Tuesday, December 24, 2024
Homeসংবাদ ও প্রেস বিজ্ঞপ্তিপার্টি ও সংগঠন সংবাদঅনির্বাচিত সরকার দেশে ফ্যাসিবাদী রাজত্ব কায়েম করেছে — বাম মোর্চা

অনির্বাচিত সরকার দেশে ফ্যাসিবাদী রাজত্ব কায়েম করেছে — বাম মোর্চা

1491529_731105550246707_393208212_o
ফাইল ফটো

৫ই জানুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনের ৪ বছর পূর্তিতে ০৪ জানুয়ারি ২০১৮ বেলা ১২ টায় গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার অস্থায়ী কার্যালয়ে  এক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার বর্তমান সমন্বয়ক গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য আব্দুস সাত্তার, বাসদ (মার্কসবাদী) অন্যতম কেন্দ্রীয় নেতা মানস নন্দী, গণসংহতি আন্দোলনের রাজনৈতিক পরিষদের অন্যতম সদস্য ফিরোজ আহমেদ, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আহবায়ক হামিদুল হক প্রমুখ। নেতৃবৃন্দ বলেন, ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ভোটারবিহীন তথাকথিত নির্বাচন করার মাধ্যমে জোর করে জনগণের ওপর চেপে বসে ক্ষমতা দখল করে । বর্তমানে এই অনির্বাচিত মহাজোট সরকার দেশব্যাপী দুঃশাষণ-শোষণ-লুণ্ঠন এবং চরম নৈরাজ্য কায়েম করেছে যা জনগণের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছে।

নিচে সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য যুক্ত করা হল-

আগামীকাল ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের লুটোরা গণবিরোধী রাজনীতির ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একটি প্রহসনমূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকার দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। এদের মাঝে ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। বাকি আসনগুলোতেও আদতে কোন নির্বাচন হয়নি। ফলে অনির্বাচিত ও প্রতিনিধিত্বহীন এই সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়েও যথেষ্ট ন্যায্য প্রশ্নও উত্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে সঙ্কট ও বৈধতার প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে, তার জের জাতিকে বহুকাল পোহাতে হবে।

৫ জানুয়ারিতে কেন আওয়ামী লীগকে একটি এমন একটি নির্বাচনের নাটক আয়োজন করতে হয়েছিল? কারণ আওয়ামী লীগ তার আগের ৫ বছরে যে দুর্নীতি, লুটপাট, নিপীড়ন ও দুঃশাসনের রাজত্ব কায়েম করেছিল যে, একদিকে সুষ্ঠ একটি নির্বাচনে তার জিতে আসার কোন সম্ভাবনা ছিল না। আরেকদিকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই বাংলাদশে এমন একটি আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম করেছে যেখানে ক্ষমতা হারানো মাত্র সেই নিপীড়নের মুখোমুখি হতে হবে যা তারা অন্যদের ওপর নিজেরা চালিয়েছিল ক্ষমতায় থাকার সময়ে। ফলে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে নিশ্চিতভাবে ক্ষমতা হারাবার ভীতি, আরেকদিকে ক্ষমতা ছাড়া মানে লুটপাটের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়া এবং দমনপীড়নের শিকার হওয়া— বাংলাদেশ শাসক গোষ্ঠী এমন একটি বন্দোবস্ত কায়েম করেছে বলেই ক্ষমতা হন্তান্তর, সুষ্ঠ নির্বাচন আয়োজন, জবাবদিহিতা এই সব কিছুই তাদের নিজেদের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ৯০ এর পর থেকেই আমরা সরকারগুলোকে তাই দেখছি, এরা প্রত্যেকেই ক্রমাগত পুরনো সরকারের নজির ভঙ্গ করে উত্তোরোত্তর আরও মরিয়া হয়ে ক্ষমতা আকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করছে, একই সাথে যে কোন বিরোধিতার প্রতিও ক্রমাগত আরও বেশি সহিংস হয়ে উঠছে।

ক্ষমতায় আসার এই প্রক্রিয়ার কারণেই গত চার বছরে আওয়ামী শুধু লুণ্ঠনেই বেপরোয়া ভূমিকায় ছিল না, দমনপীড়নেও তারা অতীতের সকল নজির ভেঙেছে। লুণ্ঠনের পুরনো রীতিগুলো তারা অব্যাহত শুধু রাখেনি, নতুন ক্ষেত্রও আবিষ্কার করেছে। বাংলাদেশ থেকে এখন বছরে লক্ষ হাজার কোটি টাকারও বেশি বিদেশে পাচার হচ্ছে। পাচারের এই পুরো অর্থটিই দেশের মাঝে নানান দুর্নীতি থেকে সংগ্রহ করা। উন্নয়নের নামে বিশাল সব প্রকল্প থেকে এই দুর্নীতির অর্থ আসে। এই কারণেই আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রকল্পের খরচ বাড়িয়ে শুধু দুই গুন পাঁচগুন নয়, কল্পনাতীত পরিমানে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে এখন রাস্তা নির্মাণের ব্যয় প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে তো বটেই, ক্ষেত্রবিশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও থেকেও বেশি। অন্যদিকে এই নির্মাণ কাজগুলোর মান এত খারাপ যে, নির্মাণের অল্পকিছুদিন পরই তা ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। এভাবে বহুগুন বেশি প্রকল্প খরচ দেখিয়ে আরেকদিকে কাজের মান খারাপ করে দ্ইু ধাপের যে চুরি বাংলাদেশে আমরা দেখছি, তার কোন তুলনা দুনিয়ার ইতিহাসে মিলবে না। পরিস্থিতি এমন যে, অর্থমন্ত্রী পত্রিকায় সাক্ষাতকার দিয়ে স্বীকার করছেন যে, মেগাপ্রকল্প মানেই মেগাচুরি, অথচ চুরিকে উৎসাহ দেয়াই বর্তমান অর্থমন্ত্রীর প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বর্তমান সরকারের আমলে ব্যাঙ্কখাতেও কি ভাবে দখল ও লুণ্ঠনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে তা আপনারা দেখেছেন। একটা মাত্র গ্রুপ এস আলম এখন এতগুলো ব্যাঙ্ক নিয়ন্ত্রণ করছে যে, এই খাতে যে কোন সময়ে একটা ভয়াবহ ধস ও বিপর্যের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া বেসিক ব্যাঙ্ক কেলেঙ্কারি, ফার্মার্স ব্যাঙ্ক কেলেঙ্কারিসহ অজস্র দুর্নীতির ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছে যেখানে সরকারের প্রভাবশালী লোকজন ও বুদ্ধিজীবী এবং ছাত্রনেতার পর্যন্ত জড়িত। ৫জানুয়ারি নির্বাচনের পরই বর্তমান সরকার জ্বালানি ও বিদ্যুতখাতেও নজিরবিহীন দুর্নীতি ও দেশবিরোধী তৎপরতার দৃষ্টান্ত দেখায়। ভারতের সমর্থনে সরকার টিকে থাকার কৃতজ্ঞতাস্বরুপ সুন্দরবনের ঘাড়ের ওপর রামপাল বিদ্যুকেন্দ্র নির্মাণে তারা যেমন মরিয়াপনা দেখিয়েছে, তেমনি সমর্থনের বিনিময়ে রূপপুরে দেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও নির্মাণ করছে। শুধু দুর্নীতি আর প্রকল্পখরচের নামে লুণ্ঠন নয়, বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্যও এগুলো হুমকিস্বরূপ। একই প্রক্রিয়ায় চীনকে উপকূলে বিদ্যুৎ কেন্দ্র বানাতে দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ আন্তার্জিাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধান নীতি হলো যে যা চায় তাকেই তা দিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে সরকারের গদি নিশ্চিত করা। জনসম্র্থনের অভাব এইভাবে তারা পূরণ করছে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেয়া নানান আন্তর্জাতিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করে।

বড় বড় প্রকল্পের এই সরকারী দুর্নীতির চাপ জনজীবনকেও দুর্বিষহ অবস্থার মাঝে ফেলেছে। মোটা চালের দাম এইবার প্রথম ৫০ টাকা অতিক্রম করেছে, সাধারণ মানুষ ভাতের কষ্টে আছে এমন শিরোনাম পত্রিকায় এসেছে। শিক্ষক নিয়োগে ঘুষ, পুলিশে নিয়োগ ও বদলিতে ঘুষ, হাসপাতালে কেনাকাটায় দুর্নীতি নিত্যদিনের বিষয়। প্রশ্নপত্র ফাঁস বাণিজ্য বর্তমান সরকারের আমলে লাভজনক বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। এর ফলে ছোটখাট বিষয় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় কেনাকাটা সর্বত্র আজ দুর্নীতির গ্রাস রাষ্ট্র ও সমাজকে আচ্ছন্ন করেছে।

দুর্নীতি ও দুঃশাসন বাংলাদেশে আগেও ছিল। কিন্তু ৫ জানুয়ারির পরিনতিতে জনসমর্থনহীন সরকারের এই দুর্নীতি ও লুণ্ঠনকে টিকিয়ে রাখতে বাংলাদেশ আজ একটি পুলিশী রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার কর্মসূচিতে পুলিশ প্রবীণ নেতৃবৃন্দকে লাঠিপেটা করেছে, জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে বা অন্য আরও অনেক শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে অগনিত টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে, লাঠিপেটা করে, শব্দবোমা ব্যবহার করে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করেছে। জেল-দমন-হুলিয়া-নির্যাতন থেকে কোন গণতান্ত্রিক কর্মসূচিই রেহাই পায়নি। গত চার বছর ক্রসফায়ার আর গুমেরও বছর গিয়েছে। অজস্র মানুষ ক্রসফায়ার আর গুমের শিকার হয়েছেন। মানুষ এখন কথা বলতে ভয় পায়। শিক্ষক বুদ্ধিজীবী ব্যবসায়ী সংবাদকর্মী রাজনৈতিক কর্মীসহ এমন কোন পেশার মানুষ নেই যারা গুম কিংবা খুনের আওতার বাইরে আছেন। বিচার বিভাগ সহ রাষ্ট্রের সবগুলো প্রতিষ্ঠান আরও বেশি ক্ষয় ও দেউলিয়াত্বের শিকার হয়েছে। বিচারপতি এসকে সিনহাকে কেন্দ্র করে যা ঘটলো তাতে প্রতিটি মানুষের কাছেই আজ পষ্ট যে, সাধারণ মানুষের আর কোন যাবার যায়গা এই রাষ্ট্রে আর বাকি নেই।

এই সংবাদ সম্মেলন যখন আমরা করছি, তখন্ও বাংলাদেশের বহু শিক্ষক অনশন করছেন এমপিওভুক্তির ন্যায্য দাবিতে। তাদের এমপিওভুক্তিতে যা অর্থ ব্যয় হবার কথা, তার চেয়ে বহুগুন বেশি র্অর্থ হলমার্ক কেলেঙ্কারিতেই চুরি হয়েছে। কিংবা চলন্ত সিড়ি বানাবার প্রকল্পে এর চেয়ে বেশি অর্থ বরাদ্দ হয়েছে। বোঝাই যায় হাজার হাজার শিক্ষকের তুলনায় প্রকল্পের নামে অর্থ খরচ করাতেই সরকারের আগ্রহ বহুগুন বেশি।

আমরা মনে করি বাংলাদেশ আজকে একটা ক্রান্তিলগ্নে উপস্থিত। ৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচন কোন বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়, বরং বাংলাদেশকে নিয়ে এদেশের লুটেরা শাসকগোষ্ঠী যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতি পরিচালনা করে এসেছে স্বাধীনতার পর থেকে, তারই ধারাবাহিকতার ফসল। কিন্তু ৫জানুয়ারি যে গভীর শাসনতান্ত্রিক ও রাষ্ট্রীয় সঙ্কটে আমাদের নিপতিত করেছে, তা থেকে উদ্ধার করা এই লুণ্ঠকদের পক্ষে আর হয়তো সম্ভব নয়। বরং আমরা দেখতে পাচ্ছি ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে একদিকে যেমন সবগুলো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা হয়েছে, তাদেরকে বশীভ’ত ও তাবেদার সংস্থায় পরিনত করা হয়েছে, আরেকদিকে সকল বিরোধী মতকে দমন করা হচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে সরকার আরও একটা নির্বাচনের বাধ্যবাধকতার মুখোমুখি হয়ে নির্বাচনক কমিশনকে স্বোচ্ছাধীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতেও প্রয়োজনীয় সব কিছু করার চেষ্টা করছে। বাস্তববতা আজ এমন যে, সরকার চায় নাকি চায় না, তার ওপর নির্ভর করছে কোন একটি নির্বাচনকে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য কায়দায় আয়োজন করা হবে কি হবে না। নির্বাচন কমিশন বা আদালতের স্বাধীন ভূমিকা কার্যত নিঃশেষ করা হয়েছে। সরকার সকল উপয়ে একটা কার্যকর ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা কায়েম করেছে যেখানে উন্নয়নের ধোঁয়া তুলে অগণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রকে জায়েজ করার প্রাণপণ চেষ্টা চলছে।

এই পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা মনে করে, রাজনৈতিক চাপ ও গণআন্দোলন ছাড়া ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার যে পাঁয়তারা সরকার করছে, তাকে প্রতিহত করার কোন উপায় নেই। রাজতৈতিক দেউলিয়াত্বের কারণেই বিএনপির পক্ষে এই ভূমিকা গ্রহণ সম্ভব না। গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা দেশের অপরাপর গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তিগুলোর সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একদিকে জাতীয় সম্পদ রক্ষা, দুর্নীতি ও সম্পদ পাচার প্রতিরোধ এবং অপরদিকে জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে। এই সংগ্রামকে বেগবান করার মধ্য দিয়েই ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে অধিষ্ঠিত সরকারটি রাষ্ট্র ও সমাজের যে বিশাল ক্ষতি সাধিত করেছে, তার কিছুটা পূরণ সম্ভব, সম্ভব দেশকে গণতন্ত্র ও জনপ্রতিনিধিত্ব ফিরিে দেয়া।

সেই কারণেই গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার পক্ষ থেকে আমাদের আহবান, বাংলাদেশের জনগণকে পাশে নিয়ে কার্যকর একটা গণসংগ্রামের মধ্য দিয়ে লুণ্ঠন, দুর্নীতি ও জনপ্রতিনিধিত্বহীনতার ওপর প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী সরকারের বিপরীতে জনগণের একটি সরকার প্রতিষ্ঠার যে লড়াই আমরা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি তাকে অগ্রসর করুন।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments