গত ৩ এপ্রিল বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুন লেগে নিহত হয়েছেন ২৬ জন। আরও বহু লোক গুরুতর আহত হয়ে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতলে চিকিৎসাধীন। এ ঘটনারও প্রায় একমাস আগে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকান্ডে নিহত হয়েছেন ৭৮ জন। বার্ন ইউনিটে এই মূহুর্তে কতজন পড়ে আছেন কেউ জানে না। ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর কোন হিসাব এদেশে রাখা হয় না।
এফ আর টাওয়ার অগ্নিকান্ডের কয়েকদিন আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেল বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবরার। আবরার গত বছর নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছিল তার বন্ধুদের সাথে। গত বছরের ২৯ জুলাই রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ২ জন শিক্ষার্থী বাস চাপায় মারা যায়। এর প্রতিবাদে এক অভূতপূর্ব ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠে। আবরার সেই আন্দোলনের একজন কর্মী ছিল। একবছরও পার হল না, আবরারকে নিয়ে আরেকটা আন্দোলন শুরু হল।
রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের আরও অনেকেই সেদিন গাড়ির নিচে চাপা পড়েছিলেন। পত্রপত্রিকায় অন্তত ১২ জনের কথা এসেছে। সেই ১২ জনের কী হলো আমরা তা জানি না। আমাদের লাশের অভাব নেই। অপচয়ের মৃত্যু এত বেশি যে আমাদের হিসাব রাখাও চলে না। নতুন লাশ আসে, পুরনো লাশ চাপা পড়ে যায়।
প্রতিদিন গড়ে ২০ জন মানুষ মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়। শ্রমিকদের মৃত্যুর খবর মিডিয়ায় বেশি আসে না, বজ্রপাতে কৃষকরা কিংবা গ্রাম-শহরের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ নানা দুর্ঘটনায় মরলে খবর হন না বেশিরভাগ সময়ে। ছাত্রদের মৃত্যুর খবর আসে। তাদের সহপাঠীরা রাস্তায় নামে। শিক্ষিত সচেতন সমাজ আক্ষেপ করেন,‘ছেলেটা বা মেয়েটা বেঁচে থাকলে হয়তো কোনদিন বড় কিছু একটা হতো।’
এই মৃত্যুগুলো খুব কষ্ট দেয় সত্য। কিন্তু এর কারণ কী? এই মৃত্যুর মিছিল কাদের সৃষ্টি? সেই আলোচনাটাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। না হলে বাস ড্রাইভার, বাড়ির মালিক কিংবা রাজউকের প্রকৌশলীদের উপর রাগ-বিষোদগার করতেই আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ব।
এ সমাজে সকল উৎপাদন, সকল ক্রিয়াকর্মের গোড়ার কথাটা হলো সর্বোচ্চ মুনাফা লাভ। সমাজের নিয়মটা তাই। কারণ এটি পুঁজিবাদী সমাজ। “কমিউনিস্টরা সুযোগ পেলেই শ্রেণিসংগ্রাম-পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ বোঝাতে থাকে, বিরক্ত লাগে, একঘেয়েমি লাগে” — এসব কোন কথা বলেই এই সত্যকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। কারণ এটা নিয়ম। আর এই নিয়মই এই ভয়াবহ মৃত্যুর মিছিলের জন্য দায়ী।
গবেষণায় এসেছে, সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ চালকের বেপরোয়া মনোভাব (৩৭%) ও অতিরিক্ত গতি (৫৩%)। এই অতিরিক্ত গতি ও বেপরোয়া মনোভাব কেন? বাস চলে চুক্তিতে কিংবা ট্রিপ সিস্টেমে। চালকদের মাসিক বেতন-ভাতা নেই। ট্রিপপ্রতি তারা টাকা পায় অথবা চুক্তিতে সারাদিনের জন্য গাড়ি নেয়। চুক্তির টাকার বাইরে বাকি টাকা তার। হেল্পার ও তেলের খরচ দিয়ে নিজের চলার টাকা জোগাড় করার জন্য সে প্রাণপণ ছুটে। যারা ট্রিপে চলে তাদের একটা নির্দিষ্ট সময়ে দুই ট্রিপের বদলে তিন ট্রিপ দিলে টাকা বেশি আসে। কম দিলে টাকা কম। ট্রিপ বেশি দেয়ার জন্য মালিকের চাপ থাকে। অনেকক্ষেত্রে চালকদের চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দেয়া হয়। পরিবহন মালিকদের নিয়ে সভা করেছেন ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ্। সেখানে বিকাশ পরিবহনের মালিক অনিসুর রহমান খান বলেছেন, “টাকার বিনিময়ে রুট পারমিট নিয়েছি। ভাড়া কমাবো কিভাবে?”
কথা ঘুরেফিরে একটাই। ভাড়া বাড়াও, খরচ কমাও — তাহলে মুনাফা বেশি আসবে। সারাদিনের চুক্তিতে মালিক বাস ছাড়বেন, তিনি কম ভাড়ায় ছাড়বেন না। চালক তা তুলতে গিয়ে বেপরোয়া হবেন, গতি বাড়াবেন। চালকের বেঁচে থাকার প্রশ্ন, মালিকের মুনাফার। আপনি রাস্তায় গাড়ি প্রতি একটা পুলিশ রাখুন, প্রতিটি গাড়িতে ক্যামেরা বসিয়ে দিন কিংবা যাই করুন — মালিকের মুনাফায় হাত না দিয়ে বিরাট বিরাট উদ্যোগ কোন মানে বহন করবে না। আনফিট গাড়ি ফিট সার্টিফিকেট কিভাবে পায়? প্রতি কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে সর্বোচ্চ ব্যয় করি আমরা আর আমাদের রাস্তার মান দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। শুধু নেপাল আমাদের নিচে অবস্থান করে। এটা কিভাবে হয়? কেন আমাদের রাস্তাগুলো এত দুর্ঘটনাপ্রবণ? নকশাবহির্ভূত ভবন কিভাবে বছরের পর বছর ধরে টিকে থাকে? চকবাজার থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরানো যাচ্ছে না কেন? এফ আর টাওয়ার ১৮ তলার অনুমতি নিয়ে ২২ তলা করলো কেন? এসকল প্রশ্নের উত্তর একটাই — তা হল ‘মুনাফা’র জন্য, সহজ বাংলায় বললে লাভের জন্য।
ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ৭২% পথচারী, এই হিসাব দেখিয়ে এখন জনসচেতনতার কাজ চলছে। বলা হচ্ছে দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হচ্ছে এই যে, জনগণ সচেতন না। আসুন আমরা আরেকটু গভীরভাবে ভাবি। এই আমজনতা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেপরোয়া রাস্তা পার হয় কেন? ঝুলে ঝুলে বাসে উঠে কেন? সে কি জানে না, এভাবে চললে সে মারা যেতে পারে? তারপরও কেন চলে? কারণ তার ‘সময় কথা বলে’। টাকায় তার এক এক মূহুর্তের হিসাব হয়। তার অফিস, তার ছোট ব্যবসা এক এক মিনিট সময়কেও ছাড় দেয় না। মুনাফা প্রতি মিনিটে কথা বলে। তার বেঁচে থাকার নামই প্রতি মূহুর্তে মৃত্যুর ঝুঁকি নেয়া। এছাড়া তার বাড়িতে রান্না চড়ে না, ছেলেমেয়েদের স্কুলের বেতন হয় না।
এখন এপ্রিল মাস চলছে। এই এপ্রিল মাসের একটা দিন হলো ২৪ এপ্রিল। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিলে ধ্বসে পড়েছিল রানা প্লাজা। ভবনে চাপা পড়ে মারা যায় ১১৬৬ জন শ্রমিক। ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। সকালে সেখানে ঢুকতে চাননি অনেক শ্রমিক। এই ভবনে ছিল ৫টি গার্মেন্টস। সকল শ্রমিককে জোর করে ঢোকানো হয় সকালে। কারণ একদিনের কাজ বন্ধ থাকলে মুনাফা কমবে। এর পরিণতিতে এতগুলো তরতাজা মানুষ লাশ হয়ে গেল। কত লোক হাত-পা হারিয়ে চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছে তা আমরা জানি না। কত ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে জানি না, স্কুলের ব্যাগ কাঁধ থেকে ফেলে দিয়ে কতজনকে কাজে যেতে হয়েছে তার হিসেবও কেউ রাখেনি।
এর আগে আশুলিয়ায় তাজরীন গার্মেন্টসের দেড় শতাধিক শ্রমিক পুড়ে কয়লা হলো। তারা আজ ইতিহাস। কিছুদিন পর পয়লা মে — মে দিবস। সরকারি গাড়িতে চড়ে বড় বড় নেতারা সেদিন মিটিংয়ে যাবেন, শ্রমিকদের অভিনন্দিত করবেন। তাদের শ্রমে যে দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরছে, সেই খবর তাদের শোনাবেন। কিন্তু কার স্বার্থ দেখার জন্য তারা ক্ষমতায় আছেন — সেটা এড়িয়ে যাবেন। মালিকদের জন্য কর্পোরেট কর হ্রাস, উৎসে কর আদায় কমানো, ব্যাংক ঋণের সুদ এমনকি আসল পর্যন্ত মওকুফ তারা করবেন, কিন্তু শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর দাবি উঠলে পুলিশী দমন চলবে। দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ কিংবা তাদের স্ত্রী-সন্তানদের চাকরিতে অন্তর্ভুক্তির দাবি উপেক্ষা করা হবে। এ বছরের শুরুতেই পুলিশের গুলিতে একজন গার্মেন্টস শ্রমিক মারা গেছে। অথচ তাদের দাবি খুব বেশি কিছু ছিল না। সরকার ঘোষিত ন্যূনতম মজুরির সাথে মিলিয়ে অন্যান্য গ্রেডগুলোর বেতন সামঞ্জস্য করার দাবি ছিল তাদের। প্রাণ দিয়েও সে দাবি তারা আদায় করতে পারলো না।
তাই প্রাণ কোন অর্থ বহন করে না রাষ্ট্রের পরিচালকদের কাছে। তারা মুনাফার দাস। মালিকরা যেমন চান সেভাবেই তাদের রাষ্ট্রটা চালাতে হয়। কারণ তারাই তাদের টাকা দিয়ে, শক্তি দিয়ে ক্ষমতায় আনে। তাই একদিকে সাধারণ মানুষ মরে, অন্যদিকে অতি ধনী বাড়ে। ধন বাড়ছেই, কিছু লোকের হাতে জমছে অঢেল টাকা। আর তাদের অতিমুনাফার বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এই লাশের মিছিল বন্ধ করতে হলে — ব্যক্তিগত মুনাফাভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে সামাজিক মালিকানার মানবিক সমাজ নির্মাণের কোন বিকল্প নেই।