আওয়ামী লীগ শাসনে গণতন্ত্র ও ভোট না থাকলেও, অনেকেই বলেন — দেশে এখন ‘উন্নয়নের জোয়ার’ বইছে। দেশের রেডিও-টেলিভিশন-পত্রিকায়, আকাশে-বাতাসে এখন একটাই খবর — উন্নয়ন। আর বেশি দিন নেই, দেশটা সুইজারল্যান্ড হলো বলে! মহাসড়কে শোভা পাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের ফিরিস্তি দিয়ে বিশাল বিশাল বিলবোর্ড! দেশের জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) বাড়ছে হু হু করে, মাথাপিছু আয় বাড়ছে, দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠানোর ঘোষণা আসছে। বিশাল নির্মাণ প্রকল্প, ঝা চকচকে অট্টালিকা, ফ্লাইওভার, চারলেন-আটলেনের সড়ক, মেট্রোরেল, বিমানবন্দর, গভীর সমুদ্র বন্দর, এলএনজি টার্মিনাল, ইপিজেড হচ্ছে একের পর এক। অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ — সবাই জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে উচ্ছ্বসিত। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সার্টিফিকেট বিলাচ্ছে দাতা সংস্থাগুলো। কিন্তু উন্নয়নের এই ঢক্কানিনাদ-উল্লাস তারপরও চাপা দিয়ে রাখতে পারছে না দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অসহায় আর্তনাদ, দারিদ্র্য ও শোষণের দগদগে ঘা-কে।
দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়ছে গত কয়েক বছর ধরে। গত অর্থ বছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭.৮ শতাংশ, এ অর্থ বছরে তা ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলে সরকার আশা প্রকাশ করছে। অর্থাৎ দেশের অর্থনীতির আকার বাড়ছে, মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে। সরকার একেই উন্নয়ন বলে প্রচার করছে। কিন্তু, জিডিপি বা মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাওয়াটাই কি উন্নয়ন? বুর্জোয়া অর্থনীতির তত্ত¡ অনুযায়ী — জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়াও, প্রবৃদ্ধির সুফল উপর থেকে থেকে চুইয়ে নিচের দিকে গড়িয়ে পড়বে, সমাজের নিচের তলায় থাকা মানুষরাও কিছু পাবে। তাতে নিম্ন আয়ের মানুষের আয় বাড়বে। একে বলা হচ্ছে — চুইয়ে পড়া অর্থনীতি (Trickle Down Economy)। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের অনেক দেশে প্রবৃদ্ধি বা মাথাপিছু আয় তরতর করে বাড়লেও, সাধারণ মানুষের জীবনের উন্নতি ঘটেনি। বরং বৈষম্য বেড়েছে। জিডিপি নিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন মাপার যে মাপকাঠি, তা নিয়েই বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদদের অনেকে আপত্তি জানিয়েছেন।
বাংলাদেশেও বা জিডিপির কী হাল! জিডিপি একদিকে বাড়ছে, অন্যদিকে ধনী-গরিব বৈষম্যও ক্রমাগত বাড়ছে। ৫ শতাংশ ধনী মানুষের আয় বেড়েছে ৬০ শতাংশ। অন্যদিকে ৫ শতাংশ গরিব মানুষের আয় কমেছে ৬০ শতাংশ। (সূত্র: সিপিডি গবেষণা ২০১৮) বিশ্বের ১৫৭টি দেশের মধ্যে ধন-বৈষম্যের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৮তম। (সূত্র: অক্সফাম, জানুয়ারি ২০১৯)
অর্থনীতির ভাষায় জিডিপি বাড়ছে মানে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে ২০১০ সালের তুলনায় বেকারত্ব দ্বিগুণ হয়েছে। উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারের সংখ্যা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ২৮টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। (সূত্র: আইএলও প্রতিবেদন ২০১৮) চাহিদা অনুযায়ী কর্মসংস্থান না হওয়ায় প্রতি বছর নতুন করে বেকার হচ্ছে ৮ লাখ কর্মক্ষম মানুষ। বাংলাদেশের বুর্জোয়া ধারার অর্থনীতিবিদরা, খোদ বিশ্বব্যাংকও এতে উদ্বিগ্ন ও বিব্রত। তারা একে বলেছেন, ‘jobless growth’ বা ‘কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি’। আরও কৌতুহলোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে — গত এক বছরে দেশে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে ১৩ লাখ, যা আগের বছর ছিল ১৪ লাখ। অর্থাৎ কর্মসংস্থান বাড়ানো তো দূরের কথা, উল্টো ১ লাখ কর্মসংস্থান কম হয়েছে। (সূত্র: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০১৮)
উন্নয়ন, কর্মসংস্থানের ঢোল বাজালেও সরকারি কর্তাব্যক্তিরা পুরো অস্বীকারও করতে পারছেন না। কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক সম্প্রতি এক সভায় স্বীকার করেছেন, “সামাজিক খাতে আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেলেও বৈষম্য সেভাবে কমাতে পারিনি। আমরা অবকাঠামোগত খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছি, পদ্মা সেতু বানাচ্ছি, বন্দর উন্নয়ন করছি, রাস্তাঘাট উন্নয়ন করছি; কিন্তু যদি শিল্পকারখানা না হয়, তাহলে কর্মসংস্থান হবে কী করে?” (সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৯ মার্চ ২০১৯)
উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাওয়া বাংলাদেশে কৃষক ফসলের ন্যায্য মূল্য পায় না, এশিয়ার সবচেয়ে কম মজুরিতে বেশি ঝুঁকিতে কাজ করেন গামেন্টস খাতের শ্রমিকেরা। বেকারত্ব থেকে বাঁচতে তরুণ-যুবকরা ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে ছুটছে প্রবাসে। সেখানে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে গিয়ে ১৩ বছরে লাশ হয়ে ফিরেছেন ৩৩ হাজার শ্রমিক। সরকারিভাবে গত ১০ বছরে স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তিপ্রতি ব্যয় বেড়েছে ২০৫ টাকার মতো। এশিয়ার অন্য দেশের তুলনায় চিকিৎসায় ব্যক্তির পকেট থেকে ব্যয় এদেশে সবচেয়ে বেশি। সরকারিভাবে শিক্ষায় ব্যয়ও খুব বেশি বাড়েনি। গত ১০ বছরে শিক্ষার্থী প্রতি ব্যয় বেড়েছে ৪৪০ টাকা। দেশে ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে। (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ৮ মে ২০১৭)
খেলাপি ঋণে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এক নম্বরে। আওয়ামী লীগ সরকারের গত ৯ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৯ গুণ। নাগরিক নিরাপত্তার বেলাতেও বাংলাদেশের অবস্থান ১১৩টি দেশের মধ্যে ১০২তম। প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে প্রায় ২০ হাজার মানুষ। আগুনে পুড়ে, বয়লার বিস্ফোরণে, বৈদ্যুতিক শকে, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে গিয়ে প্রতি বছর মারা যাচ্ছে গড়ে ৭০০ শ্রমিক।
কী অবস্থা পরিবেশের? ঢাকা পৃথিবীর বসবাস অনুপযোগী শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম শীর্ষে। পরিবেশ সুরক্ষায় ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৯ তম। আইনের শাসনে ১১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০২তম। উচ্চ প্রবৃদ্ধির এই এক দশকে দেশে সবচেয়ে বেশি বন উজাড় হয়েছে। শধু গাজীপুরেই এক দশকে ধ্বংস হয়েছে প্রায় ৭৯% বনাঞ্চল। (সূত্র : দৈনিক বণিকবার্তা ৪ নভেম্বর ২০১৭)
সাম্প্রতিককালে এদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সবচেয়ে শক্তিশালী ক্ষেত্র হলো নির্মাণ খাত। অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বিশাল বিশাল প্রজেক্ট হচ্ছে। সেজন্য সরকার প্রচুর ঋণ করছে। সস্তা শ্রম, সস্তায় কাঁচামাল, সস্তায় গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি-জমি, ট্যাক্স হলিডে, শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে বলে দেশি ও বিদেশি কর্পোরেটরা নানা রপ্তানিমুখী শিল্প করছে। সেখানে কর্মসংস্থান সীমিত, কিন্তু শ্রমশোষণ তীব্র। সরকার দেশি-বিদেশি পুঁজিপতিদের জন্য ১০০টি ইপিজেড করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এই ব্যবসায়ীদের জন্য সড়ক-রেল-নৌ পথে যোগাযোগের জন্য রাস্তা, ফ্লাইওভার, ব্রিজ দরকার। বাকি দুটি খাত হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও গার্মেন্টস সেক্টর। এই দুটি খাতের শ্রমিকরা ও কৃষকরাই টিকিয়ে রেখেছে দেশের অর্থনীতিকে। এগুলো কোনোটাই দীর্ঘমেয়াদে টেকসই ও ইতিবাচক কিছু নয়। একমাত্র টেকসই কৃষিখাত — যেখান থেকে জিডিপি-র প্রায় ১৫% আসলেও ৪০% এর বেশি শ্রমশক্তি কৃষিতে কাজ করে। অথচ সেই খাত অবহেলিত, কৃষিতে বাজেট কম, মধ্যসত্ত¡ভোগী ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি চাষীরা ফসলের লাভজনক মূল্য পায় না।
জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রক্রিয়াও বিতর্কিত। অর্থনৈতিক লেনদেন বাড়লে জিডিপি বাড়ে। ঋণের টাকায় যে বিশাল বিশাল প্রজেক্ট হচ্ছে, এতে জিডিপি বাড়ছে। বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্পে দফায় দফায় ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে দুর্নীতি-লুটপাটের কারণে। এর ফলেও জিডিপি বাড়বে। এক রাস্তা দশবার কাটাকাটি করলেও জিডিপি বাড়ে। ফ্লাইওভার হলে, পাহাড়-বন কেটে হাউজিং করা হলে জিডিপি বাড়বে, দেশে চোরাই অর্থনীতি-মাদকব্যবসা বাড়লেও জিডিপি বাড়বে। বিনা বেতনে শিক্ষা কর্মসূচি চালু করলে জিডিপি বাড়বে না, কিন্তু শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ হলে জিডিপি বাড়বে। সরকারি হাসপাতালে বিনা পয়সায় চিকিৎসা দিলে জিডিপি বাড়বে না, কিন্তু প্রচুর বেসরকারি ক্লিনিক হলে, সেখানে মানুষের গলা কাটা হলে জিডিপি বাড়তে থাকবে।
যে উন্নয়নে মুষ্টিমেয় মানুষ সম্পদের পাহাড় গড়ে, আর বেশিরভাগ মানুষ নিঃস্ব-রিক্ত হয়, প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যায়, সেটা কিসের উন্নয়ন? প্রকৃত উন্নয়ন হচ্ছে — জিডিপি বৃদ্ধির সাথে সাথে বেশিরভাগ মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটছে কি না? সবাই শিক্ষা-চিকিৎসা পাচ্ছে কি না? পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে কি না? বেকারত্ব কমছে কি না? জীবনের নিরাপত্তা আছে কি না? সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিবেশ ও বিনোদনের সুযোগ মানুষ পাচ্ছে কি না?
তবে নিশ্চিতভাবেই গত ১০ বছরের আওয়ামী রাজত্বে একটা বিষয়ে উন্নতিতে বিশ্বের সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আগের রাতেই ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে যে বিরাট সাফল্য কিংবা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মত ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ড সম্ভবত দুনিয়ার আর কোন দেশ করতে পারেনি!