ঘটনা-১
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ড. আবুল মনসুর তার বিভাগের একজন সহকর্মী ফাহমিদুল হকের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। কারণ কী? ফাহমিদুল হক ফেসবুকে মাস্টার্সের ৬৯ জনের একটি ছোট গ্রুপে যুক্ত ছিলেন। এবারের মার্স্টাসের রেজাল্ট দিতে দেরি হলো কেন— এ প্রসঙ্গে আলোচনা শুরু হলে ফাহমিদুল হক ছাত্রদের সামনে আরেক শিক্ষক ড. গীতি আরা নাসরীনের পক্ষে কিছু কথা বলেন এবং পিছনের ঘটনা উল্লেখ করতে গিয়ে ড. আবুল মনসুরের কথা উল্লেখ করেন। গ্রুপের নিয়ন্ত্রক এক ছাত্র কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ড. আবুল মনসুরকেও ওই গ্রুপে তখন যুক্ত করেন। ফাহমিদুল হকের স্ট্যাটাস পড়ে আবুল মনসুর মনে করেন, তাঁর মান ক্ষুন্ন হয়েছে। তিনি ৫৭ ধারার মতো কালা কানুনে মামলা করেন।
তবে শেষ অবধি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সারা দেশে বিষয়টি নিয়ে তুমুল বিতর্ক ও প্রতিবাদ হলে এবং আবুল মনসুরের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার জিয়া পরিষদের সাথে সংসর্গের অতীত রেকর্ড ফাঁস হয়ে গেলে তিনি মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছেন। উল্লেখ্য অধ্যাপক আবুল মনসুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করে চোখে পড়ার মতো অল্প সময়ের ব্যবধানে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। যদিও তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক পদে কাজ করছিলেন ঢাকায় যোগদানের পূর্বে। তিনি বর্তমানে বিতর্কিত সিনেটে উপাচার্যপন্থী নীল দলের নির্বাচিত প্রতিনিধি। কথিত আছে, ফাহমিদুল হক বহু আগে থেকেই প্রশাসনের বিরাগভাজন। টিভি এ্যান্ড ফিল্ম স্টাডিজ নামের নতুন বিভাগ খোলার চিন্তা থেকে শুরু করে কোর্স কারিকুলাম সবই তাঁর তৈরি। এত কিছুর পরও তিনি বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাননি। তাঁর পরিবর্তে মাননীয় উপাচার্য তাঁর খুব কাছের এবং আস্থাভাজন ড. শফিউল আলম ভূঁইয়াকে শেষ মুহূর্তে চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেন। বিভাগের দায়িত্ব পেয়ে অধ্যাপক শফিউল আলম ভূঁইয়া যথারীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্যিকীকরণ ও ফি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। তার বিভাগে অনার্স শেষ করতে টাকা ধার্য করা হয়েছে ১ লাখ ৮৩ হাজার টাকা! তিনি যে হলের প্রভোস্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন সেই বিজয় ’৭১ হলে তিনি আইডি কার্ড নবায়ন ফি রেখেছেন ৩৬০০ টাকা! শফিউল আলমদের মতো শিক্ষকদের চিন্তা ও দর্শন এখন বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার প্রধান ধারা। তাই তারা প্রশাসনের হর্তাকর্তা। শফিউল আলম একই সঙ্গে উপাচার্য কর্তৃক নিয়োগকৃত সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদেও ভারপ্রাপ্ত ডীন। এমন ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা যখন মামলা করেন তখন তা যত তুচ্ছ বিষয়েই হোক পুলিশ তা নিতে বাধ্য।
ঘটনা-২
রুশাদ ফরিদী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক। সম্প্রতি তিনি ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় একটি কলাম লিখেছিলেন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: উল্টো পথে কি শুধুই বাস?’ লেখাটিতে তিনি বিশ্ববিদালয়ের অনেকগুলো অসঙ্গতির দিক তুলে ধরেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অনিয়ম, শিক্ষকদের মধ্যে প্রচলিত অনৈতিকতার নানাদিক নিয়ে লিখেছিলেন। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি বিভাগের অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়েও সোচ্চার ছিলেন। কাজেই বিভাগের ক্ষমতাসীনদের কাছে তিনি চক্ষুশূলে পরিণত হন। লেখাটি প্রকাশের কিছুদিনের মধ্যেই রুশাদ ফরিদী জানতে পারেন যে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠিয়েছে। পরবর্তীতে শিক্ষক নেতা ফরিদউদ্দিন আহ্মেদ একটি পত্রিকাকে জানান যে, অর্থনীতি বিভাগের ৩১ জন শিক্ষক লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন যে তারা রুশাদ ফরিদের সাথে কাজ করতে আগ্রহী নন। শিক্ষকদের অনাগ্রহ থাকলেও কোনো কারণ দর্শানোর নোটিশ ছাড়াই, আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ দেয়া ছাড়াই এভাবে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর নিয়ম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান আইনে নেই। তবুও এমনটি করা হয়েছে। রুশাদ ফরিদী নিজেও জানেন না তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসলে কী?
কিন্তু নীল দলের নেতা ফরিদ উদ্দিনের বিরুদ্ধে বেশকিছু বিষয়ে অভিযোগ আছে। কিছুদিন আগে সমাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ভবনের নীচতলায় ছাত্রদের সাইকেল রাখার জন্যও ফি ধার্যের মতো হাস্যকর চেষ্টা চালিয়েছেন। পরে আন্দোলনের মুখে তা ব্যর্থ হয়। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “কোন কিছুই তো আর ফ্রি নয়।” সম্প্রতি জনতা ব্যাংকের প্রশ্নফাঁসের ঘটনাতেও তিনি অভিযুক্ত হয়েছেন। তার ডীন থাকাকালে সমাজবিজ্ঞান অনুষদে বেশ কিছু বিভাগে নাইটকোর্স খুলে পুরো সমাজিক বিজ্ঞান ভবনকে একবেলা পাবলিক, একবেলা প্রাইভেটে রূপান্তরিত করেছেন।
ঘটনা-৩
কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. রিয়াজুল হককে সাময়িক বহিস্কার করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি নাকি ক্লাসে অশ্লীল ছবি দেখিয়েছেন। কিন্তু পরবর্তীতে বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এগুলো সবই ছিল মিথ্যা অভিযোগ। গণমাধ্যমে এসেছে, ড. রিয়াজুল হকের পরের মেয়াদে চেয়ারম্যান হবার কথা ছিল। তাঁকে সে পদে বসতে না দেবার জন্য এই ষড়যন্ত্র সাজানো হয়। বিভাগের শিক্ষকরাই এর সাথে যুক্ত ছিলেন।
ঘটনা-৪
কিছুদিন আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়ে গেল সিনেট নির্বাচন। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এবং অন্যান্য স্বার্থ সুবিধাকে কেন্দ্র করে যেমন- মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার পরও উপাচার্যের ক্ষমতায় থাকা, শিক্ষক নিয়োগে প্রভাব খাটানোর সুযোগ না পাওয়া, শিক্ষক সমিতির মেয়াদ উত্তীর্ণ আহ্বায়ক কমিটির নির্বাচন না দেয়া, নানা আঞ্চলিক স্বার্থ-সুবিধা এসব কারণে শিক্ষকদের মধ্যে একটি অংশ উপচার্যবিরোধী একটি প্যানেল দেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী শিক্ষক নেতাদের ডাকেন। পরবর্তীতে উপাচার্যবিরোধী অংশ প্যানেল প্রত্যাহার করে। কী কারণে প্যানেল প্রত্যাহার হলো, উপাচার্যের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সঠিক কিনা- এর কোনো কিছুই জানা যায়নি। কিন্তু বোঝা গেছে, পুরো ব্যাপারটিই ছিল সুবিধা এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক। সুবিধার নিশ্চয়তা পেলে দ্বন্দ্ব-বিরোধ বলে কিছু থাকে না, তা এ ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে।
একসময় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ছিল আজ সেখানে শিক্ষক রাজনীতির নামে এসব চলছে। শিক্ষকতায় মূল্যবোধকে ছাপিয়ে ক্ষমতার স্বাদ আস্বাদনই মূখ্য হয়ে উঠেছে। এর সাথে ছাত্র-শিক্ষক স্বার্থের কোনো সম্পর্ক নেই। পুস্তকের পঠিত জ্ঞানের সাথে ন্যূনতম সামঞ্জস্য নেই। ক্ষমতালিপ্সা আর অর্থযোগই সবকিছু। এজন্য সহকর্মীকে হেনস্তা করার মতো ঘটনাও ঘটছে। শিক্ষকদের মধ্যেও তৈরি হয়েছে একধরনের ভয়ের পরিবেশ। ক্ষমতাধর শিক্ষকদের সাথে রাজনৈতিক-ব্যক্তিগত যেকোন প্রশ্নে বিরোধ হলে বহিষ্কার হবারও আশঙ্কা থাকে। এমন অবস্থায় স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ বা প্রশ্ন করার পরিবেশ প্রায় নেই। ফলে ভেতর থেকে নিঃশেষ হচ্ছে স্বায়ত্তশাসন। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় —যারা প্রশাসনিক বিভিন্ন পদে আছেন, তাদের অনেকেই আবার শিক্ষক সমিতির বিভিন্ন পদে আছেন। কোনো শিক্ষক সমস্যায় পড়লে প্রশাসনের সাথে দর কষাকষি করবে কে তাহলে? যিনি প্রশাসনের দায়িত্বে তিনি আবার দর কষাকষির জন্য শিক্ষক সমিতির পদে! পদ-পদবিকে ঘিরে কী রকম অনৈতিক চর্চা চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। উপরন্তু মাননীয় উপাচার্যের একান্ত আশীর্বাদ ছাড়া সরকারি দলের ব্যানারে কোনো পদে নির্বাচনের জন্য এখন আর মনোনয়ন পাওয়া যায় না।
প্রশ্ন হলো — বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তো এমন চরিত্র ছিল না? শিক্ষকরা তো এমন ভূমিকায় ছিলেন না? তাহলে আজ কেন এমন হচ্ছে? আসলে প্রচলিত সমাজের লোভ বা মুনাফার ধারণা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে প্রবলভাবে প্রবেশ করেছে। সমাজে প্রতিক্রিয়ার চিন্তা আগেও ছিল। কিন্তু জ্ঞানের আলো দিয়ে সমাজের শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ পথ দেখাতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এক্ষেত্রে ভালো ভূমিকাও রেখেছেন। কিন্তু আজ একদিকে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব অন্যদিকে জ্ঞানচর্চার প্রবল উদাসীন্যের কারণে সমাজের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাগুলোও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তৈরি হচ্ছে। শিক্ষকরা হচ্ছেন এসবের কারিগর। নিজেরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল সুবিধা ভোগ করার পর আজ তারা প্রচার করছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্রি বলে কিছু নেই। সবকিছু টাকা দিয়ে কিনতে হবে।’ এভাবে টাকা আর ক্ষমতার কাছে প্রতিদিন তারা নিজেরাই বিক্রি হচ্ছেন।
এতে কি শুধু শিক্ষকদের ক্ষতি হচ্ছে? না। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ। ‘উচ্চশিক্ষা’ সম্পর্কিত কোনো উন্নত ধারণা অবশিষ্ট থাকছে না। তাই শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা মানে যে কেবল সার্টিফিকেট পাওয়া নয়, উচ্চ মূল্যবোধ আর উচ্চ আত্মমর্যাদা অর্জনেরও সংগ্রাম — তা ভুলতে বসেছে। যদি ভিন্নমত সহ্য করা না হয়, যদি প্রশ্ন করার পরিবেশ না থাকে তবে কিসের এত গণতান্ত্রিকতার বড়াই? যে শিক্ষক ৫৭ ধারার মতো চরম প্রতিক্রিয়াশীল একটি আইনের সুযোগ নিয়ে সহকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দেন, তার কাছে কতটুকু গণতন্ত্র আশা করা যায়? শিক্ষকরা সমাজে শ্রদ্ধার পাত্র। তারা যদি ক্ষমতার পদলেহন করেন তবে সম্মানের আসনটুকু হারিয়ে ফেলেন। যদিও সম্মান-শ্রদ্ধা-নীতি-নৈতিকতা আজ অনেকের কাছে সেকেলে ব্যাপার!
তবে অন্ধকারটাই শেষ কথা নয়। আলোও আছে। নীতির প্রদীপশিখা হাতে নিয়ে যুগে যুগে জাতির ক্রান্তিকালে অনেকে দাঁড়িয়েছেন। ভারতবর্ষের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় রাষ্ট্র শক্তির প্রবল আধিপত্যের সামনে মাথা নত না করে বলেছিলেন, ‘তারা একহাতে দিয়েছেন অর্থ আরেক হাতে অধীনতা। আমি ওই অর্থ চাই না। স্বাধীনতা প্রথম, স্বাধীনতা দ্বিতীয় এবং স্বাধীনতাই শেষ কথা।’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শামসুজ্জোহা কি শিক্ষকতার সুমহান মর্যাদাকে দেশের সামনে তুলে ধরেননি? আজও তাঁরা মুক্তিকামী, স্বাধীনচেতা ছাত্র-জনতার সামনে এক অফুরন্ত প্রেরণার উৎস। তাঁদেরই পথ বেয়ে আজও দেশে ক্ষুদ্র হলেও শিক্ষকদের মধ্যে একটি অংশ আছেন, যারা নিজেদের বিকিয়ে দেননি। নীতি-নৈতিকতা-সম্মান সব হারিয়ে কেবল অর্থ আর ক্ষমতার পেছনে নিজেদের সঁপে দেননি। আজও তাঁরা নৈতিক প্রশ্নে আন্দোলনে দাঁড়ান। সংখ্যায় অল্প হলেও এঁরাই আমাদের প্রকৃত শিক্ষাগুরু। এঁরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের চেতনাকে সত্যিকার অর্থে ধারণ করেন।