Sunday, October 6, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - মে-জুন ২০২৩মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা একটি সামগ্রিক জীবনদর্শন

মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা একটি সামগ্রিক জীবনদর্শন

মানবসভ্যতার বিকাশের ধারায় একের পর এক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুদীর্ঘকাল ধরে চলা আদিম গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজের একটা স্তরে এসে সৃষ্টি হয়েছে ব্যক্তিসম্পত্তি এবং সম্পত্তিকে ভিত্তি করে শ্রেণি বিভাজন। একদিকে শাসক আর একদিকে শাসিত। জন্ম নিয়েছে মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণ। এই শ্রেণিবিভাজনের প্রথম স্তরে এসেছে নির্মম শোষণমূলক দাসপ্রথা। আবার একদিন দাসপ্রথা ভেঙে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সামন্ততন্ত্র। সামন্ততন্ত্রের শোষণমূলক ব্যবস্থারও অবসান হয়েছে। বুর্জোয়া বিপ্লবের পথে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বুর্জোয়া শ্রেণির শাসন তথা পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থা। তার একদিকে পুঁজিপতি শ্রেণি, অপরদিকে সর্বহারা শ্রেণি। আদিম গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজের পর দাসপ্রথাতে এসে মানুষের দ্বারা মানুষের যে শোষণ মানবসমাজে প্রথম জন্ম নিয়েছিল, পুঁজিবাদী সমাজেও তা অব্যাহত। সেই পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার শোষণের ফলে এক সর্বগ্রাসী সংকট দেশের আপামর জনসাধারণের জীবনকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক দিক থেকে দুর্বিসহ করে তুলেছে। শুধু আমাদের দেশই নয়, সমস্ত পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশের নিপীড়িত মানুষের জীবনই আজ বিপর্যস্ত এবং ক্রমাগত গভীর থেকে গভীরতর সংকটে নিমজ্জিত হচ্ছে। বিশ্বের শ্রমিক-কৃষকসহ সর্বস্তরের নির্যাতিত মানুষ এই অবস্থা থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষা নিয়ে দিন গুণছেন। এই শোষণমূলক পুঁজিবাদ শুধু অর্থনৈতিক সংকটই সৃষ্টি করছে তাই নয়, মানুষের সুকুমারবৃত্তিগুলিকে, মানুষে মানুষে পারস্পরিক সম্পর্কের সৌন্দর্যকেও ধ্বংস করেছে। বহুদিন আগেই ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তাহার’-এ কমিউনিস্ট আন্দোলনের পথিকৃৎ মহান মার্কস এবং এঙ্গেল্স দেখিয়েছিলেন যে, “মানুষের যে সমস্ত বৃত্তিকে এতদিন সকলে সম্মান করে এসেছে, সশ্রদ্ধ বিস্ময়ের চোখে দেখেছে, বুর্জোয়া শ্রেণি সেগুলির মাহাত্ম্যকে বিনষ্ট করে দিয়েছে। পরিবারব্যবস্থার মধ্যে আবেগের আভরণকে সে ছিন্ন করে দিয়েছে, পারিবারিক সম্পর্কগুলিকে নিছক একটা আর্থিক সম্পর্কে পরিণত করেছে।” এরপর পার হয়ে গিয়েছে একশত সত্তর বছরেরও বেশী সময়। সমস্ত দিক থেকে সংকটের চেহারা আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সংকটের সাথে সাথে আজ সমাজের মধ্যে মনুষ্যত্বের সুন্দর দিকগুলি, মানুষের সুকুমারবৃত্তি, হৃদয়বৃত্তি সমস্ত কিছুই নিঃশেষিত-প্রায়। কাব্য, সংগীত, সাহিত্য, চারুকলার বিকাশের পথ অবরুদ্ধ। এই পরিস্থিতির হাত থেকে মুক্তি পেতে গেলে সমাজকে পুঁজিবাদী শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে হবে। বিপ্লবের পথে ক্ষমতাসীন পুঁজিপতিশ্রেণীকে উচ্ছেদ করতে হবে। কমরেড শিবদাস ঘোষ এই কথাটি তুলে ধরে বলেছেন, ‘আমরা যখন বলি, ভারতবর্ষে আজ আবার একটা বিপ্লব দরকার, ভারতবর্ষের মুক্তির দরজা খুলে দিতে হলে বিপ্লবের দরকার, সমাজ প্রগতির দ্বার খুলে দিতে হলে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দরকার, তখন আমরা বলি পুঁজিবাদী লোভ, মুনাফা চক্র এবং ‘মোটিভ’(উদ্দেশ্য) থেকে উৎপাদনকে, বিজ্ঞানকে, আর্টকে, সাহিত্যকে, মূল্যবোধকে, আচার-বিচারকে এক কথায় গোটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে এবং বিজ্ঞান সাধনাকে মুক্ত করার কথা। শুধু মজুরের আর্থিক শোষণ থেকে মুক্তির লড়াই সমাজতন্ত্রের লড়াই নয়, পুঁজিবাদী শোষণ থেকে মুক্তি লাভ করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই, গোটা উৎপাদনকে, জ্ঞান-বিজ্ঞানকে মুক্ত করার লড়াই। আমাদের মূল্যবোধ, রুচি এবং আর্ট, শিল্প-সাহিত্য সমস্ত কিছুকে পুঁজিবাদী জুলুম এবং ‘মোটিভ’, যা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে তার থেকে মুক্তির লড়াই। এমনকী ভালবাসা, পারিবারিক শান্তির ক্ষেত্রেও মুক্তির লড়াই।” এই লড়াই সফল করতে না পারলে আমরা কেউই এই সংকটের হাত থেকে পরিত্রাণ পাব না। অর্থাৎ, যতদিন এই সমাজকে পুঁজিবাদী শোষণ থেকে মুক্ত করতে না পারব, ততদিন পর্যন্ত আমাদের কারোর মুক্তি নেই। কারণ, সমগ্র সমাজ মুক্ত না হলে বিচ্ছিন্নভাবে কোনো ব্যক্তির মুক্তি হতে পারে না ।
তাই সচেতন মানুষ হিসাবে আমরা যারা ব্যক্তি এবং সমাজের মুক্তি চাই, বিপ্লবী না হয়ে আমরা পারি না। আর, বর্তমান সমাজ বিপ্লব মানে পুঁজিবাদ-বিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এবং সমাজ পরিবর্তনের ধারায় তা অবশ্যম্ভাবী। এছাড়া মানবমুক্তির অন্য কোন সহজ রাস্তা নেই। সেই কারণেই, যে আদর্শের ভিত্তিতে পুঁজিবাদবিরোধী বিপ্লব বাস্তব রূপ পাবে তাকেই জীবনে গ্রহণ করতে হবে।
বিপ্লবী হিসাবে গড়ে উঠতে হলে আমাদের মার্কসবাদী দর্শনকে গ্রহণ করতে হবে
কোনও আদর্শকে জীবনে গ্রহণ করার সময় আমাদের একথা মনে রাখতে হবে, মানুষের প্রতিটি ক্রিয়ার পেছনে কোনও না কোনও দর্শন কাজ করে। বেশিরভাগ মানুষই হয়ত সে সম্পর্কে সচেতন থাকেন না। তারা বুঝতে পারেন না, তাদের ক্রিয়াটা কোন্ দর্শনের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু যারা বিপ্লবী হবেন, যারা শোষিত নিপীড়িত মানুষের মুক্তির মহান কর্মকাণ্ডে নিজেদের নিয়োজিত করবেন, তাদের বুঝতে হবে যে, প্রত্যেকটি ক্রিয়ার মধ্যে দর্শন কাজ করে এবং শ্রেণিবিভক্ত সমাজে তা কোনও না কোনও শ্রেণির দর্শন। যেহেতু পুঁজিবাদী সমাজ একটি শ্রেণিবিভক্ত সমাজ, তাই মুক্তি-পিপাসু মানুষকে গভীরভাবে অনুসন্ধান করতে হবে, সমাজ বিপ্লবের আকাক্সক্ষাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার দিশা দেবে কোন্ দর্শন। কমরেড শিবদাস ঘোষ বলছেন, “আমরা মুক্তি চাই, আমরা এই পৃথিবীকে পাল্টাতে চাই এবং সচেতন ক্রিয়ার দ্বারা সমাজপ্রগতিকে ত্বরাণি¦ত করতে চাই। এই সচেতন ভূমিকা পালন করতে হলে আমাদের প্রকৃতি জগতের অন্তর্নিহিত নিয়মকে জানতে হবে এবং সমস্ত সমস্যার প্রকৃত কারণ বুঝতে হবে। তাই এসব দর্শনের সন্ধান আমাদের করতে হবে, যা আমাদের জীবনের নানা সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ দেখাতে পারে। আমরা এমন দর্শন চাই যা সভ্যতা, সমাজ প্রগতি ও বিপ্লবের সামনে আজ যে সমস্যাগুলো দাঁড়িয়ে আছে তার সমাধানের সঠিক পথ দেখাতে পারবে এবং বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের পথে সমাজের আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে বর্তমান পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের উচ্ছেদের রাস্তা প্রশস্ত করবে।” তিনি আরও দেখিয়েছিলেন, “এই জরাজীর্ণ ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটানোর সংগ্রামে, নিজেদের পরিবর্তিত করে আরও উন্নত নীতি-নৈতিকতা মূল্যবোধের সংস্কৃতির আধারে গড়ে তোলার সংগ্রামে এবং অধঃপতিত বুর্জোয়া সংস্কৃতির প্রভাব থেকে নিজেদের মুক্ত করার সংগ্রামে মার্কসবাদ আমাদের অস্ত্র, সত্যকে জানার এবং মুক্তির পথকে আলোকিত করবার হাতিয়ার, সমগ্র মানবজাতির মুক্তি সংগ্রামের আলোকবর্তিকা।
বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা কমরেড লেনিন এই প্রসঙ্গে বলেছেন, “মার্ক্সীয় দর্শন হচ্ছে বস্তুবাদী দর্শনের সেই শীর্ষবিন্দু, যা মানবজাতি, বিশেষত শ্রমিকশ্রেণির হাতে বৌদ্ধিক জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ হাতিয়ারটি তুলে দিয়েছে। …একমাত্র মার্ক্সের বস্তুবাদী দর্শনই সর্বহারা শ্রেণিকে মুক্তির পথ দেখিয়েছে। এতকাল সমস্ত নিপীড়িত শ্রেণি যে মানসিক দাসত্বের অন্ধকারে ঘুমিয়েছিল, সেখান থেকে তাদের বেরোবার পথ নির্দেশ দিয়েছে।” এই শিক্ষাকে সামনে রেখে কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন, “বুর্জোয়া শ্রেণি ও শ্রমিক শ্রেণির দ্বন্দ্ব-সংঘাতই হচ্ছে আজকের সমাজের মূল দ্বন্দ্ব। এই মূল দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই প্রগতির পথ নির্দেশিত হচ্ছে। এই মূল সংগ্রামে শ্রমিক শ্রেণির বিজয় অর্জনের অর্থ হলো, বুর্জোয়া গণতন্ত্রের জায়গায় সর্বহারা গণতন্ত্র এবং বুর্জোয়া একনায়কত্বের জায়গায় সর্বহারা একনায়কত্বের প্রতিষ্ঠা। উৎপাদন, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, নীতি-নৈতিকতা সমস্ত ক্ষেত্রে এই যে বুর্জোয়া ও সর্বহারার একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই, এটাই হল আজকে বহু সমাজ-দ্বন্দ্বের মধ্যে মূল দ্বন্দ্ব- যে দ্বন্দ্বের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেই আমার ব্যক্তিচেতনা তথা তার অস্তিত্বই আবর্তিত হচ্ছে। তাই আমার চেতনা, আমার প্রয়োজনের উপলব্ধি যখন শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির প্রশ্নটির সাথে, শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির প্রয়োজনের উপলব্ধির সঙ্গে একাত্ম হয়েছে একমাত্র তখনই আমি বিপ্লবী। সো, আই একজিস্ট ইন রিভল্ট এগেনস্ট দি একজিস্টিং সোসাইটি অর্থাৎ বুর্জোয়া শ্রেণি ও প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করেই আমি বেঁচে আছি এবং এই লড়াই কেবলমাত্র রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, ঘরে-বাইরে, সংস্কৃতিতে, নৈতিকতায়, রুচিতে, আচরণে- সর্বত্র এই লড়াই। আমার ভালোলাগা, আমার রুচি যা বিপ্লবের পরিপূরক; যা উৎপাদনকে, শিল্পকে, সাহিত্যকে, বিজ্ঞানকে বুর্জোয়া ‘প্রিকনসেপশন’ থেকে মুক্ত করার পরিপূরক তার সাথে বুর্জোয়ার উপলব্ধি, তার সংস্কৃতি, তার ধারণা, যৌন স্বাধীনতার ধারণা সম্পূর্ণ বিরোধাত্মক। এই হল বিপ্লবীর অদ্ভুত অবস্থান। বিপ্লবী অবস্থানই করছে শ্রেণিসংগ্রামের তীব্র দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্যে।
ফলে, পুঁজিবাদবিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মকাণ্ডে যারা আত্মনিয়োগ করবেন তাদের জীবনকে পরিচালিত করতে হবে সঠিক আদর্শের দ্বারা। তাদের গ্রহণ করতে হবে নতুন আদর্শ অর্থাৎ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদকে। এই দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ যে অনেক ধরনের বস্তুবাদী দর্শনের মধ্যে কেবলমাত্র একটা দর্শন নয়, সেই বিষয়টি উত্থাপন করে কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন, “দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদই বর্তমান যুগে মানুষের হাতে একমাত্র হাতিয়ার যার সাহায্যে মানুষ সমস্ত ধরনের সমস্যার উপর সঠিকভাবে আলোকপাত করতে পারে বা সমস্যাগুলোকে সঠিকভাবে বুঝতে পারে। ফলে, আমরা যেহেতু সত্য জানতে চাই, জীবন সম্বন্ধে, বিভিন্ন ঘটনা সম্বন্ধে সত্যোপলব্ধি করতে চাই, সেই কারণেই আমরা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের চর্চা করছি। আর সত্যানুসন্ধানের জন্য দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের অনুসন্ধান ও চর্চা করি বলেই বা সেই দৃষ্টিভঙ্গীর দ্বারা পরিচালিত হই বলেই আমরা মার্কসবাদী।”
মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারলে তা সর্বহারা শ্রেণীর হাতে এক অপরাজেয় হাতিয়ার
আমাদের মনে রাখতে হবে, মার্কসবাদী দর্শনের দ্বারাই একমাত্র নিপীড়িত শোষিত শ্রমিকশ্রেণির মুক্তি অর্জন সম্ভব। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সচেতনভাবে আমাদের বিচার করতে হবে, এই দর্শনের ভিত্তিতে আমাদের ক্রিয়া পরিচালিত হচ্ছে কি না। মার্কসবাদী শিক্ষা থেকে আমরা জানি, এই বিপ্লব সফল করার জন্য চাই একটি সঠিক বিপ্লবী দল। চাই সঠিক বিপ্লবী তত্ত্ব। কমরেড শিবদাস ঘোষ এই প্রসঙ্গে মহান লেনিনের শিক্ষাকে তুলে ধরে দেখিয়েছেন, “একটি বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া বিপ্লব হতে পারে না। লেনিন যখন বলেছেন বিপ্লবী তত্ত্ব, তখন তিনি একটি দলের শুধু রাজনৈতিক প্রোগ্রাম বা পলিসি বোঝাতে চাননি, তিনি বিপ্লবী তত্ত্ব বলতে দলের কেন্দ্রিয় নেতৃত্ব কর্তৃক জীবনের প্রতিটি দিক সম্পর্কে জ্ঞান বিজ্ঞানের ধারণাগুলিকে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে সংযোজিত করে একটি পুরো জ্ঞানের পরিমণ্ডলকে বুঝিয়েছেন।” কমরেড শিবদাস ঘোষ আরও দেখিয়েছেন, “এই বিপ্লবী তত্ত্ব হচ্ছে একটি দেশের বিপ্লবের বাস্তব প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার তত্ত্ব। …ফলে, মার্কসবাদের যে বিজ্ঞান মার্কস ও এঙ্গেলস দিয়ে গিয়েছেন বা পরবর্তী সময়ে লেনিন মার্কসবাদের ভাণ্ডারে যা সংযোজন করেছেন, সমৃদ্ধ করে গিয়েছেন, সেই লেনিনীয় শিক্ষা বা তারও পরবর্তী সময়ে স্ট্যালিন যা উন্নত করে গিয়েছেন, বা চীন বিপ্লবে মাও-সে-তুং যে শিক্ষা দিয়ে গিয়েছেন আজ বিভিন্ন দেশের বিপ্লবীরা, যারা এখনও বিপ্লব করতে পারেন নি, তারা যদি তাঁর তাঁর দেশের বিপ্লবী প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে চান, তাহলে মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্ট্যালিন, মাও-সে-তুংয়ের সেই শিক্ষাগুলোকেও তাদেরও একইভাবে বিকশিত, উন্নীত ও বিশেষীকৃত করতে হবে, যাতে এই শিক্ষাগুলি তাঁদের নিজ নিজ দেশের বিপ্লবী লক্ষ্যের উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারে।”
এদেশের মাটিতে কমরেড শিবদাস ঘোষ মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে বিশেষীকৃত করেছেন এবং লেনিন নির্ধারিত ‘সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগের’ বর্তমান স্তরে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বহু বিষয়কে বিকশিত, সম্প্রসারিত ও সমৃদ্ধ করেছেন। এর মধ্য দিয়ে অন্যান্য বহু বিষয়কে বা তার উপলব্ধিকে এক নতুন ও উন্নত স্তরে পৌঁছে দিয়েছেন। একথাও আমরা সকলে জানি, শুধুমাত্র রাজনৈতিক- সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, এমনকী জীবন ও জ্ঞানজগতের সর্বস্তরকে ব্যাপ্ত করে, অর্থাৎ বিজ্ঞান, দর্শন, নীতি-নৈতিকতা-সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্যসহ সমস্ত বিষয়ে লেনিন পরবর্তী সময়ে যে সমস্ত সমস্যা দেখা দিয়েছে, সেই সমস্ত সমস্যাগুলিকে ব্যাখ্যা ও সমাধান করার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি মার্কসবাদ-লেনিনবাদের এক নতুন ও সুনির্দিষ্টভাবে বিশেষ উপলব্ধি গড়ে তুলেছেন। সেই কারণেই বর্তমান যুগের এই স্তরে কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার গভীর অনুশীলন ছাড়া মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ধারণা বা উপলব্ধি সম্পূর্ণ হতে পারে না। তাই, বর্তমান বিপ্লবের প্রয়োজনে এই চিন্তাধারাকেই গ্রহণ করতে হবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। এই গ্রহণ করার যথার্থতা প্রসঙ্গে তিনি দেখিয়েছেন, “এই কথার অর্থ, একজন যা শিখল বা সত্য বলে মানলো, সে জীবনে সর্বক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করছে, অপরকে শেখাচ্ছে…সকলেই বুঝতে পারবে, শুধু পার্টি মিটিং বা আলাপ আলোচনাতেই নয়, এটাই হল তার জীবনবেদ। এই জন্যই মার্কসবাদকে বলা হয় জীবনদর্শন। এটা একটা অর্থনৈতিক তত্ত্ব শুধু নয়। মার্কসবাদ জীবনকে পরিবর্তিত করে এবং গোটা সমাজের উন্নতির জন্য লড়াই করতে শেখায়।”
মার্কসবাদের সাথে অন্যান্য সমস্ত দর্শনের পার্থক্য প্রসঙ্গে মহান মার্কস নিজেই বলেছিলেন, “দার্শনিকরা এতদিন দুনিয়াকে শুধু নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছে। কিন্তু আসল কাজ হলো এই দুনিয়াকে পরিবর্তন করা।” অর্থাৎ দার্শনিকরা এতদিন বিভিন্নভাবে জগতকে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু মার্কসবাদ জগতকে বস্তুনিষ্ঠভাবে ব্যাখ্যা করার সাথে সাথে তাকে পরিবর্তন করার কথাও বলেছে। বিষয়টিকে স্পষ্টভাবে কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন যে, এই কথার দ্বারা কেউ যদি ধরে নেন যে, মার্কসবাদীদের দুনিয়াকে ব্যাখ্যা করার দরকার নেই, বা উল্টোদিক থেকে কেউ যদি মনে করেন, মার্কসবাদ আসার আগে অন্য কোন দর্শন দুনিয়ার পরিবর্তনে কোন ভূমিকা পালন করেনি- তাহলে তা সঠিক নয়। তিনি বলেছেন, “আসলে মার্কস এই কথার দ্বারা বোঝাতে চেয়েছেন, দুনিয়ার . . . ক্রিয়াকর্মের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবর্তনের নিয়মগুলো দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ যেভাবে বিজ্ঞানকে ভিত্তি করে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, যেটা দুনিয়াকে পাল্টাবার উপযোগী একটা সামগ্রিক ধারণার জন্ম দিয়েছে, অন্য কোন দর্শনই সে কাজ করতে পারেনি। . . . দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদই প্রথম দেখিয়েছে যে, প্রকৃতি ও সমাজের নিয়ম সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত সামগ্রিক ধরাণার ভিত্তিতে প্রকৃতির উপর মানুষ সচেতনভাবে ক্রিয়া করে। তার ক্ষতিকারক দিক যথাসম্ভব এড়িয়ে নিজেদের কাজে লাগাতে পারে এবং সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে সমস্ত অন্যায়, অবিচার, শোষণ, দুর্দশার হাত থেকে মুক্তি পেতে পারে।” অর্থাৎ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ হচ্ছে একমাত্র বিপ্লবী তত্ত্¦ যা আজকের যুগে সবচেয়ে বৈজ্ঞানিক ও সর্বশ্রেষ্ঠ মতবাদ বা ভাবাদর্শ। এবং যা বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজের পঙ্গুতা থেকে মানুষকে মুক্ত করে একটা নতুন শোষণহীন, শ্রেণিহীন, উন্নততর সমাজব্যবস্থার জন্ম দিতে পারে। এই উন্নত সমাজব্যবস্থা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে শোষিত-নিপীড়িত-সর্বহারা শ্রেণির ভূমিকা এবং তার ভাবাদর্শ সম্পর্কে কার্ল মার্কস বহু পূর্বেই ঘোষণা করেছিলেন, “দর্শন যেমন সর্বহারা শ্রেণির মধ্যে তার বস্তুগত হাতিয়ার খুঁজে পেয়েছে, তেমনি সর্বহারা শ্রেণি দর্শনের মধ্যে পেয়েছে তার ভাবগত হাতিয়ার।” এই উপলব্ধি, সমাজমুক্তি আন্দোলনের গভীর প্রত্যয় এবং আদর্শের৭৮ অনন্যসাধারণ দিক নির্দেশক শক্তির প্রশ্নটি প্রতিভাত হয়েছে কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার মধ্যে। তিনি মার্কসবাদ-লেনিনবাদের শিক্ষার ভিত্তিতেই বলেছেন, “সর্বহারাশ্রেণির . . .উপর সমাজবিকাশের বর্তমান স্তরে মানবজাতিকে সমস্ত ধরনের দাসত্ব থেকে মুক্তির পথে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বটি ঐতিহাসিকভাবে ন্যস্ত হয়েছে। তাই সর্বহারা শ্রেণিকে খুঁটিয়ে সবিস্তারে সত্যকে জানতে হবে, জ্ঞান জগতের সমস্ত ক্ষেত্রে প্রবেশ করতে হবে। আর এক্ষেত্রে মার্কসবাদ হলো তার শাণিত হাতিয়ার, অপরাজেয় অস্ত্রÑ যা শাসকশ্রেণির বিধ্বংসী পারমাণবিক অস্ত্রের চেয়েও অনেক বেশী শক্তিশালী। তাই আমাদের সকলের সামনে আজ সঠিক পথে ক্রিয়া করার জন্য একটিমাত্র দর্শন আছে- মার্কসবাদ।”

 

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments