Wednesday, December 25, 2024
Homeফিচারউন্নয়ন হচ্ছে কার?

উন্নয়ন হচ্ছে কার?

‘টিফিনের সময় পেডে খিদা লাগে, তখন পড়ালেখা ভাল্লাগে না। খেলাধুলা কইরা পেট ভইরা কলের পানি খাই’ — খাবারের কষ্টের কথাগুলো বলছিল সুনামগঞ্জের খাগাউড়া কান্দাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী প্রাপ্তি সরকার। এবারের বন্যায় তাদের ভিটে-মাটি সব বানের জলে ভেসে গেছে। শেরপুরে কোরবান আলীর মেয়ে কণিকা ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে গত ২৬ অক্টোবর। তার পরিবারের এতই অভাব যে লাশ সৎকারের খরচও এলাকার লোকজন চাঁদা তুলে দিয়েছে। মুন্সিগঞ্জেও একই পরিবারের তিনজন দিনের পর দিন খাবারের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের ৭ জেলার অর্ধেকের বেশি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করছে।

উপরে উল্লেখিত তথ্যগুলো কারও কাছে ভুল মনে হতে পারে। কেননা ঢাকা শহরে, বিভিন্ন শহরে চোখ মেলে তাকালেই দেখা যাবে সারি সারি সুউচ্চ অট্টালিকা, কোটি টাকার বিলাসবহুল প্রাইভেট কার আর রাস্তার মোড়ে মোড়ে সরকারের উন্নয়নের খতিয়ান! সরকার বলছে দেশ চলছে এখন ‘উন্নয়নের মহাসড়কে’। মন্ত্রী-এমপিরা দিন রাত উন্নয়নের গল্প শুনিয়েই যাচ্ছেন। একটি স্লোগানও প্রায়ই দেখা যায় — ‘উন্নয়নের গণতন্ত্র-শেখ হাসিনার মূলমন্ত্র।’ কিন্তু সেই উন্নয়নের কোনো ছোঁয়া কণিকা তার জীবনে খুঁজে পায়নি। ১২ বছরের শিশুটি জীবন বোঝেনি, অভাবের তীব্রতা বুঝেছে। জীবনের স্নেহময় সান্নিধ্য পাবার আগেই তার জীবন প্রদীপ নিভে গেছে। প্রশ্ন ওঠা তাই স্বাভাবিক — উন্নয়ন তাহলে হচ্ছে কার?

বাংলাদেশে জাতীয় আয়, মাথাপিছু আয় বাড়ছে। কীভাবে বাড়ছে? জিডিপি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির পিছনে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো টাকার বড় ভূমিকা আছে। ভূমিকা আছে গার্মেন্টস আর কৃষি খাতেরও। বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমেরও মূল্য কম নয়। কিন্তু এখানেও একটা দারুণ বৈপরীত্য! যারা এই সম্পদ সৃষ্টি করছে তাদের জীবনে অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতা দুটোই খুব তীব্র। প্রায় প্রতিদিনই বিদেশ থেকে শ্রমিকের লাশ আসে, দেশে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার শিকার হয়ে, আগুনে সেদ্ধ হয়ে শ্রমিক মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। কৃষক ফসলের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে রাস্তায় ফসল আর চোখের জল ফেলে। বোঝাই যায়,সরকার যে উন্নয়নের গল্প বলে সেটা আসলে এই শ্রমিক-কৃষকদেরই রক্ত নিংড়ানো শ্রমের ফল।

বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ১৬০২ মার্কিন ডলার। এই হিসাবের ভিত্তিতেই বাংলাদেশ এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ। কিন্তু এই হিসাবের মধ্যে একটা ফাঁকি আছে। আফ্রিকার বহু দেশ মাথাপিছু আয়ে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে কিন্তু সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রার মান বাংলাদেশের চেয়ে নিম্ন। যেমন নাইজেরিয়ার মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু তাতে তাদের জীবনযাত্রার মান বাংলাদেশের চেয়ে ভালো তা বলা যাবে না। অর্থাৎ দেখতে হবে মাথাপিছু আয়ের সাথে সাথে জীবন যাত্রার মান কতটুকু উন্নত হলো। মাথাপিছু আয়ের হিসাবটা একটু ভালো করে বোঝা দরকার। ধরা যাক, একটি পরিবার যদি ১ কোটি টাকা আয় করে আর আরেকটি পরিবার যদি ১০ হাজার টাকা আয় করে তবে উভয় পরিবারের গড় আয় হবে ৫০ লক্ষ ৫ হাজার টাকা। এতে কি দুই পরিবারের প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাবে? একইভাবে ১৬০২ মার্কিন ডলার মাথাপিছু আয় ধরে চার সদস্যের একটি পরিবারের বার্ষিক গড় আয় হয় প্রায় ৬.৫ হাজার মার্কিন ডলার অর্থাৎ মাসে প্রায় ৫২ হাজার টাকা। বাংলাদেশে কয়টি পরিবার মাসে ৫২ হাজার টাকা উপার্জন করতে পারে? পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে শতকরা ৮০টি পরিবারের গড় মাসিক আয় ১০ হাজার টাকারও নিচে।

তাহলে খাতা-কলমে জিডিপি, মাথাপিছু আয়ের এই বাড়তি হিসাব আসে কীভাবে? এখানেই লুকিয়ে আছে মূল সত্যটা। দুর্নীতি-লুটপাট করে সম্পদের বিপুল বৃদ্ধি জিডিপি ফুলে ফেপে উঠতে ভূমিকা রাখে। চুরি করে, অপচয় করে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়েও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অবয়ব বড় দেখানো যায়, এতেও জিডিপি বাড়ে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসনের ব্যাপক বাণিজ্যিকীকরণ ঘটলেও কিছু মানুষের হাতে সম্পদ জমে, তাতেও জিডিপি বাড়ে। তাই কেবল জিডিপি ও মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে উন্নয়ন পরিমাপ করলে মূল উন্নয়নের কথাটা আড়ালে পড়ে যায়।

সত্য কথাটি হলো, সরকারের উন্নয়নের গল্পটা দেশের মুষ্টিমেয় ধনীদের জন্য প্রযোজ্য। এ চিত্র আজ কেবল বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বেই একই পরিস্থিতি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অক্সফাম বলছে, পৃথিবীর শীর্ষ ৮ জন ধনীর হাতে বিশ্বের অর্ধেক মানুষের সমান সম্পদ আছে। কী ভয়াবহ বৈষম্য! উন্নত প্রযুক্তি আসছে বাজারে। কিন্তু তা ব্যবহৃত হচ্ছে শ্রম শোষণে, বাড়িয়ে দিচ্ছে বেকারত্ব। বোঝাই যাচ্ছে ‘উন্নয়ন’ কথাটির কোনো একক অর্থ নেই। উন্নয়ন যদি বেশিরভাগ মানুষের বঞ্চনা আর বৈষম্য বাড়িয়ে দেয়, জীবনে অনিশ্চিয়তা নিয়ে আসে, তবে সেই উন্নয়ন এক বিভীষিকার নাম। ‘উন্নয়ন’ যদি কারও কাছে অঢেল বিত্ত বৈভব তৈরির উপায় হয়, তবে অনেকের কাছে তা আতঙ্কের প্রতিশব্দ।

তাহলে মানুষ যাবে কোথায়? তাই বিক্ষোভ চলছে, আমেরিকা থেকে ইউরোপ; এশিয়া থেকে আফ্রিকা। সবখানেই আওয়াজ উঠছে – এই বৈষম্যের সমাজ ভাঙতে হবে। এমন পরিস্থিতির কথা বহু আগেই বলেছিলেন মহান দার্শনিক কার্ল মার্কস। বাতলে দিয়েছিলেন মুক্তির পথও। সেই পথ পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা পত্তনের পথ। একমাত্র সমাজতন্ত্রেই ধনী-গরীবের বৈষম্য দূর হয়, সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানা সৃষ্টি হয়। তেমন একটি রাষ্ট্র নির্মাণ করতে হলে আজ বাংলাদেশের শ্রমজীবী-নিপীড়িত মানুষকেও লড়াই করতে হবে। উন্নয়নের রঙিন ফানুস দিয়ে যে মানুষের কষ্ট-যন্ত্রণাকে চাপা দেয়া যায় না, তা আজ স্পষ্ট।

সাম্যবাদ ডিসেম্বর ২০১৭

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments