সরকার সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিকভাবে জনগণের অনুমোদন ছাড়াই ক্ষমতায় এসেছে তাদের সাথে রাজনৈতিক বোঝাপড়ায় তাদের এতটুকু বাধে না। এরই নাম কি তাহলে ধর্ম পালন?

এই শক্তিগুলোর সাথে হাত মিলিয়েছে সরকারও। মূলত রাজনৈতিক সুবিধা নেবার জন্যই নানা সময়ে সরকার হেফাজতে ইসলামসহ অন্য ইসলামী দলগুলোর সাথে যুক্ত হয়েছে। সরকার খুব ভালো করেই জানে রাজনৈতিক পরিস্থিতি পুরোটা তাদের অনুকূলে নেই। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ইসলামী দলগুলোকে সাথে নিয়ে সেই অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে। তাই হেফাজতে ইসলামের দাবির সাথে সুর মিলিয়ে সরকার প্রধানও ভাস্কর্য অপসারণের কথা বলেছেন। এছাড়াও কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমতুল্য ডিগ্রি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া, পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন ইত্যাদি সবই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে করা হয়েছে। আগামীতে হয়ত এরকম আরও কিছু ঘটনা ঘটবে। এগুলো কোনোটিই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। নির্বাচনে জিততে হলে হয়তো এভাবেই ‘ইসলামের পক্ষের শক্তি’ হিসেবে সরকারকে প্রমাণ দিতে হবে।

১৯৭১ সালে যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের অবসান ঘটিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল, স্বাধীনতার ৪৬ বছরে সেই ধর্ম নিয়ে শাসকদের উন্মাদনা কমেনি, বেড়েছে। কেন? কারণ বৈষম্য কমেনি, শোষণ-নির্যাতনের অবসান ঘটেনি, বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে যুক্তিবাদী মননকাঠামো গড়ে তোলা যায়নি ইত্যাদি নানা কারণে। এছাড়াও সংবিধান ঘোষিত একধারার শিক্ষার বদলে মাদ্রাসাসহ কয়েক ধারার শিক্ষাব্যবস্থা বহাল রাখা হয়েছে, ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

বৈষম্য যত বাড়ছে, তত মানুষের মধ্যে বিক্ষুব্ধতা-প্রতিবাদী হয়ে উঠার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। শাসকরাও তাই ভীত হয়ে উঠছে ক্রমাগত। মানুষের সচেতনতা অন্যায়-জুলুমের ভিত কাঁপিয়ে দিতে পারে, এ কথা অন্যায়কারীরা জানে খুব ভালোভাবেই। তাই তারা সবসময় জনগণের চেতনাকে মেরে দিতে চায়। চেতনা নাশকের মতো ব্যবহার করে ধর্মের নামে অধর্ম-কুসংস্কার; যুক্তিবাদিতার নামে ব্যবহার করে অন্ধ বিরোধিতা কিংবা আনুগত্যের ধারণা; মনুষ্যত্ব-মানবিকতাকে ভুলিয়ে করে অমানুষ-পশু। ফলে মানুষ আর মানুষ থাকে না। হয় যন্ত্রের মতো শৃঙ্খলা পরায়ন, নয়তো নিস্পৃহ-নির্লিপ্ত, নতুবা উগ্র বিরোধী। এর কোনোটি শাসকের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারে না। তাই সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও উন্নত চেতনা আয়ত্ত করা খুব জরুরি। এর অভাবে চারপাশের অরাজকতা দেখে কেউ হতাশ হতে পারে: আবার সঠিকভাবে ধারণ করলে সমাধানের পথ ও করণীয় বুঝতে পারে। তাই ভাস্কর্য অপসারণের এই ঘটনাও আমাদের সামনে বলে গেল- কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা একে দেখব? ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ কী হবে? কোন নৈতিকতাকে আমরা ধারণ করব? ধর্ম কি শাসকের হাতের হাতিয়ার হবে নাকি মানুষের কল্যাণে তার ব্যবহার হবে?

‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/ কান্ডারী ! বল্, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার…’ নজরুলের এই আহ্বান আজ আবারও গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে।

অনুশীলন আগষ্ট ২০১৭

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments