শিক্ষাকে বিবেচনা করা হয় একটি দেশের মেরুদ- হিসেবে। শিক্ষার্থীরা ভালো পড়াশুনা করবে, তার ফলশ্রুতিতে তারা ভালো ফল করবে এটা আমাদের সকলেরই চাওয়া। কিন্তু বিগত প্রায় এক দশক ধরে আমাদের দেশের পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে পাসের হার এতটাই দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে, বিষয়টি আশার চেয়ে সন্দেহেরই উদ্র্রেক করেছে বেশি। বিশেষত ক্লাসরুমের সংকট, শিক্ষক সংকট তদুপরি তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ঘাটতি, অবকাঠামোগত দুর্বলতা প্রভৃতি যখন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে ফি-বছর পাসের হারের এরকম উল্লম্ফন কোন্ যাদু বলে সম্ভব হচ্ছে সে প্রশ্ন মনে না আসাটাই বরং অস্বাভাবিক।
অথচ শিক্ষামন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের কোন মহলই এটিকে আমলে নিচ্ছেন না। তাদের মতে এটি স্রেফ শিক্ষাখাতে সরকার যে ‘বিপ্লবাত্মক’ উন্নয়ন ঘটিয়েছে তার বিরুদ্ধে সরকারবিরোধীদের ষড়যন্ত্র! এই ‘উন্নয়নের’ ধারাবাহিকতা সর্বশেষ এইচ.এস.সি পরীক্ষাতেও অব্যাহত থাকল। যাতে পাসের হার শতকরা ৭৮ জনেরও বেশি, আর সর্বোচ্চ জিপিএ- জিপিএ ৫ পেয়েছে ৭০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী।
কিন্তু চোখ বন্ধ করলে কি আর প্রলয় বন্ধ থাকে? যথারীতি শিক্ষাখাতেও থাকেনি। এই গগনচুম্বী পাসের হার আর সর্বোচ্চ জিপিএ এর বাহুল্যের অসারতা ধরা পড়ে যায় যখন এই একই শিক্ষার্থীরা তাদের উচ্চতর শিক্ষালাভের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যাচ্ছে এ বছর ক,খ,গ ও ঘ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় পাসের হার যথাক্রমে শতকরা ২১.৫, ৯.৫৫, ২০.৬১ ও ১৬.৫৫ ভাগ! মানে সরকারি হিসেবে যেখানে শতকরা ৭৮ ভাগ কৃতকার্য তাদের অন্তত ৭৮.৫ ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্যতা তো পরের বিষয় তাতে পাস নম্বর তোলারও যোগ্যতা রাখে না।
এতো গেল সাধারণ ভাবে পাস করা শিক্ষার্থীদের চিত্র। আর জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করছে যারা তাদের অবস্থা কি? সেটা বোঝা যাবে আরেকটি পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে। এবার বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সর্বোচ্চ জিপিএ নিয়ে পাস করেছে ২৭,৮৭৩ জন (যার মধ্যে ১৯,৭৮১জন ঢাকার), আর ঢাবির বিজ্ঞান অনুষদের ভর্তি পরীক্ষায় সব মিলিয়ে পাস করেছে ১৬,৪৮০ জন! মানে সাধারণ ভাবে পাস করা ছাত্ররা তো বটেই এমনকি বর্তমান ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থীদের বিরাট একটা অংশ ওই অকৃতকার্য ছাত্রদের তালিকাভুক্ত। বলা বাহুল্য অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রেও একই রকম চিত্র লক্ষ্য করা গেছে।
সরকারী মহলসহ অনেকে এই বিপর্যয়কে একটি বিছিন্ন ঘটনা হিসেবে উপস্থিত করতে চাইছেন। আবার অনেকে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন পদ্ধতি নিয়েও কথা বলছেন। কেউ আবার এককভাবে দায়ী করছেন এইচএসসি পরীক্ষার সময়ে নজিরবিহীন ভাবে প্রশ্নপত্রফাঁসের ঘটনাকে। কেউ আবার বলছেন সময় কম পাওয়ার কথা। ক্যালকুলেটর ব্যবহার করতে না দেয়ার কথাও বলছেন অনেকে, যদিও সকল অনুষদের ক্ষেত্রে ক্যালকুলেটরের প্রয়োজনীয়তা আগেও ছিল না।
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের বিগত বছরগুলোর ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলের দিকে মনোনিবেশ করা দরকার। সারণী-১ এ ২০০৮-০৯ সাল থেকে ২০১৪-১৫ সালে ঢাবির ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল সন্নিবেশিত হয়েছে।
এবারের লাগাতার প্রশ্নপত্রফাঁস আমাদের গোটা শিক্ষা-কাঠামোর অন্তঃসারশুন্যতাকে একেবারে নগ্নভাবে উন্মোচিত করেছে। কিন্তু তা বলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা যে শুধু কাঠামোগত ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয় তা এই চিত্রটি দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যায়। তাই শুধু প্রশ্নপত্রফাঁসের কারণেই ফলাফলে এমন বিপর্যয় এসেছে এভাবে ভাবলে শিক্ষার মানের যে ক্রমাবনতি তাকে অগ্রাহ্য করা হয়। মূল ঘটনা হলো, শিক্ষাখাতে নিজেদের সাফল্য জাহির করতে গিয়ে পাশের হার বৃদ্ধির এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত সরকার। অতীতের সরকারের চেয়ে নিজেদের আমলে পাসের হার আর জিপিএ ৫ কত বাড়ল এবং সেটা কিভাবে প্রতিনিয়ত নিজেই নিজের রেকর্ড ভেঙ্গে এগিয়ে চলছে, সেটা তুলে ধরতে গিয়ে তারা শিক্ষার মানের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করেনি। অবশ্য শিক্ষাখাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ না দিয়ে, শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে রাষ্ট্রীয় ব্যয় সংকোচনের নীতি গ্রহণের মাধ্যমে যেখানে শিক্ষাকে ক্রমান্বয়ে বাণিজ্যিকীকরণের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে সেখানে এই পথ ছাড়া ‘সাফল্য’ আসবেই বা কি করে?
সরকারের এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার ছাপ অবধারিত ভাবেই এসে পড়েছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উপরে। এই প্রতিযোগিতামূলক সমাজে টিকে থাকতে হলে যে কোনো প্রকারে এগিয়ে যেতে হবে! অতএব যে ভাবে পারো ফল ভালো কর! পরীক্ষা মানে এখন কেবল একজন শিক্ষার্থীকে যাচাই করার বিষয়। অথচ এটা একই সাথে এই শিক্ষা ব্যবস্থা ও তার সাথে জড়িত সকলেরই পরীক্ষা, শিক্ষক কতটুকু শেখাতে পারছেন, শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের শিক্ষা অর্জনে কতটুকু ভুমিকা পালন করছে এসবই যাচাই হয় শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার মাধ্যমেইÑসেটা আমরা বেমালুম ভুলতে বসেছি। এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে আমরা হয়ত শতভাগ পাস ঠিক অর্জন করতে পারব কিন্তু, দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে, মনুষ্যত্বসম্পন্ন জ্ঞান-বিবেচনা সম্পন্নœ মানুষ হিসেবে ভবিষ্যত প্রজন্মকে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হব ।
অনুশীলন : অক্টোবর ২০১৪ || সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট