Monday, December 23, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - মে ২০১৮অর্থনৈতিক সংকটের গতিমুখ কোন দিকে?

অর্থনৈতিক সংকটের গতিমুখ কোন দিকে?

money_laundering_0

ব্যাংক খাতে সম্প্রতি সংঘটিত একের পর এক দুর্নীতির জের ধরে দেশের পুঁজিবাদী অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়েছে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, নিয়ন্ত্রণহীন এই লুটপাট যদি থামানো না যায়, তাহলে দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি দুই-তিন বছরের মধ্যেই ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। আসলে যে-কোনো অর্থনৈতিক সংকটে সবচেয়ে বেশি মাশুল দিতে হবে শ্রমজীবী মানুষ এবং মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তকে। যাদের কারণে এই সংকট, তারা ততটা ভুগবে না। কারণ, জনগণের টাকায় ওইসব লুটেরাদের ‘বেইল আউট’ করা হয়।

এই লুটপাটের নেতৃত্ব দিচ্ছে তথাকথিত ব্যবসায়ীদের একটা অংশ। এদের ‘তথাকথিত’ বলার কারণ হচ্ছে – বলতে গেলে এদের তেমন কোনো পণ্য উৎপাদন নেই। শুধু ব্যাংক ঋণ পাওয়ার জন্যই এরা কিছু পণ্যের উৎপাদন দেখায়। আগে এই লুটপাটকারীরা ব্যাংক ঋণ আত্মসাৎ করতো, আর এখন দখলে নিচ্ছে পুরো ব্যাংকই। লুটপাটের নতুন এই ধরন শুরু হয়েছে ২০১৭ সাল থেকে।

পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে লুটপাট একটি সাধারণ বিষয়। ইউরোপের পুঁজিতন্ত্র বিকশিত হয়েছে সারা দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে থাকা উপনিবেশগুলি লুট করে। আবার ভারতসহ বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি দখলের মাধ্যমেই পুঁজিতন্ত্রের বিকাশ হয়েছে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রধান সংকট হচ্ছে দেশ থেকে পুঁজি পাচার।

প্রশ্ন হলো, কীভাবে এই পুঁজি পাচার হচ্ছে? ব্যবসা-বাণিজ্য তো বৈধভাবেই হচ্ছে, তাহলে মুদ্রাপাচার কীভাবে হচ্ছে?
কারখানায় শ্রমিক, জমিতে কৃষক আর বিভিন্ন সেবাখাতে মধ্যবিত্ত যে শ্রম দেয়, তার মাধ্যমেই পুঁজি তৈরি হয়। এই পুঁজির স্থানিক রূপ হচ্ছে টাকা আর বৈশ্বিক প্রতীক হচ্ছে মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ থেকে এখন প্রধানত দুই প্রক্রিয়ায় পুঁজি বা টাকা পাচার হচ্ছে। এই ধরনগুলো হচ্ছে – আমদানির সময় পণ্যের নির্ধারিত দামের সময় বেশি মূল্য দেখানো আর রফতানির সময় কম মূল্য নির্ধারণ করা। সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট’ দীর্ঘদিন ধরে এই প্রক্রিয়ায় পুঁজি পাচার বা মুদ্রাপাচারের বিষয়ে সতর্ক করে আসছে।

টাকা পাচার করার জন্য দেশের পুঁজিপতিদের একটা অংশ এই উভয় প্রক্রিয়াই অনুসরণ করছে। আর এ কাজে ব্যবহার করছে তাদের দখল করা ব্যাংকগুলোকে। বাংলাদেশ ব্যাংকও তাদের এই অনিয়ন্ত্রিত পুঁজি পাচার বন্ধ করতে পারছে না। কারণ, ব্যাংকিং সেক্টরের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির উচ্চপদে বসানো হয়েছে ওইসব লুটেরা-পাচারকারীদের প্রতিনিধি। এর সাথে যুক্ত হয়েছে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতার ব্যবহার।

এরপরও টাকা পাচারের ছোট কিছু ঘটনা সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, এবি ব্যাংকের মাধ্যমে গত দুই বছরে সিঙ্গাপুর ও আরব আমিরাতে পাচার হয়েছে ৫০৫ কোটি টাকা। অন্য ব্যাংকেও এই ধরনের পাচার এখন দেদারছে চলছে। কিন্তু সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন দল স্বাধীনভাবে কাজ করার অনুমতি পায়নি। এবি ব্যাংকের মালিকগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি’র বলে এই ধরনের কেলেঙ্কারির তথ্য প্রকাশিত হয়।
সিঙ্গাপুরের সংবাদপত্র দ্যা বিজনেস টাইমস ২০১৬ সালের জুলাইয়ে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাংলাদেশের এস আলম গ্রুপ সেখান ৮১০ কোটি টাকা দিয়ে বড় স্থাপনা কিনেছে। ওই সময় সাংবাদিকরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করে। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ থেকে কোনো ব্যবসায়ী দেশের বাইরে বিনিয়োগ করতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু এস আলম গ্রুপের এই ধরনের কোনো অনুমোদন ছিল না।

টাকা পাচারের পাশাপাশি এই গ্রুপটি গত এক বছরে ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক দখল করে নিয়েছে। এছাড়া ইউনিয়ন ব্যাংক, আল-আরাফাহ ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এখন এই গ্রুপের মালিকানাধীন।

এস আলম গ্রুপের পাশাপাশি বেক্সিমকো, এজি অ্যাগ্রো লিমিটেড, ইলিয়াছ ব্রাদার্সসহ আরও বেশকিছু প্রতিষ্ঠান বিপুল অংকের ব্যাংক ঋণ নেওয়ার মাধ্যমে অর্থনীতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আর এই ধরনের লুটপাটের খেসারত দিতে গিয়ে ফার্মার্স ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার পথে বসেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একই রকম লুটপাট হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে। এসব ব্যাংককে বাঁচানোর জন্য সরকার ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১৮ হাজার ৫০৫ কোটি টাকার বেইল আউট দিয়েছে। আগামী অর্থবছরেও দেওয়া হবে ২ হাজার কোটি টাকা। অন্যথায়, এসব সরকারি ব্যাংক অনেক আগেই দেউলিয়া হয়ে যেত।

বর্তমানে ব্যাংকিং সেক্টরে ভয়াবহ রকমের টাকার সংকট চলছে (তারল্য সংকট)। এই টাকা গেল কোথায়? দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা বলছে, মুদ্রাপাচারের জের ধরেই এই সংকটের উদ্ভব। গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্য়ন্ত ৬১.৬৩ বিলিয়ন ডলারের মুদ্রাপাচার হয়েছে। ২০১৪ পরবর্তী বছরগুলোতে পাচার হওয়া টাকার পরিমাণ কত সে বিষয়ে সংস্থাটি এখনও কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। তবে এই হার যে বেড়েছে তা ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের ব্যাপকতাই ইঙ্গিত দেয়। ২০১৭ সালে খেলাপি ঋণ বেড়ে ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে, যা আগের বছর ছিল ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা।

প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে কতদিন চলবে? এর পরিণতি কী হবে?

মুদ্রা পাচার আর খেলাপি ঋণের এই সংকটের যদি এখনই লাগাম টানা না যায়, তাহলে গোটা আর্থিক খাত ভয়াবহ এক সংকটের মুখে পড়ে যাবে।

প্রথমত, ব্যাংকগুলো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও আমানতকারীদের টাকা সরবরাহ করতে ব্যর্থ হবে। একই সঙ্গে আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহও করতে পারবে না। প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে না পেরে শিল্প কারখানাগুলো বাধ্য হবে তাদের উৎপাদন কমাতে বা বন্ধ করতে। সেবা খাতও এই সঙ্কট থেকে মুক্তি পাবে না। পরিণামে লাখ লাখ শ্রমিক ও পেশাজীবী বেকার হবে। ২০০৮ সালে উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপ এই রকম সঙ্কটে পড়েছিল।

প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার কি টাকা ছাপিয়ে এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে পারে? সাধারণভাবে মনে হয়, পারে। কিন্তু অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী তা সম্ভব নয়। কারণ, সুনির্দিষ্ট সম্পদের বিপরীতে টাকা ছাপাতে হয়। অন্যথায়, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। একই রকম সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল জিম্বাবুয়ে। দেশটি মিলিয়ন ডলারের নোট ছাপিয়েও সঙ্কটের মোকাবেলা করতে পারেনি।

আপাতত শ্রমজীবী মানুষের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার (রেমিট্যান্স) মাধ্যমে অর্জিত ডলারের মাধ্যমে অর্থনীতির এই সংকট মোকাবেলা করা হচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটা সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, মুদ্রাপাচার যে গতিতে হচ্ছে, সে হারে রেমিট্যান্স আসছে না। বাংলাদেশের চলতি হিসাবের গতিপ্রকৃতি দেখলে এ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। চলমান অর্থবছরের প্রথম আট মাসে চলতি হিসাবে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭.০৬-৭.০৭ বিলিয়ন ডলার। এটা ইতিহাসের সর্বোচ্চ ঘাটতি। ‘চলতি হিসাব’ হচ্ছে একটি দেশ থেকে বৈধপথে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে কী পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসল এবং গেল তার ফলাফলের সূচক। এই ধরনের রেকর্ড ঘাটতি আগে কখনোই বাংলাদেশ মোকাবেলা করেনি।

অর্থনীতির এই পুরো পরিস্থিতিকে কেউ বলছেন টাইম বোমা, কেউ বলছেন ভূমিকম্পের পূর্বাভাস। নাম যাই দেওয়া হোক, সংকট চূড়ান্ত রূপ নিলে তার ফলাফল কী হতে পারে সেটা প্রতিটি সচেতন মানুষকে অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে।

সাম্যবাদ মে ২০১৮

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments