Wednesday, November 20, 2024
Homeবিশেষ নিবন্ধম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ - মানস নন্দী

ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ – মানস নন্দী

1361295836ম্যাক্সিম গোর্কির কালজয়ী অসাধারণ উপন্যাস ‘মা’ দুনিয়াজুড়ে সর্বাধিক পঠিত, সবচেয়ে বেশি আলোচিত- এ কথা সকলেই স্বীকার করবে। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে, যারাই বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন করবার চিন্তা করছে, সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তনে শ্রমিকশ্রেণির সচেতন সংঘবদ্ধ নেতৃত্বকারী ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে, তাদের কাছে ‘মা’ অবশ্যপাঠ্য উপন্যাস হয়ে উঠেছে। এখনো এ পাঠ থেমে নেই। প্রায় শতাব্দীকাল জুড়ে কোনো উপন্যাসের এতটা প্রভাবের দ্বিতীয় কোনো তুলনা আছে বলে আমাদের জানা নেই।

১৯০৫ সালের বিপ্লবী পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ১ মে’র মিছিলের ঘটনাবলিকে উপজীব্য করে লেখা এ উপন্যাস বাস্তব অবস্থার জীবন্ত রূপ তুলে ধরেছে। যা হয়ে উঠেছে বিশ্বজনীন Ñ সকল দেশের, সকল শ্রমিকের। বিপ্লবী সংগ্রামে অচেতন ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে শ্রমিক যোগ দেয়, কীভাবে সে সঠিক আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে পরিচালিত হয়ে অবিচল দৃঢ়তায় লক্ষ্যাভিমুখী এগিয়ে চলে, এটা বোঝা যায় ‘মা’র পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। দুনিয়া পরিবর্তনের আদর্শ ধারণ করে যে শ্রমিক, পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় তাকে হয়ে উঠতে হয় কর্তব্য সাধনের উপযুক্ত নৈতিকবোধের ও সংগ্রামী চেতনার অধিকারী।

পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিকের জীবন বংশপরম্পরায় একই থাকে। পাভেলের জীবন তার বাবার জীবন থেকে ভিন্ন কিছুই হতো না, যদি সে আদর্শের সন্ধান না পেত। পাভেলের বন্ধু খখল মাকে বলে, “ওরকম জীবন যে কী সাংঘাতিক বিশ্রী, সেটুকু তো আপনি বুঝতে পেরেছেন, হাজার হাজার লোক তারা আপনার চেয়ে অনেক ভাল জীবন পেতে পারে, তবুও তারা থাকে জানোয়ারের মতো। আজ দেখছি মানুষ খাটছে। কালও তাই। সারা জীবন ঐ করবে। এক সময় বিয়ে করবে, ছেলেপুলে হবে, ছেলেপুলে নিয়ে খেলা করবে। কিন্তু যেই তারা আরো বড় হয়, মুখ বাড়ে, পেট বাড়ে, তখনই ফ্যাসাদ বাঁধে। তখন আরম্ভ হয় গালিগালাজ আর শাপমন্যি। সারাদিন চেঁচায় : শুয়োরগুলোকে বসিয়ে রেখে আর খাওয়াব ক’দিন। বাড়–ক শিগগির, খাটার সময় হয়েছে। ছেলেপুলেকে পোষা জন্তুর মতো পরিণত করতে চায়। তারা পেটের জন্য খাটতে শুরু করে – আবার সেই একই জীবনের পুনরাবৃত্তি।” মানুষের মনের এই যে দাসত্ব শৃঙ্খল, এ শৃঙ্খল ভাঙার ব্রত যারা গ্রহণ করেছে তারাই আসল মানুষ। শ্রমিক জীবনের এ দুঃসহ ধারাপাত, প্রতি মুহূর্তে মনুষ্যত্ব খোয়ানো চূড়ান্ত গ্লানির এ জীবন কীভাবে আদর্শের সংগ্রামে নতুন জীবনের ভবিষ্যত পথ রচনা করে – গোর্কির এ লেখায় তা ফুটে উঠেছে। এটা হতে পারে তখনই, যখন শ্রমিকদের মধ্যে জীবনের যথার্থ ধারণা, মর্যাদাবোধ আর প্রবল আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলা যায়। তারা যখন ভাবে, “শুধু এক পেট খেতে পাওয়াটা আমাদের সব নয়। যারা আমাদের ঘাড়ের উপর চেপে বসে আছে, আমাদের চোখে ঠুলি এঁটে রেখেছে, তাদের দেখাতে হবে আমরা সব দেখতে পাচ্ছি। আমরা বোকা নই, জানোয়ার নই যে পেট পুরে খেতে পেলেই খুশি থাকবো, আমরা বাঁচতে চাই। শত্রুদের দেখাতে হবে, যত নিচেই তারা আমাদের ফেলে রাখুক, যত অত্যাচার করুক, আমরা মানুষ এবং জ্ঞানের মাপকাঠিতে তাদের সমান হতে বাধা নেই, এমনকি তাদের চেয়ে বড় হতে … …” – তখন শ্রমিকের মনে নতুন শক্তির উদ্বোধন ঘটে। যথার্থ জ্ঞান ও ইতিহাসচেতনা তাকে ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থের পরিসর থেকে টেনে আনে আন্তর্জাতিকতা আর বিশ্বভ্রাতৃত্বের বৃহত্তর সীমানায়। দিগন্ত প্রসারিত এক মহামিলনের প্রবল আকাক্সক্ষায় উদ্বেলিত হয় সে : “… আমাদের সবার হাসিকান্না এক হয়ে গেছে। আমরা জাত-ধর্ম জানিনে, আমরা শুধু জানি দোস্ত আর দুশমন। সারা দুনিয়ার যত শ্রমিক সবাই আমাদের বন্ধু আর বড়লোক আর সরকারের লোক আমাদের শত্রু। দুনিয়ার দিকে ভালো করে তাকালে বুঝি কত শ্রমিক আমরা আছি সারা পৃথিবীতে, আর কী শক্তি আমাদের। সে দেখে আমাদের আনন্দের আর সীমা থাকে না। প্রাণের মধ্যে স্রেফ খুশির হাওয়া বয়। জার্মান, ফরাসি, ইতালীয় মানুষ-জীবনের দিকে তাকিয়ে সকলের এই কথাই মনে হয়। শ্রমিক সব এক মায়ের ছেলে – সারা দুনিয়ার শ্রমিক ভাই ভাই! এই আমাদের প্রাণের অক্ষয় মন্ত্র। এই মন্ত্র আমাদের বুকের বল, প্রাণের আগুন। ন্যায়ের আকাশে সূর্যটা জ্বলছে ঝলমল করে। সেই আকাশটা শ্রমিকের মনে। সমাজতন্ত্রী হলে সে নিজেকে যাই বলুক না কেন, সে আমাদের ভাই। এক ভাবনায় বাঁধা সত্যিকারের ভাই। আজকের, কালকে ও চিরকালের ভাই।”

আর এ বিপ্লবী জ্ঞান চর্চার কাজ সবার, কিন্তু উদ্যোগ থাকতে হয় ব্যক্তির। পাভেল মাকে বলে, “প্রথমে নিজে জানবো, তবে অন্যদের জানাতে পারবো।” কতটা জীবনতৃষ্ণা আর বিপ্লবী স্পৃহা থাকলে এ কথা ভাবা যায়, যখন পাভেলের বন্ধু খখল মাকে এ বয়সেও পড়াশোনা করার উৎসাহ যোগায়। বলে, “আমরা সবাই বৃষ্টির ফোঁটার মতো। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা ফসল ফলাবার কাজে লাগে। … … পড়তে একবার আরম্ভ করুন তো দেখি।” আজ সামাজিক আন্দোলন, বিপ্লবী আন্দোলনের কর্মীদের এ কথা ভাবতে হবে – তাঁরা এ জ্ঞান চর্চায় কতখানি একাগ্র, কতটা উদ্দেশ্যমুখীন।

সামাজিক আন্দোলন কখনো ব্যক্তিস্বার্থ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত হয় না, হয় সমষ্টিগত সামাজিক স্বার্থ প্রতিষ্ঠার জন্য। ফলে এ আন্দোলনের চরিত্র নৈর্ব্যক্তিক। এর ঘাত-প্রতিঘাতকেও নিতে হয় নৈর্ব্যক্তিকভাবে। কত সহজে খখলকে বলতে দেখি, “অপমানের কথা মনে রাখতে গেলে কাজ হয় না। শুধু সময় নষ্ট।” কিংবা মা যখন তার দুঃখময় জীবনের কথা তুলে ধরেন, যিনি দিনের পর দিন অনবরত স্বামীর মার খেয়েছেন – আমরা দেখি, এসব কথা বলতে গিয়ে কোনো রাগ-দুঃখ নেই মায়ের। শুধু ঠোঁটের কোণে অনুতাপের হাসি। এ অনুতাপ পুঁজিবাদী শোষণে ক্লিষ্ট স্বামীর মতো অগণিত শ্রমিকের চেতনাহীন জান্তব জীবনের জন্য। যদি কারো মানুষ সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকে তবে সে বোঝে মানুষ নিজেরাই খারাপ হয়ে জন্মায় না। খারাপ যদি হয়েই থাকে সে দোষ ওদের নয়। যে সমাজ গড়ে উঠেছে অন্যায় আর অপরাধের ভিত্তির উপর, সে অপরাধের প্রবণতা সর্বত্র ছড়িয়ে দেবে এটাই স্বাভাবিক। আর মানুষ তখনই সুন্দর হয়ে উঠতে পারে যখন অপরাধমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা হয়। ‘মা’ উপন্যাসে গোর্কি নিকলাই-এর বয়ানে বলছেন, “জুলুম করবার এ লোভ ওদের ব্যাধি। সমস্ত মানুষের চরিত্র নষ্ট করে দিচ্ছে। এ পশুসুলভ সমাজব্যবস্থায় বাধ্য হয়ে আপনা থেকে মানুষকে জানোয়ার হতে হয়।”

বিপ্লবী আন্দোলনের একান্ত আবেগের সংকটে পড়ে অনেককেই পিছিয়ে আসতে দেখা যায়। এতে বিবেক পরাজিত হয়, নৈতিক বোধ ক্ষুন্ন হয়। সঠিক বিপ্লবী চেতনা কখনোই কর্তব্যের ডাক উপেক্ষা করতে পারে না। পাভেলের দৃঢ়চিত্ততা আবেগের দোলাচল থেকে মুক্ত হবার সাহস যোগায় : “জেনে শুনে সে গেছে। অন্ধকারে ঝাঁপ দেবার ছেলে সে নয়। …ও মানুষই আলাদা। জেনে শুনেই গেছে সে, হয় বেয়নেটের খোঁচা দেবে, নয় ঠেলে দেবে সাইবেরিয়ায়। তবুও এগিয়ে চলে যেত ও।” কিংবা সাশা যখন সিজভকে বলে : “আমার বাবার চাইতে আমার কাছে ন্যায় বড়।” এভাবে সমাজ প্রগতির সংগ্রামে মানুষের অনুভূতি পাল্টায়, আবেগের পুরানো কাঠামো পাল্টায়। ন্যায়-নীতি ধারণ করে উন্নত আবেগের জন্ম দেয়। এমনকি প্রেম-ভালোবাসা জীবনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া চাই। পাভেল যখন বলে, “ভালোবেসে পায়ে শিকল বেঁধে পিছন দিকে টানবে, এমন ভালোবাসা-দোস্তি চাই না আমি।” ভালোবাসা বিপ্লবী জীবনেও দরকার : ‘তার জন্য চাই আদর্শের হানি না ঘটিয়ে একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলবার মতো সঙ্গী।’ উদ্দেশ্যমুখীন একত্রে পথ চলার মধ্য দিয়ে বিপ্লবীরা সত্যিকার ভালোবাসার আনন্দের সন্ধান পেতে পারে।

‘মা’ উপন্যাসে গোর্কি যে ভবিষ্যৎ সমাজের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, সোভিয়েত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তার রূপ সূর্যোদয়ের আভার মতো দেখা দিয়েছিল। যুগদ্রষ্টা এ মহান সাহিত্যিক গভীর বিশ্বাসে ঘোষণা করেছিলেন : “আমি জানি, সময় আসবে যখন প্রতিটি মানুষ আর সকলের কাছে তারার মতো হয়ে উঠবে। তাদের রূপে নিজেরাই মুগ্ধ হবে। পৃথিবীর বুকে থাকবে শুধু মুক্ত মানুষ। মুক্তি তাদের মহিমা দিয়েছে। প্রত্যেকটি হৃদয়ের দুয়ার খুলে যাবে। কারো মনে দ্বেষ-হিংসা থাকবে না। জীবন রূপ পাবে মানুষের সেবায় – মানুষের মূর্তি পাবে স্বর্গের দেউল। কিছুই মানুষের আয়ত্তের বাইরে নয়। মানুষ সেদিন সুন্দর হবে। সত্য আর সুন্দরের মুক্তিতে পাবে সে তার বীজমন্ত্র। আর যে মানুষ সারা পৃথিবীকে কোল দিতে পারবে, তাকে সবচেয়ে ভালবাসবে, সর্ববন্ধনমুক্ত সে মানুষ হয়ে উঠবে নরোত্তম, কারণ সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য ওই মুক্তিতে। এ নবজীবনের মানুষই রচনা করবে মহাজাতি।”

আজ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে যখন সংশোধনবাদীরা ক্ষমতায় বসে প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রকে সরিয়ে পুঁজিবাদ কায়েম করেছে, গোটা দুনিয়ায় শ্রমিক আন্দোলন আদর্শগত ও সংগঠনগতভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে, যার পরিণতিতে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণ তীব্র্রতর হচ্ছে, তখন ‘মা’ উপন্যাস সাহস দেবে, প্রেরণা দেবে।

নভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষে ঐকতান – চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments