Friday, April 19, 2024
Homeফিচাররাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ : কার লাভ, কার ক্ষতি

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ : কার লাভ, কার ক্ষতি

আওয়ামী লীগ সরকার  কোনো নোটিশ ছাড়াই রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫টি পাটকল বন্ধ  করে দিল। এর ফলে বেকারে পরিণত হলো স্থায়ী, বদলি ও দৈনিকভিত্তিক প্রায় ৫৭ হাজার শ্রমিক। মিলগুলোকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করা লাখ লাখ দোকানদার, হকার, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, বিভিন্ন পেশার মানুষ উচ্ছেদ হবে ও জীবিকা হারাবে। শুধু শ্রমিক ও এলাকাবাসী নয়, এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৪০ লাখ পাটচাষি। সবমিলিয়ে পাটশিল্প ও পাটচাষের সাথে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যুক্ত সর্বমোট ৪ কোটি মানুষ। করোনা মহামারিতে পুরো দুনিয়ায় যখন মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপন্ন, বিভিন্ন দেশের সরকার নানা প্রণোদনা দিয়ে জনগণকে রক্ষার চেষ্টা করছে, ঠিক সেসময় বাংলাদেশ সরকার কারখানা বন্ধ করে হাজার হাজার শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করে অমানবিকতার এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করল।

ছাঁটাই হওয়া স্থায়ী শ্রমিকদের বেশিরভাগের চাকরি স্থায়ী হয়েছে ৮/১০বছর। এ মধ্য বয়সে তাদের অন্য কোনো কাজ করা কঠিন। সম্পূর্ণ অস্থায়ী শ্রমিক দিয়ে উৎপাদন চালানো ৫টি মিলের শ্রমিক এবং অন্যান্য মিলের বদলি-দৈনিকভিত্তিক শ্রমিকদের জন্য কোনো আর্থিক ক্ষতিপূরণের ঘোষণা সরকার দেয়নি। সরকারি পাটকল একটা নির্দিষ্ট দামে চাষিদের কাছ থেকে পাট কিনতো। সরকার আর পাট না কেনায়, বেসরকারি পাটকলগুলো সিন্ডিকেট করে ইচ্ছেমতো পাটের দাম নিয়ন্ত্রণ করবে। পাটচাষিরা বঞ্চিত হবে পাটের ন্যায্য দাম থেকে। ভারতে কাঁচা পাট চোরাচালান বাড়বে। সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের অর্থনীতি।

প্রতারণাপূর্ণ প্রতিশ্রুতি

সারা বিশ্বে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের চাহিদা বাড়ছে, পাটের বিরাট সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, সেসময় কেন রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ করা হলো? প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক। প্রবল সমালোচনার মুখে তাই সরকারের বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় গত ২ জুলাই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছিল-“আধুনিকায়ন ও রিমডেলিংয়ের জন্য উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আগামী ৬ মাসের মধ্যে পিপিপি(পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশীপ)-এর আওতায় আধুনিকায়ন করে এসব পাটকলগুলো উৎপাদনমুখী করা হবে। পরে এ কারখানাগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বর্তমান শ্রমিকদের প্রাধান্য দেয়া হবে।” পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী তখন বলেছিলেন-সেপ্টেম্বরের মধ্যে শ্রমিকদের সমস্ত পাওনা পরিশোধ করা হবে। যে কেউ বুঝতে পারবেন, বাস্তবে  শ্রমিকদের প্রতারিত করার উদ্দেশ্যেই এসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল! এখন পাটমন্ত্রী বলছেন-পিপিপি করতে ৩-৪ বছর সময় লাগবে, ব্যবসায়ীরা ৯৯ বছরের লিজ চান। তাই এসব পাটকল লিজ ভিত্তিতে ব্যবসায়ীদের দেওয়া হবে।

সেপ্টেম্বর শেষ হলো, করিম জুট মিল ছাড়া আর কোনো মিলের শ্রমিকরা বকেয়া পাওনা পাননি। বকেয়া ও পাওনা শেষ পর্যন্ত পাবেন কিনা, তা নিয়ে স্থায়ী শ্রমিকরা আছেন চরম অনিশ্চয়তায়। আর প্রায় ২৪ হাজার অস্থায়ী শ্রমিক, যার মধ্যে অনেকেই ১০/১৫ বছর চাকরি করেও অস্থায়ীই রয়ে গিয়েছেন, তাদের বিষয়ে কোনো কথা নেই! ধরে নিই, স্থায়ী শ্রমিকরা তাদের সমস্ত পাওনা বুঝে পেলেন। পিপিপি বা লিজের ভিত্তিতে কখনও মিল চালু হলে, সেখানে তারা চাকরি পাবেন, এমন কোনো নিশ্চয়তা আছে কি? চাকরি পেলেও যে মজুরি পাবেন, তাতে সংসার চলবে কীভাবে? রাষ্ট্রায়ত্ত  পাটকলে ২০১৫ সালের মজুরি কমিশন অনুযায়ী (এবছর থেকে বাস্তবায়িত) একজন শ্রমিক সর্বনিম্ন ৮ হাজার ৩০০ টাকা বেসিক মজুরি, সবমিলিয়ে ১৪-১৫ হাজার টাকা মজুরি পাওয়ার কথা। অথচ বেসরকারি পাটকলগুলোতে শ্রমিকের বেসিক শুরু হয় মাত্র ২৭০০ টাকায়, সবমিলিয়ে তারা ৫-৬ হাজার টাকার বেশি পান না। বেশিরভাগই দৈনিক চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করে। ‘নো ওয়ার্ক, নো পে’-এর ভিত্তিতে দৈনিকভিত্তিক একজন শ্রমিক পান ১৬৫ টাকা থেকে ২০০ টাকা। চাকরির কোনো নিশ্চয়তা নেই, নেই অবসরকালীন কোনো সুবিধা। অথচ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের শ্রমিকরা মজুরি ছাড়াও পেনশন, গ্র্যাচুইটি, নিজের ও পরিবারের চিকিৎসা সেবা, মিলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ, খেলাধুলা ও বিনোদনের আয়োজনসহ নানা অধিকার ও সুবিধা ভোগ করতেন। বেসরকারি পাটকলে এসবের কোনো বালাই নেই।

পাটশিল্পের লোকসান কমানো নয়, বেসরকারিকরণের উদ্দেশ্য লুটপাট

সরকার বলছে, লোকসানী বলেই সরকারের পক্ষে এ পাটকল আর চালানো সম্ভব নয়। তাই ব্যক্তিমালিকদের হাতে দেওয়া হবে। যেন বেসরকারি খাতে দিলেই লাভজনক হবে। পূর্বের অভিজ্ঞতা কী বলে? লোকসানের কারণ দেখিয়েই গত কয়েক দশকে একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকারখানা বন্ধ ও বেসরকারিকরণ করা হয়েছে। প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের ‘বেসরকারিকৃত শিল্পপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সমীক্ষা প্রতিবেদন-২০১৩’ অনুযায়ী-১৯৭৫ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া ৬৪৪টি কারখানার মধ্যে ৪৫৮টি কারখানার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। খোঁজ পাওয়া গিয়েছে ১৮৬টি কারখানার, যার মধ্যে চালু আছে মাত্র ৯৬টি। ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেওয়া বিভিন্ন কারখানার কোনোটি খণ্ড খণ্ড করে বিক্রি করে আবাসন ব্যবসা চলছে। আবার কোথাও গড়ে তোলা হয়েছে দোকানপাট, বাণিজ্যিক ব্যবসা। বেশিরভাগ কারখানার বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির বিল, ট্যাক্স দীর্ঘদিন বাকি (২২ অক্টোবর ২০১৪, দৈনিক কালের কণ্ঠ)। যেমন-২০০৪ সালে বাওয়া জুট মিল বেসরকারিকরণ করা হয়েছিল। দেখা গেল, বাওয়া জুট মিলের মূল ক্রেতা মিলের যন্ত্রপাতি, গাছপালাসহ জমি বিক্রি করে দেয়। পরবর্তী মালিক বসুন্ধরা গ্রুপ মিলের জমি রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় রূপান্তরিত করে। পিপিপি’তে দেওয়া পাটকলগুলোর শোচনীয় অবস্থাও আমরা দেখেছি।

বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পিপিপি প্রকল্পে চলছে। বিদ্যুতের ইচ্ছেমতো দাম নির্ধারণ, দুর্নীতি, লুটপাটের ফলে উল্টো প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। সোজা কথায়, পিপিপি(PPP) মানে দাঁড়িয়েছে, পাবলিক মানি টু প্রাইভেট পকেট। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল হচ্ছে জনগণের সম্পদ, একে আজ মুষ্টিমেয় পুঁজিপতির মুনাফার জন্য তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এখন ব্যবসায়ীরা পিপিপি-তে যেতে চাইছে না। কারণ তাতে মিলগুলোর দায়দেনা তাদের বহন করতে হবে। তারা চাইছে ৯৯ বছরের লিজ। সরকারও পূর্বের অবস্থান থেকে সরে এসে বলছেন, লিজ দেওয়া হবে। লিজ চাওয়ার কারণ, জমি পুঁজিপতিদের কাছে সবচেয়ে লোভনীয় জিনিস। জমি বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া যাবে। ২৫টি রাষ্ট্রীয় পাটকলে ১২০০ একরের মতো জমি, মিলের যন্ত্রপাতি, স্থাপনা মিলে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ আছে। এই সম্পদের উপর নজর এখন লুটেরাদের।

পাট শিল্পের বিপুল সম্ভাবনা

করোনা পরবর্তী বিশ্বব্যাপী পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ার ফলে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের চাহিদা বাড়ছে বিপুলভাবে।  ইউরোপের ২৮টি দেশে প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ হচ্ছে। ২০২২ সাল নাগাদ শুধু পাটের ব্যাগের বৈশ্বিক বাজার দাঁড়াবে ২৬০ কোটি ডলারের। পাট থেকে পলিমার ব্যাগ, ঢেউটিন, মিহিসুতা ভিসকস, পাট ও তুলা থেকে তৈরি কাপড় জুটন উৎপাদন সম্ভব। জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি) এরই মধ্যে ২৩৫ ধরনের দৃষ্টিনন্দন বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদন করছে। বিশ্বব্যাপী বিলাসবহুল মোটরগাড়ি, জাহাজ ও নির্মাণ শিল্পে পাটের বিশাল সম্ভাবনা আছে। করোনাকালে যেখানে অন্যান্য রপ্তানি পণ্য থেকে আয় কমেছে, সেখানে বিশ্বে চাহিদা বাড়তে থাকায় পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে। এ বছর জুলাই মাসে পাট খাত থেকে রপ্তানি আয় গত বছরের জুলাই থেকে ৩৮.২৩% বেশি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্ভাবনাময় আন্তর্জাতিক বাজারের ১০ শতাংশও দখল করতে পারলে, শুধু এই পাট দিয়েই বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। চাল-গম-আটা-চিনিসহ ১৮টি পণ্যের মোড়ক ব্যবহারে পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে ২০১০ সালে প্রণীত আইন বাস্তবায়ন হলে দেশের বাজারেও পাটের বিপুল চাহিদার সৃষ্টি হবে। আমাদের দেশে আছে উৎকৃষ্ট মানের পাটের জাত, উৎপাদনের জন্য উর্বর মাটি ও প্রাকৃতিক পরিবেশ, গত পাঁচ দশকে গড়ে উঠা অভিজ্ঞ ও দক্ষ জনশক্তি। পাটশিল্পের যন্ত্রপাতি দেশে তৈরি ও মেরামত করা সম্ভব। অর্থাৎ, বিদেশ থেকে কিছুই আমদানি করতে হয় না। যেখানে গার্মেন্টস শিল্পের ৮০% কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ দূষণে ১৮০টা দেশের মধ্যে ১৭৯তম। অন্যান্য শিল্পের তুলনায় পাট শিল্পের পরিবেশ দূষণ প্রায় নেই, বরং পরিবেশ বান্ধব। পাটের সাথে শিল্প ও কৃষি দুটোই যুক্ত। পাটকে কেন্দ্র করে এ দুই খাতেই বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে। দেশে কর্মসংস্থান হলে দেশের তরুণ-যুবকদের কাজের সন্ধানে বিদেশ যেতে সাগরে ডুবে, বসনিয়ার জঙ্গলে, থাইল্যান্ডের গণকবরে জীবন দিতে হতো না। ফলে প্রয়োজন, পাটকে কৌশলগত খাত হিসেবে বিবেচনা করে এর বিকাশে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ও পরিকল্পনা।

পাটকলে লোকসান কেন

এখন প্রশ্ন, এত বিপুল সম্ভাবনা সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় পাটকলে কেন লোকসান? বিজেএমসি’র রিপোর্টেই বলা হচ্ছে : রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর লোকসানের প্রধান কারণ-সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে না পারা। জুলাই-আগস্ট মাসে যখন কৃষকের হাতে পাট থাকে এবং পাটের দাম ১২০০-১৫০০ টাকা তখন রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানার পাট কেনার জন্য টাকা বরাদ্দ করা হয় না। আবার যখন পাট চলে যায় আড়তদারের কাছে এবং দাম মণপ্রতি ২২০০-২৫০০ টাকা হয়ে যায়, তখন পাট কেনার টাকা বরাদ্দ হয়। এতে কৃষকের লাভ হয় না মোটেই, কিন্তু কারখানার লোকসান হয় প্রচুর। এর দায় কার, শ্রমিকের না নীতি নির্ধারকদের? আবার প্রয়োজনীয় পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ না করায় পাট ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা যায় না। স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলোর কোনো আধুনিকায়ন হয়নি। সবগুলো কারখানায় বেশিরভাগ তাঁতই বিকল ও পুরাতন হয়ে পড়ায় উৎপাদন কমে যাচ্ছে।  ২০১৮-১৯ সালে তাঁত চালু ছিল মাত্র ৩৮%। ফলে চাহিদার অর্ধেকেরও কম কাঁচামাল আর ৩৮% সচল তাঁত দিয়ে উৎপাদন করে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো প্রতিযোগিতায় বেসরকারি পাটকল থেকে পিছিয়ে পড়ে। যার ফলে লোকসানের পাল্লা বেড়েছে। উৎপন্ন পাটপণ্যও গুদামে পড়ে থেকে নষ্ট হয়, মার্কেটিং হয় না। এর জন্য কি শ্রমিক দায়ী, নাকি ম্যানেজমেন্ট দায়ী?

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের পেছনে সরকারের বড় অজুহাত লোকসান। কিন্তু কেন লোকসান, কাদের কারণে লোকসান, লোকসান কাটাতে কী কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল? পাটকলে লোকসানের প্রধান কারণ-১. সময়মত ও চাহিদামত পাট কেনার জন্য অর্থ বরাদ্দ না দেওয়া, ২. বেশি দামে নিম্নমানের পাট কেনা, ৩. মাথাভারী প্রশাসনের উচ্চ ব্যয়, ৪. ৫০-এর দশকের পুরনো তাঁত দিয়ে উৎপাদন করা, ৫. বিজেএমসি ও পাট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-মন্ত্রীদের দুর্নীতি-অদক্ষতা-দায়িত্বহীনতা, ৬. উৎপাদিত পণ্য মার্কেটিং করতে না পারা, ৭. রাষ্ট্রায়ত্ত খাতকে লোকসান দেখিয়ে বেসরকারিকরণের সরকারি নীতি। লোকসানের জন্য দায়ী দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কারও কি আজ পর্যন্ত কোনো শাস্তি হয়েছে? লোকসানের কারণ দূর না করে জনগণের সম্পদ লুটপাটের আয়োজন করা হচ্ছে ও শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে।

পাটকল বন্ধ ছাড়া কি উপায় ছিল না?

২০১৬ সালে চীনের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত পাট সংস্থা বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে সরেজমিনে পাটকলগুলো পরিদর্শন করে। তারা সুপারিশ করে মাত্র ২৬৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিলে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো সম্পূর্ণ আধুনিকীকরণ করা যাবে। কিন্তু সরকার চীনের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্মতিপত্র চুক্তিতে স্বাক্ষর করে পরে তা থেকে সরে আসে। আধুনিকায়নের জন্য সে বরাদ্দও আর করেনি। শ্রমিক নেতৃবৃন্দ হিসেব করে দেখিয়েছিলেন, ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা খরচ করে আধুনিক তাঁত স্থাপন করলে উৎপাদন বাড়বে তিনগুণ, শ্রমিকদের গড়ে ২৫ হাজার টাকা বেতন দিয়েও পাটকল লাভজনক করা সম্ভব।

সরকার বলে, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলে ৪৪ বছরে ১০ হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে, জনগণের টাকা এভাবে লোকসান কেন দেব? এভাবে দেখলে বিমান, রেল, বিআরটিসি, ক্রীড়া, সংস্কৃতি ইত্যাদি অনেক খাত থেকে সরকারের লাভ হয় না, ভর্তুকি দিতে হয়। তাহলে কি এসব বন্ধ করে দিতে হবে? এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের তথ্যমতে অনেকগুলো কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে কোনো উৎপাদন না হওয়া সত্ত্বেও, সরকার মাত্র ৬ বছরে ৬২ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্র ভাড়া দিয়েছে। সেগুলো তো বন্ধ করা হয়নি? লোকসানের কথা বলে ও শ্রমিকদের চাকরি হারানোর ভয় দেখিয়ে গার্মেণ্টস মালিকদের হাজার হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দেয়া হয়। এ টাকা কি জনগণের নয়? লোকসানের কথা বলা হয়, কিন্তু পাটকলগুলো ৪৪ বছরে সরকারকে কি পরিমাণ ট্যাক্স, বিদ্যুৎবিল, পানির বিল ইত্যাদি দিয়েছে-সে হিসেব দেওয়া হয় না। তারা শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্য বাসস্থানের দায়িত্ব নিয়েছে, তারও অর্থংনৈতিক মূল্য আছে। সে তুলনায় প্রতি বছর লোকসানের পরিমাণ কত?

স্বাধীনতার পর ৭৭টি পাটকল জাতীয়করণ করে বিজেএমসি’র অধিভুক্ত করা হয়। ’৮১ সাল নাগাদ এই সংখ্যা হয় ৮২টি। সামরিক শাসক এরশাদ ক্ষমতায় বসে এই মিলগুলি বিক্রি ও বন্ধ করা শুরু করে। ২০০২ সালে বিএনপি-জামাত জোট সরকার বিশ্বের বৃহত্তম পাটকল আদমজীকে বন্ধ করে দিয়েছিল মাত্র ১২০০ কোটি টাকা লোকসানকে অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে। এর ধারাবাহিকতায় ২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একের পর এক পাটকল বন্ধ করা হয়। পাটশিল্পকে লাভজনক করার অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। বিরাষ্ট্রীয়করণকৃত ৫টি পাটকল চালু করে সরকার বাহ্বা নিয়েছে, ‘পাট দিবস’ পালন ও ‘পাটের সোনালী দিন ফিরিয়ে আনা’র ঘোষণা দিয়েছে, পাটের জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কারের কৃতিত্ব দাবি করেছে। কিন্তু সরকারি পাটকলের লোকসানের কারণ দূর করে লাভজনক করতে কোনো পদক্ষেপই তারা নেয়নি। বরং পরিকল্পিতভাবে বছরের পর বছর ধরে পাটকল শ্রমিকদের মজুরি-গ্র্যাচুইটি বকেয়া রেখে, সরকারদলীয় শ্রমিকনেতাদের দিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে হতাশা-সুবিধাবাদ ছড়িয়ে তাদের সংগ্রামী মনোভাব ধ্বংস করা হয়েছে। এখন তারা অনেকেই মনে করে-লস দিয়ে পাটকল আর চলবে না, তাদের পাওনা-বকেয়া দিলেই তারা খুশি।

পুঁজিপতিশিল্পপতিদের স্বার্থেই বিরাষ্ট্রীয়করণ

সরকার ৫ হাজার কোটি টাকা খরচ করে পাটকল বন্ধের উদ্যোগ নিল কেন? বিএনপি-জামাত জোট সরকার কেন আদমজী বন্ধ করেছিল?

এর পেছনে আছে সরকারগুলোর নয়া উদারনৈতিক অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত। পুঁজিবাদের বাজার সংকট কাটাতে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের মতো সাম্রাজ্যবাদী সংস্থা ও বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা মুক্তবাজার, বেসরকারিকরণের দাওয়াই দিচ্ছেন। বলছেন-‘রাষ্ট্র কেন ব্যবসা করবে? ব্যবসা করবে ব্যক্তি। রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন, শাসনকার্য পরিচালনা, নোট ছাপানো, সীমান্ত রক্ষা এধরনের কিছু কিছু দায়িত্ব পালন করবে। শিল্প, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সেবাখাত বাজারের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। চাকরি দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়। বাজারই সব ঠিক করবে।’ এটিই নয়া অর্থনৈতিক উদারনীতিবাদ। উদ্দেশ্য বেসরকারিকরণের মাতম তুলে দেশে দেশে রাষ্ট্রীয় সংরক্ষণের যতটুকু দেয়াল আছে তা তুলে দেওয়া, পুঁজিপতিদের অবাধ মুনাফা ও লুটপাটের  মৃগয়াক্ষেত্র প্রস্তুত করা। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এ নয়া উদারনৈতিক অর্থনৈতিক দর্শনেই রাষ্ট্র পরিচালনা করছে।

সাম্যবাদ পত্রিকার গত কয়েক বছরের সংখ্যাগুলোতে আমরা দেখিয়েছি, কীভাবে বাংলাদেশে ইতোমধ্যে একটি শক্তিশালী বড় পুঁজিপতিগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। সস্তা শ্রম ও পুঁজিপতিদের লুটপাটের অবাধ সুযোগ থাকায় বাংলাদেশে বিদেশি পুঁজিও আসছে। দেশি-বিদেশি এ পুঁজিপতিগোষ্ঠীর আশীর্বাদেই অনির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার গায়ের জোরে ক্ষমতায় টিকে আছে। তাদের খুশি রাখতেই নয়া উদারনৈতিক নানা অর্থনৈতিক পদক্ষেপ সরকার নিচ্ছে। তারই ফলাফল রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ এবং ব্যবসায়ীদের লিজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত। ফলে এটি বিচ্ছিন্ন কোনো সিদ্ধান্ত নয়, সম্ভাবনাময় পাটখাত পুরোটাই ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়ার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনারই অংশ। এ যেন সে প্রবাদটির মতো, ‘To kill a dog, give him a bad name’। কুকুরটিকে মারতে হলে, পাগলা কুকুর বলে প্রচার কর। পরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা লোকসানী বানাও, এরপর রাষ্ট্রীয় টাকা অপচয়ের মায়াকান্না কেঁদে এ অজুহাতে বন্ধ কর!

ক্ষতি হবে সারা দেশের মানুষের

আজ যারা ভাবছেন, আমি তো পাটকলে চাকরি করি না, আমার কী? বা সরকার কাজটা ভালো করেনি, কিন্তু প্রতিবাদ করে লাভ কী? তাদেরকে বলি-পাটকল বন্ধই শেষ নয়! বিনা প্রতিরোধে, বিনা প্রতিবাদে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্ত যদি আজ সরকার সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতে সরকার বস্ত্র-চিনি-ইস্পাত ইত্যাদি রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা যতটুকু এখনও টিকে আছে তা বন্ধ করবে। রেল-বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস ইত্যাদি রাষ্ট্রায়ত্ত সেবামূলক প্রতিষ্ঠানেও হাত দেবে। শিক্ষা-স্বাস্থ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকার যে এখনও কিছু দায়িত্ব নেয়, তাও ব্যবসায়ীদের হাতে পুরোপুরি ছেড়ে দেবে। ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের প্রেসক্রিপশনে রেল-বিদ্যুৎ-গ্যাসের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত সেবামূলক প্রতিষ্ঠানকে ধীরে ধীরে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার আয়োজন চলছে। তার বাস্তবায়ন দেখছি, দফায় দফায় রেল ভাড়া-বিদ্যুৎ-গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধিতে। আজ খড়গটা পাটকল শ্রমিকদের উপর পড়ছে, আগামীকাল আপনার আমার উপর পড়বে। ফলে নিজের ও দেশের শোষিত মানুষের স্বার্থেই আজ পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি তুলতে হবে। আধুনিকায়ন করে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল চালু করার দাবি দেশের রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক নীতি  কার স্বার্থে পরিচালিত হবে-সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ, না মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের স্বার্থে-তার ভবিষ্যত গতিমুখ নির্দিষ্ট করার জরুরি প্রশ্নের সাথেও যুক্ত। তাই আমরা আহ্বান জানাই-পাট, পাটশিল্প ও পাটচাষি রক্ষার চলমান আন্দোলনে যুক্ত হোন, আওয়ামী লীগ সরকারের গণবিরোধী অর্থনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন।

সাম্যবাদ অক্টোবর ২০২০

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments