[এবছর ২৬ সেপ্টেম্বর ছিল ভারতীয় নবজাগরণে সেক্যুলার মানবতাবাদী ধারার পথিকৃৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০–১৮৯১) দ্বিশতজন্মবার্ষিকী। সমগ্র ভারতবর্ষ যখন ধর্মান্ধতা–কুসংস্কারে ডুবে আছে, সেই সময় বিদ্যাসাগর আধুনিক জ্ঞান–বিজ্ঞানের আলোকে জীবনবোধকে প্রদীপ্ত করার অসমসাহসী কাজ শুরু করেছিলেন। সমাজের সর্বস্তরে শিক্ষা বিস্তারের প্রচেষ্টা ছিল তাঁর কাছে সামগ্রিক সমাজ সংস্কারের প্রবেশদ্বার। গোটা সমাজের গোড়ামির বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিনি নারী শিক্ষা, বহু বিবাহ ও বাল্য বিবাহ রোধ, বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের জন্য এক অবিস্মরণীয় সংগ্রাম চালিয়েছিলেন। নিপীড়িত মানুষের প্রতি দরদবোধ বিশেষত নারী সমাজের অগ্রগতিতে তাঁর অবদান অনন্য। যুক্তি ও বিজ্ঞানকে ভিত্তি করে তাঁর যে উপলব্ধি ও জীবনদর্শন, তার সাথে অভিন্ন ছিল তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও চরিত্র। এই মহান মানবতাবাদী মনীষীর দ্বিশতজন্মবার্ষিকীতে তাঁর চরিত্র, আপোষহীন ও নীতিনিষ্ঠ জীবনসংগ্রাম, সমাজ সংস্কারে তাঁর উন্নত দৃষ্টিভঙ্গির কথা আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।]
করোনার মধ্যে দেশে ঘূর্ণিঝড় ও এক অংশে বন্যা দেখা দিল। অনেকে বললেন-আামাদের কপালই এমন, আল্লাহর গজব আমাদের ওপর পড়ছে। এসব আমাদের পাপকর্মের ফল। কিন্তু আল্লাহ কেবল আমাদের ওপর গজব দিলেন কেন? বিধর্মী ইউরোপ আমেরিকার উপর তো দিলেন না? পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নদী ‘মিসিসিপি’ প্রতি বছর কেন আমেরিকাকে ডুবায় না? পৃথিবীর সবচেয়ে খরস্রোতা নদী ‘রাইন’ কেন প্রতি বছর জার্মানকে বানের জলে ভাসিয়ে দেয় না? সরকার নদী ড্রেজিং করে দুই তীরের পরিচর্যা করে বা বাঁধ দিয়ে বন্যা থেকে স্থায়ীভাবে মানুষকে রক্ষা করতে পারে। এটা মানুষ বুঝতে পারলে শাসকদের বিপদ। শাসকদের জন্য জনগণের ধর্মবোধটা খুব কাজে লাগে। তাই যুগে যুগে শাসকরা বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তার প্রসারে বাঁধা দেয়, জনগণের মধ্যে অধ্যাত্মবাদী চিন্তা, কুসংস্কার, কপাল নির্ভরতার প্রসার ঘটায়। যাতে জনগণের মধ্য অধিকারবোধ তৈরি না হয়।
এই ধর্মটা সবসময় সবদেশে একরকম ছিল না। মানুষকে দাস যুগে দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে ধর্ম বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। ইসলাম ধর্মের নবীর বেলালকে দাসত্বমুক্ত করে আজানের দায়িত্ব দেওয়ার কথা সকলের জানা। খ্রিস্ট ধর্মেরও বিরাট ভূমিকা আছে দাস ব্যবস্থা ভাঙার সংগ্রামে। সে সময় মানুষ ধীরে ধীরে বহুঈশ্বরবাদিতা থেকে একেশ্বরবাদিতায় এসেছে। তখন সমাজে শৃঙ্খলা ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ধর্মের বিরাট ভূমিকা ছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু সামন্ত জমিদারি সমাজ ও রাজতন্ত্র থেকে বের হয়ে মানুষ যখন আধুনিক গণতান্ত্রিক পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে আসলো, তখনই আসলো ব্যক্তির মুক্তির প্রশ্ন। গণতান্ত্রিক চিন্তা জনগণের সার্বভৌমত্বের কথা বলে আর মধ্যযুগীয় ধর্মচিন্তা ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের কথা বলে। সেক্যুলার মানবতাবাদ জন্ম নেয়। এই মানবতাবাদের মূল কথা হলো-‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। এই যে ব্যক্তি স্বাধীনতা, ব্যক্তি মুক্তি, নারী স্বাধীনতা, গণতন্ত্র-এসব ইউরোপে যখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাকে আমরা ইউরোপের রেনেসাঁস বা নবজাগরণ বলেছি।
এর প্রথম ঢেউ ভারতবর্ষে লাগে রাজা রামমোহন রায়ের মাধ্যমে। তিনি ধর্মীয় সংস্কারক ছিলেন। তার মানবতাবাদী চিন্তা ধর্মীয় চিন্তার সাথে মিশে ছিল। তার পরেই ভারতবর্ষে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পূর্ণ সেক্যুলার মানবতাবাদী চিন্তা ইউরোপ থেকেই নিয়ে আসেন। আমরা তা বুঝতে পারিনি বলে এই বন্যার প্রকৃত কারণ, শ্রমিকের কপাল খারাপ নাকি পুঁজিপতি সৃষ্ট দুর্দশা-এসব নিয়ে আজও আমরা অন্ধকারেই আছি। ভারতবর্ষের আধুনিক যুগের বড় মানুষের চরিত্র থেকে যদি শিখতে চাই তাহলে বিদ্যাসাগরকে স্মরণ করতেই হবে। ‘রাজা রামমোহনের অভ্যুত্থান এ দেশের নব জাগরণের ইতিহাসে অনেকটা উষাকালের মতো-রাত্রির অন্ধকার অপসৃয়মান, তখনো সূর্যোদয় ঘটেনি, কিন্তু পূর্বদিগন্তে তারই রক্তিম পূর্বাভাস। আর বিদ্যাসাগর হচ্ছেন কয়েক হাজার বছরের অন্ধকার ভেদ করে প্রথম রক্তিম সূর্যোদয়।’
মানুষ চিনতে চোখ লাগে, অন্য কথায় একটা দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন হয়। যথার্থ দৃষ্টিভঙ্গি না থাকলে বড় মানুষ সম্পর্কে বিচারধারাও সঠিক হয় না। বিদ্যাসাগরকে বিচার করতে গিয়ে কেউ বিদ্যার সাগর, কেউ দয়ার সাগর, কেউ করুণার সাগর বলেছেন। তা দিয়ে কি বিদ্যাসাগরের সাথে দাতা হাতেম তাঈ বা হাজী মোহাম্মদ মুহসীনের পার্থক্য বোঝা যায়? সমাজ সংস্কারক, শিক্ষা সংস্কারক, বিধবা বিবাহ প্রবর্তক, বাল্য বিবাহ-বহুবিবাহ নিবারক ইত্যাদি নানাভাবে তাঁর অবদান ব্যাখ্যা করা হয়েছে-যার সবগুলিই সত্য বটে এবং আজকের দিনে দুর্লভও বটে। কিন্তু এ সবের কোনোটাতেই তাঁর চরিত্রের পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ হয় না। রামমোহন, বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকানন্দ থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সকলেই মানবতাবাদের জয়গান গেয়েছেন, কিন্তু তার মধ্যে অধ্যাত্মবাদ ও ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদী চিন্তা মিশে ছিল। সেখানে বিদ্যাসাগরই প্রথম ভারতবর্ষে সেক্যুলার মানবতাবাদী চিন্তার জনক হিসাবে আবির্ভূত হন। এটাই হলো বিদ্যাসাগরকে সঠিকভাবে বোঝার সবচেয়ে বড় দিক।
এ প্রসঙ্গে এ যুগের বিশিষ্ট মার্কসবাদী দার্শনিক, ভারতবর্ষের এসইউসিআই(সি) দলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কমরেড শিবদাস ঘোষের বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে প্রজ্ঞাদীপ্ত মূল্যায়নের একটি অংশ স্মরণীয় :
“… বিদ্যাসাগর মশাইয়ের অভ্যুত্থান রেনেসাঁ আন্দোলনে একটি অভূতপূর্ব ঘটনা এবং যতদূর মনে হয় বিদ্যাসাগর মশাই-ই প্রথম ব্যক্তি যিনি ধর্মীয় সংস্কারের পথে রেনেসাঁস আন্দোলনের মধ্যে একটা ব্রেক ঘটালেন। তিনিই প্রথম এদেশে যতদূর সম্ভব মানবতাবাদী আন্দোলনকে ইতিহাস, বিজ্ঞান ও যুক্তির শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে চাইলেন। … একথা ঠিক, বাইরে তাঁর শাস্ত্রকারের মতো এবং নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণের বেশই ছিল। কিন্তু, ভিতরে তিনি ছিলেন তদানীন্তন ভারতীয় সমাজ পরিবেশে একজন খাঁটি ‘হিউম্যানিস্ট’। … তাঁর শিক্ষা সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি বিচার করলে অতি সহজেই ধরা পড়বে যে, ধর্মীয় সংস্কারের পথে আমাদের দেশে রামমোহন রায়ের সময় থেকে যে রেনেসাঁস আন্দোলন শুরু হলো-বিদ্যাসাগর মশাই ছিলেন সেই ধারার মধ্যে একটি বলিষ্ঠ ছেদ, যিনি মানবতাবাদী আন্দোলনকে তদানীন্তন পরিবেশে যতদূর সম্ভব ধর্মীয় বিচার-বুদ্ধি ও প্রভাব থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। এ সত্য তাঁর সমস্ত জীবনের কার্যকলাপ, আচার-আচরণ, কথাবার্তার মধ্য দিয়েই নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়।…” (কমরেড শিবদাস ঘোষ, নির্বাচিত রচনাবলী : তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪১৬-১৭)
শিক্ষাক্ষেত্রে টোলকেন্দ্রিক শিক্ষা থেকে আধুনিক স্কুল-কলেজকেন্দ্রিক শিক্ষার প্রসারে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। শিক্ষার পাঠ্যক্রমে সেক্যুলার পাঠ্যক্রম চালুর ক্ষেত্রেও তিনিই অগ্রণী। বাংলা গদ্যের বিকাশে তাঁর অবদান ঐতিহাসিক। বর্ণপরিচয়, কথামালা, বোধোদয় প্রভৃতি পুস্তকে তিনি বাংলা বর্ণমালার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়েছেন। আধুনিক সাহিত্যের পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছে তাঁর কিছু সাহিত্যসম্ভার। দুর্বোধ্য বাংলা ব্যাকরণকে সহজবোধ্য করে তিনি ‘কৌমুদি’ রচনা করেছেন। বিদ্যাসাগর যখন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ, তখন বেনারস সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ব্যালেন্টাইন সাহেব সরকারের নির্দেশে সংস্কৃত কলেজ পরিদর্শন করে সুপারিশ করেন যে, কলেজে যেন বিশপ বার্কলে রচিত দর্শন পুস্তক ‘ইনকোয়ারি’ পড়ানো হয়। নিজে সংস্কৃতে পণ্ডিত হয়েও বিদ্যাসাগর এতে আপত্তি করে বলেন, বার্কলের দর্শন ভ্রান্ত, শুধু তাই নয়, দেশীয় দর্শন সাংখ্য-বেদান্তও ভ্রান্ত। এর সাহায্যে ছাত্র-ছাত্রীদের যথার্থ জ্ঞানের বিকাশ, আজকের দিনে সম্ভব না। ছাত্র-ছাত্রীদের মিলের লজিক পড়ানো দরকার, ইংরেজি ভাষা চর্চা দরকার বললেন।
বিদ্যাসাগর তাঁর নিজের রচিত ‘জীবনচরিত’ পুস্তকে বৈজ্ঞানিক গ্যালিলিও, কোপারনিকাস, নিউটনের জীবনী লিখেছেন। ডুবাল, জেনঙ্কেসরা গরিব অবস্থা থেকে কীভাবে লড়াই করে পড়াশুনা করে বড় হয়েছেন এসব কাহিনী লিখে পড়িয়েছেন যাতে ছাত্ররা এসব চরিত্র থেকে অনুপ্রেরণা পায়। ইংল্যান্ডে প্রকাশিত ‘দ্যা রুডিমেন্টস অব নলেজ’ নামের পুস্তক অবলম্বনে বিদ্যাসাগর তার ‘বোধোদয়’ রচনা করলেও সে পুস্তকের ঈশ্বর ও আত্মা সম্পর্কিত অংশ বোধোদয় থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ইউরোপীয় মিশনারীদের প্রবল আপত্তির মুখে সরকার মি. মার্ডক নামে একজনকে তদন্ত করতে পাঠান। তিনি রিপোর্ট করেন-বিদ্যাসাগর লিখেছেন মানুষ মারা গেলে সৎকার হয়, কিন্তু তিনি একথা লেখেননি যে আত্মা অবিনশ্বর। কারণ তিনি আত্মা মানতেন না, তাঁর লেখার কোথাও ভগবানের পূজা এসব আনেননি। মার্ডক বলেছেন-বিদ্যাসাগরকে যে হিন্দুসংস্কারক বলা হয় তা ঠিক নয়। তিনি কোথাও হিন্দুধর্মীয় কোনো আন্দোলনে নেই, ব্রাক্ষসমাজ আন্দোলনে নেই, তিনি হচ্ছেন সমাজ সংস্কারক। ইংল্যান্ডের রবার্ট ওয়েন-সেন্ট সাইমন যেমন সেক্যুলার, বিদ্যাসাগরও তাই।
বিদ্যাসাগর এফ জি ময়েট-এর কাছে লেখা পত্রে শাস্ত্রীয় পণ্ডিতদের গোড়ামি সম্পর্কে বলছেন, “আরব সেনাপতি আমর আলেকজান্দ্রিয়া বিজয় করিয়া যখন খালিফা ওমরকে জিজ্ঞাসা করিয়া পাঠাইল-আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থশালার ব্যবস্থা কি করা যাইতে পারে। খালিফা উত্তর দিলেন, গ্রন্থাগারের গ্রন্থগুলি হয় কোরাণের মতের অনুযায়ী, না হয় বিরুদ্ধে। যদি অনুরূপ হয় ত এক কোরাণ থাকিলেই যথেষ্ট, আর যদি বিরুদ্ধ মত হয় ত গ্রন্থগুলি নিশ্চয়ই অনিষ্টকর। অতএব ঐগুলি ধ্বংস কর। আমার বলিতে লজ্জা হয়-ভারতীয় পন্ডিতগণের গোড়ামি ঐ আরব খালিফাদের গোঁড়ামির চেয়ে কিছু কম নয়।”
বিদ্যাসাগর সে যুগে নিরীশ্বরবাদী ছিলেন, অজ্ঞেয়বাদী ছিলেন। ইউরোপে রেনেসাঁসের সে যুগটাই ছিল যান্ত্রিক বস্তুবাদের যুগ। বেকন, হব্স, লক, স্পিনোজা’দের বক্তব্য নিয়ে তখন ইউরোপে বস্তুবাদের জোয়ার চলছে। বস্তুবাদকে ভিত্তি করে কান্টের অজ্ঞেয়বাদ, ফুয়েরবাখের মানবতাবাদ এসব এসেছে। এসব চিন্তার সাথে বিদ্যাসাগরের খুব ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। বিদ্যাসাগর ভগবান মানতেন না, ঈশ্বর মানতেন না, দেবতা মানতেন না, পূজো-আর্চায় বিশ্বাস করতেন না, তবুও এদেশে সকলেই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল। অথচ সে সময় এ দেশে গভীর বিশ্বাস ছিল-ঈশ্বর না মানলে, ভগবান না মানলে চরিত্র হয় না, বড় মানুষ হয় না। আজও এই ধারণা সমাজে প্রবলভাবে আছে।
সমাজের কল্যাণ কামনাই ছিল বিদ্যাসাগরের কাছে পরম ধর্ম। তিনি এক চিঠিতে লিখেছেন, “যে ব্যক্তি যে দেশে জন্মগ্রহণ করেন, সে দেশের হিতসাধনে সাধ্যানুসারে সচেষ্ট ও যত্নবান হওয়া, তাহার পরম ধর্ম ও তাহার জীবনের সর্বপ্রধান কর্ম।” বিদ্যাসাগর আরও বলেছেন, “চোখের সামনে মানুষ অনাহারে মরবে, ব্যাধি-জরা-মহামারীতে উজাড় হয়ে যাবে, আর দেশের মানুষ চোখ বুঁজে ‘ভগবান’ ‘ভগবান’ করবে-এমন ভগবৎ প্রেম আমার নেই, আমার ভগবান আছে মাটির পৃথিবীতে, স্বর্গ চাইনা, মোক্ষ চাই না, বারে বারে ফিরে আসি এই মর্ত্য বাংলায়।”
বিধবা বিবাহ প্রবর্তন এবং বহু বিবাহ বন্ধের আন্দোলনে যখন তিনি নামলেন তখন এমন কি অনেক শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত লোকেরাও বিদ্যাসাগরের তীর্যক সমালোচনা করেছেন। সমাজকে জয় করতে নানা ধর্মগ্রন্থ, শাস্ত্র ঘেঁটে তিনি বিধবা বিবাহ শাস্ত্রসিদ্ধ প্রমাণ করেছিলেন। তাঁর বয়োকনিষ্ঠ বঙ্কিমচন্দ্র বিষবৃক্ষ উপন্যাসে লিখেন, “ঈশ্বর বিদ্যাসাগর নামে কলকাতায় কে নাকি বড় পন্ডিত আছেন তিনি বিধবা বিবাহের বই বাহির করিয়াছেন। যে বিধবার বিবাহের ব্যবস্থা দেয় সে যদি পন্ডিত, তো মূর্খ কে?” এক চাটুকার ভেবেছিল, যেহেতু বঙ্কিমচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বিরূপ, ফলে বিদ্যাসাগরকে বঙ্কিমবিরোধী কথা বললে ঘনিষ্ঠ হওয়া যাবে। তাই সে বলল, “জানেন তো বিদ্যাসাগর মশাই, বঙ্কিমচন্দ্র সারাদিন ইংরেজদের অধীনে ডেপুটিগিরি করে আর রাতে মদ বাঈজি নিয়ে থাকে।” বিদ্যাসাগর তাকে হতাশ করে বললেন, “বল কি, তাহলে ত তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল। সারাদিন অফিসের কাজের পর রাতে এসব করে, ারপরও এত সুন্দর বই লেখে কি করে?” এই হলেন বিদ্যাসাগর।
আবার যথার্থ আত্মমর্যাদার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তিনি সংস্কৃত কলেজ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। কলেজের সেক্রেটারি রসময় দত্ত যখন সহকারি সেক্রেটারি হিসাবে তার পাঠ্যক্রম সংক্রান্ত প্রস্তাব উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানালেন না, তখন তিনি পদত্যাগ করলেন। রসময় দত্ত পরিচিত একজনকে দিয়ে বলালেন, চাকুরি যে ছেড়ে দিল চলবে কি করে ? বিদ্যাসাগর দৃঢ়ভাবে বললেন, “বিদ্যাসাগর আলু পটল বেচে খাবে, মুদি দোকান করে খাবে, যে চাকরিতে সম্মান নেই তা করবে না।” আরেকজনকে বলছিলেন, “আমি নুন ভাত খাব, দু’বেলার জায়গায় একবেলা খাব, একদিন অন্তর একদিন খাব, কিন্তু আত্মমর্যাদা বিক্রি করবো না”। ক’জন আজ এভাবে বলতে পারে!
তিনি এমনকি পারিবারিক জীবনেও কখনো নীতি-আদর্শের সাথে বিন্দুমাত্র আপোস করেননি। নিজের ছেলে যখন বিধবা বিবাহ করতে সম্মত হলো, তখন তিনি বিবাহের ব্যবস্থা করলে আত্মীয়রা দেশাচারের কথা তুলে আপত্তি জানান। তিনি সাফ জানালেন তিনি দেশাচারের দাস নন। আত্মীয়রা বিগড়ে যাবেন বলে তিনি পিছপা হননি। আবার সেই ছেলে যখন পরবর্তীতে সেই স্ত্রীকে অসম্মান করতে লাগলো, তখন ছেলেকে ত্যাজ্য ঘোষণা করতেও তিনি দ্বিধা করেননি। এ নিয়ে নিজের স্ত্রীর সাথেও বিদ্যাসাগরের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। মেয়ের জামাই সূর্য্যকুমার অধিকারী মেট্রোপলিটন কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালে তিনি টের পেলেন ফান্ডের তিন চার হাজার টাকার হিসাব গরমিল। সাথে সাথে জামাইকে ডেকে তিরস্কার করে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করে দিলেন। তিনি যা সত্য বলে জীবনে গ্রহণ করেছেন, বিশ্বাস করেছেন, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাকে দৃঢ়ভাবে পালন করেছেন।
আমরা ক’জন আজ এই মূল্যবোধ নিয়ে দাঁড়াতে পারব? এই প্রশ্নের মীমাংসা নিজের মধ্যে করতে পারলে আমরা বিদ্যাসাগরকে যথাযথভাবে স্মরণ করতে পারব এবং দেশকে একটা আধুনিক গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত করতে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারব। পারব নারী স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও জনগণের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে।
[তথ্যসূত্র : কমরেড প্রভাস ঘোষ রচিত ‘ভারতীয় নবজাগরণের পথিকৃৎ : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর–একটি মার্কসবাদী মুল্যায়ন’ পুস্তিকা অবলম্বনে রচিত।]