Sunday, October 6, 2024
Homeঐকতানসমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামই মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম - সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামই মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম – সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

সভাপ্রধান, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী) পার্টির সাধারণ সম্পাদক, কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী এবং উপস্থিত সুধীবৃ23172751_1560995950633311_6901497697988681565_nন্দ, আমি প্রথমে চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রকে আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানাব তাদের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য এবং বিশেষভাবে বিপ্লবের সঙ্গে সংস্কৃতিকে যুক্ত করার যে লক্ষ্য তারা স্থির করেছে তার জন্য। ১০০ বছর আগে রুশ দেশে যে বিপ্লব হয়েছিল সে বিপ্লবের তাৎপর্য সাংস্কৃতিকভাবে তুলে ধরা আজকে খুবই প্রয়োজনীয়। এ অনুষ্ঠানের শুরুতে আমরা যে চারটি গান শুনলাম সেই গানগুলোতে বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতা উন্মোচিত হয়েছে। এই শিল্পী চর্মচক্ষে দেখতে পান না কিন্তু মনের মধ্যে স্পষ্ট দেখেছেন যে বাংলাদেশের অবস্থাটা এখন কী। এখানে চালের দাম, এখানে চাষীর দুঃখ, এখানে রাষ্ট্রীয় মালিকানার কল-কারখানা ব্যক্তি মালিকানায় দিয়ে দেওয়া এবং এখানে কয়লা খননের নামে প্রকৃতিকে ধ্বংস এবং মানুষের জীবনকে বিপন্ন করা, এই যে বাস্তবতা বিভিন্ন ভাবে সেটা তাঁর গানে উঠে এসেছে। গানগুলো একটা কথাই বলে, সেটা হলো আমরা আছি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার যে চরম রূপ তার ভেতরে। আমি এই কথাটায় আবার ফেরত আসব।

তার আগে আমি সংস্কৃতির ব্যাপারটা যে কত জরুরি সেটা উপলব্ধি করার কথা বলব। আমরা জানি যে, সংস্কৃতিকে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। সংস্কৃতির মধ্যে আমাদের আত্মপরিচয় আছে, আমাদের জীবনাচার আছে, আচার-ব্যবহার আছে। শিল্প-সংস্কৃতি আছে। সংস্কৃতির ভেতরেই এরা আছে বলা যাবে। আবার আছে আমাদের সংগ্রাম। মানুষের সংগ্রাম, বাঁচার জন্য। প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম, প্রবৃত্তির সাথে সংগ্রাম। সংস্কৃতিতে রয়েছে সমস্ত কিছু। আমরা বলে থাকি যে শিক্ষাই জাতির মেরুদ-। কিন্তু আসল মেরুদ- হচ্ছে সংস্কৃতি এবং এটা দেখা যাবে যে সভ্যতার চাইতেও সংস্কৃতির গুরুত্ব বেশি এবং স্থায়ী। আমরা সভ্যতার পতন দেখি কিন্তু সভ্যতার পতনের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতি শেষ হয়ে যায় না। সংস্কৃতির সৃষ্টিগুলো, সংস্কৃতির অর্জনগুলো, সংস্কৃতির মূল্যবোধগুলো রেখে যায় পরবর্তী ইতিহাস-এর জন্য। ঝড়ে জাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে রবিনসন ক্রুসো সাঁতরে গিয়ে উঠেছিল নির্জন এক দ্বীপে; তার জন্য সহায়ক কিছুই ছিল না, কিন্তু ভেতরে ছিল তৎকালীন বিকাশমান পুঁজিবাদী সংস্কৃতি। তারই জোরে সে বেঁচেছে, নির্জন দ্বীপে ২৩ বছর টিকে থেকেছে, প্রকৃতির সঙ্গে সমঝোতায় এসেছে, চাষ করেছে ফসলের, ছাগলের খামার তৈরি করেছে, তোতা পাখির সঙ্গে কথাবার্তা বলেছে, বাইবেল পড়েছে, দিনলিপি লিখেছে, বিপন্ন একজন মানুষকে আশ্রয় দিয়ে তাকে সঙ্গী ও সহকারী হিসেবে কাজে লাগিয়েছে, এবং অপেক্ষা করেছে উদ্ধারকারীর জন্য। উদ্ধারকারী শেষ পর্যন্ত এসেছেও, ঘটনাক্রমে। ভেতরে জোরটা ছিল সংস্কৃতির, সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের ইংরেজ সংস্কৃতির জোরটা না থাকলে রবিনসন ক্রসো নিশ্চিতই মারা পড়তো।

আমরা দেখব, সভ্যতার যে বিবর্তন হয়েছে সেই বিবর্তনে নতুন নতুন পর্যায় পার হয়েছে এবং এই পর্যায়গুলোর সাথে সংস্কৃতির যে সম্পর্ক সেটা অত্যন্ত নিবিড়। আমরা এটা জানি যে, এক সময় আদিম সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত ছিল। মানুষ যা পেত তাই খেত, গাছ থেকে ফল ছিঁড়ে খেত, পানি থেকে মাছ তুলে খেত। তখন উদ্বৃত্ত বলতে কিছু ছিল না। তারপরে সভ্যতা এগিয়েছে। সভ্যতার সেই অগ্রগতিতে পিতৃতান্ত্রিকতা এসেছে, ব্যক্তিমালিকানা এসেছে। আমরা দেখেছি যে দাস সমাজ একসময় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তারপরে সেটা ভেঙে সামন্ত সমাজ এলো, তারপর সেটা ভেঙে পুঁজিবাদী সমাজ এলো। এগুলো সবই অগ্রগতি। একটাকে ছাড়িয়ে আরেকটার নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে মানুষ। কিন্তু ওই যে দাস সমাজ, ওই যে সামন্ত সমাজ, বর্তমানের পুঁজিবাদী সমাজ এদের ভেতরে যে একটা জিনিস আছে, সেটা হল ব্যক্তিমালিকানা। অগ্রগতির তিনস্তরেই ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠিত ছিল। এবং যে বিপ্লব ঘটেছে সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯১৭ সালে সেই বিপ্লব এই মালিকানার প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছিল। মালিক কি ব্যক্তি থাকবে, নাকি মালিক হবে সমাজ? উৎপাদন করে অনেকে মিলে একসাথে, কিন্তু মালিকানা ছিল অল্প কিছু মানুষের হাতে।

এই যে মালিকানার সমস্যা এই সমস্যা পুঁজিবাদ সমাধান করতে পারে নাই। সেই জন্যই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রয়োজন হয়েছিল। বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার। আমরা জানি সোভিয়েত রাষ্ট্র ৭২ বছর টিকে ছিল। ইতিহাসে আমরা আরো অনেক বিপ্লব দেখেছি। আমরা ফরাসি বিপ্লবের কথা জানি, আমরা শিল্প বিপ্লবের কথা জানি, আমরা আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা জানি, আমরা আমাদের দেশে যে সিপাহী অভ্যুত্থান হয়েছিল সেটাও বৈপ্লবিক ছিল বলি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধকেও আমরা বৈপ্লবিক বলি। কিন্তু এই যে অক্টোবর বিপ্লব, সেই বিপ্লব সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের। কেননা সেই বিপ্লব মালিকানা উচ্ছেদের প্রশ্নটাকে মীমাংসা করে দিতে চেয়েছিল। অন্য বিপ্লবগুলো ব্যক্তিমালিকানাকে রক্ষা করে চলেছে। সোভিয়েত বিপ্লব আমাদের সামনে যে প্রশ্ন এনেছে সেটা হলো মালিক কে থাকবে সম্পদের? মালিক কি অল্প কয়েকজন মানুষ থাকবে? শতকরা ৫ জন মানুষ নাকি ৯৫ জন মানুষ? পুঁজিবাদ ৫ জনের পক্ষে। এবং পুঁজিবাদী নৃশংসতা, বর্বরতা, অমানবিকতা আজকে সর্বোত্র উন্মোচিত। কাজেই এই বিপ্লবের যে তাৎপর্য সেটা হচ্ছে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে এই যে, এই বিপ্লব যে বিষয়টি সামনে নিয়ে এলো সেটা হলো কোনটা বড় – মুনাফা বড় নাকি মানুষ বড়? পুঁজিবাদ মুনাফাকে বড় করে দেখে, মুনাফা ছাড়া সে অন্য কিছু বোঝেই না। এবং সমাজতন্ত্র মানুষকে বোঝে, মনুষ্যত্বকে গুরুত্ব দেয়। এজন্য সমাজতন্ত্রের যে সংগ্রাম সেই সংগ্রাম মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। এ সংগ্রাম মুনাফাখোরি ভাঙার সংগ্রাম। অক্টোবর বিপ্লবের বিশেষ বিশেষত্ব এইখানেই যে এই বিপ্লব বলেছে মুনাফা নয়, মনুষ্যত্বকেই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মুনাফার রাজত্বে কি ঘটে সেটা আমরা দেখেছি, আমরা দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধ দেখেছি। আজকে বর্বরতা দেখছি। এবং সমাজতন্ত্র থেকে সরে গেলে রাষ্ট্রের চেহারা যে কী দাঁড়ায় তা আমরা রাশিয়াতে দেখলাম। তা আমরা চীনে দেখছি। বলা হয় সমাজতন্ত্রের পতন ঘটেছে। আসলে তা নয়। সমাজতন্ত্র থেকে রাষ্ট্রগুলো সরে গেছে। রাশিয়া যখন সমাজতন্ত্র থেকে সরে গিয়ে পুঁজিবাদকে প্রতিষ্ঠা করল তখন অন্যসব দুর্দশার মধ্যে প্রধান দুর্দশা হয়ে দাঁড়ালো নারীদের। যে নারীরা মর্যাদার আসনে ছিলেন সেই নারীরা কেউ কেউ আবার বিপ্লব-পূর্ববর্তী সময়ের মতো নিজেদের দেহ বিক্রি করতে বের হলেন। যে অধ্যাপক মর্যাদার সাথে ছিলেন সেই অধ্যাপককে দেখা গেল ভিক্ষা করছেন। এই যে পরিবর্তন, সমাজতন্ত্র থেকে পুঁজিবাদে পরিবর্তন, সেটা আমরা দেখছি।

আমরা দেখেছি যে চীন যখন সমাজতান্ত্রিক ছিল তখন সে সারাবিশ্বের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে সমর্থন দিত। কিন্তু চীন যখন থেকে পুঁজিবাদী অবস্থান গ্রহণ করেছে তখন থেকে মানুষের মুক্তির বিষয়টিকে প্রাধান্য না দিয়ে নিজের জাতীয়তাবাদী স্বার্থ, পুঁজিবাদী স্বার্থ, মুনাফার স্বার্থকে বড় করে তুলেছে। সেই জন্য আজকে মিয়ানমারে যে ঘটনা ঘটছে, যে গণহত্যা ঘটছে সেখানে চীন সেখানকার যে বর্বর শাসক, সামরিক শাসক, ফ্যাসিবাদী শাসক তাদেরকে সমর্থন করছে। রাশিয়া তার সাথে যুক্ত হয়েছে। মুনাফাকে তারা প্রধান করে তুলেছে। মনুষ্যত্বকে প্রধান করে দেখছে না। রুশ বিপ্লব বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ এই জন্য যে, সে মুনাফায় নয় মনুষ্যত্বে বিশ্বাস করে।

আমাদের দেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখব যে আমরা দীর্ঘকাল সংগ্রাম করেছি। এই সংগ্রামে সমাজতন্ত্রীরা ছিলেন, জাতীয়তাবাদীরা ছিলেন। পার্থক্য ছিল এই যে জাতীয়তাবাদীরা ছিলেন পুঁজিবাদী এবং সমাজতন্ত্রীরা ছিলেন সামাজিক মালিকানায় বিশ্বাসী। নানান ঐতিহাসিক কারণে সমাজতন্ত্রীরা জয়ী হতে পারেননি। জাতীয়তাবাদীরা, পুঁজিবাদীরা জয়ী হয়েছেন। এবং পুঁজিবাদীরা জয়ী হলে যে কি পরিণতি হয় তা আজকে চারটি গানের মধ্যে আমাদের এই শিল্পী বন্ধু উন্মোচিত করে দিয়েছেন। এটিই হচ্ছে পরিণতি। আমরা পুঁজিবাদের মধ্যে এই চরিত্রটা দেখব রবার্ট লুই স্টিভেনশন বলে একজন লেখকের একটি গল্পে। গল্পটা হয়ত আপনারা অনেকেই জানেন। নাম ড. জেকিল এন্ড মিস্টার হাইড। ড. জেকিল খুব বড় মাপের একজন চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, সন্ন্যাসীর মতো মানুষ। তাঁর কোনো শত্রু নেই। তিনি সারাক্ষণ গবেষণা করছেন। মানুষের উপকারের জন্য গবেষণা করছেন। কিন্তু তাঁর ভিতরে আর একটা মানুষ আছে, সেই মানুষটার নাম মি. হাইড।

এই লুকিয়ে-থাকা মানুষটা ভয়ঙ্কর। সে দেখতে কুৎসিত, আচরণে নিষ্ঠুর। তার ভেতর ন্যায় অন্যায়ের কোনো বোধ নেই। ড. জেকিল একটা ওষুধ আবিষ্কার করেছেন, যেটা খেলে তিনি মি. হাইড হয়ে যান, আবার মি. হাইড থাকা অবস্থায় ওষুধ খেয়ে ড. জেকিলে রূপান্তরিত হতে পারেন। একবার সেটা খেয়ে মি. হাইড রূপে রাস্তায় বের হয়ে গেছেন। ধাক্কা লেগেছে একটি কিশোরীর সঙ্গে। তাকে পদদলিত করেছেন। হৈ চৈ হয়েছে। টাকা দিয়ে রক্ষা পেয়েছেন। ড. জেকিল এরপর সতর্ক হয়ে গেছেন। কিন্তু এক দুর্বল মুহূর্তে আবার ওষুধ খেয়ে ফেলেছেন; এবার হাইড বের হয়ে ড. জেকিলের ওপর অনেক হম্বিতম্বি করলেন; কেন তাকে এতদিন আটকে রাখা হয়েছিল, সেটা জিজ্ঞাসা করলেন। ক্রোধান্বিত অবস্থায় বের হয়ে গিয়ে মি. হাইড রাস্তায় পেয়েছেন বৃদ্ধ এক ভদ্রলোককে, তাকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মেরেই ফেললেন। ভদ্রলোক ছিলেন পার্লামেন্টের সদস্য, সন্ধ্যায় ভ্রমণে বের হয়েছিলেন। হট্টগোল হলো। হাইড পালিয়ে গেলেন এবং ওষুধ খেয়ে ড. জেকিলের রূপ নিয়ে রক্ষা পেলেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারলেন যে তাঁর ওষুধ দুর্বল হয়ে আসছে, এবং মি. হাইড নিয়ন্ত্রণে থাকতে চাচ্ছেন না। তাঁর মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিল, মি. হাইড পরিচয় ধরা পড়ে যাবার আতঙ্ক। তখন তিনি নিজের ঘরে নিজেকে আটকে রাখলেন। এবং আটক অবস্থায় মারা গেলেন। অর্থাৎ আত্মহত্যা করলেন।

ড. জেকিলের আবিষ্কার দক্ষতা পুঁজিবাদী উন্নতির প্রতীক। উন্নতি অসাধারণ, কিন্তু সে আবার বিপজ্জনকও। সে মি. হাইডকে অবমুক্ত করে। মি. হাইড অশুভ, ধ্বংসে উন্মুখ ও স্বেচ্ছাচারী। ওদিকে ড. জেকিলের তবু লজ্জা শরম কিছু ছিল, নিজের দুষ্কর্ম দেখতে পেয়ে তিনি লজ্জা পেয়েছেন, এবং নিজের সেই ভেতরকার কুপ্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন না জেনে আত্মহত্যা করেছেন। পুঁজিবাদের চিন্তায় কিন্তু ওসবের বালাই নেই; পুঁজিবাদ যেমন নৃশংস তেমন বেপরোয়া। এটা বেহায়া। নিজের লাভ ছাড়া অন্য কিছু বোঝে না।

পুঁজিবাদী বিশ্বের অভূতপূর্ব কারিগরি উন্নতি ঘটেছে। সেটা দেখে কেউ কেউ বলেন, এবং ভয় পান যে এমন দিন হয়তো আসবে যখন মানুষের আর প্রয়োজন হবে না। রোবট সব করবে, যন্ত্রই চালক হবে। এককালে ডায়নোসর ছিল। কত বড় প্রাণী। সেই প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন মানুষ এসেছে, সৃজনশীল মানুষ, উদ্ভাবনশীল মানুষ, বিবেকবান মানুষ। কিন্তু এই মানুষও ঝুঁকির মুখে পড়েছে। কেউ কেউ আশঙ্কা করছে মানুষ একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, তখন এই যন্ত্রগুলো, এই রোবটগুলো বুদ্ধিমান হয়ে উঠবে। এবং সেই কাজগুলো করবে যে কাজ মানুষ করছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ব্যক্তিমালিকানায় প্রযুক্তিকে কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। দেখতে পাচ্ছি বেকারত্ব সৃষ্টি করা হচ্ছে। শ্রমের মূল্য কমিয়ে আনা হচ্ছে। শ্রমিক ও শ্রমকে অপ্রয়োজনীয় করে তোলার চেষ্টা চলছে। এর কারণ পুঁজিবাদী মূল্যবোধ। পুঁজিবাদ শ্রমের ওপর, প্রকৃতির ওপর, মনুষ্যত্বের ওপর নির্যাতন করছে। এবং সেই জন্যই আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে যে হয়তো আমাদের সভ্যতা একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে এবং যন্ত্রের শাসন চালু হবে। ভরসা এই যে, বিশ্বের বিবেকবান মানুষেরা সেটা হতে দেবে না। রুখে দেবে। যন্ত্র থাকবে, কিন্তু তার নিয়ন্ত্রণটা হবে সামাজিক। যন্ত্র কাজ করবে মানুষের উপকার করার জন্য, মানুষকে শাসন করবার জন্য নয়। এর জন্যই পুঁজিবাদকে হটানো চাই, প্রতিষ্ঠা চাই সামাজিক মালিকানার।

পুঁজিবাদ যা করে তা হলো সবকিছুকে পণ্যে পরিণত করা। বাংলাদেশে আমরা সেই ব্যাপারটা দেখছি। চিকিৎসা ও শিক্ষা পণ্যে পরিণত হয়েছে। খুনী ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে। বাঁচার প্রয়োজনে মানুষ নিজের শ্রমশক্তি বিক্রি করার জন্য হাটে-বাজারে উপস্থিত হচ্ছে। ক্রেতা পায় তো দাম পায় না, অনেক সময়ে ক্রেতাও পায় না।

আমাদের ইতিহাসে আমরা বুদ্ধিজীবীদের দেখেছি। বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা দেখেছি। তারা মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করেছেন। যেমন ধরুন, আমরা খুব শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি দু’জনকে। রামমোহন রায়কে এবং বিদ্যাসাগরকে। রামমোহন রায় ও বিদ্যাসাগরের মধ্যে যে পার্থক্য সেটি কিন্তু বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। রামমোহন ইংরেজদের ভারতে এসে বসবাস করার পক্ষে ছিলেন। তিনি তাদেরকে আহ্বান করেছেন। বলেছেন ইংরেজরা কেন এখানে এসে বসবাস করছে না? ভারতবর্ষকে প্রত্যক্ষ কলোনিতে পরিণত করছে না? প্রত্যক্ষ কলোনিতে পরিণত করলে সাহেবরা এখানে এসে বসবাস করবে, তাদের সাথে মিলে-মিশে আচার-আচরণে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চায় স্থানীয় মানুষেরা অর্থাৎ ব্রাহ্মণরা, বিত্তবানরা, অনেক উৎকর্ষ অর্জন করবেন। এটা ছিল রামমোহনের চিন্তা। রামমোহন আধুনিক মানুষ। রামমোহনকে আমরা আধুনিকতার পথিকৃৎ বলি, অভিভাবক বলি। কিন্তু তাঁর চিন্তা উপনিবেশিক চিন্তা। এবং তিনি যখন বাংলা গদ্যের উদ্ভাবন করলেন তাতে ঘটল সংস্কৃতবাহুল্য। সাধারণ মানুষ তা বুঝবে না এবং এই গদ্য দিয়ে তিনি ধর্মগ্রন্থ অনুবাদ করলেন। তুলনা চলে মার্টিন লুথারের সঙ্গে। মার্টিন লুথার যখন বাইবেল অনুবাদ করলেন তখন অনুবাদ করলেন কৃষকের ভাষায়। এবং সেই অনুবাদের জন্য তিনি একটা ভাষা তৈরি করে নিলেন। কৃষকের মুখের ভাষা থেকে যার উৎপত্তি। যার ফলে বাইবেল সমস্ত মানুষের বোধগম্য হলো। এবং মানুষের চিন্তা জগতে বিপ্লব এলো। রেনেসাঁসের প্রধান ভিত্তি চিন্তার ক্ষেত্রে বিপ্লব, সেটার একটি ভিত্তি এভাবে তৈরি হলো। রামমোহনের অনুবাদ তেমন কিছু করতে পারল না। লুথারের সঙ্গে রামমোহনের পার্থক্যের মূল কারণ লুথার ছিল জনমানুষের সঙ্গে, আর রামমোহন ছিল বিত্তবানদের সঙ্গে। রামমোহনের পরে বিদ্যাসাগর এসেছেন। বিদ্যাসাগর ব্রিটিশ শাসনকে মেনে নিয়েছেন। বিদ্যাসাগর ব্রিটিশের অধীনে কাজ করেছেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর খুব বড় যে কাজটা করলেন সেটা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। এই অর্থে যে তিনি বললেন মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দিতে হবে। ইংরেজি মাধ্যমে নয়, মাতৃভাষার মাধ্যমে, এবং যারা শিক্ষার উন্নয়ন চান তাঁদের দায়িত্ব হবে এমন একটা সাহিত্য তৈরি করা যা বাংলাভাষাকে করবে সমৃদ্ধ।

বিদ্যাসাগর নিজেও সে কাজ করেছেন। বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের মুক্তি ঘটালেন। ঘটালেন এই প্রয়োজনেই যে তিনি এর সাথে শিক্ষাকে যুক্ত করেছেন। সাধারণ শিক্ষাকে যুক্ত করেছেন। বিদ্যাসাগরের সেই সাহস ছিল। তিনি সরকারি বড় চাকরি করতেন। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। অনেক বেতন পেতেন, আরও উন্নতি করতে পারতেন, চাকরিতে প্রমোশন হতো। কিন্তু তিনি ওই চাকরি ছেড়ে দিলেন। তখন কথা উঠেছিল যে বিদ্যাসাগর চাকরি ছেড়ে দিলে খাবেন কী? বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, বিদ্যাসাগর আলু-পটল বেচে খাবে। সরকারি চাকরী ছেড়ে এই যে আলু-পটল বেচে খাওয়ার সঙ্কল্প এটা হচ্ছে এগিয়ে যাওয়া, বুর্জোয়া বিকাশের পথে এগিয়ে যাওয়া। তার পরে তিনি বই লিখলেন। সেই বই ছাপার জন্য ছাপাখানা এবং বিক্রির জন্য দোকান খুললেন। কিন্তু বিদ্যাসাগরকে আর এক জায়গায় গিয়ে থেমে যেতে হয়েছে। তিনি এটা দেখতে পাননি, দেখার অবকাশ ছিল না।

মার্কস এবং বিদ্যাসাগর সমসাময়িক ছিলেন। কিন্তু মার্কস যে রকম চিন্তা করেছিলেন সেরকম চিন্তা তো বিদ্যাসাগরের পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। বিদ্যাসাগর তো উপনিবেশের মানুষ, দরিদ্র মানুষ, নিম্নমধ্যবিত্ত এবং অবিকশিত একটা সংস্কৃতির মানুষ। কাজেই মার্কসের যে চিন্তা, সমাজ বিপ্লবের যে চিন্তা, বিদ্যাসাগরের সেই চিন্তা ছিল না। সেই জন্য তিনি শিক্ষার মধ্য দিয়ে সমাজে পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন। তিনি কিন্তু কোন ধর্মগ্রন্থের অনুবাদ করেননি। তিনি অনুবাদ করেছিলেন শেক্সপীয়রের নাটক, তিনি অনুবাদ করেছিলেন হিন্দী কাহিনী, অনুবাদ করেছিলেন সংস্কৃত শকুন্তলা। এইগুলো করেছেন, ধর্মের কাছে যাননি। এবং বলা হয় বিদ্যাসাগর নাস্তিক ছিলেন। নাস্তিক আস্তিকের বিষয়টা বড় প্রশ্ন নয়, বিদ্যাসাগর ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন সেটাই বড় কথা। ধর্মকে একেবারেই গুরুত্ব দিতেন না। কিন্তু তবু পথ তো খুঁজে পেলেন না। শেষ জীবনে বিদ্যাসাগর কী কী করলেন, কী করতে বাধ্য হলেন? মধ্যবিত্ত পরিম-ল, যা তাঁকে অপমান করেছিল নানান ভাবে, যেখানে তিনি বিদ্বেষ দেখেছেন, তাকে পরিত্যাগ করে তিনি সাঁওতালদের মধ্যে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করলেন। এটা কিন্তু বিপ্লবের পথ নয়। এটা পরিত্যাগের পথ, যে-পরিত্যাগ তিনি করেছিলেন।

আমরা পরবর্তীতে দেখব কাজী নজরুল ইসলামকে। তিনি অসাধারণ কবি, তিনি এই রুশ বিপ্লবের অনুপ্রেরণাকে ও মূল্যবোধকে নিজের মধ্যে গ্রহণ করলেন সেটাও আশ্চর্য এক ঘটনা। তার সেই গ্রহণ ক্ষমতা ছিল যেটা শ্রেষ্ঠ মেধার প্রতীক, যেটা উইলিয়াম শেক্সপীয়রের ছিল। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, কিন্তু গ্রহণ করার ক্ষমতা আছে। শেক্সপীয়র ও নজরুলের সঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ একটা মিল আছে। সেটা এই যে দু’জনেরই মেলামেশা ছিল সাধারণ মানুষের সঙ্গে। গ্রহণ করার ক্ষমতার জন্যই নজরুল বিপ্লবী হয়েছিলেন। তিনি বিদ্রোহ দিয়ে শুরু করেছিলেন। অত্যন্ত অল্পসময়ের মধ্যেই বিপ্লবের পথে চলে গেছেন, সাম্যবাদের কথা বলেছেন, নারী পুরুষের কোনো ভেদাভেদ নেই বলেছেন, চাষী মজুর-এর কথা বলেছেন। যে কুলি কলকাতার রেল স্টেশনে অপমানিত হচ্ছে সেই কুলির অপমান দেখে তিনি বিশ্ব মানুষের, বিশ্ব মানবতার অপমানের কথা ভাবছেন, এবং বলেছেন এটা শেষ হবে, অবশ্যই শেষ হবে। ১৯১৭-এর যে বিপ্লব, তার প্রতিধ্বনি আমরা নজরুল ইসলামের মধ্যে শুনি। কবিতার নাম, কবিতার বইয়ের নাম দিচ্ছেন সাম্যবাদী ও সর্বহারা। বিপ্লবী কবিতা লিখেছেন। চাষীর গান, শ্রমিকের গান, জেলের গান, ছাত্রদলের গান লিখেছেন, কবিতা লিখেছেন বারাঙ্গনাদের পক্ষে। এবং বিপ্লবের পক্ষে কাজ করেছেন।

কিন্তু নজরুল ইসলামকেও থেমে যেতে হয়েছে। কেন থেমে যেতে হলো? বিপ্লবী আন্দোলনের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন, কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর কেবল যে নৈতিক যোগাযোগ তা নয়, প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল। এবং তিনি পরিবর্তিত হয়েছিলেন বলশেভিক মতবাদের দ্বারা। তাঁর প্রথম পত্রিকার নাম ধুমকেতু, যেটা বিপ্লব করবে। কিন্তু পরিষ্কার ছিল না কোন ধরনের বিপ্লব। পরবর্তী পত্রিকা বের করেছেন লাঙ্গল নামে এবং কলকাতার পত্রিকা অফিসের সাইনবোর্ডে একটা লাঙ্গল টানিয়ে দিয়েছেন। সেখান থেকে তিনি চলে যাচ্ছেন গণবাণী’তে। এই যে অগ্রসর হচ্ছেন, তার সমান্তরালে যে আন্দোলন চলছিল, বিপ্লবের আন্দোলন, শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন, কৃষকের আন্দোলন, সেটা তেমন এগোয়নি। দারিদ্র্য ছিল, পারিবারিক শোক ছিল, পুত্র শোক ছিল, নিজে অসুস্থ ছিলেন, সেজন্য একসময় তিনি স্তব্ধ হয়ে গেলেন। এই পরিণতিগুলি আমরা দেখি। আমরা দেখি বেগম রোকেয়াকে। বেগম রোকেয়া নারীমুক্তির প্রশ্নটাকে কেমন ভাবে নিয়ে এসেছেন এবং মূল কথাটা বলেছেন এইখানে যে, ধর্মগ্রন্থগুলো দেখে মনে হয় এসব যেন কোন পুরুষের লেখা, পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা। এই কথা প্রায় একশ’ বছর আগে একজন নারী এই দেশে বসে বলেছিলেন, চিন্তা করেছিলেন। সেটা আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় যে তিনি কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন। কিন্তু তিনি তো পর্দার আড়ালে থাকতেন, তিনি তো একাকী ছিলেন। তিনি নজরুল ইসলামের ধূমকেতু পত্রিকায় লিখতেন। কিন্তু চিন্তায় রোকেয়া-নির্দেশিত ওই ধারাটি আর এগোয় নি। সামন্তবাদীরা এগোতে দেয় নি; পুঁজিবাদীরা রুদ্ধ করে দিয়েছে, বলতে গেলে।

আমাদের দেশে দু’টি বড় ট্রাজেডি ঘটেছে, মস্ত বড় দু’টি ট্রাজেডি। প্রথম ট্রাজেডি ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ, দ্বিতীয় ট্রাজেডি ১৯৪৭-এর দেশভাগ। সেই দেশভাগ সাংস্কৃতিক ভাবে, রাজনৈতিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে, এমনকি প্রাকৃতিক ভাবে আমাদেরকে ভাগ করে দিয়ে আমাদের যে ক্ষতি করেছে তা পূরণ হবার নয়। অন্নদাশঙ্কর রায়-এর কবিতাটা আপনাদের মনে আছে; শিশুটি তেলের একটি শিশি ভেঙে ফেলেছে। কবি বলছেন, ‘তেলের শিশি ভাঙলো বলে শিশুর উপর রাগ করো/ তোমরা যে সব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো তার বেলা?’ বুড়ো খোকারা ভারত ভেঙে ভাগ করেছে। ইংরেজ প্ররোচনা দিয়েছে। কেমন করে যে সাংস্কৃতিক ভাবে এই ভাঙা-ভাঙির ব্যাপারটা কাজ করছিল তার নানান দৃষ্টান্ত আমরা নানা জায়গায় পাব।
ক’দিন আগে আমি একটা বই পড়ছিলাম আমাদের ঢাকা সম্পর্কে লেখা অলকনন্দা প্যাটেলের। লেখিকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতে অধ্যাপক পিতার সাথে শৈশবকাল কাটিয়েছেন। পিতা ড. অমিয় কুমার দাশগুপ্ত বড় মাপের অর্থনীতিবিদ। তাঁর সহকর্মী ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আশুতোষ সেন। আশুতোষ সেন রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক; তিনি অমর্ত্য সেন-এর পিতা। আশুতোষ সেন তাঁর বন্ধু, তাঁর তরুণ বন্ধু ও সহযোগীকে চিঠি লিখছেন। চিঠিতে বন্ধু অমিয় দাশগুপ্তকে তিনি বলছেন, নির্বাচনতো আসছে এখন তাদের কর্তব্যটা কি? সেটি ১৯৪৬-এর নির্বাচন, যে নির্বাচনে পাকিস্তান হিন্দুস্থান ভাগাভাগি হয়েছে। সেই নির্বাচনে প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আসন ছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েরও একটি আসন ছিল। সেখানে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী, যিনি অন্য কোথাও জিততে পারতেন না, তিনি জিতেছেন। সেবারও তিনি দাঁড়িয়েছেন এবং জয়ী হয়েছেন, অন্যসব আসনে যদিও তাদের প্রার্থীর জামানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন হচ্ছে। এখান থেকে একজন প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন। আসনটি সংরক্ষিত ছিল মুসলমানদের জন্য। প্রার্থী দুইজন। একজন হচ্ছেন ফজলুর রহমান। তাকে আমরা চিনি; এই ভদ্রলোক পরে পাকিস্তান সরকারের শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন, আরবী হরফে বাংলা লেখার কথা বলেছিলেন, ওই লক্ষ্যে গবেষণার জন্য টাকা দিয়েছিলেন, বাংলা ভাষার বিরোধী ছিলেন। আরেক জনের নাম পাওয়া যাচ্ছে, নুরুল হুদা। তিনি বোধ হয় স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন। আশুতোষ সেনের মত বিদগ্ধ মানুষ অমিয় দাশগুপ্তকে বলছেন, এ নির্বাচনে আমরা ফজলুর রহমানকেই ভোট দেব। ফজলুর রহমান কট্টর মুসলিমলীগ পন্থী, অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল, নবাব বাড়ির লোক। তাকেই ভোট দেবেন বলছেন। কেন? ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। ফজলুর রহমান জিতলে হিন্দুদের সুবিধা হবে। হিন্দুদের সুবিধা মানে বড়লোক হিন্দুদের সুবিধা। কাজেই তিনি তাঁর তরুণ বন্ধুকে বলছেন, তুমি কেবল নিজের ভোটটি দেবে না, অন্যদেরকেও বলবে ফজলুর রহমানকেই ভোট দিতে। এখানে আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? আমরা দেখতে পাচ্ছি যে একদিকে কট্টর মহাসভাপন্থীরা কাজ করছিলেন, অন্যদিকে কট্টর মুসলিম লীগাররা কাজ করছিলেন; এবং এই আপাত-শত্রুরা একসাথে মিলেছেন নিজেদের স্বার্থে, হিন্দু ব্রাহ্মণরা তাঁদের স্বার্থে, মুসলমান ব্রাহ্মণরা তাঁদের স্বার্থে দেশকে ভাগ করছেন। এই রাজনীতি তখন ছিল, এই রাজনীতি এখনও আছে। বর্তমান অবস্থাটা আজকের অনুষ্ঠানে-গাওয়া চারটি গানে ধরা পড়েছে। এখানে একটা বিশেষ কথা আছে। কৃষকের দুঃখের কথা। কৃষক দুঃখে আছে, তার বিশেষ দুশ্চিন্তা কন্যা-সন্তানকে নিয়ে সে কি করবে? কন্যা-সন্তানকে কীভাবে বিয়ে দেবে? এবং আমরা দেখি যে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ চালু আছে। তার প্রধান কারণ হচ্ছে কন্যাশিশুকে নিয়ে পিতা-মাতার দুশ্চিন্তা। পিতা-মাতা মনে করেন যে কোনোমতে মেয়েটাকে পার করতে পারলেই বাঁচা গেল। দায় মুক্ত হলেন। কন্যার নিরাপত্তা নিশ্চিত হলো। কিন্তু বাংলাদেশে তো মানুষের নিরাপত্তা নেই।

বিশেষ ভাবে নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা নেই। ১৯৭১ সালে আমরা দেখেছি যে পাকিস্তানী হানাদারেরা গণধর্ষণ করেছে। সেই রকম গণধর্ষণ আজ বাংলাদেশে চলছে। কাজটা বাঙালীরাই করছে। এখন পাঞ্জাবী হানাদার নেই। বাঙালী যুবকরা নারী ধর্ষণ করছে, গণধর্ষণ করছে। বাসে করে যাচ্ছিল উচ্চশিক্ষার্থী রূপা। তাকে একা বাসে পেয়ে পাঁচ জনে মিলে ধর্ষণ করল ওই চলন্ত বাসে। কাজ শেষে গলা দুমড়েমুচড়ে তাকে হত্যা করেছে, যেমন ভাবে মুরগিকে হত্যা (জবাই) করে গৃহস্থ। তাকে জানালা দিয়ে ফেলে দিয়েছে জঙ্গলে, বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে। মেয়েটির সঙ্গে মোবাইল ছিল, টাকা ছিল পাঁচ হাজার, হাতিয়ে নিয়েছে তাও। এটি কোনো ব্যতিক্রম নয়, এরকম খবর অহরহ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এ রকম ঘটনা তো বাংলাদেশের ইতিহাসে আগে কখনো ঘটেনি। এ রকম ঘটনা ঘটবে বলে তো আমরা বাংলাদেশকে স্বাধীন করিনি। এ রকম ঘটনা ঘটবে বলে এই দেশে ত্রিশ লক্ষ প্রাণ দেয়নি। দুই লক্ষ নারী তাদের সম্ভ্রম হারায় নি। কিন্তু এটা এখন বাংলাদেশের বাস্তবতা। অহরহ ঘটছে। কেবলই রূপা নয়, শিশু ধর্ষিত হচ্ছে, এবং শিশুকে ধর্ষণ শেষে গলা টিপে মেরে ফেলা হচ্ছে। তার লিভার, তার অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বের করে নেয়া হচ্ছে। এই যে বীভৎসতা, এই বীভৎসতা ঘটছে কি কারণে? যে যুবকরা গণধর্ষণ করছে, তারাও দরিদ্র, তারাও সুখে-শান্তিতে নেই, তাদেরও বাড়িতে মা-বোন আছে, কিন্তু তারা এ কাজ করছে কেন? করছে এবং করতে পারছে কারণ তারা পুঁজিবাদের যে আদর্শ সেই আদর্শে দীক্ষিত। তারা মুনাফায় বিশ্বাস করে। এবং এই মুনাফা হচ্ছে ভোগের মুনাফা। এতে কোনো বিনিয়োগ নেই। যত বেশি ভোগ করা যায় তত বেশি সুখ। এদের আচরণ এবং যে হানাদার একাত্তরে গণহত্যা ও গণধর্ষণ করেছে তাদের আচরণের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বরঞ্চ এদের আচরণ হানাদারের চাইতেও খারাপ। হানাদারেরা ছিল বিদেশী, এরা স্বদেশী। আসলে দুর্বৃত্তদের চেহারাটাই যা আলাদা, নইলে একই জায়গা থেকে তারা এসেছে। সে-জায়গাটা হলো পুঁজিবাদ। বাংলাদেশে পুঁজিবাদের বর্বরতাটা গণধর্ষণ ও শিশুধর্ষণের মধ্য দিয়ে সর্বাধিক উন্মোচিত হয়ে যায়।

আর পুঁজিবাদের এই মনুষ্যত্ববিরোধী তৎপরতার জন্যই প্রয়োজন হচ্ছে সামাজিক বিপ্লবের, যার জন্য দীর্ঘকাল আমরা সংগ্রাম করেছি, অপেক্ষা করেছি। যে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মালিকানার প্রশ্নের মীমাংসা হবে। সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে ব্যক্তি মালিকানার জায়গায়। এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মুনাফার জায়গায় মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠা পাবে। সামাজিক বিপ্লবের জন্য আমরা সংগ্রাম করছি। সামাজিক বিপ্লব সম্ভব হয় নি। আমরা ১৯৭১ সালে সামাজিক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিলাম, আশা করেছিলাম বিপ্লব ঘটবে, কিন্তু ঘটেনি, কারণ পুঁজিবাদীরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিয়েছে। পেটিবুর্জোয়ারা বুর্জোয়া হয়ে গেছে এবং যারা বুর্জোয়া হতে পারেনি তারা বুর্জোয়া মানসিকতা, মুনাফার মানসিকতা দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এবং সেজন্য অবাধে নারীধর্ষণ, শিশুধর্ষণ, গণধর্ষণ এইসব করছে।

১৭২৯ সালে, এখন থেকে প্রায় ৩০০ বছর আগে লেখক জনাথন সুইফট একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন আয়ারল্যান্ডের শিশুদের দুর্দশা দেখে। তিনি বলেছিলেন, “শিশুদেরকে আমরা খাওয়াবো, মোটা তাজা করব। এক বছর ধরে তাদের কাপড় চোপড় দেব। তারপর তাদেরকে কসাইখানায় বিক্রি করে দেব। এবং কসাইরা তাদের কেটে মাংস হিসেবে বিক্রি করবে বড়লোকদের কাছে। বড়লোকেরা তা সুস্বাদু খাদ্য হিসেবে খাবে।” সেটা তিনি চরম একটা ক্রোধ থেকে, প্রচ- হতাশা থেকে বলেছিলেন। আজকের বাংলাদেশের শিশুরা কিন্তু ভীষণ দুর্দশায় রয়েছে। জনাথন সুইফট পথের সন্ধান পাননি। আমরা কিন্তু পথের সন্ধান জানি। আমরা বিপ্লবের পথ জানি। আমরা ফরাসী বিপ্লব থেকে শিক্ষা নিতে পারি। আমরা প্যারি কমিউন থেকে শিক্ষা নিয়েছি, আমরা রুশবিপ্লব থেকে শিক্ষা নিয়েছি।

এটাও আমরা জানি যে এই বিপ্লবে সংস্কৃতির কী অসামান্য ভূমিকা। রুশ দেশে বিপ্লব কখনোই হতো না যদি সেই দেশের সাংস্কৃতিক মান অত উঁচু না হতো। তলস্তয়, দস্তয়ভস্কির লেখায় বিপ্লবের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। বুদ্ধিজীবীরা গবেষণা করেছেন, তর্ক করেছেন এবং প্লেখানভ-লেনিন এমনকি ট্রটস্কিরও যে অসামান্য বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান তার তুলনা হয় না। লেনিনের মতো দ্বিতীয় মানুষ তাঁর সময়ে পুরো ইউরোপে ছিলেন না। যেমন মার্কসের মতো সমান জ্ঞানী ও বিপ্লবী মানুষ তাঁর সময়ে আর কেউ ছিলেন না। বিজ্ঞানে হয়তো ছিলেন। কিন্তু সামাজিক চিন্তার ক্ষেত্রে তাঁর দ্বিতীয়টি ছিলেন না। এই উচ্চতায় থেকে মার্কসবাদকে লেনিন নিজের দেশে নিয়ে এসে প্রয়োগ করলেন। মার্কসবাদকে যদি লেনিন তাঁর দেশে প্রয়োগ করতে না পারতেন, তাহলে মার্কসবাদ একটা তত্ত্ব হয়ে থাকতো, একটা স্বপ্ন হয়ে থাকতো। স্বর্গীয় কল্পনা বলে লোকে তাঁকে উপহাস করত। বলতো এই ধরনের কল্পনার খবর আমরা আগেও পেয়েছি। ইউটোপিয়ার অনেক কাহিনী আছে। যেটা লেনিন করেছেন সেটা হচ্ছে এই যে মেহনতি মানুষকে সংগঠিত করে তাদের মধ্যকার শক্তির জোরে বিপ্লব সংঘটিত করা। আমাদের যেটা স্মরণ করতে হবে তা হলো রুশ দেশে তখন সোভিয়েত ছিল। বলশেভিক পার্টি যদি কেবল রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিত তাহলে বিপ্লব সফল হতো না। সোভিয়েত ছিল। সোভিয়েত মানে পরিষদ, পরিষদ ছিল শ্রমিকের, কৃষকের, সৈনিকের। স্থানীয় পরিষদ। এগুলো গঠিত হয় ১৯০৫ সালের জারবিরোধী অভ্যুত্থানের পরে, যার ফলে এরা ছিল জারবিরোধী চরিত্রের। লেনিনের আওয়াজ ছিল ক্ষমতা আমাদের পার্টির কাছে দেওয়ার দরকার নাই, ক্ষমতা যাবে সোভিয়েত-এর কাছে।

বাংলাদেশে আমাদেরকেও ওই রকম কেন্দ্র তৈরি করতে হবে। রাজনৈতিক কেন্দ্র এখনই না পারা যাক, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র চাই। চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র যে কাজগুলো করছে এরকম অসংখ্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। পাঠাগার তৈরি করতে হবে। দেশের আনাচে-কানাচে পাঠাগারকে কেন্দ্র করে সংস্কৃতির চর্চা হবে, বিতর্ক হবে, প্রতিযোগিতা হবে, লেখা চলবে, আলোচনা হবে এবং মানুষ জেগে উঠবে। ফলে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করবার যে সংগ্রাম সেই সংগ্রাম জয়যুক্ত হবে। কেবল জয়যুক্ত হবে না, বিপ্লব ঘটলে রাষ্ট্রক্ষমতাকে ধরে রাখার, তার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটাবার যে প্রয়োজন, সেই প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হবে। সেই জন্যই সাংস্কৃতিক কাজটা এত গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপের সে সময় সংস্কৃতিচর্চাতে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছিল, তারই পরিণতিতে বিপ্লব ঘটেছে। এবং সেই উন্নতি সমাজবিপ্লবীরা নিজেদের মধ্যে ধারণ করেছে অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়ে, জ্ঞানচর্চার মধ্য দিয়ে। এবং আমরা চীনের ঘটনা দেখেছি। মাও সে তুং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। কেন করেছিলেন এটা নিয়ে অনেক কথা আছে। এমনও বলা হয় যে এটা একটা হাস্যকর ব্যাপার ছিল। কিন্তু এটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ব্যাপার ছিল। তিনি দেখেছিলেন যে, পুঁজিবাদ ফেরত আসছে, ব্যক্তিমালিকানা চলে আসতে চাইছে। তিনি দেখেছিলেন যে, মুনাফা মনুষ্যত্বের উপর আধিপত্য করতে উদ্যত হয়েছে। তখন তাঁর অনেক বয়স। সেই বয়সে তিনি বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। এ বিপ্লব যে কত প্রয়োজন ছিল, সাংস্কৃতিক বিপ্লব যে কত আবশ্যক ছিল সেটা পরবর্তীতে এখন চীনের বর্তমান পুঁজিবাদী আচরণ দেখে, সেখানে মিস্টার হাইডের যে তৎপরতা সেটা দেখে আমরা বুঝতে পারি।

বুঝতে পারি সংস্কৃতি কত জরুরি, সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি কত জরুরি। আমরা আমাদের দেশে বিপ্লবের জন্য অপেক্ষা করছি। এই বিপ্লবে কেবল ক্ষমতা হস্তান্তর হবে না। এই যে আগে যে বিপ্লবগুলো হয়েছে, দাস ব্যবস্থা থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়েছে সামন্ত ব্যবস্থার কাছে, সামন্ত ব্যবস্থার হাত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়েছে পুঁজিবাদের কাছে, এ বিপ্লব সে রকমের হবে না। এ বিপ্লব ক্ষমতা হস্তান্তরের নয়, হবে ক্ষমতা-কাঠামোর মৌলিক পরিবর্তনের। এ বিপ্লব মীমাংসা করবে সামাজিক মালিকানার প্রশ্নের। এ বিপ্লব মুনাফাকে পরাজিত করে মনুষ্যত্বকে প্রতিষ্ঠিত করবে।

সারা বিশ্বে এই সংগ্রাম চলছে। এ সংগ্রাম আমাদেরও, এবং এই সংগ্রামের যে বিশ্বজনীন উত্তরাধিকার সে উত্তরাধিকার অক্টোবর বিপ্লব আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে। ওই উত্তরাধিকারকে বিকশিত করা, সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সাংস্কৃতিক যে কাজ সেই কাজটাকে রাজনৈতিক কাজের কেবল পরিপূরকই নয়, রাজনৈতিক কাজের প্রস্তুতি হিসেবে আমাদেরকে নিতে হবে। কাজেই চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের যে কাজ সে কাজ খুবই জরুরি এবং এ কাজ অত্যন্ত ব্যাপকভাবে করা দরকার।
যারা সমাজে বিপ্লব চান তারা জ্ঞানের চর্চা করবেন। এবং এটা অত্যন্ত সত্য কথা, মারাত্মক সত্য কথা যে আমাদের দেশে জ্ঞানের চর্চা নীচে নেমে গেছে। আমরা যেখান থেকে বক্তৃতা করছিÑ আলোচনা করছি, সেখানে তো ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছে। এইখানেই ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ সাহেব এখানেই বক্তৃতা করেছেন, এইখানে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করেছে। এই সমস্ত ঘটনার পরিণতিতে পরবর্তীতে যে কাজটা, নতুন সমাজ গড়া, মানবিক সমাজ গড়া, সেটি আমরা করতে পারিনি। এবং সেটা করতে না পারার কারণে আজকে আমাদের কন্যাশিশু এই ভাবে ধর্ষিত হচ্ছে, এভাবে আমাদের বোন ধর্ষিত ও নিহত হচ্ছে। যে কাজ মিয়ানমারে তাদের পুঁজিবাদী শাসকরা ফ্যাসিস্ট আচরণ করছে, সেই কাজ আমাদের দেশে হচ্ছে। মুক্তির যে সংগ্রাম সেটা আন্তর্জাতিক বৈপ্লবিক সংগ্রাম। এবং এই বিপ্লবের আরো বড় তাৎপর্য হলো অন্য বিপ্লবগুলো ছিল স্থানীয় বিপ্লব। ফরাসি বিপ্লব ফরাসি দেশের বিপ্লব, কিন্তু ১৯১৭ সালের সোভিয়েত বিপ্লব হচ্ছে আন্তর্জাতিক বিপ্লব। সারা বিশ্বে সে বিপ্লবের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছে এবং বিশ্বময় পুঁজিবাদকে পরাস্ত করে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়বার আকাক্সক্ষা এবং দৃষ্টান্ত – দুটোই প্রতিষ্ঠিত করেছে। সেই কথাটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আমার বক্তব্য এখানেই শেষ করছি।

(গত ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ মহান নভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আয়োজিত ‘নভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষে ঐকতান’- এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং ‘অক্টোবর বিপ্লব শতবর্ষ উদ্যাপন জাতীয় কমিটি’র আহ্বায়ক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যে আলোচনা করেন তা এখানে সামান্য পরিমার্জনা ও সম্পাদনা করে তুলে ধরা হল।)

নভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষে ঐকতান – চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments