এবছরের ১৩ সেপ্টেম্বর ইরানে ‘নৈতিকতা পুলিশ’ গ্রেপ্তার করেছিল মাশাহ আমিনি নামে ২২ বছর বয়সী একজন কুর্দি তরুণীকে, যিনি তাঁর ভাইয়ের সাথে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় কুর্দিস্তান প্রদেশ থেকে তেহরানে এসেছিলেন। আমিনির মাথার স্কার্ফের নীচে কিছু চুল দৃশ্যমান থাকায় ইরানে প্রচলিত বাধ্যতামূলক হিজাব আইন ভঙ্গ করার ‘অপরাধ’-এ তাকে আটক করা হয়। একটি বিশেষ ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়ার পর পুলিশি হেফাজতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনদিন পর ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান। মৃত্যুর জন্য পুলিশ ও সরকার তাঁর পূর্বের অসুস্থতাজনিত হার্ট অ্যাটাককে দায়ী করেছে। আমিনির পরিবার দাবি করেছেÑতিনি সুস্থ ছিলেন এবং পুলিশের নির্যাতনে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
আমিনির মৃত্যুর প্রতিবাদে ইরান জুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, যা ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে এখনো চলমান। এই বিক্ষোভে শত শত নারী সমবেত হয়ে বাধ্যতামূলক হিজাব আইনের প্রতিবাদ জানিয়ে জনসমক্ষে তাদের হিজাব ছুঁড়ে ফেলেছে, পুড়িয়েছে, অনেকে তাদের চুল কেটে ফেলেছে। বিক্ষোভকারীরা শ্লোগান দিয়েছে—‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’। অনেকে ইরানের ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আলী খামেইনীর কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান দাবি করেছে। নারী-পুরুষের মিলিত এই অসংগঠিত ও স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভে অসংখ্য স্থানে পুলিশ বাধা দিয়েছে, দমন-সংঘর্ষ-গুলি-লাঠিচার্জ চলেছে, এ পর্যন্ত শতাধিক মৃত্যু ও সহস্রাধিক গ্রেপ্তার হয়েছে, সংকুচিত করা হয়েছে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পরিষেবা।
যে নৈতিকতা পুলিশের হাতে আমিনির মৃত্যু, ইরানে তাদের বলা হয় ‘গাশত-ই এরশাদ’ (গাইডেন্স পেট্রল)। এটি পুলিশেরই একটি বিশেষ ইউনিট, যাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ইসলামিক নৈতিকতার সম্মান নিশ্চিত করার এবং পোশাকবিধি অনুসরণ না করা ব্যক্তিদের আটক করার। ২০০৫ সালে পুলিশের এই বিশেষায়িত বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইসলামিক শরিয়ার ব্যাখ্যার ভিত্তিতে তৈরি করা আইনের অধীনে ইরানে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে যেকোন নারীকে জনসম্মুখে বাধ্যতামূলকভাবে তাদের চুল ঢেকে (হিজাব বা মাথার স্কার্ফ দিয়ে) রাখতে হয় এবং লম্বা ও ঢিলেঢালা পোশাক পরতে হয়। আর তারই বাস্তবায়নের দায়িত্ব বর্তায় নৈতিকতা পুলিশের ওপর। ইরানের ইসলামী সরকারের ভাষ্যমতে—‘নৈতিকতা পুলিশ নারীদের সুরক্ষার জন্য কাজ করছে। যদি নারীরা সঠিকভাবে পোশাক না পরে, তাহলে পুরুষরা উত্তেজিত হতে পারে এবং তাদের ক্ষতি করতে পারে।’
বাধ্যতামূলক হিজাবের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের মূল বক্তব্য—‘এ আমার শরীর, এই শরীরে কী পোশাক আমি পরবো বা পরবো না, সেই সিদ্ধান্ত আমি নেব, অন্য কেউ নয়।’ এরা কিন্তু হিজাব জিনিসটা অর্থহীন এ কথা বলছেন না। কোনও মেয়েরই হিজাব পরা উচিত নয়, এ কথাও তারা বলছেন না। এরা ‘বাধ্যতামূলক’ ব্যাপারটিকে বিদায় করতে বলছেন। যার ইচ্ছে, সে হিজাব পরবে; যার ইচ্ছে নয়, সে পরবে না। তারা আরো বলছেনÑনারীকে ভোগ্যবস্তু হিসেবে দেখার পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানো প্রয়োজন, মানুষ হিসেবে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। হিজাব-বোরখার আড়ালে ঢেকে বা গৃহবন্দী করে, পোশাক ও চলাফেরার স্বাধীনতা সংকুচিত করে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না। বাধ্যতামূলক হিজাবের পাশাপাশি নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইন সংশোধন করে নারী-পুরুষের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানাচ্ছেন তারা। ইরানে নারীদের শিক্ষা ও চাকুরির সুযোগ পেতে বাধা নেই, বরং শিক্ষা ও পেশাগত ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। এই শিক্ষিত ও সচেতন নারী-পুরুষরাই প্রধানত আন্দোলন করছেন ধর্মের নামে জবরদস্তি বন্ধ, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে।
হিজাব বাধ্যতামূলক করার বিরুদ্ধে ইরানের নারীদের আন্দোলন নতুন কিছু নয়। ইসলামি বিপ্লবের বছর ১৯৭৯ সালের মার্চেই নারীরা বাধ্যতামূলক হিজাবের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসে। সাম্প্রতিককালে ২০১৪ সালে ইরানের প্রবাসী সাংবাদিক মাসিহ আলিনেজাদ ‘আমার গোপন স্বাধীনতা’ নামে ফেসবুক পেইজ খুলেছিলেন। অনেক মেয়েরা রাস্তাঘাটে-দোকানপাটে পাবলিকের ভিড়ে দাঁড়িয়ে হিজাব খুলে ফটো তোলে, সেই ফটো ওই পেইজে পোস্ট করে। ২০১৭ সালে মাসিহ আলিনেজাদ আরেকটি আন্দোলন শুরু করেন, এবারেরটির নাম ‘সাদা বুধবার’। এবার তিনি মেয়েদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বাধ্যতামূলক হিজাব আইনের বিরুদ্ধে সাদা রঙের হিজাব পরে আন্দোলন করার জন্য। ডিসেম্বর ২০১৭ নাগাদ হিজাব নিয়ে অনেক ধরনের প্রতিবাদ শুরু হয়। ২৭ ডিসেম্বর তারিখে ভিদা মভায়েদ নামে ৩১ বছর বয়সী এক তরুণী রাস্তার পাশে ইউটিলিটি বাক্সের ওপর দাঁড়িয়ে একটি লাঠির মাথায় পতাকার মতো উড়িয়ে দেন নিজের মাথা ঢাকার স্কার্ফ। তাকে হাজতে নিয়ে যাওয়া হয়, কয়েক সপ্তাহ পরে হাজত থেকে মুক্তি পান তিনি। মভায়েদের শান্তিপূর্ণ হিজাব-বিরোধী প্রতিবাদের পর আরও অনেক মেয়েই ইউটিলিটি বাক্সের ওপর বা কোনও উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে লাঠি বা গাছের ডালে বা কঞ্চিতে হিজাব বেঁধে পতাকার মতো উড়িয়েছেন। ২০১৮ সালের মার্চে ৪২ বছর বয়সী ইরানী নারী শাপারক সাজারিজাদেহকে হিজাব না পড়তে চেয়ে প্রতিবাদ করায় ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডসহ মোট ২০ বছরের সাজা দেওয়া হয়। সাজার ভয়ে তার আগেই তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। ওই আন্দোলনে ৩০ জনেরও বেশি নারীকে জনসম্মুখে হিজাব খুলে প্রতিবাদ করার জন্য গ্রেফতার করা হয়।
চলতি ২০২২ সালের ১২ জুলাই ইরানে নারীরা একটি হিজাববিরোধী প্রচারণা শুরু করেছিলেন। এই প্রচারণায় নারীরা হিজাব ছাড়াই তাদের ভিডিও NO-TO-HIJAB হ্যাশট্যাগ দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন। এই হ্যাশট্যাগটি ইরানে শীর্ষ প্রবণতা ছিল এবং হাজার হাজার মহিলা হিজাব ছাড়া ছবি পোস্ট করেছেন। হিজাবের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদের তারিখটিও ছিল বিশেষ। ১২ জুলাই ইরান হিজাব এবং সতীত্বের জাতীয় দিবস উদযাপন করে। এ সময় সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোকে পুরো সপ্তাহে হিজাব প্রচারের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু ইরানের নারীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এই দিনে তারা হিজাবের বিরোধিতা করবেন। এই ঘটনার পর ১৫ আগস্ট হিজাব আইনে নতুন পরিবর্তন আনা হয়। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, কোনো নারী হিজাব ছাড়া ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করলে তাকে চাকরিচ্যুত করা হবে। সরকারি সুযোগ-সুবিধাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কারাদণ্ড ১০ দিন থেকে ২ মাস পর্যন্ত হতে পারে। ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ ইরানি রিয়াল পর্যন্ত জরিমানা এবং ৭৪ বেত্রাঘাতের শাস্তিও দেওয়া হবে। পাশাপাশি, হিজাব না পরা মহিলাদের চিহ্নিত করতে ‘ফেসিয়াল রেকগনিশন’ প্রযুক্তি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইরান সরকার। অর্থাৎ জরিমানা, চাবুকের ভয় দেখিয়ে নারীদের জোর করে হিজাব পরতে বাধ্য করা হচ্ছে।
সাম্প্র্রতিককালে ইসলাম ধর্মের নামে মেয়েদের জবরদস্তি হিজাব বা বোরখা পরতে বাধ্য করা এবং নারীর চলাফেরা-শিক্ষা-কাজের অধিকার সংকুচিত করার দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছি তালেবানশাসিত আফগানিস্তান, আইএস-আলকায়েদা ইত্যাদি ইসলামী মৌলবাদী সংগঠন নিয়ন্ত্রিত এলাকায় এবং সৌদিআরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের তথাকথিত মুসলিম দেশগুলোতে। তবে, ইরান কিন্তু আফগানিস্তানের মত পশ্চাদপদ মধ্যযুগীয় রাষ্ট্র নয়, বা সৌদি আরবের মত মার্কিন তাঁবেদার প্রতিক্রিয়াশীল রাজতন্ত্র নয়। ইরানে তরুণদের মধ্যে শিক্ষার হার প্রায় শতভাগ, শিক্ষার মানও উঁচু, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণাতে তারা বেশ অগ্রসর। ইরানে সার্বজনীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট আছে, কিন্তু নীতি-নির্ধারণী বিষয়ে চূড়ান্ত ক্ষমতা ‘সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা’ ও ইসলামী মৌলবাদীদের নিয়ে গঠিত ‘অভিভাবক পরিষদ’-এর হাতে।
ইরানে ১৯৭৯ সালের ‘ইসলামী বিপ্লব’ ছিল মূলত অত্যাচারী রাজতন্ত্রবিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠনবিরোধী একটি গণঅভ্যুত্থান। ১৯৫৩ সালে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ইরানের জাতীয়তাবাদী ড. মোসাদ্দেক সরকারকে সিআইএ নিয়ন্ত্রিত সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতায় বসানো হয় নির্বাসিত রাজপরিবারের রেজা শাহ পাহলভিকে। মার্কিনীদের চোখে মোসাদ্দেক সরকারের ‘অপরাধ’ ছিল—তিনি ইরানের সমৃদ্ধ তেলসম্পদকে পশ্চিমা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর হাত থেকে মুক্ত করে জাতীয়করণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই থেকে শাহ এর নেতৃত্বে ইরান কার্যত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলোনীতে পর্যবসিত হয়। এর বিরুদ্ধে ইরানের বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী শক্তি, বামপন্থী ও ইসলামী দলগুলোর মিলিত আন্দোলন গড়ে ওঠে। ১৯৭৯ সালের শাহবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের সময় এই সম্মিলিত ফ্রন্টের নেতৃত্ব হিসেবে সামনে চলে আসেন প্রবাসী ধর্মীয় নেতা রুহুল্লাহ খোমেইনী। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মধ্যপন্থী জাতীয়তাবাদী দলগুলোর দোদুল্যমানতা এবং শক্তিশালী দুটি বামপন্থী দল মুজাহিদীন খালক ও তুদেহ পার্টির বিভ্রান্তির সুযোগে ইসলামী শক্তি বিপ্লবের নেতৃত্ব নিয়ে নেয়। ১৯৭৯ সালের পরবর্তী কয়েক বছরে বামপন্থী ও মধ্যপন্থীদের হটিয়ে কট্টর ইসলামী মৌলবাদীরা তাদের ক্ষমতা সংহত করে এবং ইরানকে শরিয়াশাসিত ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করে।
সাম্রাজ্যবাদের প্রভাবমুক্ত স্বাধীন জাতীয় বিকাশ ও জাতীয় সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণের যে আকাক্সক্ষা ইরানের শক্তিশালী ধনিকশ্রেণী ও জনগণের ছিল তাকে ধারণ করে ধর্মীয় শাসকগোষ্ঠী পশ্চিমা খবরদারির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। কয়েকহাজার বছরের পারস্য সভ্যতার সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও শিয়া ধর্মতন্ত্রের মতাদর্শিক প্রভাব এক্ষেত্রে সহায়ক হয়। মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদের ওপর কর্তৃত্ব হাতছাড়া হওয়ার আশংকায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ শুরু থেকেই ইরানের নতুন শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। এক্ষেত্রে ওই শাসকগোষ্ঠীর ধর্মীয় চরিত্র তাদের কাছে প্রধান সমস্যা ছিল না। কারণ ওহাবিবাদী রাজতান্ত্রিক সৌদি আরব, ওসামা বিন লাদেনের উগ্রবাদী আল-কায়েদা ও আফগান ‘মুজাহিদ’রা ছিল আমেরিকার একসময়কার বন্ধু। দেশে দেশে অগণতান্ত্রিক সামরিক শাসকদের প্রতি মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতার কথাও সবাই জানেন। মূল সমস্যা ছিল ইরানের নতুন সরকারের জাতীয়তাবাদী চরিত্র ও সাম্রাজ্যবাদীবিরোধী ভূমিকা। মার্কিন মদদে ও অস্ত্র সাহায্যে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন ইরান আক্রমণ করেন। এই ইরাক-ইরান যুদ্ধ ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত চলে। ১৯৭৯ সালের পর ইরানের তেলক্ষেত্র থেকে মার্কিন তেল কোম্পানিগুলো বহিষ্কৃত হবার পর থেকেই আমেরিকা নানা অজুহাতে ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাখে। পরবর্তীতে ‘ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে’Ñএই অভিযোগে এই অর্থনৈতিক অবরোধে সামিল হয় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো। এইসব নিষেধাজ্ঞাগুলোর উদ্দেশ্য ছিল—ইরানকে অর্থনৈতিকভাবে পযুর্দস্ত করে সাম্রাজ্যবাদের কাছে নতজানু করা এবং ইরানের জনগণকে অর্থনৈতিক দুর্দশায় ফেলে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ করে তোলা।
কিন্তু সমৃদ্ধ তেলসম্পদ, দক্ষ জনশক্তি ও ইরানের জনগণের প্রবল সাম্রাজ্যবাদীবিরোধী মনোভাবের ওপর ভর করে ইরান তার স্বাধীন অবস্থান অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হয়। বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন পরবর্তী একমেরু বিশ্বে মার্কিনবিরোধী ভূমিকা নিয়ে এভাবে এতদিন টিকে থাকতে পারা নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা এবং ইরানীদের জাতীয় গৌরববোধ, দৃঢ়তা ও সক্ষমতার পরিচায়ক। সাম্প্রতিককালে জায়নবাদী ইসরাইল রাষ্ট্রের হাতে নিপীড়িত প্যালেস্টাইনীদের প্রতি ইরানের ধারারবাহিক সমর্থন, মার্কিন মদদপুষ্ট ইসলামী উগ্রবাদী বিদ্রোহীদের দমনে রাশিয়ার সাথে হাত মিলিয়ে সিরিয়ার বাশার-আল-আসাদ সরকারকে সামরিক সহযোগিতা, মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে মার্কিন-ইসরাইল-সৌদি চক্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রাশিয়া ও চীনের সাথে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক, ইয়েমেনে সৌদি-মার্কিনবিরোধী শিয়া হুতি বিদ্রোহীদের মদদ দেয়া, লেবাননের হিজবুল্লাহ ও প্যালেস্টাইনের হামাসকে সামরিক-অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান ইত্যাদি কারণে ইরানের প্রতি আমেরিকা আরো বেশি ক্রুদ্ধ ও আগ্রাসী হয়ে ওঠে। কিন্তু ইরাক-লিবিয়া-আফগানিস্তান-সিরিয়ার মত ইরানে সরাসরি সামরিক আগ্রাসন চালানোর মত সাহস আমেরিকা এখনো করে উঠতে পারেনি। যদিও পরোক্ষভাবে অর্থনৈতিক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে এবং আমেরিকা-ইসরাইল নানাভাবে ইরানের অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাত, গোয়েন্দা তৎপরতা, নেতৃস্থানীয় ইরানী বিজ্ঞানী ও সেনানায়কদের খুন ইত্যাদি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।
শাসক মৌলবাদীশ্রেণির সাম্রাজ্যবাদীবিরোধী অবস্থান ও রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ ইরানের বুর্জোয়াশ্রেণীর প্রাথমিক বিকাশে সহায়ক হলেও পরবর্তীতে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বও প্রকাশিত হয়েছে। এর বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় ইরানের রাজনীতিতে ‘রক্ষণশীল’ ও ‘উদারপন্থী’দের বিরোধের মধ্যে। ১৯৯৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে উদারপন্থীদের প্রতিনিধি মোহাম্মদ খাতামি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে ইরানে কিছু সংস্কারের চেষ্টা চালান। আবার ২০০৫ সালের নির্বাচনে রক্ষণশীল প্রার্থী মাহমুদ আহমাদিনেজাদ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তিনি এসব সংস্কার ও আধুনিকীকরণ প্রচেষ্টার রাশ টেনে ধরার চেষ্টা চালান। ব্যক্তিস্বাধীনতা ও নারী অধিকারের দাবিতে সোচ্চার তরুণসমাজের ওপর নিপীড়ন জোরালো হয়। ২০০৯ সালের নির্বাচনে মোল্লাতন্ত্রের সমর্থনে আহমাদিনেজাদ ভোটে কারচুপি করে পুনঃনির্বাচিত হওয়ার অভিযোগে দেশব্যাপী প্রবল আন্দোলন গড়ে ওঠে। ২০১৩ সালের নির্বাচনে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা খামেইনীর বিরোধিতা সত্ত্বেও মধ্যপন্থী প্রার্থী হাসান রুহানি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি পারমাণবিক কর্মসূচি সংকুচিত করে পশ্চিমাদের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে ইরানের ওপর চেপে থাকা অসহনীয় অর্থনৈতিক অবরোধ থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা চালান। অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে তিনি বিশ্বব্যাংক ও আইএম এফ-এর অনেক শর্ত মেনে জনকল্যাণমূলক খাতে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি হ্রাস ও কিছু শিল্পের বিরাষ্ট্রীয়করণ করেন। ইরানের পুঁজিপতি শ্রেণী ও মধ্যবিত্তরা এসব সংস্কারকে সমর্থন করে। ভর্তুকি হ্রাসের ফলে জ্বালানি ও জনজীবনে দুর্ভোগ বৃদ্ধি পেলে ২০১৭ সালে এর বিরুদ্ধে বিরাট আন্দোলন গড়ে ওঠে। আবার ২০১৯ সালেও প্রবল সরকারবিরোধী বিক্ষোভে নামে অর্থনৈতিক সংকটে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ। এই পরিস্থিতির সুযোগে কট্টরপন্থীরা তাদের অবস্থান সংহত করে এবং ২০২১ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে রক্ষণশীল ইব্রাহিম রাইসি প্রেসিডেন্ট পদে বসেন। সাম্প্রতিক হিজাববিরোধী বিক্ষোভকারী প্রগতিশীলদের ওপর তার সরকার অত্যাচারের স্টীমরোলার চালাচ্ছে ‘সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা’ খামেইনির অফিসের নির্দেশে। এভাবে পুঁজিবাদী আধুনিকীকরণ ও ইসলামী মৌলবাদী শাসনের দ্বন্দ্ব ইরানে চলমান।
সাম্প্রতিক হিজাববিরোধী বিক্ষোভ ও নিপীড়নমূলক মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন ইরানি নারী ও যুবসমাজের ন্যায়সঙ্গত গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা থেকেই সৃষ্ট। মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের পক্ষের যেকোন মানুষ একে সমর্থন জানাবে ও শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের প্রতিবাদ জানাবে। কিন্তু একে কাজে লাগিয়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী শিবির ও তাদের প্রচারমাধ্যম তাদের পুরনো ‘শাসক পরিবর্তন’ এজেন্ডা নিয়ে যেভাবে মাঠে নেমেছে, তার বিরুদ্ধেও সতর্ক থাকতে হবে। যে সাম্রাজ্যবাদীরা ইরানে নারী অধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য আজ মায়াকান্না কাঁদছে, তারাই আল কায়েদা-আইএস-তালেবানদের মত নারীবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে একসময় মদদ দিয়েছে। সৌদিসহ উপসাগরীয় আরব রাজতন্ত্রগুলো তাদের বন্ধু, প্যালেস্টইনী জনগণের ওপর ‘জাতিগত নিধন’ চালানো ইসরাইল রাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র। আসলে, তাদের উদ্দেশ্য—ইরানে অনুগত সরকার বসিয়ে সেখানকার সম্পদ লুণ্ঠনের পুরনো আমল ফিরিয়ে আনা এবং মধ্যপ্রাচ্যে পরিপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্য নিশ্চিত করা। ইরানে কোন্ ধরণের শাসনব্যবস্থা থাকবে তা নির্ধারণের অধিকার ইরানের জনগণের, তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলনের পথে নিজেদেরই লড়াই করে আদায় করতে হবে। সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষের নৈতিক সমর্থন তাদের পাশে থাকবে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ বা সহযোগিতা ইরানের জনগণের বা নারীদের কোন কল্যাণ করবে না। আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসন ও পরবর্তীতে সৈন্য প্রত্যাহারে বাধ্য হওয়ার পর মৌলবাদী তালেবানদের পুনরুত্থানে সেখানকার জনগণ ও নারীদের অবস্থা এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়।