প্রধানমন্ত্রীর সম্পূর্ণ কোটা বাতিলের ঘোষণা অযৌক্তিক
ব্যবহৃত রাবার বুলেট আর টিয়ারশেলের কৌটা পড়ে আছে রাস্তায়। টিয়ারশেলের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধে চোখের তীব্র জ¦ালা আর শ্বাস বন্ধ হবার যোগার। শাহবাগ থেকে পুরো ক্যাম্পাসে একই অবস্থা। বৃষ্টির মতো ছোড়া হয়েছে রাবার বুলেট। চালানো হয়েছে অকথ্য লাঠিচার্জ। বুকে, পিঠে, চোখে লেগে মারাত্মক আহত হওয়া দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী ততক্ষণে হাসপাতালে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইট, কাঠ, পাথর, বাঁশ। স্থানে স্থানে ধোঁয়ার কুন্ডলী। যেন এক যুদ্ধক্ষেত্র। গত ৮ এপ্রিল রাত ১০টায় শাহবাগের চিত্র এটি। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশি নির্মমতার প্রতিচ্ছবিও। এমন নিষ্ঠুর আক্রমণ এখানেই থেমে থাকেনি। চলেছে রাতভর। পুলিশের সাথে পরে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। চলেছে যৌথ সন্ত্রাসী কার্যক্রম। পরবর্তীতে এদের কিছু না হলেও অজ্ঞাতনামা কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ৪টি মামলা করা হয়েছে।
যাদের উপর এমন পুলিশ-ছাত্রলীগ দিয়ে নির্যাতন চালানো হলো, কিংবা কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর ভাষায় যারা ‘রাজাকারের বাচ্চা’, তারা আসলে কারা? কী ছিল তাদের দাবি? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, চট্টগ্রাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকার সাত কলেজের শিক্ষার্থীবৃন্দ এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজসমূহের যে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী এই আন্দোলন করেছে, তারা প্রায় সবাই দেশের মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। শিক্ষিত হয়ে একটা কর্মসংস্থানের সুযোগ পাওয়া এদের বড় প্রয়োজন, তাদের প্রতি পরিবার-পরিজনের প্রধানতম প্রত্যাশা। পরিবারগুলোর সবচেয়ে বড় বিনিয়োগের জায়গাও তাদের পড়াশুনা। তারাই নেমেছিল এই আন্দোলনে একটি যৌক্তিক দাবি তুলে ধরে। দাবিটি ছিল বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের। কিন্তু অন্য আরও অনেক দাবির মতো তাদের দাবিও সরকার এতদিন কর্ণপাত করেনি। একগুয়েমি দেখিয়ে বলেছে ‘কোটা সংস্কারের কোনো সুযোগ নেই।’
শুধু এতটুকুতেই সরকারের কর্তাব্যক্তিরা সন্তুষ্ট থাকেননি। অন্যান্য সময়ের মতো আন্দোলনকারীদের ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ’ বলে ভাগ করার চেষ্টা করেছে। আন্দোলনকারীদের ‘জামাত-শিবির কর্মী’, ‘বিএনপি’র স্বার্থরক্ষাকারী’, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধিতাকারী’, ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ ইত্যাদি নানা কিছু বলে বাস্তবে সারাদেশের মানুষ, মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানদের অপমান করেছে। কিন্তু জনগণের প্রতি ন্যূনতম দায়বোধ থাকলে তারা বুঝতে পারতো — কতটা পতিত দশার কারণে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী এভাবে আন্দোলনে যুক্ত হলো। বুঝতো, সরকারের উন্নয়নের গল্পের ভাগীদার এই ছেলে-মেয়েরা বা তাদের পরিবার-পরিজন নয়। দেখতে পেত, একদিকে সম্পদ-বিত্ত-বৈভবের পাহাড় জমা হলেও লক্ষ লক্ষ ছেলে-মেয়েরা আজও তাদের শিক্ষাগ্রহণের দিনগুলোতে হলে-মেসে থাকে কষ্ট করে, বাসে-ট্রেনে ঝুলে যাতায়াত করে, খেয়ে-না খেয়ে তাদের স্বপ্নগুলো বাঁচিয়ে রাখে শিক্ষা শেষে কাজের আশায়। তাদের বৃদ্ধ বাবা-মায়েরাও দিন গোনে সন্তানের মাধ্যমে কষ্টের দিনগুলো পাল্টানোর। কিন্তু সে ব্যাকুলতা শোনার সময় কোথায় সরকারের? তারা ব্যস্ত ষড়যন্ত্র খুঁজতে। তাই তো পুলিশ আর সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিতে পেরেছে তারা।
কিন্তু এটা ঘটনার একটা দিক মাত্র। এবারের কোটা আন্দোলন দেখিয়েছে সাধারণ মানুষের অসাধারণ ক্ষমতার নমুনা। যুক্তির শক্তি আর সাহসের সাথে ঐক্যবদ্ধ হলে যেকোনো দমন-পীড়ন-নির্যাতন যে রুখে দেয়া যায়, তেমন দুর্দমনীয় শক্তির স্ফূরণ। দেশব্যাপী লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে আসাতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন বাস্তবে গণআন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। ঢাকা শহর কার্যত অচল হয়ে পড়েছিল। এতে জনগণের কষ্ট হয়েছে সত্যি। কিন্তু তবুও এ আন্দোলনে ছিল তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন। পথচারীরা আন্দোলনকারীদের পানি, খাবার দিয়েছে। জানিয়েছে তাদের আবেগের কথা।
আন্দোলনকারীরাও জরুরি সেবা নিতে যাওয়া যাত্রীদের, অ্যাম্বুলেন্সে থাকা রোগীদের রাস্তা ছেড়ে দিয়ে চলাচলে সহযোগিতা করেছে। আন্দোলন যে উচ্চ সংস্কৃতির জন্ম দেয়, তাও দেখা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলে-মেয়েরা রাতভর একসাথে রাজপথে থেকেছে। কিন্তু কোথাও শোনা যায়নি লাঞ্ছনা-অপমানের কথা। স্লোগানে মুখরিত ছিল ক্যাম্পাস। একে দাঁড়িয়েছে অন্যের প্রয়োজনে। এক খাবার ভাগাভাগি করে খেয়েছে। তথাকথিত বড় ভাই-বোনদের চরম অপমান-নিপীড়নের পরও যারা এতদিন সবকিছু মুখ বুজে সয়েছে, তারও চোখে চোখ রেখে প্রতিবাদ করেছে, সকল বাধা উপেক্ষা করে আন্দোলনে এসেছে। ভাইদের আহত হবার কথা শুনে রাত ১টায় হলের তালা ভেঙে বেড়িয়ে এসেছে বোনেরা। সুফিয়া কামাল হলে ছাত্রী নির্যাতনের খবর পেয়ে মধ্যরাতে ছুটে গেছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি হল, ক্যাম্পাস সন্ত্রাসী আর দখলদারী শক্তির আখড়া, যেখানে ‘গেস্টরুম কালচারের’ নামে চরম শারীরিক-মানসিক নির্যাতন চালানো হয়, যেখানে ভিন্ন চিন্তা, ভিন্ন মতাদর্শ নিয়ে হলে অবস্থান করা দুঃসাধ্য — সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের এভাবে রাস্তায় নেমে পড়াটা ছিল বহুদিনের অচলায়তন ভেঙে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের শক্তি নিয়ে দাঁড়ানো। পরিস্থিতি এমন ছিল, আন্দোলনের চাপে সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রলীগের সভাপতিকে ছাত্রী নির্যাতনের দায়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! কী নির্ভয়, আর কতটা মানবিক!
শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত যৌক্তিক দাবি নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিল। কেননা বাংলাদেশে সরকারি তথ্য মতেই প্রায় ৪ কোটি ৮২ লক্ষ বেকার। প্রতিবছর শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে ১২-১৫ লক্ষ যুবক-যুবতী। নতুন কর্মসংস্থান প্রায় নেই, সরকারি চাকুরির সুযোগ ভীষণ অপ্রতুল। বেশিরভাগ বেসরকারি চাকুরিতে অর্থনৈতিক-সামাজিক নিরাপত্তা বলে প্রায় কিছু নেই। তাই তরুণ-তরুণীরা হন্যে হয়ে ‘সোনার হরিণ’ হয়ে ওঠা সরকারি চাকুরির জন্য ছুটছে। এরকম অবস্থায় জেলা কোটা, নারী কোটা, মুক্তিযোদ্ধা কোটা, উপজাতি কোটা, প্রতিবন্ধী কোটা ইত্যাদি প্রায় ২৫৮ ধরনের কোটার ব্যবস্থা রেখেছে সরকার। সরকারি চাকুরিতে কোটার ভাগ ৫৬%। মেধার ভিত্তিতে কাজের সুযোগ আছে মাত্র ৪৪ শতাংশের। অর্থাৎ সাধারণের চেয়ে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্তদেরই সুযোগ বেশি। ফলে বৈষম্য বেড়েছে প্রকটভাবে। অথচ বিশেষ অংশের জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা প্রথা চালু হবার পিছনে কারণই থাকে বৈষম্য দূর করা। কোটাকে বলা হয় Positive discrimination। অর্থাৎ আপাত অর্থে বৈষম্য মনে হলেও এটা আসলে একটা নির্দিষ্ট সময় পর বৈষম্য দূর করারই একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু এমনটা হয়নি আমাদের দেশে। বিশেষ অংশের সুবিধা দেবার নামে বৈষম্যই বেড়েছে। তাই কোটা প্রথা সংস্কারের দাবি উঠেছে। দেশের সকল প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ এই দাবিকে সমর্থন জানিয়েছেন। কিন্তু টনক নড়েনি সরকারের।
১৯৭২ সাল থেকে চালু হওয়া কোটা প্রথায় অন্যান্য কোটার সাথে ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা’ ছিল। আজও আছে। সেদিন কেবল মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানদের জন্য এই সুবিধা দেয়া হয়েছিল, এখন ঘোষণা করা হয়েছে তাদের নাতি-পুতিরাও এই সুবিধা পাবে। এই কোটার হার ৩০ শতাংশ। ১৯৭২ সালে গণপরিষদ বিতর্কে ‘আহত ও পঙ্গু’ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটার সুবিধা দেবার কথা ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এটা সকল মুক্তিযোদ্ধার জন্য কার্যকর করা হয়। এর মাধ্যমে ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে বিতর্কের বিষয়বস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে বিভক্তি টানা হয়েছে। অথচ সংবিধানেও এভাবে কোটা সুবিধার ব্যাপারে কিছু বলা নেই। নাগরিকের মধ্যে যে ‘অনগ্রসর’ অংশের কথা সংবিধানে বলা হয়েছে তার মধ্যে সকল মুক্তিযোদ্ধারা পড়েন না। আবার একজন মুক্তিযোদ্ধা দেশের জন্য লড়েছেন কিন্তু এর সুফল কেবল তার নাতি-পুতিরা পাবে কেন? এই সুযোগ কি তাদের জন্য সুবিধা নয়? আহত ও নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের জন্য কোটা সুবিধা থাকতেও পারে। কিন্তু ঢালাওভাবে সকলের জন্য এবং বিশেষত তাদের কয়েক প্রজন্মের জন্য এই সুবিধা যৌক্তিক হতে পারে না।
মুক্তিযোদ্ধা কারা — সেটাও কি ঠিক করতে পেরেছে সরকার? যিনি অস্ত্র নিয়ে সম্মুখ সমরে ছিলেন তিনি যেমন যুদ্ধ করেছেন, তেমনি যিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন তিনিও এই সংগ্রামের অংশীদার। অল্প কিছু রাজাকার-আলবদর ছাড়া কোটি কোটি জনগণ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এই সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন। ৩০ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছেন, ২ লক্ষ নারীকে অকথ্য নির্যাতন করা হয়েছে। স্বীকৃতি দিতে হলে তো এদের প্রত্যেককেই দিতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সঠিকভাবে আজও নির্ণীত হয়নি। একেক সরকারের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পাল্টে একেকরকম হয়েছে। ১৯৮৬ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের তালিকা অনুসারে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৬৯ হাজার ৮৩৩। অথচ বর্তমান সরকারের প্রথম দিকের একটি তালিকায় ২ লাখ ২ হাজার ৩০০ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম প্রকাশিত হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন — এই মর্মে আপত্তি দাখিল হয়েছে ৬২ হাজার। (তথ্যসূত্র : প্রথম আলো, ১২ এপ্রিল) সম্প্রতি খবর বেড়িয়েছে- প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের পাঁচ সচিব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নিয়ে চাকুরি করছেন। (তথ্যসূত্র : বিডিনিউজ ২৪ ডট কম, ১৬ এপ্রিল ’১৮) এভাবে কোটার লোভে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা দিয়ে তালিকা ভরানো কেবল ভয়াবহ দুর্নীতির উদাহরণই নয়, আত্মত্যাগী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চরম অপমানেরও।
আওয়ামী লীগ সরকার এই যন্ত্রণা ধারণ করার সামর্থ্য রাখে না। কেননা মুক্তিযুদ্ধও তাদের কাছে রাজনীতির কূটকৌশলের একটি হাতিয়ার। সব অপকর্মই তারা করে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র কথা বলে। আজ বাংলাদেশ খেলাপি ঋণে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে, বিদেশে অর্থ পাচারে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে, সবচেয়ে কম মজুরিতে এশিয়ার মধ্যে শীর্ষে, পরিবেশ সুরক্ষায় ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৭৯ তম। এগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আক্রান্ত হয় না। হয় কেবল কোটার ব্যাপার আসলে?
এমন অন্যায্য কোটা প্রথার বিরুদ্ধে লক্ষ শিক্ষার্থী রাস্তায় নামে। প্রথমে ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’র নামে কোটা আন্দোলন শুরু হলেও ক্রমেই তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী ছাত্রদের দাবির মুখে গত ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদের এক প্রশ্নোত্তর পর্বে কোটাব্যবস্থা সম্পর্কে বক্তব্য দিতে বাধ্য হন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে ছাত্র-জনতার আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। শিক্ষার্থীরা কোটা প্রথা সংস্কারের দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তা পুরোপুরি বাতিলের কথাই বলেছেন। তাঁর পুরো বক্তব্য ছিল স্ববিরোধিতায় পূর্ণ। তিনি এই আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়েও তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। সবচেয়ে বড় ব্যাপার — তাঁর এই ঘোষণার ফলে প্রতিবন্ধী, আদিবাসী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনসাধারণের জন্য স্বীকৃত যে অধিকার ছিল তাও সংশয়ের মধ্যে পড়ে গেছে। বর্তমানে দেশের বৈষম্যমূলক আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে কোটা প্রথা পুরোপুরি বিলোপ সাধনের সুযোগ নেই। এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করে একটা যৌক্তিক সংস্কারের কথাই আন্দোলনকারী এবং বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন। কিন্তু তা না করে যদি কোটা পুরোপুরি তুলে নেয়া হয় তাহলে প্রকৃত অর্থেই যারা কোটা সুবিধা পাবার যোগ্য তাদের সাথে অন্যদের দ্বন্দ্বের সুযোগ তৈরি হবে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য এমন বিভ্রান্তিই ছড়িয়েছে।
কোটা আন্দোলন অনেক আকা-বাঁকা পথে এগিয়েছে। ছাত্রলীগ সারাদেশে আন্দোলনের বিরোধিতা করলেও, হামলা-নির্যাতন করলেও পরে এসে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর বিজয় মিছিলও করেছে। ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ নামের ব্যানারে কেন্দ্রীয় কমিটি আন্দোলনকে সঠিকখাতে পরিচালিত করতে পারেনি। ৯ এপ্রিল আন্দোলন যখন উত্যুঙ্গ অবস্থায়, তখন তারা সরকারের সাথে বৈঠক করে এক মাসের জন্য কর্মকা- স্থগিত রাখার ঘোষণা দেয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় কমিটির এই নির্দেশনা বিপুল অংশের শিক্ষার্থীরা মেনে নেয়নি। তারা এরপরও আন্দোলন চালিয়ে গেলে এবং সারাদেশে একযোগে শিক্ষার্থীরা নেমে গেলে কেন্দ্রীয় কমিটি তার আগের অবস্থানে থাকতে পারেনি। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী সম্পূর্ণ কোটা বাতিলের অযৌক্তিক ঘোষণা দেবার পরও তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে ‘মাদার অব এডুকেশন’ আখ্যা দিয়ে আন্দোলন শেষ করার ঘোষণা দিয়েছে। এই আন্দোলনে নেতৃত্বের একটি অংশের মধ্যে শুরু থেকেই সরকারকে খুশি করে দাবি আদায় করার প্রবণতা দেখা গেছে। ব্যানারে, স্লোগানে ছিল তারই ছাপ। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। সরকারের নির্মম দমন-পীড়ন ঠিকই আন্দোলনকারীদের উপর নেমে এসেছে। মাঠের লড়াইয়ে থেকে অনেকেই তখন সরকারের প্রকৃত স্বরূপটি বুঝতে পেরেছে। একপর্যায়ে আন্দোলন তাই সরকার বিরোধিতার দিকেই ধাবিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ছাত্রদের দাঁড়ানো, মতিয়া চৌধুরীসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীদের ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্যের জোড়ালো প্রতিবাদের মধ্যে এই পরিবর্তন বোঝা যায়।
৫৬ শতাংশ কোটা থাকা যেমন অন্যায্য তেমনি সম্পূর্ণরূপে কোটা ব্যবস্থা তুলে দেয়াও অসঙ্গত। এটাই করেছে দেশের সরকার। তবে একটা কথা সবসময় মনে রাখা দরকার, সকলের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করাসহ জনগণের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ কোনো সরকারই করতে পারবে না। কারণ যে ব্যবস্থা দেশে চলছে সেখানে ব্যক্তিগত মুনাফার প্রয়োজনের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় শিল্প-কলকারখানার সংখ্যা, উৎপাদনের সীমা। সকল মানুষের মধ্যে সুযোগের সমতা এখানে বিবেচিত হয় না। তাই কোথা প্রথা বাতিল কিংবা সংস্কার কোনোটি করেই দেশের সকল কর্মক্ষম ব্যক্তির কর্মসংস্থানের সুযোগ এই ব্যবস্থায় করা সম্ভব হবে না। তাইতো দেশে একদিকে বিপুল প্রবৃদ্ধির গল্প শোনা গেলেও ৮০ হাজার বেকার প্রতিবছর নতুন করে যুক্ত হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশের তকমা গায়ে লাগলেও ৪৭ শতাংশ উচ্চশিক্ষিত যুবক থেকে যাচ্ছে বেকার। প্রতিনিয়ত বাড়ছে কোটিপতি আর গৃহহীন মানুষের সংখ্যা। এই ব্যবস্থাটার নাম পুঁজিবাদ। একে পাল্টে সবক্ষেত্রে উৎপাদনের সামাজিক মালিকানার পত্তন আজকের দিনে মানুষের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের একমাত্র পথ।
কোটা আন্দোলন একটা ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থার সংস্কারের কথা বলল। সেই অর্থে এটি একটি সংস্কারমূলক আন্দোলন। এই আন্দোলন করতে গিয়ে দেশের লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণী কিছুটা হলেও চিনেছে রাষ্ট্রের স্বরূপ, দেখেছে শাসকের নিপীড়ন। একইভাবে উপলব্ধি করেছে যৌথভাবে লড়াইয়ের শক্তি। এই আন্দোলনেই উন্মোচিত হয়েছে শাসকের অনুগত তথাকথিত সুশীল সমাজ, সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের ধামাধরা শিক্ষকসমাজ, মাথা বিক্রি করা বুদ্ধিজীবীদের স্বরূপ। এই আন্দোলনের তাই অনেক অর্জন। নানা দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে যে তারুণ্য আজ সংস্কারের জন্য দাবি তুলছে, তারাই হয়তো একদিন সবকিছু নিয়ে দাঁড়াবে ব্যবস্থাটিরই আমূল পরিবর্তনের জন্য। সেই দিনের জন্যই এদেশের নিপীড়িত জনগণ, সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের যত অপেক্ষা। সেই ক্ষণ যত এগুবে, ততই ছাত্র-জনতার মুক্তির পথ ক্রমেই পরিস্ফূট হতে থাকবে।