শিশুদের আনন্দময় শৈশব অসুস্থ প্রতিযোগিতার বলি যেন না হয়
পিইসি পরীক্ষা বাতিল কর
প্রশ্নপত্র ফাঁস ও কোচিং বাণিজ্য বন্ধ কর
হাসতে নাকি জানে না কেউ
কে বলেছে ভাই?
এই শোন না কত হাসির
খবর বলে যাই।
খোকন হাসে ফোঁকলা দাঁতে
চাঁদ হাসে তার সাথে সাথে
কাজল বিলে শাপলা হাসে
হাসে সবুজ ঘাস।
খলসে মাছের হাসি দেখে
হাসেন পাতিহাঁস।
ছড়ায় ছড়ায় এরকম প্রাণবন্ত শৈশবের ছবি এঁকেছিলেন কবি। শৈশবের এই ছবি কি আর আছে? আমাদের চারপাশে যে শিশুরা বড় হয়ে উঠছে তারা আজ আর ফোঁকলা দাঁতে হাসতে পারে কি? চাঁদের হাসি, বিলের শাপলা, সবুজ ঘাস আর রাঙ্গা ঠোঁটের টিয়ে দেখার অবকাশ কই? তাদের পিঠে আজ বড্ড ভারী স্কুলের ব্যাগ, রাত্রি-দিন পরীক্ষা, আর চারপাশ ঘিরে আছে কোচিং সেন্টার, স্যারের বাসা। শিক্ষার যাতাকলে চাপা পড়ছে শৈশব, দুরন্ত শৈশব! মানব জীবনের সবচেয়ে প্রাণবন্ত সময়ের আনন্দ— উচ্ছ্বাস কেড়ে নিচ্ছে পরীক্ষার প্রকোপ বিশেষত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা বা পিইসি। অত্যধিক চাপে শিশুদের মধ্যে মনোবৈকল্য দেখা দিচ্ছে। যে বয়সে আনন্দের সাথে, আগ্রহের সাথে শেখবার কথা; ভালো রেজাল্ট করতে হবে — এই চাপে বরং পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে ছেলে-মেয়েরা। রেজাল্ট নির্ভর শিক্ষা হওয়ায় প্রাইমারি স্তরেও প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। পত্রিকায় এসেছে, এবছর প্রত্যাশিত ফল না পাওয়ায় মানসিক চাপ সইতে না পেরে কয়েকজন শিশু আত্মহত্যা করেছে। অর্ধযুগেরও বেশি সময়ের মর্মান্তিক এ অভিজ্ঞতায় মানুষের সামনে রাষ্ট্রীয় প্রচারের মহিমা আজ ম্লান হয়ে পড়েছে।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টসহ সমাজের সচেতন মহলের আন্দোলন ও অভিভাবকদের প্রবল চাপের মুখে ২০১৬ সালের জুন মাসে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, ‘এ বছর থেকেই পঞ্চম শ্রেণীর প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা হচ্ছে না’। ১৬ সাল গিয়ে ১৮ সালে ঠেকেছে কিন্তু পিইসি পরীক্ষা বহাল তবিয়তে আছে। কোনো উপায়ন্তর না দেখে অভিভাবকদের একটি অংশ যখন পরীক্ষা বন্ধের জন্য হাইকোর্টে রিট করলেন, তখন জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী অনেকটা ধমকের স্বরে বললেন, ‘খুচরা বিষয় নিয়ে আদালতের সময় কাটানো কেন’? এই তো জননেত্রীর জনগণের আবেগ অনুভূতি ধারণের নমুনা! অভিভাবকের করুণ আর্তি, কোমলমতি শিক্ষার্থীর অসহায় কান্না সরকার বাহাদুরের কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে না। তাই বধিরকে শোনাতে উচ্চ শব্দ প্রয়োজন, এ শব্দ জনগণের সংগঠিত প্রবল প্রতিরোধ। সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট এ লড়াই গড়ে তুলতে চায়, তাই আমরা আমাদের বক্তব্য সকলের সামনে পুনরায় তুলে ধরছি।
যে ভাবে এলো
বাহারি নাম আর রকমারি আয়োজনে শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামোগত ও পদ্ধতিগত পরিবর্তন খুব ঘন ঘন ঘটছে। সরকারের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে প্রতিবারেই চিৎকার করে সাফাই গাইতে থাকেন তথাকথিত একদল আমলা-বুদ্ধিজীবী। অবশ্য গুণকীর্তনের এই জোয়ারে ভাটা পড়তেও বেশি সময় লাগে না, যদিও ততদিনে ক্ষতি যা হবার হয়ে যায়। যে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্যে এতো ব্যস্ততা, আয়োজন তারাই শুধু পড়ে থাকে আড়ালে। শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকার ও ব্যবসায়ীদের নিত্য-নতুন ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’র মহড়ায় অসহায় গিনিপিগে পরিণত হয় শিক্ষার্থীরা, আর শিক্ষকরা হন ভারবাহী মাত্র। ২০০৯ সালে সরকার ধসে পড়া শিক্ষাব্যবস্থার স্বর্ণমুকুটে আরেকটি পালক যুক্ত করলো, তা হলো — ‘পিইসি’ পরীক্ষা।
প্রতিশ্রুতি আর কল্পনার ফানুস ছড়িয়ে চালু করা এই পদ্ধতির সত্যিকার চিত্র আজ সকলের কাছে উন্মোচিত। তাহলে সরকার কেন এই পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল আর কেনই বা আজও তা বাতিল করতে চাইছে না? বাস্তবে শিক্ষার বুনিয়াদী স্তরে যে নৈরাজ্য চলছে তার মূলে প্রবেশ না করে বারবার হাজির করা হচ্ছে টোটকা দাওয়াই। ফলে কাঠামোগত বা পদ্ধতিগত প্রশ্নে যতই পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো হোক না কেন আখেরে ক্ষতিই হচ্ছে বেশি। পিইসি-জেএসসি পরীক্ষার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তাই দুটি দিক আমাদের ভেবে দেখা দরকার, একটি পিইসি পরীক্ষা আমাদের বাস্তবতায় কতটুকু যৌক্তিক, আরেকটি হচ্ছে সরকার কি চায়?
পরীক্ষা কার: শিক্ষার্থী না ব্যবস্থার?
মূল আলোচনায় যাবার পূর্বে একটি বিষয়ে আলোকপাত করা জরুরি। সেটি হলো পরীক্ষা আসলে কী, আর এর প্রয়োজনই বা কোথায়? সারা বছর ধরে একজন শিক্ষার্থী সমাজ, প্রকৃতি আর তার চারপাশ সম্পর্কে কতটুকু জানলো, কী উপলব্ধি করলো, তার সম্ভাবনার দিক কোনটি, কোথায় তার ত্রুটি — সামগ্রিক এই মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার নামই হলো পরীক্ষা। এতে একজন শিক্ষার্থীর যেমন মূল্যায়ন হয়, একই সাথে যারা শেখাচ্ছেন, যা শেখাচ্ছেন এবং যেভাবে শেখাচ্ছেন তারও একটা মূল্যায়ন হয়। তাই পরীক্ষায় শুধু একজন শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন নয় বরং মূল্যায়ন হয় গোটা ব্যবস্থার। ফলে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় উন্নত মূল্যায়ন ব্যতীত প্রকৃত শিক্ষার্জন সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সাধারণত দু’ধরণের পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় – প্রথমটি শিক্ষণ ভিত্তিক (teaching based) অপরটি শিখন ভিত্তিক (learning based)। শিক্ষণ ভিত্তিতে সারা বছর জুড়ে একজন শিক্ষার্থী কতটুকু জানলো, কী বুঝলো অর্থাৎ তার অর্জিত জ্ঞানের পরিমাপ করা হয় একটি বার্ষিক বা সমাপনী পরীক্ষার মাধ্যমে। এতে পুরো বছর জুড়ে যে পড়াশোনা ও পড়াশোনা বহির্ভূত শিক্ষা সহায়ক কর্মকান্ড পরিচালিত হয় তার মূল্যায়ন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে শিক্ষক যত সক্রিয় থাকেন, শিক্ষার্থী ততই নির্জীব হয়ে পড়ে। অপরদিকে শিখন ভিত্তিক প্রক্রিয়ায় পড়ালেখার উদ্দেশ্য থাকে শিক্ষার্থীর নানা ধরণের কর্মকান্ডের মূল্যায়ন। সেখানে শিক্ষার্থী পড়াশোনা ছাড়াও নানা ধরণের কর্মকান্ডে সক্রিয় থাকে, শিক্ষক সহায়কের ভূমিকা পালন করেন। এ প্রক্রিয়ায় সময়ে সময়ে একজন শিক্ষার্থী কতটুকু শিখলো তার মূল্যায়ন এবং সে অনুযায়ী feedback নেয়া হয়। আবার একটি বছর কিংবা নির্দিষ্ট একটি সময় শেষে সার্বিক ভাবে কী শিখলো তারও পরিমাপ করা হয়। আমাদের দেশে প্রথম সাময়িক, ষান্মাষিক, মডেল টেস্ট বলে দায় সারাগোছের কিছু পরীক্ষা চালু থাকলেও মূলত শিক্ষণ ভিত্তিতেই মূল্যায়ন করা হয়। এতে যদি কোনো শিক্ষার্থী কৃতকার্য না হয়, তাহলে তার সমস্ত দায় চাপিয়ে দেয়া হয় শিক্ষার্থীর উপর। অথচ যে ব্যবস্থায়, যে পদ্ধতিতে পাঠদান হচ্ছে — অকৃতকার্য হওয়ার পেছনে তার দায় কতখানি অর্থাৎ শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটির দিকে নজর দেয়া হয় না।
বাস্তবে প্রাথমিক শিক্ষার প্রকৃত চিত্র কী? এখানে প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থা খুব জরাজীর্ণ। ৬৪ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ২১ হাজার স্কুলই চলছে প্রধান শিক্ষক ছাড়া, শূন্য আছে ১৭ হাজার সহকারি শিক্ষকের পদ। ২০১৩ সালে জাতীয়করণকৃত ২৬ হাজার স্কুলের অবস্থা তো আরও করুণ। এদিকে বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত ৪৯.৩৫ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথা বাদ দিলেও সরকারি স্কুলগুলোর প্রায় ৩০ হাজার স্কুলেই রয়েছে নানারকম অবকাঠামোগত সমস্যা। ফলে এই অবস্থায় কোনো ভাবেই সার্বিক মূল্যায়ন বা শিখন ভিত্তিক প্রক্রিয়া এখানে অনুশীলনের সুযোগ নেই। এর মধ্যে গাইড বই, কোচিং এবং মুখস্থ নির্ভরতা কমিয়ে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল করার মোড়কী স্লোগান সামনে এনে চালু করা হয়েছে ‘সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি’। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ধরণ, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, অপ্রতুল আয়োজন, প্রশিক্ষণের দুর্বলতা বিবেচনায় না নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা মনোবিজ্ঞানী ব্যাঞ্জামিন এস ব্লোমসের ‘শিক্ষা টেক্সনমি’ আধাখাচড়া ভাবে চাপিয়ে দেয়া হলো। অথচ এক গবেষণায় দেখা গেছে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদের প্রায় ১৩ শতাংশ সৃজনশীল প্রশ্ন বুঝেন না, আর নিজে বুঝলেও অন্যকে বুঝাতে পারেন না আরও ৪২ শতাংশ শিক্ষক অর্থাৎ সব মিলে প্রায় ৫৫ শতাংশ শিক্ষকই এই প্রশ্নপদ্ধতি অন্যকে বুঝাতে অক্ষম। আবার যে গাইড বই নির্ভরতা কমানোর কথা বলে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি চালু করা হলো আজ খোদ ৪৭ শতাংশ শিক্ষকই নির্ভরশীল গাইড বইয়ের উপর। ফলে স্থান, কাল, পাত্র বিচার না করে চাপিয়ে দেয়া সৃজনশীল প্রশ্নপত্র গোটা শিক্ষা ও পরীক্ষা ব্যবস্থায় সৃষ্টি করে রেখেছে বন্ধ্যাত্ব। এমতাবস্থায় চালু হওয়া পিইসি-জেএসসি পরীক্ষা যে চূড়ান্ত নৈরাজ্যের জন্ম দেবে তা বলার অপেক্ষা রাখে কি?
পিইসির পক্ষে কতিপয় যুক্তি ও বাস্তবতা:
পিইসি এবং জেএসসি নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু যুক্তি উপস্থাপন করা হয়। গত ৮/৯ বছরের অভিজ্ঞতায় মানুষ এর অসারতা দেখেছেন। অথচ সরকার একতরফা ভাবে তার মাহাত্ম্য বর্ণনা করেই চলেছেন। সরকারের যুক্তির বিপরীতে আমরা আমাদের বক্তব্য তুলে ধরছি।
ক. মেধার মূল্যায়ন ও শিক্ষার মান বৃদ্ধি:
মেধার যথার্থ মূল্যায়ন ও শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করা প্রয়োজন — একথায় কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। যে কোনো শিক্ষা ব্যবস্থায় এ দিকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত প্রাথমিক শিক্ষায় অত্যন্ত মনোযোগ ও যত্নের সাথে এ কাজটি করতে হয়। কারণ শিশুর অন্তর্নিহিত স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য অপার বিস্ময়, অফুরন্ত প্রাণ শক্তি, অসীম আনন্দ ও সীমাহীন কৌতূহল কতটুকু নির্ভীকভাবে বিকশিত হচ্ছে তা প্রধানত নির্ধারিত হয় প্রাথমিক শিক্ষার দ্বারা। প্রাথমিক শিক্ষাই হচ্ছে শিক্ষা জীবনের ভিত্তি। আর এর উপরই নির্ভর করে পরবর্তী সময়ে একজন মানুষের সামগ্রিক বিকাশ। কিন্তু প্রশ্ন হলো শুধু একটি বা দু’টি পরীক্ষার মাধ্যমেই কি মেধার সঠিক মূল্যায়ন হয়? শিক্ষার মান বৃদ্ধি হয়? মেধার মূল্যায়ন ও শিক্ষার মান বৃদ্ধি গোটা শিক্ষাব্যবস্থার সাথে যুক্ত। শুধু পরীক্ষা দিয়ে যেমন মেধার মূল্যায়ন হয় না, তেমনি পাশের হার দিয়ে শিক্ষার মান বৃদ্ধি হয়েছে একথা বলা যায় না। অথচ আমাদের শিক্ষাকর্তা আর রাষ্ট্রীয় নীতি-নির্ধারকেরা জোর গলায় এই আওয়াজ তুলছেন। নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করছেন।
পিইসির পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে অনেকে বলছেন, তাহলে বৃত্তি কীভাবে দেয়া হবে? ভাবখানা এই যেন পিইসি পরীক্ষা চালুর আগে আর বৃত্তি দেয়া হয়নি। আমরা মনে করি, পুরনো যে পদ্ধতিতে বৃত্তি দেয়া হত তাই বহাল রাখা যায়। এতেও অনেকে বলেন, এভাবে নাকি সবার মেধার মূল্যায়ন হয় না। সবার মেধার মূল্যায়নের নামে যে পদ্ধতি আনা হল সেখানে মূল্যায়নের নামে পাশের হার বৃদ্ধির রহস্য আজ আর গোপন নেই। ‘প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা’ চালু হওয়ার পর অধিক হারে পাশ ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষা বিভাগ থেকেই শিক্ষক পরীক্ষকদের ধমক দিয়ে বলা হয়েছিল, “নম্বর কি তাঁদের পৈতৃক সম্পত্তি নাকি? দশের অধিক পেলেই পাস করানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল”। ফলে পিইসি চালু হওয়া মাত্রই পাশ ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তি মহামারি আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু এটা কি প্রমাণ করে যে এতে শিক্ষার মান বেড়েছে কিংবা মেধার মূল্যায়ন হচ্ছে? বরং ২০১৫ সালে ইউনেস্কোর ‘এশিয়া-প্যাসিফিক রিজিওনাল ব্যুরো ফর এডুকেশন’র এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার মান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষকের অভাবেই শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত হচ্ছে না। প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে পিছিয়ে। শুধু তাই নয় খোদ সরকারি গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। ‘শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার্থীরা তাদের প্রয়োজনীয় শিক্ষার মাত্র ৪০ শতাংশ পাচ্ছে প্রতিষ্ঠান থেকে। রিপোর্টে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়, পঞ্চম শ্রেণী পড়ুয়া ৯০% শিক্ষার্থীর গণিতে মান খুব নিম্ন, এমনকি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ুয়া ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থীই বাংলা ভাষা শিক্ষায় নিম্নমান নিয়ে অবস্থান করে। ফলে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে জিপিএ-৫ কিংবা পাশের হার বাড়িয়ে দিয়ে বাহবা হয়তো পাওয়া যায় কিন্তু শিক্ষার মান বৃদ্ধি হয়েছে এই দাবি করা যায় কি? বাস্তবে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও শৈশব কৈশোরের নির্মল আনন্দ থেকে বঞ্চিত এই শিশুরা এখন আর শিক্ষার্থী নয়, পরীক্ষার্থী! তাই পরীক্ষার প্রতিযোগিতায় ফেলে শিশুর প্রাণশক্তি, স”জনীশক্তি কেড়ে নেয়ার পর খোলস ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট থাকে কি? মেধার মূল্যায়নের নামে এই আত্মঘাতী প্রক্রিয়া আর কতদিন চলবে?
খ. পরীক্ষা ভীতি কমবে; মানসিক শক্তি ও সাহস বাড়বে!
পিইসি পরীক্ষা বহাল রাখার পক্ষে এক অদ্ভূত সাফাই গেয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। তিনি দাবি করেছেন, এতে নাকি শিশুদের পরীক্ষা ভীতি কমেছে। সত্যি কি তাই! একটু তলিয়ে দেখা দরকার। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় দ্বাদশ ক্লাসের মধ্যে ৪টি পাবলিক পরীক্ষা চালু আছে, যা শুধু নজিরবিহীনই নয়, চূড়ান্ত অবৈজ্ঞানিকও বটে। ১১বছর বয়সের একটি শিশু যখন জিজ্ঞাসু মন নিয়ে হেসে খেলে বেড়ে ওঠার কথা, তখনই তাকে নামতে হচ্ছে পাবলিক পরীক্ষার ইঁদুর দৌড়ে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই তাকে শিখতে হচ্ছে ‘এ প্লাস’ পেতে হবে। পরীক্ষার প্রস্তুতি আর পরীক্ষা দেয়াই যেন এখন শিক্ষার্থীদের একমাত্র কাজ। সাংবাদিক আবুল মোমেন লিখেছেন, ‘আমাদের সমাজে পরীক্ষার মোহ এবং জিপিএ-৫-এর নেশা ধরিয়ে দেওয়া গেছে।… পরীক্ষা মানুষের সেই চাহিদা যেভাবে মেটাতে পারে, শিক্ষা তা পারে না।… আমরা শিশুর কাছেই ফল চাই- প্রথম শ্রেণী, আদতে প্রাক-প্রাথমিক থেকেই ফল চাওয়া শুরু হয়ে যায়।…নিরন্তন পরীক্ষার ড্রিলের ভেতর দিয়ে… চাপের মধ্যে সে মুখস্ত বা বারবার অভ্যাস করে যে বিদ্যা আয়ত্ত করেছে, তার সঙ্গে আত্ম বিকাশের-আত্মপ্রকাশের তেমন সম্পর্ক না হওয়ায় পরীক্ষার পর শেখা বিষয়গুলো তাদের কিছুই মনে থাকে না।” তাই পাশের বন্ধুটির সাথে একটু খেলা, একটু ঝগড়া, একটু মান অভিমানের মাধ্যমে সামাজিক ও মানবিক বিকাশের সময়টুকু হারিয়ে যাচ্ছে কোচিং সেন্টার, স্যারের বাসা আর গাইড বই মুখস্ত করতে করতে। ফলে পাশের ছাত্রটি এখন আর বন্ধু নয়, কেবল প্রতিযোগী, প্রতিদ্বন্দ্বী। পরস্পর পরস্পরকে জানা বুঝার মধ্য দিয়ে হৃদ্যতা প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে তৈরি হচ্ছে জিঘাংসা, স্বার্থপরতা। আর পরীক্ষা ভীতি কমানোর নামে একে উস্কে দিয়ে ছোট ছোট বাচ্চাদের মধ্যে তৈরি করা হচ্ছে একটা কৃত্রিম উত্তেজনা। এই তীব্র প্রতিযোগিতার ঘূর্ণাবর্তে হারিয়ে যায় মানুষের দু’টি মূল্যবান সম্পদ মৌলিকতা ও সৃজনশীলতা। যার অনিবার্য পরিণতিতে শৈশব-কৈশোরের স্বাভাবিক কোমলতা হারিয়ে একদিকে তৈরি হচ্ছে ‘কিশোর গ্যাং’ সংস্কৃতি অর্থাৎ লক্ষ্যহীন উগ্রতার উন্মাদনা অপরদিকে বাড়ছে সমাজ সম্পর্কে নিস্পৃহতা, উদাসীনতা। ফলে যুক্তি-বুদ্ধি, গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে একটি মননশীল প্রজন্ম গড়ে উঠার পরিবর্তে তৈরি হচ্ছে মানবিক বোধ বর্জিত আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর, নিঃষ্প্রাণ একটি যান্ত্রিক প্রজন্ম। ছোট শরীরে বাসা বাধছে নানা ধরনের জটিল রোগ। শিশুদের শুধু এই মানসিক বৈকল্যই তৈরি হচ্ছে না, এমনকি আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে। এবছর পিইসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ না পাওয়ায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বেশ কয়েকজন শিশু আত্মহত্যা করেছে। এরপরও কি এই দাবি যৌক্তিক যে পিইসি শিশুদের পরীক্ষা ভীতি কমিয়ে সাহসী করে তুলছে? আর কত জীবনের মূল্য দিলে এই নিষ্ঠুর সত্যকে শাসকরা অনুধাবন করতে পারবে?
গ. বৈষম্য কমবে: সময় ও অর্থের অপচয় রোধ হবে!
এ দেশে ধনবৈষম্য চূড়ান্ত, এ বিষয়ে বির্তকের কোনো অবকাশ নেই। পিইসি পরীক্ষা চালুর পর থেকে আজ পর্যন্ত সরকার জোর গলায় প্রচার করছে এর মাধ্যমে বৈষম্য কমিয়ে সময় ও অর্থের অপচয় রোধ করা হবে। এক্ষেত্রে প্রথমত দেখা যায় আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত। এই বিভিন্ন ধারার প্রত্যেকটিরই রয়েছে স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য। এগুলোর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ভিন্ন, শিক্ষাদান পদ্ধতি, শিক্ষকের মান-যোগ্যতা সবই ভিন্ন। শুধু প্রাথমিক স্তরেই কমিউনিটি, স্যাটেলাইট, রেজিস্ট্রার্ড, নন রেজিস্ট্রার্ড, সরকারি, এবতেদায়ী, কিন্ডারগার্টেনসহ ১১ ধরনের বিদ্যালয় আছে। এই বিদ্যালয়গুলোতে সুযোগ সুবিধার বৈষম্য প্রকট, আবার অবস্থানগত কারণে গ্রাম-শহরে এ বৈষম্য আরও তীব্র। ফলে বিভিন্ন ধারার শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন না করে, ইতোমধ্যে বিরাজমান সমস্যার সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে শুধু একটা পাবলিক পরীক্ষা চাপিয়ে দিয়ে বৈষম্যের অবসান সম্ভব কি? এদিকে আমরা পূর্বেই দেখিয়েছি পিইসি চালুর ফলে প্রাথমিক শিক্ষা পরিণত হয়েছে পরীক্ষা ব্যবস্থায়। পাবলিক পরীক্ষা যত বাড়ছে, কোচিং ব্যবসা ততই রমরমা হচ্ছে। আজ ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে পরীক্ষায় ভালো ফল করতে হলে কোচিং সেন্টার ও গাইড বইয়ের দ্বারস্থ হতে হবে। ইতোমধ্যে সারা দেশে গজিয়ে উঠা ২ লক্ষ কোচিং সেন্টারে প্রতি বছর লেনদেন হয় প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। আর গাইড বই ব্যবসা তো আছেই, বাজারে প্রচলিত আছে ৩৫ ধরনের গাইড। শুধু প্রাথমিকের কথাই ধরুন। প্রতি বছর পিইসিতে অংশগ্রহণ করে ৩০ লক্ষ শিক্ষার্থী। যদি ধরে নিই, এরা প্রত্যেককেই ১টি করে গাইড বই কিনেছে আর যদি প্রতিটির দাম ৫’শ টাকা হয় তবে শুধু এই খাতেই বছরে বাণিজ্য হয় ১৭৫ কোটি টাকা। পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করতে গাইড বই আর কোচিং সেন্টারের ২য় কোনো বিকল্প নেই, আর তা নির্ভর করছে আর্থিক সামর্থ্যরে উপর। আবার প্রাথমিকে বেসরকারি খাতে পরিচালিত ৪৯.৩৫% শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনাও নির্ভর করছে আর্থিক সামর্থ্যরে উপর। ফলে যার যত টাকা আছে সে ততই ভালো শিক্ষা (!) কিনতে পারবে এই হাল দাঁড়িয়েছে। এতো একটি দিক মাত্র, শুধু মাত্র স্কুলে বা কোচিংয়ে গেলেই তো হলো না, এর সাথে জড়িয়ে আছে শিক্ষা উপকরণ ও আনুষাঙ্গিক নানা আয়োজন নিশ্চিত করার প্রশ্ন। পিইসি চালুর সময় (২০০৯ সালে) এক দিস্তা নিউজপ্রিন্ট কাগজের মূল্য ছিলো ১২/১৪ টাকা যা আজ বেড়ে হয়েছে নূন্যতম ২০ টাকা। এর সাথে স্কুল ড্রেস, বাধ্যতামূলক কোচিং ফি, পরীক্ষা ফি, টিফিন খরচ তো আছেই। ফলে এত টাকার যোগান না দিতে পারার কারণে শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষের ছেলে-মেয়েদের জন্যে প্রাথমিক শিক্ষার দরজা বন্ধ হতে চলেছে। ফলে কথার বাহার যত বাড়ছে একই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বৈষম্যও।
ঘ. ঝরে পড়া রোধ ও একটি সার্টিফিকেট!
পিইসি চালুর পক্ষে একটি অত্যন্ত পরিচিত যুক্তি এই ঝরে পড়ার হার রোধ ও একটি সার্টিফিকেট তত্ত্ব। বাস্তবে যে অর্থনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থার কারণে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর পড়াশোনার ইতি ঘটছে তার মূলে না গিয়ে সামনে আনা হচ্ছে ভিন্ন কথা। পিইসি চালুর সময় (২০০৯ সালে) যত শিশু প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হতো তাদের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী ৫ম শ্রেণী শেষ করার পূর্বেই ঝরে পড়তো। পিইসি চালুর সাথে সাথেই দেখা গেল পাশের হার বেড়ে দাঁড়ালো শতকরা ৯০ শতাংশে। শিক্ষা ব্যবস্থায় কোন যাদুর স্পর্শ লাগলো যে মূহুর্তে এমন ভোজবাজি হয়ে গেল। আসলে এ কোনো জাদু নয়, পিইসি চালুর পর সরকার যেকোনো উপায়ে পাশের হার বাড়ানোর কৌশল নিয়েছে, পরীক্ষায় দশের অধিক পেলেই পাশ দেখানোর সরকারি নির্দেশ পর্যন্ত আছে। সরকারি বাধ্যবাধকতার কারণে স্কুলগুলোও ভালো ফল দেখাতে গিয়ে পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থীদের উত্তর বলে দেয়া, প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা অনিয়মের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছে। এভাবে কৌশলে প্রাথমিকে পাশের হার বৃদ্ধি করা হলেও পঞ্চম শ্রেণী পাশ করা প্রায় এক তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থীই অষ্টম শ্রেণী শেষ করার পূর্বে ঝরে পড়ে। এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী প্রতি বছর ঝরে পড়ে মূলত আর্থিক কারণে। শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করার সামর্থ্য নেই বলে। ঝরে পড়া রোধ করতে হলে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ প্রয়োজন। সেই দায়িত্ব গ্রহণ না করে সরকার বরং এই ঝরে পড়াকে আরো ত্বরান্বিত করতে একটি সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা করেছে। এই সার্টিফিকেট নিয়ে যেন শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে পারে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের কোনো স্তরে বা অন্য কোনো ক্ষেত্রে কি এই সার্টিফিকেটের মূল্য আছে? এর মধ্য দিয়ে সরকার এটাই বোঝাতে চাইছে — বেশি লেখা পড়া করে আর কী হবে? উচ্চশিক্ষা সংকোচনের নীতি থেকেই সরকার একাজ করছে। এদেশে প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষার চিত্র দেখলেই এটা পরিষ্কার হয় যে, এখানে মূল্যায়নের নামে শিক্ষার্থীদের স্তরে স্তরে ছাঁটাই করা হয়। বাস্তবে সরকার শিক্ষার দায়িত্ব নিতে চায় না, ফলে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের একটি সার্টিফিকেট দিয়ে নিজেদের দুর্বলতা বা দায়িত্বকে আড়াল করছে। যা পক্ষান্তরে শিশু শ্রমকেই বৈধতা দেয়ার নামান্তর।
ঙ. শিক্ষকদের জবাবদিহিতা ও অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি:
একটি প্রবাদ বাক্য প্রচলিত আছে ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আজকের এই নন্দ ঘোষটি হলেন শিক্ষকরা। শিক্ষাঙ্গন বা শিক্ষাব্যবস্থায় যত সমস্যা তার জন্যে সব সময় তীর তাক করা থাকে শিক্ষকদের উপর। একসময় শিক্ষকতা ছিল সবচেয়ে শ্রদ্ধার, সম্মানের কিন্তু আজ আর তা নেই। কেন এমন হলো? শিক্ষার তিনটি স্তরের মধ্যে প্রাথমিকে আসা সহকারি শিক্ষকরা এখনো প্রজাতন্ত্রের তৃতীয় স্তরের কর্মচারী। এই শিক্ষকরাই গত ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে কনকনে শীতে যখন গোটা দেশ কাঁপছিলো, তখন নিজেদের বেতনস্কেলে বৈষম্য কমানোর দাবিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আমরণ অনশনে বসেছিলেন, সরকার বাধ্য হয়ে দাবি পূরণের আশ্বাস দিলেও কতটুকু বাস্তবায়ন হবে তা এখনও দেখার বিষয়। আবার সব সময়েই প্রাথমিকের শিক্ষকদের দক্ষতার অভাব ইত্যাদি সামনে আনা হয়, কিন্তু মূল কারণ বরাবরই থাকে আড়ালে। এই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ বলতে গেলে জীবনে একবারই হয়, সেই ফাউন্ডেশন ট্রেনিং। কিন্তু এর কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে বা কাজে লাগছে তার কোনো মূল্যায়ন নেই। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, নানা-সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে শিক্ষকরা তাদের দক্ষতার পুরোটা দিতে পারছেন না এটা ঠিক, কিন্তু সরকার কী তার দায় এড়াতে পারে? এখানে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ তা হলো শিক্ষাব্যবস্থাটি কী প্রক্রিয়ায়, কাদের দ্বারা চলবে? শিক্ষাব্যবস্থায় যখন কাঠামোগত বিভিন্ন পরিবর্তন করা হয় তখন পাশ্চাত্যের দেশ সমূহের নজির হাজির করা হয়। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনার ক্ষেত্রে সেসব দেশের নজির অনুসরণ করা হয় না। সেসব দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মর্মবস্তুটি অনুধাবন না করে, তার খোলসটি আমদানি করা হয়। বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার মধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে খানিকটা উন্নত হিসেবে ধরা হয় ফিনল্যান্ডকে। তাদের এই অবস্থার পেছনে যে বিষয়টি আছে তা হলো গোটা শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকদের অংশগ্রহণ। ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা কেন বিশ্ব সেরা তা গবেষণা করে দেখিয়েছেন কলম্বিয়া গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব জার্নালিজম-এর শিক্ষক লিনেন হ্যানকক। তিনি দেখান, ‘শিক্ষার নতুন কাঠামো দাঁড় করানোর পর ফিনল্যান্ড শিক্ষা পরিদর্শন কার্যক্রমই বন্ধ করে দিয়েছে। জবাবদিহিতা ও তদারকির দায় ভার ছেড়ে দিয়েছে শিক্ষক, বিশেষ করে প্রতিষ্ঠানের প্রধান অধ্যক্ষের উপর।” শুধু তাই নয় সরকারি উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষকদের ৫ বছরের বাধ্যতামূলক ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিক শিক্ষা দেওয়া হয় আর গোটা প্রাথমিক শিক্ষাই পরিচালিত হয় সরকারি পরিচালনায়। অথচ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়। শিক্ষকের ভূমিকা এখানে শুধু শ্রেণী কক্ষেই সীমাবদ্ধ, আর বাকি সমস্ত বিষয়ে অর্থাৎ নীতিগত কিংবা পদ্ধতিগত প্রশ্নে নীতি নির্ধারণ করেন আমলা, মন্ত্রী আর ধুরন্ধর রাজনৈতিক নেতারা, এমনকি স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিতে পর্যন্ত শিক্ষকরা থাকেন উপেক্ষিত। ফলে শিক্ষকদের নিজস্বতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে একাত্মতা গড়ে উঠতে পারে না। এহেন পরিস্থিতিতে শিক্ষকদের জবাবদিহিতার মানে কী দাঁড়াচ্ছে তা ফুটে উঠেছে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসানের সম্প্রতি প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক লেখায়। তিনি লিখেছেন “…ঘুরতে ঘুরতে বগুড়া জিলা স্কুলে গিয়ে দেখি রাতের বেলায় শিক্ষকরা দরজা বন্ধ করে খাতা দেখছেন। স্কুলে ভর্তি পরীক্ষার খাতা। আর সেটা তত্ত্বাবধান করছেন জেলা প্রশাসনের লোকজন। পঞ্চগড়ে গিয়ে শুনি, পরদিন সেখানেও ঠাকুরগাঁও জেলার সরকারি স্কুলের ভর্তি পরীক্ষা। শিক্ষকরা বললেন, ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন করেন জেলা প্রশাসনের লোকজনই, শিক্ষকরা নন। আমার চমকানো দেখে তাঁরা জানালেন, এই নিয়ম নাকি বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে। জেলা শহরগুলোতে সরকারি স্কুলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন করার যোগ্যতা আমাদের শিক্ষকদের নেই। এই প্রশ্ন করেন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা স্কুলের শিক্ষকেরা কেবল খাতা দেখেন। তা-ও আবার কঠিন পাহারার মধ্যে। যত রাতই হোক পরীক্ষার দিনই নাকি খাতা দেখা শেষ করতে হয়। আর ফলাফল প্রকাশ করে ওই জেলা প্রশাসন।” এ শুধু পঞ্চগড়ের একটা বিচ্ছিন্ন চিত্র নয়, গোটা শিক্ষাব্যবস্থার চিত্র। ফলে শিক্ষকদের এমন অবস্থায় রেখে ভালো কিছু প্রত্যাশা করা যায় না। আবার পিইসি পরীক্ষা চালু হওয়ায় অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধির বদলে আর্থিক অনিশ্চয়তা, দুঃশ্চিন্তা আর হয়রানি বেড়েছে কয়েকগুণ। অভিভাবক মাত্রই তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।
ষোল আনা থেকে যদি ষোল আনা যায়
“স্কুলের ব্যাগটা বড্ড ভারী, আমরা কি আর বইতে পারি/এও কি একটা শাস্তি নয়, কষ্ট হয়, কষ্ট হয়/ আমার কষ্ট বুঝতে চাও, দোহাই পড়ার চাপ কমাও”-এ নিছক কবির কল্পনা নয়, আজ তা স্কুলগামী হাজারো কচি মুখের নীরব আর্তনাদ। শৈশব-কৈশোরের সকল আনন্দ নিংড়ে নিয়ে সরকার এ কোন পথে পরিচালিত করছে গোটা প্রজন্মকে। নীতি-নৈতিকতা, মনুষ্যত্ব মানবিকতা বিকিয়ে দিয়ে পিইসি পরীক্ষা আমাদের প্রশ্নপত্রফাঁস আর কোচিং বাণিজ্য ছাড়া আর কী দিতে পারলো — আসুন সে আলোচনায় যাই।
ক. প্রশ্নপত্র ফাঁস:
শরৎচন্দ্রের একটি গল্পের কথা দিয়ে শুরু করি। গ্রামের মাঝারি মানের একটি দোকানের মালিক বৈকুণ্ঠ। তাঁর দুই ছেলে গোকুল আর বিনোদ। বড় ছেলে গোকুল নিতান্তই সাদাসিধে আর সহজ সরল, পড়াশোনায়ও ততোধিক অপটু। অপর দিকে বিনোদ, ঠিক তার বিপরীত। স্কুলের ভালো ছাত্র, সকলের প্রিয় পাত্র, শুধু তাই নয় ইতোমধ্যে সে ডবল প্রমোশন পেয়ে গোকুলের ক্লাসে উত্তীর্ণ হয়েছে। এবার আবার পরীক্ষা শুরু হয়েছে, শুরুতেই প্রধান শিক্ষক এসে বলে গিয়েছেন পরীক্ষায় দেখে লেখা অন্যায়; কেউ যেন দেখে না লেখে। পরীক্ষায় গোকুল চুপচাপ বসে আছে দেখে দায়িত্বরত শিক্ষক নানা ইশারা ইঙ্গিতে বই দেখে লেখার কথা বুঝাতে থাকেন, কারণ ইতোমধ্যে গোকুলদের দোকানে প্রচুর টাকা তাঁর বাকি পড়েছে। কিন্তু যার জন্যে শিক্ষকের এত চেষ্টা, সেই বসে রইলো নির্বাক, নিশ্চুপ। গোকুলের এহেন বোকামোতে তাজ্জব শিক্ষক! পরীক্ষা শেষে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না, তিনি জিজ্ঞেস করলেন কেন সে দেখে লিখলো না। তিনি তো তাকে কিছু বলতেন না, যেমন কিছু বলেননি মল্লিকদের ছেলেদের। প্রতি উত্তরে গোকুল আরোও বোকার মত উত্তর দিলো, হেডমাস্টার মশাই যে বললেন দেখে লেখা পাপ। তাই সে দেখে লেখেনি। যাই হোক পরীক্ষা ফল প্রকাশ হলো, যথারীতি বিনোদ বিস্ময়কর সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হলো আর গোকুল ফেল করলো। বিনোদের সাফল্যে আপ্লুত শিক্ষক এলেন তাদের বাড়িতে। তিনি গোকুলের সৎ মায়ের কাছে বলতে লাগলেন, আমি নিশ্চিত বিনোদ একদিন বড়ে হয়ে জজ-ব্যারিষ্টার হবে আর গোকুল, সে তো একটা আস্ত বোকা। একে দিয়ে কিছু হবে না। বলার উৎসাহে তিনি সেদিনের পুরো ঘটনাই বিবৃত করলেন। সমস্ত কথাই ঘরের ভেতর থেকে শুনছিলেন বৈকুন্ঠ। শিক্ষক চলে গেলে তিনি তার স্ত্রীকে বললেন বিনোদ বড় হয়ে জজ-ব্যারিস্টার হবে কি’না আমি জানি না, কিন্তু গোকুলের কাছে তোমাকে রেখে আমি নিশ্চিন্তে মরতে পারবো। আজ যখন প্রশ্নপত্র ফাঁসের মহোৎসবে গোটা দেশ ভাসছে, তখন নিজের সন্তানের উপর এমন নির্ভার থাকতে পারবেন ক’জন?
প্রশ্নপত্র ফাঁস এখন একটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যপার। প্রথম শ্রেণী থেকে শুরু করে বিসিএস সকল পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে নিয়মিত। ফেসবুক, কোচিং সেন্টার থেকে পাড়ার ফটোকপির দোকান সর্বত্রই মুড়ি মুড়কির মতো প্রশ্নপত্র বিক্রি হচ্ছে। এ যে আজকে একটা বিরাট মহীরুহে পরিণত হলো তার কারণ কী ? দেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে তার মূল উদ্দেশ্য আজ চরিত্র অর্জন, বড় মানুষ তৈরি কিংবা প্রকৃতি ও সমাজকে জানা নয়, তথাকথিত ক্যারিয়ারমুখী। সর্বত্র অনিশ্চয়তা, কাকে ফেলে কে এগিয়ে যাবে তার অসুস্থ প্রতিযোগিতা। ফলে যে কোনো ভাবে ভালো রেজাল্ট চাই! এই অবস্থায় শিক্ষক, কোচিং সেন্টার প্রভৃতির সাথে সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের যোগসাজসে ফাঁস হয়ে যায় প্রশ্ন। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে হয়তো বাহারি ফলাফলে জয়জয়কার পড়ছে চারদিকে, অথচ এই সাফল্যের পেছনেই আছে আত্মগ্লানি-নীতিহীনতা। সন্তানের প্রতিষ্ঠার কথা ভেবে যে মা-বাবা ছোট্ট শিশুদের হাতে পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছেন, ভবিষ্যতে সেই প্রতিষ্ঠার জন্যে সে মা-বাবাকেও ফেলে দিতে কুন্ঠা বোধ করবে কি? ১৯৭৯ থেকে ২০০৮ সাল এই ২৯ বছরে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ৫৫টি ঘটনা ঘটলেও সম্প্রতি তা বেড়েছে মহামারি আকারে, গত ৪ বছরে বিভিন্ন পরীক্ষায় ঘটেছে ৬৫টি প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা। অথচ সরকার এ ব্যাপারে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। ১৯৭৯ সালে প্রশ্নপত্র ফাঁসের পর ‘পাবলিক পরীক্ষা আইন’-এ প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের ১০ বছরের কারাদন্ডের বিধান ছিল, যা পরবর্তীতে কমিয়ে ৪ বছর করা হয়। অথচ সর্বশেষ প্রণীত শিক্ষা আইনে এ ব্যাপারে একটি শব্দও নেই — এ থেকে সরকারের মনোভাব স্পষ্ট। সরকার ও শিক্ষা ব্যবসায়ীরা মিলে শিক্ষাব্যবস্থাকে নিমজ্জিত করেছে অনৈতিকতার পঙ্কে। প্রশ্নপত্রফাঁস, ঘুষ, দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন শিক্ষা প্রশাসনের মন্ত্রী সর্বশেষ প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন সহনীয় মাত্রায় উৎকোচ গ্রহণ করতে। মানবিকতা, মূল্যবোধের কফিনে যেন এরা শেষ পেরেকটি ঠুকে দিতে চান। আপনার সন্তানকে এই অবস্থায় ছেড়ে দিয়ে আপনি কি নিশ্চিন্ত হতে পারেন?
খ. কোচিং বাণিজ্যের ফাঁদে শিক্ষা:
শিক্ষা এখন কোচিংমুখী। পরীক্ষা নির্ভরতার কারণে শিক্ষার মূল কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে কোচিং সেন্টার আর স্যারের বাসা। বেশির ভাগ স্কুলে অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, শিক্ষকের দক্ষতার অভাব ইত্যাদির কারণে প্রাথমিক শিক্ষার মাত্র ৪০% মান পূরণ করতে পারছে স্কুলগুলো। ফলে ভালো ফলের আশায় শিক্ষার্থীরা বাধ্য হচ্ছে কোচিং সেন্টারে যেতে। কোচিং সেন্টারগুলোও নিজেদের শ্রেষ্ঠতা প্রমাণ করতে গিয়ে ভালো ফল দেখানোর অভিপ্রায়ে যুক্ত হয়ে পড়ছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে। এ সম্পর্কে সৈয়দ আবুল মকসুদ বলছেন, “পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা যত বাড়বে, পাড়ায় পাড়ায় তত গজিয়ে উঠবে কোচিং সেন্টার। ছিল এসএসসি, এইচএসসি, স্নাতক; তাতেই ছাত্র-ছাত্রীরা কূল কিনারা পাচ্ছিল না, যোগ হলো আরও ছোটদের পিইসি, জেএসসি যন্ত্রণা। হয়তো খুব শিগগির চালু হবে কেএসসি বা কিন্ডারগার্টেন স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা দুগ্ধপোষ্যদের জন্য। ব্যবস্থাটা এমন হয়ে গেছে যে ছেলে-মেয়েদের পাবলিক পরীক্ষায় ভাল ফল করতে হলে গাইড বই ও কোচিং সেন্টারের দ্বারস্থ না হয়ে উপায় নেই।…কোচিংয়ে দৌড়াদৌড়ি করে ছেলে-মেয়েরা করছে কষ্ট, আর অভিভাবকেরা পড়েছেন অর্থকষ্টে।” বাস্তবে ২০/২৫ বছর আগে সারাদেশে ক’টিই বা কোচিং সেন্টার ছিল, আজ এসে তার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ লাখে। দেশের মোট সাড়ে ৫ কোটি শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪ কোটি ২৪ লক্ষ অর্থাৎ প্রায় ৭৮%শিক্ষার্থী কোচিং সেন্টারে যায়। আর এগুলোতে প্রতি বছর লেনদেন হয় ৫০ হাজার কোটি টাকা, যেখানে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে জাতীয় বাজেটে সরকার এ বছর বরাদ্দ করেছে ৬৫,৪৫০ কোটি টাকা। কি চমকে উঠলেন! চমকে উঠারই কথা বটে। এই রমরমা শিক্ষা ব্যবসা সরকারের বাণিজ্যিকীকরণ-বেসরকারিকরণ ও শিক্ষা সংকোচন নীতির অনিবার্য ফল মাত্র। একদিকে সরকার কোচিং ব্যবসা বন্ধে যেমন কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না অন্যদিকে কোচিং ব্যবসার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে খোদ স্কুলেই চালু করেছে বাধ্যতামূলক কোচিং। ২০১২ সালে কোচিং বাণিজ্য বন্ধের জন্যে প্রণীত নীতিমালায় স্কুলে কোচিং বাণিজ্যের বৈধতা দিয়ে বলা হয় ‘সব বিষয়ের জন্যে বিদ্যালয়ভিত্তিক কোচিং ফি ১২০০টাকার বেশি হবে না’ কিন্তু এও কেউ মানছে কি? এমনকি ৮৬ শতাংশ স্কুলই এখন তাদের শ্রেণী কার্যক্রম বাদ দিয়ে কোচিং এর দিকে ঝুঁকছে। ফলে আজ কোচিং সেন্টারই হয়ে দাঁড়িয়েছে স্কুলের বিকল্প। তাই যত দিন যাচ্ছে ততই পরিস্কার হয়ে উঠছে শিক্ষায় উন্নয়নের নমুনা। এমন উন্নয়ন আমরা চেয়েছিলাম কি?
পরীক্ষা বন্ধ করা কি যৌক্তিক?
অবস্থার চাপে পরে ভুক্তভোগী অভিভাবক ও শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের একাংশ বলছেন ছোট ছোট বাচ্চাদের আবার পরীক্ষা কী? পরীক্ষার কারণেই তো এত সমস্যা, এই পরীক্ষাই বন্ধ করে দেয়া উচিত। পরীক্ষা বন্ধ বা পাশ-ফেল তুলে দেয়াই কি এ সমস্যা থেকে সমাধানের পথ? নাকি এক সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজতে গিয়ে আরেক সমস্যা ডেকে আনা? এমনিতেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা একটি সংকটের চোরাবালি, তার উপর পরীক্ষা তুলে দিলে সংকট বাড়বে বৈ কমবে না। একটি অভিজ্ঞতার দিকে নজর দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে। আমাদের দেশের সামগ্রিক অবস্থার সাথে মিল রয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ১৯৮২ সালে সরকার পরীক্ষা বা পাশ ফেল প্রথা তুলে দেয়। এর ফলাফল কি? ১৯৯২ সালে এসে দেখা যায় “এর ফলে প্রাথমিকের শিশুদের যতটুকু শেখা উচিত ছিল তা হচ্ছে না, স্কুল ছুটের সংখ্যা বাড়ছে।” এমনকি অতি সম্প্রতি আরেক গবেষণায় তারা দেখছে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্ররা ভাল করে ইংরেজি ২৬টি অক্ষর লিখতে বা বলতে পারে না। বিজ্ঞান, গণিত এবং ইংরেজিতে তাদের অবস্থা ৩য় শ্রেণীতে পড়ুয়া ছাত্রদের মত। এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে সেখানে জনগণ আন্দোলন করছেন। পরীক্ষা পদ্ধতি তুলে দেয়ার পক্ষে আরেকটি যুক্তি হচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন মূল্যায়ন প্রক্রিয়া। শ্রেণীকক্ষে নিরবচ্ছিন্ন মূল্যায়ন করতে পারলে আলাদা পরীক্ষার দরকার হয় না। এই প্রক্রিয়া চালু করতে হলে ছাত্র শিক্ষক অনুপাত হওয়া দরকার ৫:১ জন। শুধু তাই নয়, এর জন্যে শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ জরুরি। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকারের আচরণের কারণে শিক্ষক আর অবকাঠামোর কী হাল তা আমরা পূর্বেই দেখিয়েছি। এ অবস্থায় নিরবচ্ছিন্ন মূল্যায়ন চালু করা কতটা সম্ভব? ফলে পরীক্ষা পদ্ধতি তুলে দেয়া নয় বরং প্রাথমিক স্তরে পাবলিক পরীক্ষা তুলে দিয়ে বিদ্যালয়েই পরীক্ষা বা মূল্যায়ন করা যৌক্তিক। যেটা প্রতিটি বিদ্যালয়ে পূর্বেই চালু ছিল।
কাঠামোগত বা পদ্ধতিগত পরিবর্তন কি সমাধান?
একটি শিক্ষাব্যবস্থার দুটি দিক আছে। একটি তার নীতিগত, অপরটি পদ্ধতিগত। সবাই শিক্ষা পাবে কি পাবে না, শিক্ষার দায়িত্ব কে নেবে, শিক্ষার বিষয়বস্তু বিজ্ঞানভিত্তিক হবে না সাম্প্রাদয়িক হবে — এগুলো হলো নীতিগত দিক। আর এই নীতিগত দিকটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তৈরি হয় পদ্ধতিগত দিকটি। পরীক্ষা পদ্ধতি কেমন হবে, প্রশ্নপত্র সৃজনশীল হবে কি’না, কিংবা শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ পাবে কি’না ইত্যাদি পদ্ধতিগত দিকের অর্ন্তভূক্ত। এখন যদি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকাই তাহলে দেখবো স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত যত শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে সবগুলোই নানা শব্দের আড়ালে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ-বেসরকারিকরণের পথ অবমুক্ত করেছে। অর্থাৎ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার নীতিগত দিকটি হলো শিক্ষাকে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে মুনাফা অর্জনের নীতি। ফলে এই নীতির উপর দাঁড়িয়ে যত পদ্ধতিগত বা কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে তা শিক্ষা বাণিজ্যের পথকেই প্রশস্ত করেছে, ৯২ সালে চালু করা ৫’শ নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন কিংবা ৯৬ সালে চালু করা কমিউনিকেটিভ ইংলিশ তো এর এক একটি জলন্ত উদাহরণ। গত ১০ বছরে কোনো ধরণের বিচার বিবেচনা না করে কখনও সৃজনশীল প্রশ্নপত্র (৭টি, ১০টি) চালু, কখনও পিইসি-জেএসসি চালু অর্থাৎ কাঠামোগত বা পদ্ধতিগত যত পরির্বতনই করা হয়েছে, তা মেধার মূল্যায়ন, ঝরে পড়ার হার কমানো তো দূরের কথা বরং সমৃদ্ধ করেছে শিক্ষা ব্যবসায়ীদের মুনাফার ভান্ডার। তাই পদ্ধতিগত পরিবর্তন শিক্ষাব্যবস্থার সংকটের ইতর বিশেষ উন্নয়ন করতে পারেনি। শিক্ষা ব্যবসার নীতি বহাল রেখে সবার জন্যে শিক্ষা কোনো দিনই নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
সরকার কী চায়?
ইতোমধ্যে পিইসি পরীক্ষাটি সরকার ছাড়া অন্য সকলের কাছে অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। অভিভাবক, শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবী মহল এর প্রতিবাদ করেছেন, এমন কি পরীক্ষা বন্ধে আদালতের দারস্থ পর্যন্ত হয়েছেন। কিন্তু সরকার তার অবস্থানে অনড়। সরকারের এই অনমনীয় অবস্থানের কারণ কি? এর উত্তর পেতে হলে আমাদের একটু গভীরে প্রবেশ করতে হবে, ফিরে তাকাতে হবে বর্তমান বিশ্বের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের দিকে।
ক. এমডিজি বা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন:
১৯৯০ পরবর্তী সময়ে সংকটগ্রস্থ বিশ্ব অর্থনীতিকে রক্ষার জন্যে শুরু হয় মুক্তবাজার নীতি অনুসরণে অর্থনীতিতে ব্যাপক উদারিকরণ। বিশ্বায়নের নামে এই উদারিকরণের তীব্র স্রোতে গা ভাসিয়েছে সরকার। এর ফলে রাষ্ট্র সকল ক্ষেত্রে তার ভূমিকা কমিয়ে, ভর্তুকি কমিয়ে ব্যক্তি মালিকদের উৎসাহিত করছে, রাষ্ট্রীয় সকল সীমা অতিক্রম করে যেকোনো জায়গায় ব্যক্তি মালিক তার পুঁজি বিনিয়োগ করবে এই নীতি স্বীকৃত হয়। বিশ্বায়নের এই নতুন হাওয়া ব্যবসায়ীদের জন্যে উন্মুক্ত করলো মুনাফার এক নব দিগন্ত। এর ধারাবাহিকতায় ২০০০ সালে জাতিসংঘ বিশ্বব্যাপী এক কর্মসূচি হাতে নেয় ‘মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল’ বা এমডিজি নামে। এই কর্মসূচিতে কিছু লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে। দারিদ্র ও ক্ষুধা নির্মূল, সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা, শিশু মৃত্যুর হার কমানো, নারীর ক্ষমতায়ন প্রভৃতি। এই লক্ষ্যমাত্রা বিশেষত শিক্ষাক্ষেত্রে এই লক্ষ্য পূরণে সরকার ছলচাতুরির আশ্রয় নেয়। এমনিতেই এদেশে সমস্ত শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে পারে না। যারা স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার আগেই অর্ধেক ঝরে পড়ে। এমতাবস্থায় সরকারের এমডিজি পূরণ কঠিন হয়ে যায়। ফলে পিইসি পরীক্ষায় যারা অংশগ্রহণ করে তাদের মধ্যে শতভাগ/নব্বইভাগ পাশের হার দেখিয়ে সরকার দেখাতে চাইছে সবার জন্যই প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে। এই পরিসংখ্যানের ফাঁক ফোকরে এমডিজি অর্জন করে মধ্যম আয়ের তকমা দেশের গায়ে সাঁটতে চাইছে সরকার।
খ. শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ:
এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০১৫ সালের মধ্যে সকলের জন্যে শিক্ষা নিশ্চিত করার ঘোষণা ছিল, অন্যদিকে ১৯৯০ সালে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচিও ঘোষণা করেছিল সরকার। ১৯৯৫ সালে WTO-র আওতায় গ্যাটস চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, সেখানে বাংলাদেশও স্বাক্ষর করে। যার মূল কথা হলো শিক্ষাসহ ১৬১টি পরিসেবা খাতকে দেশি বিদেশি ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেয়া। এই ব্যবসায়ীরা হিসেব করেছে যে যদি বিশ্বব্যাপী শুধুমাত্র শিক্ষাকে বাণিজিকীকরণের আওতায় নিয়ে আসা যায় তবে এক বছরেই প্রায় ৩৫০০ বিলিয়ন টাকার মুনাফা করা যাবে। সে উদ্দেশ্যেই সরকার শিক্ষাখাতে ক্রমাগত ভর্তুকি বা বরাদ্দ হ্রাস করছে। অন্যদিকে শিক্ষায় পুঁজি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করছে। বেসরকারিকরণের উদ্যোগ নিচ্ছে। এজন্যে আমরা দেখবো ২০০৮ সালে ‘প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন তথা শিক্ষার্থীর হাজিরা বৃদ্ধি, ঝরে পড়া হ্রাস, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনের হার বৃদ্ধি এবং শিক্ষার্থীর শিখন দক্ষতার গড় মান উন্নয়ন’-এর কথা বলে প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব ব্র্যাকের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল। প্রতিবাদের মুখে যদিও এই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়, কিন্তু পরের বছরই একই স্লোগান সামনে এনে পিইসি পরীক্ষা চালু করা হয়। সরকারের এসব পদক্ষেপের ফলাফল কী? ব্যানবেইস এর সর্বশেষ তথ্য মতে, প্রাথমিকের ৪৯.৩৫ শতাংশ, মাধ্যমিকের ৯৫.৩৯ শতাংশ এবং উচ্চ মাধ্যমিকের ৯৩ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারিভাবে অর্থাৎ শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান ধারাটিই এখন বেসরকারি। একইভাবে বছর শেষে কোচিং সেন্টারগুলোর ৫০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য, গাইড বই ব্যবসা, খাতা-কলম-বইসহ শিক্ষা উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি এ কথাই প্রমাণ করে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ রূপে ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গিয়েছে। পিইসি চালুর সাথেও বাণিজ্যিকীকরণের সম্পর্ক আছে। অনেকের কাছে মনে হতে পারে এ ‘ধান ভানতে শিবের গীত’, মোটেই তা নয়। একদিকে যথেচ্ছভাবে পাশের হার বাড়িয়ে এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা, অন্যদিকে যত বেশি পাবলিক পরীক্ষা আর পরীক্ষার্থী তত বেশি ব্যবসা, ততোধিক লাভ। শুধু তাই নয়, এর ফলে যে স্কুল নির্মাণ বা অবকাঠামোগত পরিবর্তন ঘটবে তাতেও সৃষ্টি হবে নতুন নতুন বাণিজ্য। এ কারণেই বিশ্বব্যংকের পরামর্শে স্কুল পর্যায়ে স্যাকায়েপ চালু কিংবা শিক্ষানীতি-২০১০ এ সম্পদশালীদের শিক্ষাক্ষেত্রে এগিয়ে আসার আহ্বান করা হয়েছে। এত কিছুর পর ২০১৭ সাল অতিক্রান্ত কিন্তু সরকার এখনও শিক্ষাক্ষেত্রে এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষা ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত করার কথা ছিল । কয়েকবার ঘোষণা দিয়েও সরকার সে অবস্থান থেকে সরে এসেছে। কারণ চরম আর্থিক বৈষম্য ও অভাবের কারণে পঞ্চম শ্রেণী পাশ করা শিক্ষার্থীদের এক তৃতীয়াংশ ঝরে পড়ে অষ্টম শ্রেণীতে যাওয়ার পূর্বেই। তাই প্রাথমিক শিক্ষার গন্ডি পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত রেখে এবং পিইসি বহাল রেখে পাশের হার যথেচ্ছভাবে বাড়িয়ে দিয়ে ‘সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ অর্জন করতে চায় সরকার। ফলে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট, সে শিক্ষাকে ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিতে চায়। পিইসি-জেএসসি পরীক্ষা এর নতুন সংযোজন মাত্র।
শিশুর প্রাণবন্ত শৈশবের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলুন
মানব জীবনের সবচেয়ে আনন্দময়, প্রাণবন্ত সময় শৈশব আর কৈশোর। জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাতে কত কিছু হারিয়ে যায় তবু অম্লান হয়ে থাকে এই স্মৃতিটুকু। একে নিয়ে কত কল্পনা, কত স্মৃতি। আজ এই শৈশব যেন ধূসর, দুরন্ত কৈশোর আজ বন্দী। এমনিতেই খেলার মাঠ দখল করে নিচ্ছে গগনচুম্বি অট্টালিকা, খোলা আকাশের বিশালতা ঢেকে যায় স্যাটেলাইটের বাহারি প্রচারণায়, তার উপর আবার চেপেছে পরীক্ষা আর বইয়ের বোঝা। চারপাশের এই তীব্র প্রতিযোগিতায়, রিলে রেসে ক্লান্ত এদেশের শিশুদের শৈশব কৈশোর। অন্যকে হারিয়ে দেয়ার উত্তেজনায় ‘এ প্লাস’ হয়তো সে পায় কিন্তু অজান্তেই হারিয়ে তার ভেতরের মানুষটি। পড়ার চাপে ক্লান্ত কচি মুখগুলো ভোগতে থাকে একাকিত্বে, মানসিক যন্ত্রণায়। প্রবল মনোদৈহিক অস্থিরতায় বেড়ে উঠা মানুষগুলো পরিণত হয় এক একটি যন্ত্রে। মায়ের ভালবাসা, পিতার শাসন, বোনের স্নেহ কিছুই তাকে স্পর্শ করে না। এমনই মানুষ তৈরি হচ্ছে আমাদের ঘরে ঘরে। আমাদের স্বপ্ন, আমাদের ভালবাসা, আমাদেরই অজান্তে হারিয়ে যাচ্ছে। এ দায় কার? তাই আসুন নির্বিকার নিশ্চিন্ত না থেকে আমাদের শিশুদের রক্ষা করি। সর্বনাশা পিইসি পরীক্ষার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলি। শিশুর প্রাণবন্ত শৈশব আর দুরন্ত কৈশোর নিশ্চিত করি। প্রত্যেকেই নিজ নিজ অব¯’ান থেকে প্রতিরোধে সামিল হোন, অঞ্চলে অঞ্চলে গণ সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন।
তথ্যসূত্রঃ
১.আবুল মোমেনঃ ‘হা শিক্ষা, হা পরীক্ষা’ ‘শিশুর জন্যে আমাদের প্রস্তুতি’ ‘শিক্ষাকে বলি দিয়ে শিক্ষা বিস্তার’ ‘শিক্ষার উল্টো যাত্রা আর কত দিন চলবে’।
২.সৈয়দ আবুল মকসুদ : ‘শিক্ষা,পরীক্ষা ও কোচিং সেন্টার’।
৩.তরুন কান্তি নস্করঃ ‘বিদ্যালয় স্তরে পাশ ফেল প্রথার অবলুপ্তি শিক্ষায় আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রনের প্রকৃষ্ট উদাহরণ’।
৪.রাখাল রাহাঃ ‘যে কারণে পিইসি বাতিল করা যাচ্ছে না’।
৫.নিশাত সুলতানা : ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা’।
৬.মুনির হাসান : ‘সবার উপরে পরীক্ষা সত্য’ ‘শিক্ষকদের কাজ শিক্ষকদের করতে দাও’।
৭.সাম্যবাদ : ডিসেম্বর’১৭ ও জানুয়ারি’১৮ সংখ্যা।
৮.অনুশীলনঃ এপ্রিল-২০১৫, জুন-২০১৬,আগস্ট-২০১৭ সংখ্যা।
৯.শিক্ষা ব্যয়বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলুন- সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট।
১০.আনু মুহাম্মদ : সরকার স্কুল করে না কেন?
১১.দৈনিক শিক্ষাঃ ১৫ ও ২১ জানুয়ারি’১৬ এর আপডেট।
১২.রিচার্স ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব কমপ্লিট এডুকেশন (রেস) এর রির্পোট।