Thursday, December 5, 2024
Homeবিশেষ নিবন্ধসমাজতন্ত্র-সাম্যবাদই মানবমুক্তির পথ - কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী

সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদই মানবমুক্তির পথ – কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী

[২০১৫ সালের নভেম্বরে মহান রুশ বিপ্লবের ৯৮তম বার্ষিকী এবং আমাদের দল বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী)-এর ৩৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীউপলক্ষে আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেটে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন। সেখানে তিনি রুশ বিপ্লব, সমসাময়িক আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও জাতীয় রাজনীতি- এই তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। সেই বক্তব্যসমূহ সংকলন করে ও পরবর্তীতে কমরেড মুবিনুল হায়দারের আরও কিছু সংযোজনীসহ এই বক্তব্যটি ‘সাম্যবাদ’ পত্রিকার ডিসেম্বর ২০১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। লেখাটির অংশবিশেষ আমরা রুশবিপ্লব বার্ষিকী উপলক্ষ্যে প্রকাশ করছি।]
. . .পুঁজি ও শ্রমের দ্বন্দ্ব যে সমাজের সবকিছুকে আবর্তিত করছে- এটা কার্ল মার্কস আবিষ্কার করলেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি মানব সমাজের অগ্রগতি কোন পথে হতে পারে, কোন শ্রেণিটি বিকাশমান, কোন শ্রেণিটি অবক্ষয়ী- সেটা মানুষের সামনে উপস্থিত করলেন। তিনি দেখালেন যে, পুঁজিবাদ এমন একটি শ্রেণির সৃষ্টি করেছে যা ব্যক্তিগত সম্পত্তির বন্ধন থেকে ছিন্ন হয়ে এক নতুন শক্তির জন্ম দিয়েছে এবং এই শ্রেণিটিই এখনকার সময়ের সামাজিক ব্যবস্থার সবকিছুকেই পরিচালনা করছে। তাদের শ্রমেই সবকিছু গড়ে উঠেছে এবং এটি ব্যক্তিগত শ্রম নয়, সামাজিক শ্রম। এই সামজিক শ্রমই দুনিয়ার সবকিছুর সৃৃষ্টিকর্তা। এই শ্রমিকরা তাদের কায়িক ও মানসিক শ্রমের মধ্য দিয়ে আদিম মধ্যযুগীয় সমাজ ভেঙে আধুনিক উন্নত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর সমাজে রূপান্তর ঘটিয়েছে। এই শ্রেণিটি সর্বহারা শ্রেণি। তারা সমস্ত রকম সম্পত্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সর্বহারা হয়েছে। এই শ্রেণিটি পুঁজিবাদী শোষণের ফলে ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে এবং এরা একমাত্র শ্রমকে কেন্দ্র করেই জীবন ধারণ করে।
পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় একদিকে শ্রমজীবীদের সংখ্যা বাড়ছে, আরেকদিকে আছে অল্পসংখ্যক লোক, যারা পুঁজি খাটিয়ে মুনাফা অর্জন করছে। পুঁজিবাদী সমাজে এই দুটি শ্রেণির স্পষ্ট মেরুকরণ ঘটছে। ঊনবিংশ শতাব্দির মধ্যভাগে কার্ল মার্কস সমাজের এই চিত্রটি তুলে ধরেন, এই সময়ে সমাজের বিকাশ কোন পথে হতে পারে তার নিয়মগুলি মানুষের সামনে রাখেন এবং কীভাবে দুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য গড়ে উঠার মধ্য দিয়ে একদিন সমস্ত মানুষ সাম্যে যাবে, তার দিক নির্দেশ করেন। এটি একটি ঐতিহাসিক নিয়ম। কল্পনা নয়, বাস্তব নিয়ম। মার্কস-এঙ্গেলস্ দুজনে মিলে মানব সমাজকে এই নতুন ধরনের বিজ্ঞানের ভিত্তি দিয়েছিলেন। এরপর দেশে দেশে তার অনুশীলন হয়। ১৯১৭ সালে, তখনকার সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের দুর্বল গ্রন্থি রুশদেশে, কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি বিপ্লব সম্পন্ন করে। লেনিন তখনকার সময়ে বুর্জোয়াদের যে পাণ্ডিত্য ও শিক্ষা, মার্কসবাদের উপর তাদের নানা আক্রমণ- ইত্যাদি মোকাবেলা করতে করতে বিশেষ দেশে, বিশেষ বিপ্লবের জন্য, বিশেষ পার্র্টির যে প্রয়োজনীয়তা তা নিয়ে আসেন এবং সেই বিশেষ পার্টির ঐতিহাসিক ভূমিকা কেমন হবে, তা নির্দেশ করেন। এভাবে তিনি মার্কসবাদী বিপ্লবী রাজনীতি, যা মার্কস-এঙ্গেলস এনেছিলেন, তাকে আরও উন্নত ও বিকশিত করেন। এরই প্রায়োগিক দিক ছিল রুশ বিপ্লব। রুশ বিপ্লব মানব সমাজে শ্রমিক-কৃষকের মৈত্রীর মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হওয়া প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব।
রুশ বিপ্লব দুনিয়ার সামনে একটি নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আসে, তা হলো শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষরা, যারা পিছিয়ে পড়া, তারা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে পারে এবং এটি দুনিয়ার দেশে দেশে মানুষের মুক্তির সংগ্রামে পথ নির্দেশক হিসেবে এসে যায়। এইভাবে সারা পৃথিবীতে তখন রুশ বিপ্লবের প্রভাব পড়তে থাকে। ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’- এই শ্লোগানকে সামনে রেখে তখন দেশে দেশে শ্রমিকরা এই বিপ্লবের জন্য কাজ করতে শুরু করে। কিন্তু বিপ্লবী আন্দোলনের পাশাপাশি, সমস্ত বিষয়কে মোকাবেলা করার জন্যবিপ্লবীদের যে জ্ঞান দরকার, তার অভাবের সুযোগে বিপ্লববিরোধী শক্তি এর অভ্যন্তরে কাজ করতে থাকে। এটি হলো সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক শক্তি। এরা বুর্জোয়া শ্রেণি ও সর্বহারাদের মধ্যে আপোসকামী শক্তি। এরা নিজেদের সর্বহারা বলে পরিচয় দেয়, বাস্তবে বুর্জোয়াদের পক্ষেই কাজ করতে থাকে। শ্রমিকদের সুসংগঠিত আন্দোলনের মধ্যে তারা বিভ্রান্তি ও বিভ্রম নিয়ে আসে। সকল দেশেই এই সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক রাজনীতিকে উন্মোচিত করতে করতেই সেই দেশের বুকে বিপ্লবী রাজনীতি মূর্তরূপে প্রকাশিত হয়। একাজটি লেনিন রুশদেশে করেছিলেন।
লেনিনের এই শিক্ষার ভিত্তিতেই রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয় এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজের উন্নতি ও সমৃদ্ধি হতে থাকে। মহান লেনিনের মৃত্যুর পর সমাজতান্ত্রিক সমাজ লেনিনের শিক্ষা অনুসরণ করে বেশ খানিকটা সমাজতান্ত্রিক উন্নতির পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হয়। জার্মানি ও ইতালিতে উগ্র জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হয়। সে সময় জার্মানি ও ইতালি দুটোই সাম্রাজ্যবাদী দেশ। দুই দেশেরই বাজার দখল করার দরকার। কিন্তু তার কোনো বাস্তবতা তখন ছিলনা। কারণ ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সÑএ তিন দেশ তখন গোটা বিশ্বের উপর প্রভাববিস্তার করে ছিল। তারা বিশ্বের যে কোনো দেশে হস্তক্ষেপ করত, কর্তৃত্ব করত, কলোনি বানিয়ে শোষণ করত। তখন জার্মানি ও ইতালির বড় কোনো কলোনি ছিলনা। ফলে তাদের ছিল তীব্র বাজার সংকট। তাদের দেশে গড়ে ওঠা একচেটিয়া পুঁজিপতিদের পুঁজি খাটানোর আর কোনো জায়গা ছিলনা। তাই বাজার দখল ছাড়া যখন তার বেঁচে থাকার আর কোনো উপায় নেই, তখন সে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ আক্রমণ করতে লাগল। নিজ নিজ দেশের জনগণের মধ্যে জাতীয় অপমান-অবমাননাবোধ কাজে লাগিয়ে অন্য রাষ্ট্রের উপরে আধিপত্যবাদী মনোভাব তাদের মধ্যে গড়ে তুলল। এই রাষ্ট্রসমূহের পরিচালকরা মানুষকে তাদের পেছনে জড়ো করার জন্য বিজ্ঞানের কারিগরি দিকটাকে গ্রহণ করল, কিন্তু জনগণের চিন্তাকে পুরনো ধর্মীয় কুসংস্কার-কূপমণ্ডকতায় আচ্ছন্ন করে রাখল। উগ্র জাত্যাভিমান গড়ে তুলে এক দেশের জনগণকে অন্য দেশের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লাগিয়ে দিল।
সোভিয়েত ইউনিয়ন জন্মের পর ছিল একা। তাই তখন আন্তর্জাতিক ঘটনাসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি সেঅর্জন না করতে পারলেও প্রতিবাদ করার শক্তি হিসেবে সে আবির্ভূত হয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালেই দুনিয়ার দেশে দেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে উঠছিল এবং তা ক্রমশই পরিণতির দিকে যাচ্ছিল।ভিয়েতনাম ও কোরিয়ায় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই চলছিল। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে চলছিল ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াই। এমন সময়ে জার্মানি যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে, তখন সোভিয়েত তার সমস্ত শক্তি দিয়ে বিরাট শিল্পোন্নত দেশ জার্মানিকে পিছু হটতে বাধ্য করে এবং এক সময় পরাজিত করে রাইখস্ট্যাগে লাল পতাকা উত্তোলন করে। যুদ্ধ পরবর্তীকালে চীন বিপ্লব সংগঠিত হয়। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো, যেগুলো প্রথম আক্রমণেই জার্মানির কর্তৃত্বে চলে এসেছিল, সেগুলোতে কমিউনিস্ট ও দেশপ্রেমিক জনতার ঐক্য শেষ পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে পরিণতি পায়। তখন রাশিয়া, চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, পূর্ব ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ- এই মিলে সমাজতান্ত্রিক শিবির গড়ে ওঠে। এই সময়ে মানব সভ্যতাকে রক্ষা করার এক বিরাট শক্তিকে মানুষ দেখল- যার প্রকাশ ঘটিয়েছিল রাশিয়া।আর তখন বিশ্বে সে একা নয়, একটা সমাজতান্ত্রিক শিবির সে গড়ে তুলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন যে কোনো দেশের উপর যখন ইচ্ছা হস্তক্ষেপ করতে পারত, সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অভ্যুত্থানের পর তা আর সম্ভব হলোনা। নভেম্বর বিপ্লবের পথেই এই অভ্যুত্থান ঘটে।
আরেকটি ব্যাপার সে সময় ঘটেছিল।সারা বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদীদের শাসিত উপনিবেশসমূহে জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম শুরু হলো। যেহেতু সমাজতান্ত্রিক শিবিরের উপস্থিতির কারণে চাইলেই সাম্রাজ্যবাদীরা এসব দেশে আগের মতো অত্যাচার-হত্যা-গণহত্যা চালিয়ে আন্দোলন দমন করতে পারেনা, তখন ঔপনিবেশিক দেশসমূহ তাদের শক্তিতেই একে একে মুক্ত হওয়া শুরু করল। এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের জোয়ার সৃষ্টি হলো। এ কারণে রুশ বিপ্লব শোষিত মানুষের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনা।
সেসময় একদিকে সমাজতান্ত্রিক শিবির সারা পৃথিবীর শোষিত-নিষ্পেষিত-পরাধীন মানুষের মুক্তির কাণ্ডারী, সারা দুনিয়ার মানুষের সামনে সে সাম্যের স্বপ্ন জাগিয়ে তুলেছিল, আবার একই সময়ে শোধনবাদী চিন্তা কমিউনিস্ট আন্দোলনের অভ্যন্তরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। লেনিন এ সম্পর্কে কিছু হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। স্ট্যালিনও তাঁর জীবদ্দশায় শেষ কংগ্রেসে এই সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু এগুলো ছিল ইঙ্গিত। এ সম্পর্কে সবচেয়ে সঠিক ও কার্যকরীভাবে বলেছেন এ যুগের অন্যতম মার্কসবাদী দার্শনিক ও চিন্তানায়ক, ভারতের এসইউসিআই(কমিউনিস্ট) পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কমরেড শিবদাস ঘোষ। ১৯৪৮ সালেই তিনি বলেছিলেন, সাম্যবাদী শিবিরআন্তর্জাতিক নানা বিষয়ের উপর প্রভাব বিস্তার করছে ঠিক; কিন্তু ভেতরে তাদের যে ঐক্য, যে সংহতি থাকা দরকার তা নেই; সমষ্টির স্বার্থের সাথে ব্যক্তি স্বার্থের যে বিরোধীতাকে কীভাবে মীমাংসার দিকে নিয়ে যাবে, কোন নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে নিয়ে যাবে- এসব প্রশ্নে তাদের বিভ্রান্তি আছে। কমরেড শিবদাস ঘোষ বিশেষভাবে, কার্যকরীরূপে, কী ধরনের সমস্যার জন্য এরকম হচ্ছে- সেটা চিরে চিরে দেখিয়েছিলেন। এমনকি স্ট্যালিন জীবিত থাকাকালেও কমিউনিস্ট আন্দোলনে কী ধরনের দুর্বলতার সৃষ্টি হচ্ছে, সেটাওতিনি দেখিয়েছেন। ‘সাম্যবাদী শিবিরের আত্মসমালোচনা’ প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছেন, দুনিয়ার কমিউনিস্ট আন্দোলন যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এখন আর আগের মতো সাম্রাজ্যবাদীরা যাকে ইচ্ছা তাকে আক্রমণ করতে পারেনা। কিন্তু কমিউনিস্টদের উন্নততর চেতনা, মূল্যবোধ ও মার্কসবাদী রাজনীতি আরও সঠিকভাবে ধারণ করার ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণতা আছে। এগুলি বিপদ হিসেবে সামনের সময়ে আসবে। আর বাস্তব ইতিহাস হলো এই যে, সেই ত্রুটিগুলি না শোধরানোর কারণে একসময়ে দৃষ্টান্তমূলক শক্তি হিসেবে মানব সমাজের সামনে বহুরকম কার্য সম্পাদনকারী সমাজতান্ত্রিক শিবিরের একসময় পতন ঘটল।
কমরেড শিবদাস ঘোষ কমিউনিস্ট পার্টিসমূহের মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের পরিবর্তে যান্ত্রিক সম্পর্কের যে প্রভাব, তার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। সেটি অনুধাবন করার ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টিসমূহের মধ্যে যে অভিজ্ঞতার পার্থক্য আছে, সেটাকে কেন্দ্র করে তাদের পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্বে উপনীত হতে হয়, ঐক্যে পৌঁছাতে হয়- তৎকালীন সময়ে তা ঘটেনি। ফলে পার্টিসমূহের মধ্যে যান্ত্রিক সম্পর্ক বিরাজমান ছিল। এই যান্ত্রিক সম্পর্ক, আদর্শগত ক্ষেত্রে অনুন্নত অবস্থা তৈরি করে। কারণ এক সময়ের বড় আদর্শও যদি ক্রমাগত বিকশিত না করা হয়, তবে অন্য এক সময় সে হয়ে পড়ে অকার্যকরী। কমিউনিস্ট দলগুলোর নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সমন্বয়েরমাধ্যমে আদর্শগত উন্নয়নের এ প্রক্রিয়াটি তখন কার্যকরী ছিল না।
আবার সমস্ত বিশ্বেই ব্যক্তিবাদ তখন চূড়ান্ত রূপ নিচ্ছিল, তার প্রভাব সমাজতান্ত্রিক সমাজেও এসে পড়েছিল। সমাজতান্ত্রিক সমাজের মধ্যে ব্যক্তিস্বার্থ ও সামাজিক স্বার্থের যে দ্বন্দ্ব, সেটির বাস্তবিক সমাধান কীভাবে হবেÑকমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্ব সে সম্পর্কিত কোনো পরিচ্ছন্ন ও সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারলেন না। কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন, সমাজতন্ত্র বাস্তবে এমন একটা ব্যবস্থা নিয়ে এসেছে যেটি সমষ্টিগত স্বার্থঅধিকার প্রতিষ্ঠার সামাজিক ব্যবস্থা। মানুষের ব্যক্তিগতভাবে চাইবার যে অধিকারবোধ, সেটা বুর্জোয়া সমাজ থেকে পাওয়া। সমাজতন্ত্রে সে অধিকারের প্রশ্ন নেই। কারণ শ্রমজীবী মানুষই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মালিক। তাদের যদি কোনো অভাব থাকে, তবে প্রত্যেকেই ব্যক্তিগতভাবে দক্ষতা-যোগ্যতা অর্জন করে সেই অভাব দূর করার সংগ্রাম করবে, ব্যক্তিগতভাবে কিছু চেয়ে সমাজের সাথে বিরোধ করার কোনো ব্যাপার নেই, কারণ তার কোনো ভিত্তিই সে সমাজে নেই। পুঁজিবাদী সমাজে যেমন পুঁজিপতি শ্রেণি বেশিরভাগ মানুষকে ঠকিয়ে সমস্ত অধিকার একাই ভোগ করে, তার বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির ব্যক্তিগত অধিকারের দাবি তুলতে হয়, তার কোনো অস্তিত্বই সমাজতান্ত্রিক সমাজে নেই। পুঁজিবাদী সমাজের বঞ্চনার কোনো ভিত্তিই সমাজতান্ত্রিক সমাজে বিরাজ করেনা। ফলে সেখানে রাষ্ট্রের সাথে ব্যক্তির অধিকার নিয়ে কোনো লড়াই থাকতে পারেনা।
সমাজতন্ত্রে প্রত্যেক মানুষের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ এবং তার ভিত্তিতে পারিশ্রমিক দেওয়া- সেটা হয়েছিল। কিন্তু ব্যক্তির চাহিদা অনুযায়ী সমাজের দিতে না পারার যে সীমাবদ্ধতা- সেটা সমাজতান্ত্রিক সমাজের সৃষ্টি নয়, সেই অভাব সে অতীত সমাজ থেকে নিয়ে এসেছে। কারণ সামাজিক মালিকানার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এ ব্যবস্থায় সামাজিক কোনো বাধা নেই ব্যক্তিগত অধিকারের। শুধু ব্যক্তি যা চায়, তা দেওয়ার মতো সক্ষমতা সামাজিকভাবে তৈরি হয়নি- এই পার্থক্য। তাই ব্যক্তির প্রয়োজনমতো সমাজের দেওয়ার যে ক্ষমতা- যৌথভাবে, ক্রমাগত সংগ্রাম করতে করতেই তা অর্জিত হতে পারে।এই অভাব যখন সামাজিকভাবে দূর হবে, তখন ব্যক্তিগতভাবেও ব্যক্তি সে অভাব থেকে মুক্ত হবে। আবার এ কথাও ঠিক যে, যতক্ষণ পর্যন্ত পার্থক্যসমূহ থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ব্যক্তিসত্তা ও সামাজিক স্বার্থের মধ্যে দ্বন্দ্বও থাকবে। এ দ্বন্দ্বের মীমাংসা কীভাবে হবে? মানুষের ন্যায়-নীতি, মূল্যবোধ, সংস্কৃতির উচ্চতর সংগ্রাম- এর মধ্য দিয়ে তাদের চেতনাকে এমন উন্নত স্তরে তুলতে হবে যাতে সে বুঝতে পারে, ব্যক্তিগতভাবে যতটুকু অভাব তার আছে তা দেওয়ার ক্ষমতা সমাজের যে নেই, সেটা কোনো বিপরীত শ্রেণির শোষণের জন্য নয়। সেজন্য প্রতিটি মানুষকে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করতে হবে। যোগ্যতা অনুযায়ী সে সমাজের কাছ থেকে পাবে। আর নৈতিকভাবে সে সামাজিক স্বার্থের সাথে অভিন্ন হওয়ার সংগ্রামে যুক্ত থাকবে। এইভাবে বৈষয়িকভাবে সমাজের যে দেওয়ার ক্ষমতা, সেটা ক্রমাগত বিকশিত হতে হতে মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী দেওয়ার ক্ষমতা সে অর্জন করবে। আবার মানুষের মননশীলতাও সেই স্তরে উন্নীত হবে যে, সে বুঝতে পারবে, সামাজিক স্বার্থের ব্যক্তিস্বার্থকে একীভূত করার মধ্য দিয়েই ব্যক্তির মুক্তি সম্ভব। কিন্তু তখনকার সময়ে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের নেতৃত্বে থাকা সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দ তা বুঝতে পারলেন না। এই দ্বন্দ্বের প্রকৃতিই তারা ধরতে পারলেন না। তখন যেভাবেই হোক উৎপাদন বাড়াবার ঝোঁকে তারা শ্রমিকদের ইনসেনটিভ দেওয়া শুরু করলেন। পুঁজিবাদী অর্থনীতির এই বিপজ্জনক জিনিসকে ক্রুশ্চেভ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মধ্যে নিয়ে এলেন।
স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর ক্রুশ্চেভ সোভিয়েতের নেতৃত্বে এলেন। তিনি এসেই ব্যক্তিপূজার বিরুদ্ধে লড়াই করার নামে ব্যক্তি স্ট্যালিনকে কালিমালিপ্ত করা শুরু করলেন।স্ট্যালিন এমন একটি নাম, যে নামের সাথে সমাজতন্ত্রের এক মহিমাময় যুগের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগে লেনিনের চিন্তার যে কার্যকারিতা, তার সবচেয়ে উন্নত উপলব্ধি ছিল স্ট্যালিনের মধ্যে। স্ট্যালিনের নেতৃত্বকে কেন্দ্র করেই দেশে দেশে বিপ্লবী আন্দোলনগুলো গড়ে উঠেছিল।তার মর্মে আঘাত করে স্ট্যালিনকে কালিমালিপ্ত করার মধ্য দিয়ে তারা লেনিনবাদের প্রকৃত উপলব্ধিরই গণ্ডগোল করে দিলেন। ব্যক্তিপূজার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে অথরিটিকেই অস্বীকার করে বসলেন এবং সংশোধনবাদ প্রবেশ করার দ্বার উন্মোচন করে দিলেন। স্ট্যালিনের বিরাট ভূমিকা সারা বিশ্বের বিপ্লবী সংগ্রামকে যেমন উদ্বুদ্ধ করছিল, তেমনি অন্ধতাও তার মধ্যে জড়িয়ে ছিল। অর্থাৎ তাঁকে মানার মধ্যেই এক ধরনের অন্ধতা ছিল, সেটা তাঁর জীবিতকালেই ঘটেছিল, যেটি তাঁর বিরাট ঐতিহাসিক ভূমিকাকে ঠিক ঠিকভাবে বোঝার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করে। বিপ্লবী সংগ্রামে লেনিনের চিন্তাকে স্ট্যালিন যেভাবে ধারণ করতেন, তার পারসনিফিকেশন তিনি যেভাবে ঘটিয়েছিলেন, স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর তা ধসে পড়ল। এর মানেই হলো স্ট্যালিন যেভাবে লেনিনকে ধারণ করতেন, যৌথভাবে তা ধারণ করার মতো সংগ্রাম দলের অভ্যন্তরে হয়নি। সে সংগ্রাম অনেকখানি দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। চিন্তার এই অনুন্নত মানকে কেন্দ্র করে ক্রুশ্চেভের মতো টেকনোক্র্যাট, বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ লোক নেতৃত্বে এসে গেলেন। স্ট্যালিন যে নিজে ব্যক্তিগতভাবে সমাজতান্ত্রিক সমাজের সাথে অভিন্ন ছিলেন, ব্যক্তি স্ট্যালিন ও সমাজতান্ত্রিক সমাজের মধ্যে যে কোনো ফাঁক ছিলনা, এটি তখনও তত্ত্বগতভাবে আসেনি। অর্থাৎ কমরেড শিবদাস ঘোষ যেভাবে যৌথ নেতৃত্বের বিশেষীকৃত রূপ হিসেবে ব্যক্তি নেতৃত্বের আবির্ভাবের কথা বলেছেন, সেভাবে বিষয়টি আসেনি। সে কারণে স্ট্যালিনকে তারা মেনেছে অন্ধভাবে, বাতিল করেছেও অন্ধভাবে। এ পুরো কাজটিই হলো ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বে। একদিকে দলের মধ্যে যান্ত্রিক চিন্তার প্রভাব, অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদকে মোকাবেলা করার জন্য বিরাট আত্মত্যাগ, অনেক নেতা-কর্মীর মৃত্যুÑএই সুযোগে ক্রুশ্চেভ পার্টির নেতৃত্বে চলে এলেন। ক্রুশ্চেভ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে স্ট্যালিনকে কালিমালিপ্ত করার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে স্ট্যালিনের অথরিটিকেই ধ্বংস করে দিলেন।
এই প্রক্রিয়ায় সংশোধনবাদ সোভিয়েতের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করল। এই মহাশক্তিকে সাম্রাজ্যবাদীরা আক্রমণ করে হারাতে পারেনি। ভেতরের দুর্বলতার কারণে তার পতন ঘটল। কেউ কেউ বলবেন হেরে গেল। হেরে যায়নি, ভেতরের দুর্বলতার কারণে পর্যুদস্ত হয়েছিল। বিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রই বুঝতে পারবেন, যে সমাজ মানুষের সামনে এগোবার ইতিহাস রচনাকারী, একেবারে নতুন সমাজব্যবস্থা হিসেবে যেহেতু সেটি দুনিয়ায় এসেছিল, তাকে ধারণ করার অভিজ্ঞতাজনিত ঘাটতির জন্য সে টিকে থাকতে পারল না। এভাবে সভ্যতার প্রতি ক্ষেত্রে নানারকম সংকট কাটিয়ে কাটিয়েই একটি নতুন সমাজব্যবস্থা স্থাপিত হয়। এটিই সমাজ বিকাশের প্রক্রিয়া। অনেক ক্ষেত্রে সামনে এগোবার রাস্তায় প্রবল বাধা থাকে। তখন মানুষ এক পা পিছিয়ে আবার এগোতে থাকে। তাই পিছানোটা বড় সমস্যা নয়। বিচার করে দেখতে হবে বিকাশের পথে সমাজতন্ত্র অনিবার্য কিনা। সমাজের একস্তর থেকে অপর স্তরে উন্নীত হওয়ার নিয়ম আছে। সেটি মানুষের চিন্তানিরপেক্ষভাবে অবস্থান করে। বস্তুজগতের (সে প্রাণীর বিকাশই হোক কিংবা সমাজের) বিকাশের ধারাবাহিকতায়মানুষের চেতনার ভূমিকা এই যে, চেতনা বস্তুর বিকাশের সেই নিয়মের উপর ক্রিয়া করে তাকে ত্বরান্বিত করে, কিন্তু মানুষের চেতনার উপর নির্ভর করে বস্তুজগৎ বিকশিত হয়না। বিকশিত হয় তার নিজস্ব নিয়মের দ্বারা।ফলে সমাজ বিকাশের অনিবার্য নিয়মে সমাজতন্ত্র আসতেই হবে। দেশে দেশে গড়ে ওঠা শ্রেণি সচেতন বিপ্লবী সংগ্রামের মধ্য দিয়েই সে পরিণতি পাবে।

আজকের যুগে অর্থাৎ লেনিন বর্ণিত সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের এ যুগে বিশ্বপুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার সংকট আগের চেয়ে আরও ব্যাপক,ভয়াবহ ও জটিল রূপ ধারণ করেছে।
১৯১৬ সালে সর্বহারার মহান নেতা কমরেড লেনিন তাঁর ‘সাম্রাজ্যবাদ- পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর’ বইটিতে দেখিয়েছিলেন, পুঁজিবাদের ঊষালগ্নের অবাধ প্রতিযোগিতার যুগ আর নেই। উন্নত পুঁজিবাদী দেশসমূহে মুষ্টিমেয় কিছু পুঁজিপতি কাঁচামাল ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বৃহৎ অংশ নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে একচেটিয়া পুঁজিপতিতে পরিণত হয়েছে।এই একচেটিয়া পুঁজিপতিরা শিল্প পুঁজি ও ব্যাংক পুঁজিরমিলন ঘটিয়ে লগ্নি পুঁজির জন্ম দিয়েছে ও তা তুলনামূলক সস্তা শ্রমের দেশগুলোতে খাটাচ্ছে। এভাবে পুঁজি রপ্তানি করে অন্য দেশের সস্তা শ্রম ও কাঁচামাল শোষণ করার এই চরিত্রটি ছিল পুঁজিবাদের পূর্বতন বৈশিষ্ট্য থেকে নতুন এবং লেনিন এর নাম দিয়েছেন সাম্রাজ্যবাদ। লেনিন বলেছিলেন, এই সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর।এরপর পুঁজিবাদের বিকশিত হওয়ার আর কোনো উপায় নেই।এই সাম্রাজ্যবাদীরা বাজার সংকটে পড়ে বাজার দখলের জন্যই দুই দুইটা বিশ্বযুদ্ধের জন্ম দিয়েছে, কোটি কোটি মানুষকে হত্যা করেছে। কারণ এই প্রক্রিয়ায়ই পুঁজিবাদকে টিকে থাকতে হবে, এ ছাড়া তার আর কোনো পথ নেই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে কমরেড লেনিন বলেছিলেন,

The war of 1914-18 was imperialist (that is, an annexationist, predatory, war of plunder) on the part of both sides; it was a war for the division of the world, for the partition and repartition of colonies and spheres of influence of finance capital. (Imperialism: The highest stage of capitalism)

আজকের এই সময়ে সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগবৈশিষ্ট্য এক থাকা সত্ত্বেও তার মাত্রা আজ একই রকম নেই। লেনিনের সময় থেকে তার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। সংকট আরও প্রকট হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত সব রকম সংকট সত্ত্বেও পুঁজিবাদের যে আপেক্ষিক স্থায়িত্ব ছিল, তা আজ আর নেই। সে এখন প্রতি মুহূর্তে সংকটে পড়ছে, তা থেকে বাঁচার জন্য সে যে রাস্তা বেছে নিচ্ছে, তা তাকে আরও গভীর সংকটে নিমজ্জিত করছে। এককথায় পুঁজিবাদের সংকট আজ এবেলা-ওবেলার সংকটে পরিণত হয়েছে।
সংকট থেকে বাঁচার জন্য পুঁজিবাদ দেশে দেশে অর্থনীতির সামরিকীকরণ ঘটাচ্ছে।অর্থাৎ সমস্তশিল্প যখন মন্দায় ডুবছে, তখন ব্যাপক পরিমাণে সামরিক শিল্পের প্রসার ঘটাচ্ছে।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের এই প্রবণতাটি ব্যাখ্যা করে কমরেড শিবদাস ঘোষ বলেছেন,“শিল্পের সামরিকীকরণ বলতে বোঝায়, সরকার যেখানে নিজেই অর্ডার দেয়, আবার সেই মাল সরকার নিজেই কেনে। উৎপাদিত মাল বিক্রির জন্য বাজারের উপর, অর্থাৎ সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার উপর নির্ভর করতে হয়না। শুধু সামরিক খাতে সরকারের বাজেট বাড়তে থাকে। ফলে, মন্দা- অর্থাৎ, যাকে আমরা বলি বাজার নেই, কাজকর্ম নেই, অর্ডার নেই – এই সমস্যার হাত থেকে সাময়িকভাবে হলেও শিল্পগুলো বাঁচে। অবস্থাটা দাঁড়ায় এইরকম যে, সরকার নিজেই ‘প্লেন’ তৈরি করার, ‘ফাইটার’ তৈরি করার এবং নানা সামরিক সরঞ্জাম তৈরি করার অর্ডার দেয়, আবার এই তৈরি মালগুলো সরকারই কেনে। ফলে, বাজারের উপর বা লোকের ক্রয়ক্ষমতার উপর নির্ভর করতে হয়না বলে সাময়িকভাবে ‘রিসেশন’ বা বাজার-মন্দার চাপ থেকে অর্থনীতিকে কিছুটা পরিমাণে রক্ষা করা সম্ভব হয়। কিন্তু, এই পরিকল্পনার আবার একটা কনট্রাডিকশন বা উল্টোদিক আছে। তা হলো এই যে, যত মাল বা অস্ত্রশস্ত্র তৈরি হতে থাকবে- সেগুলি যদি বসে থাকে, অর্থাৎ সেগুলি যদি খালাস করা না যায়, তাহলে মাল ক্রমাগত জমতে থাকার ফলে অর্থনীতিতে বন্ধ্যাত্বের ঝোঁকের (টেন্ডেন্সি অব স্ট্যাগনেশন) জন্ম হবে এবং এর ফলে সামরিক শিল্পেও আবার লালবাতি জ্বলতে শুরু করবে। অথচ সরকার বিনা প্রয়োজনে এই মালগুলো কিনে গুদামজাত করতে পারেনা। কাজেই এই মাল খালাস করার প্রয়োজনেই তাদের চাই স্থানীয় ও আংশিক যুদ্ধ।”
তাই আজ দেখা যায়, অর্থনীতির সামরিকীকরণইসকল বড় বড় পুঁজিবাদী দেশের বেঁচে থাকার একমাত্র পথ। আমেরিকার দিকে তাকিয়ে দেখুন, আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে বড় পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশ। বিশ্বের মোট জিডিপির ২২ শতাংশের যোগানদাতা হলো আমেরিকা। কিন্তু এ দিয়ে আমেরিকার অর্থনীতিকে বোঝা যাবেনা। ঐ বিশাল অর্থনীতি আজ কাঁপছে। আমেরিকার অর্থনীতির আকার ১৭.৮৪১ ট্রিলিয়ন ডলার। আর তার ঋণের পরিমাণ ১৮.১ ট্রিলিয়ন ডলার। আজ আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত জাতি। অথচ সে বাহ্যিকভাবে মহাশক্তি নিয়ে আছে। সেটি অস্ত্র উৎপাদনের মধ্য দিয়ে গায়ের জোরে অন্য দেশের উপর হামলা করে।বাস্তবে তার গোটা অর্থনীতিই যুদ্ধ অর্থনীতির উপর দাঁড়িয়ে আছে। সে চোরাবালির উপর দাঁড়ানো। যে কোনো সময় ধ্বসে পড়ল বলে।
আমেরিকার ১৬টির বেশি গোয়েন্দা সংস্থা আছে দেশে-বিদেশে গোয়েন্দা তৎপরতা চালানোর জন্য। যেখানে এক লক্ষ সাত হাজারেরও বেশি লোক কাজ করে। সম্প্রতি কাউন্টার টেরোরিজম সিস্টেমে নতুন করে দশ হাজার লোক নেওয়া হয়েছে। এরা হলো আর্মি ও ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির বাইরের লোক। আর্মি ও ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সিতে দশ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান হয়। এগুলো হলো গোটা ডিফেন্স সিস্টেমে সরাসরি যুক্তদের একটি গড় হিসাব। তাও যে সকল তথ্য প্রকাশিত, সেগুলো অনুসারে। এর সাথে যুক্ত হবে এই বিরাট অস্ত্র উৎপাদনের সাথে সহযোগী শিল্প ও ব্যবসাসমূহ। সেখানে যুক্ত আরও লক্ষ লক্ষ লোক। ডিফেন্স বাজেট কমানোর কথা কংগ্রেসে এক সদস্য বলেছিলেন, কয়েকজন তাকে সমর্থনও করেছিলেন। অস্ত্র কোম্পানির মালিকেরা তাতেই চোখ রাঙিয়ে বললেন, তাহলে আমেরিকায় এক ধাক্কায় মিলিয়ন মিলিয়ন লোক বেকার হয়ে যাবে। এই হলো আমেরিকার শিল্পোন্নতির নমুনা।
আমরা আগেই বলেছি, অস্ত্র উৎপাদন চালু রাখতে হলে তাকে খালাসও করতে হবে। এর জন্য যুদ্ধের প্রয়োজন। আজ আমেরিকা সারা বিশ্বে আংশিক ও খণ্ড যুদ্ধ চালু রেখেছে। আমেরিকা যে সারা দুনিয়া ঘুরে সবার ভালো করতে চায়, সবার স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য সে যে ছটফট করে, ছুটে যায়Ñতার আসল রহস্য এখানে। তার অস্ত্র খালাসের প্রয়োজনে সে এর খবর তাকে বলে, ওর খবর একে দেয়, খবর তৈরি করে, খবর বিক্রি করে,এর বিরুদ্ধে তাকে লাগায়। অর্থাৎ যুদ্ধ বা সংঘর্ষ না থাকলে তার অর্থনীতি চোখ বুজবে।
তাই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য যার বিরুদ্ধে সে যুদ্ধ করে, তাকেই আবার অস্ত্র সরবরাহ করে। অর্থাৎ এ যুদ্ধ জয়ের জন্য নয়। বিজয়ী হলে যুদ্ধ থেমে যাবে। তাই জয় দরকার নেই, যুদ্ধ দরকার। আইএস-এর ক্ষেত্রে তাই হয়েছে।আবার রাশিয়া আইএস ঘাঁটিতেটানা হামলামৌলবাদের হাত থেকে মানবতা রক্ষার জন্য করেনি। একদিকে আসাদের পতন ঘটলে ও সিরিয়ায় মার্কিন আধিপত্য তৈরি হলে রাশিয়ার জন্য ভীষণ সমস্যা, আবার তার অস্ত্রও খালাস হওয়া দরকার। আমেরিকার পরে সে বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র ব্যবসায়ী দেশ। আমেরিকা বিশ্বের অস্ত্র রপ্তানির ৩১ শতাংশের যোগানদাতা, রাশিয়া ২৭ শতাংশের।তাই তারও যুদ্ধ দরকার।
গোটা দুনিয়ায় যখন যাকে দরকার তাকেই আক্রমণ করছে আমেরিকা ও ন্যাটো জোট, যেখানে আছে বড় বড় পুুঁজিবাদী দেশসমূহ। তার জন্য কোনো কারণ দেখানোর দরকার নেই। পত্রিকায় একটা কিছু বললেই হলো। তার ঠিক-বেঠিকেরও ব্যাপার নেই। ভুল অভিযোগ তুলে ইরাক আক্রমণ করে গোটা ইরাককে তছনছ করে দেওয়া হলো। আজ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার স্বীকার করছেন, সেটি ভুল ছিল। তাহলে কেন আক্রমণ করা হলো? কারণ আক্রমণ না হলে, যুদ্ধ না হলে তাদের অর্থনীতি বাঁচবেনা।. . .

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments