Wednesday, December 25, 2024
Homeফিচারআন্দোলনের মধ্য দিয়েই বামপন্থীদের সামনে আসতে হবে - কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী

আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বামপন্থীদের সামনে আসতে হবে – কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী

DLA_04.09
[গত ৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার জাতীয় কনভেনশনে বাসদ (মার্কসবাদী)’র সাধারণ সম্পাদক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী প্রদত্ত বক্তব্য এখানে প্রকাশ করা হল।]
গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার এ কনভেনশনে শুরুতে যে বক্তব্যটি পড়ে শোনানো হলো, তার সাথে বেশির ভাগ জায়গায়ই আমি সহমত। তবে নির্বাচন সম্পর্কে অনেক বর্ণনা এখানে এসেছে, কিন্তু বাম-গণতান্ত্রিক শক্তি কীভাবে আন্দোলন গড়ে তুলবে, কী ধরনের আন্দোলন গড়ে তুলবে, আন্দোলনের শক্তি বাস্তবে কারা, বামমোর্চার বাইরে কাদেরকে গণতান্ত্রিক শক্তি আমরা মনে করি – এই সকল প্রশ্নগুলি এই লিখিত বক্তব্যে খুব পরিষ্কারভাবে আসেনি। আমি মনে করি আজকের কনভেনশনের প্রতিনিধিবৃন্দ, যারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছেন, তারা বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করবেন।

বন্ধুগণ, গোটা বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ আজ দুর্গতির মধ্যে আছে। গ্রাম থেকে লোকেরা উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে, গৃহহারা হচ্ছে। কিন্তু দেশে তাদের জন্য কোনো কাজ নেই। কাজের জন্য তারা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে এবং সেজন্য কীভাবে জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে, দলে দলে মারা যাচ্ছে তা আপনারা খবরের কাগজের পাতায় দেখেছেন।

এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো কেন? এর একমাত্র কারণ হলো – এটি একটি পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা। আজকের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে সে সাম্রাজ্যবাদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে যতটুকু তার শেয়ার তারা নিতে পারে সে চেষ্টাই করছে। সর্বোচ্চ মুনাফার নীতির ভিত্তিতে সে উৎপাদন ব্যবস্থাকে পরিচালিত করছে এবং তা করতে গিয়ে সারাদেশের মানুষকে ভয়ংকর নির্যাতনের মুখে ফেলছে। এরকম একটা জুলুম-নির্যাতনের ব্যবস্থা রক্ষা করার জন্য সকল গণতান্ত্রিক অধিকারকেও সে পদদলিত করছে। অথচ এই বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার মধ্যেই একসময় ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন হয়েছিল। সে সময় আমরা যে আত্মাহুতি দিয়েছিলাম – তার সবকিছুকেই তারা আজ ব্যর্থ করে দিয়েছে।

এরকম অবস্থার পরিবর্তনের জন্য গণআন্দোলন দরকার। আমাদের মধ্যে বামের নামে কিছু শক্তি আছেন যারা নির্বাচনের জন্য চেষ্টা করছেন। নির্বাচন দিয়ে কী হবে? আরেকটি পার্টি ক্ষমতায় আসবে। জনগণের ক্ষুব্ধতার সুযোগ নিয়ে বিএনপিও আসতে পারে। সে আসলেও নিপীড়ন-নির্যাতনের এই সমাজব্যবস্থাই বহাল থাকবে। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের আকাক্সিক্ষত সমাজ আসবে না।

এখন নিরঙ্কুশ একনায়কত্বের একটা ব্যবস্থা আমাদের দেশে চলছে। এ সরকার কোন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসেনি। আপনারা রাজনীতি সচেতন নেতা-কর্মীরা এখানে উপস্থিত আছেন, আপনারা সবই জানেন। জনগণও প্রত্যক্ষ করেছে, কীভাবে আমাদের দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। এই অবৈধ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনেই আমরা অংশগ্রহণ করতে পারি না।

একটা কথা স্পষ্টভাবে বামপন্থী নেতাকর্মীদের বোঝা দরকার – নির্বাচন মূল লক্ষ্য হতে পারে না। গণআন্দোলনই হলো মূল লক্ষ্য। ইতিহাসে বাম-গণতান্ত্রিক শক্তিই এখনও পর্যন্ত দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের অভ্যন্তরে শেষ শক্তি হিসেবে টিকে আছে। তারাই একমাত্র জনগণের আশা-আকাঙ্খাকে ধারণ করে। তারাই এ সমাজব্যবস্থার অভ্যন্তরে যা কিছু অন্যায়, তার বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পারে। বর্তমান সময়ের কথা ভিন্ন, কিন্তু স্বাভাবিক সময়ে বামপন্থীরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নির্বাচন সম্পর্কে জনগণের যে মোহ আছে তা কাটানোর জন্য। জনজীবনের সমস্যা সমাধানের জন্য যায় না। এমন প্রত্যাশাও তারা দেখায় না। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নির্বাচন হলো মানি, মাসল ও মিডিয়া নির্ভর। এগুলো ছাড়া নির্বাচনে সামনে আসা যায় না।

আরেকটা কথা এই লিখিত বক্তব্য সম্পর্কে বলি। গণআন্দোলন যেটা আমরা পরিচালনা করবো, তার শুরুতেই একটা গান্ধিবাদী ভাব থাকলে চলে না। অর্থাৎ আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করব, এরকম বলা ঠিক হয় না। আমরা ছোট শক্তি, বিরাট একটা দাঙ্গা-হাঙ্গামা করার কোনো শক্তিই না। তাহলে শুরুতেই ‘আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করব’ – এরকম কথা বলার কী দরকার? আমরা জনগণকে তাদের যে রোষ, তাদের যে ক্ষোভ, তাদের যে তীব্র ঘৃণা এ সমাজ সম্পর্কে – সেটা জাগিয়ে তুলে তাদেরকে নিয়ে একটা বিরাট militant democratic movement গড়ে তুলব। গণতান্ত্রিক movement militant হতে পারে, জঙ্গী হতে পারে। সেটি লড়াই-সংগ্রামের ভিত্তিতে হতে হবে, শ্রেণীসংগ্রামের ভিত্তিতে পরিচালিত হতে হবে। বামপন্থীরা শ্রেণীসংগ্রামের ভিত্তিতেই গণআন্দোলন পরিচালনা করে।

এ আন্দোলনে বামপন্থীদের সাথে গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ অংশ নিতে পারে। সেই গণতান্ত্রিক শক্তি এদেশে কারা? গণতান্ত্রিক শক্তি বলে যদি কেউ থাকে তবে তাকে তো সেক্যুলার হতে হবে। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে সেক্যুলারিজমের কথা তাদের মধ্যে এসেছিল, সেই সেক্যুলার শক্তি হিসেবে তাদের আন্দোলনে আসতে হবে। তাদের দেশপ্রেমিক শক্তি হতে হবে এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সবসময়ই রাস্তায় আছে – এরকম একটা শক্তি হিসেবে তাদের মানুষের সামনে বের হয়ে আসতে হবে। এরকম শক্তি কারা এদেশে আছে তা আপনারা এখানে আলোচনা করে ঠিক করুন।

লিবারেল শক্তি বলে যাদের দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, তারা আসলে বুর্জোয়াদেরই বিভিন্ন ধারা। তারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সুন্দর বাচনে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছেন।

এ কনভেনশনে ঠিক করতে হবে দেশের এ পরিস্থিতির জন্য কে দায়ী? দেশের বুর্জোয়ারা মার্কিন-ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের সাথে হাত মিলিয়েছে। এ বিষয়টি বুঝতে হবে। ভারতকে একটি সা¤্রাজ্যবাদী দেশ হিসেবে দেখতে হবে। ভারত যে সাম্রাজ্যবাদী, তার প্রমাণ কিছুদিন আগে নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময়ে দৃষ্টি ফেরালেই পাওয়া যাবে। নিজের স্বার্থে ট্রানজিট-করিডোরসহ কি নেয়নি ভারত। সবই ছিল একতরফা চুক্তি। আমাদের দেশের সকল ব্যাপারেই ভারত মতামত দিচ্ছে, ক্রিয়াও করছে। এককথায়, ভারত একটি বিপদ হিসেবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

আবার এই প্রশ্ন যখন আমরা এভাবে তুলি তখন মাথায় রাখতে হবে যে, ভারতের সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকার বিরোধিতা করতে গিয়ে আমাদের দেশে যে পুরনো পাকিস্তানভিত্তিক সাংস্কৃতিক মানসিকতা আছে সেটা যাতে কোনোভাবেই চাঙ্গা না হয়ে উঠতে পারে। তার জন্য ভারতীয় জনগণের সমস্ত গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে আমাদের সমর্থন থাকতে হবে। আপনার জানেন যে, মোদি সরকারের সাম্প্রদায়িক মনোভাব ও সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশকে বিভাজিত করার বিরুদ্ধে সেদেশের বাম-গণতান্ত্রিক শক্তি প্রান্তে প্রান্তে লড়াই করছে। গত ২ আগস্ট গোটা ভারতে শ্রমিক সংগঠনগুলোর ডাকে একটা সফল ধর্মঘট হয়ে গেল।

মার্কিন-ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের সাথে যুক্ত হয়ে এদেশের অল্পসংখ্যক পুঁজিপতি দেশকে পদানত করে রাখার চেষ্টা করছে। কিছুদিন আগেও তারা ছিল সাধারণ ঘরের ছেলে – দরিদ্র স্কুল মাস্টার বা কৃষকের ঘরের ছেলে। আজ তারা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। এই বিপুল সংখ্যক টাকা তারা রোজগার করেছে লুটপাট করে। এরাই আজ সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে মিলে দেশকে ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে।

তাই আজ যদি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়, তাহলে এই কথাটা প্রথমেই বুঝতে হবে যে, এদেশে সাম্রাজ্যবাদীদের কে বা কারা রক্ষা করছে? সাম্রাজ্যবাদকে রক্ষা করছে এদেশের পুঁজিপতিরা – যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসে আছে। তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মধ্যেই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই জড়িয়ে আছে।
আজ শ্রেণীসংগ্রামের ভিত্তিতেই গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আমরা যখন শুরু করব তখন সেটা স্বাভাবিকভাবেই শান্তিপূর্ণ হবে। কিন্তু লড়াই যখন চলতে থাকবে, মানুষের ক্ষোভ-দুঃখ এগুলো নিয়ে যখন আমরা সংগঠিতভাবে গড়ে উঠব, তখন লড়াই যদি গণঅভ্যুত্থানের দিকে যায় – সেটা সবসময় শান্তিপূর্ণ হবে এমন কোনো কথা নেই। দুনিয়ার ইতিহাস যারা অধ্যয়ন করেন, তারা জানেন এসব কিভাবে হয়।

আর একটা ব্যাপার, আন্দোলনে নেতৃত্ব খুব গুরুত্বপূর্ণ। বামমোর্চা সেই নেতৃত্বকারী সংগঠন হিসেবে গড়ে ওঠার চেষ্টা করুক। আমরা ছোট হতে পারি। ছোট হওয়া কোনো সমস্যা নয়। সঠিক রাজনীতি, শত্রুকে যথার্থভাবে চিনতে পারা এবং শত্রুর বিরুদ্ধে যে শক্তিগুলো একত্রিত করে লড়াই করতে হয় সেটা নির্ধারণ করা – এই প্রশ্নগুলি খুব গুরুত্বপূর্ণ।

আজকের কনভেনশনে বামমোর্চা প্রতিজ্ঞা করুক রামপালে পরিবেশবিধ্বংসী কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে রোডমার্চের যে প্রোগ্রাম তারা নিয়েছে – কোনো বিবেচনায়ই যাতে তারা তার থেকে পিছিয়ে না আসে। আমরা যাতে এক পার্টির মতো আন্দোলনে নামতে পারি।

বাংলাদেশ কাঁপছে। বাংলাদেশ কাঁদছে। তারা আন্দোলন চায়। আমাদের দলের ছেলেমেয়েরা মানুষের কাছে দলের জন্য অর্থ সংগ্রহে যখন যায়, তখন তারা বলে, ‘আপনারা কী করছেন? জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়ে গেল – আপনারা কী করছেন? আপনাদের টাকা কেন দেব? আপনাদের সবরকম সাহায্য করব, নিজেরাও যুক্ত হব, আপনারা ঠিক ঠিক ভাবে আন্দোলনে নামুন। আপনারা একটু ঝুঁকি নিন।’

ঝুঁকি আমাদের নিতেই হবে। কতদিন বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে গণআন্দোলন হয় না। বিপদকে নিয়েই বিপ্লবী রাজনীতি গড়ে ওঠে। অত্যাচার-অন্যায়কে মোকাবেলা করেই বিপ্লবী রাজনীতি গড়ে ওঠে। এরকম একটা অন্যায়-জবরদস্তির শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গেলে বহুরকম সমস্যার সম্মুখীন আমরা হব। তাকে মোকাবেলা করতে হবে। আর আমরাও কখনও নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মানুষের সামনে আসতে পারব না। এরকম চিন্তা ভুল। বামপন্থীরা নিজেদের আর ঠকাবেন না। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বামপন্থীরা শক্তি হিসেবে বেরিয়ে আসতে পারবে না। আমাদের আসতে হবে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।

তাই বন্ধুদের বলছি, লড়াই সংগ্রামের পথে এগিয়ে আসুন। দেশের সামগ্রিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের দিকনির্দেশ একসময় এই লড়াই-সংগ্রাম থেকেই গড়ে উঠবে।

সাম্যবাদ – সেপ্টেম্বর ২০১৫

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments