[dropcap]ঊ[/dropcap]নসত্তরের গণঅভ্যুত্থান আমাদের কিছু পবিত্র নাম মনে করিয়ে দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্র শহীদ আসাদ; নবকুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণীর ছাত্র কিশোর শহীদ মতিউর যে বাসা থেকে বের হবার আগে একটি চিরকুটে লিখেছিল, “মাগো মিছিলে যাচ্ছি। যদি না ফিরি মা, তবে যেনো তোমার ছেলে বাংলার মানুষের জন্য,…….জীবন দিয়েছে।” আসাদের মৃত্যু তাকে আলোড়িত করেছিল মতিউরকে, উদ্বুদ্ধ করেছিল প্রাণ দিতে।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সাথে জড়িয়ে আছে আরেকটি নাম, ডঃ শামসুজ্জোহা। বাংলার প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান তৈরি করেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত। যাঁদের আত্মত্যাগে এ সংগ্রাম গণআন্দোলনে রূপ নিয়েছিল, তাদের অন্যতম ডঃ শামসুজ্জোহা। এসএম হলের ছাত্র শামসুজ্জোহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে মাস্টার্স পাশ করেন। পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন ইংল্যান্ডের ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে। তিনি একাধারে হকি, ফুটবল ও ক্রিকেট লীগে খেলতেন। পাকিস্তান ওয়াহ ট্রাস্টে উচ্চপদস্থ গবেষকের চাকুরি ছেড়ে দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। একসময় দায়িত্ব পান প্রক্টরের। ৬৯ সালে আন্দোলন চলছিল দেশজুড়ে। পাকিস্তানি জান্তা ১৫ ফেব্র“য়ারি বন্দি অবস্থায় গুলি করে হত্যা করে কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে। এর প্রতিবাদে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের মিছিলে সেনাবাহিনীর গুলিতে আহত হয় অসংখ্য ছাত্র। ডঃ জোহা ছাত্রদের হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। ১৭ ফেব্র“য়ারি ছিল ছাত্র ধর্মঘট। এতে বিনা উস্কানিতে পুলিশ লাঠি চার্জ করে ছাত্রদের রক্তাক্ত করে। এরপর ১৩ জন ছাত্রকে একটি ছোট্ট ভ্যানে রক্তাক্ত অবস্থায় গাদাগাদি করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। ডঃ জোহা ছিলেন এ বিপদগ্রস্ত ছাত্রদের সাথে। সে সময় ক্যাম্পাসে চলছিল একুশের অনুষ্ঠান যা প্রতিবাদ সভায় পরিণত হয়। ডঃ জোহা এই প্রতিবাদ সভায় বলেছিলেন, “সিরাজদ্দৌলাকে অন্ধকূপে হত্যার মিথ্যা দুর্নাম দেয়া হয়েছিল। আজ অন্ধকূপ দেখে এসেছি। ছোট্ট একটা গাড়িতে বার চৌদ্দজন রক্তাক্তদেহী ছাত্রকে ঠাসাঠাসি করে তোলা হয়েছিল। আমার ছাত্রদের রক্তের দাগ আমার গায়েও লেগেছে, সেজন্য আমি গর্বিত…..।”
১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের মিছিল ক্যাম্পাস থেকে বের হওয়ার মুখে। পাক আর্মি ও ছাত্রদের মুখোমুখি অবস্থান। খবর পেয়ে ডঃ জোহা বুক চিতিয়ে এগিয়ে গেল সামনে। আর্মিদের উদ্দেশ্য করে বললেন, “ডোন্ট ফায়ার! আমি বলছি কোন গুলি বর্ষণ হবে না। কোন ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে যেন আমার গায়ে গুলি লাগে।” এভাবে ছাত্রদের আগলাতে তিনি নিজে পাকসেনাদের নিশানা হলেন। পাকসেনারা ডঃ জোহাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ফেলে রেখে যায়।
স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের সংগ্রাম ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন জন্ম দিয়েছিল ডঃ জোহাদের মত নীতিনিষ্ঠ মানুষদের। আজ এঁদের মতো মানুষের বড় অভাব। চারিদিকে কেবল ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধা আর ভোগ সর্বস্বতার প্রতিযোগিতা। তাই জোহাদের মত মানুষ, শিক্ষক তৈরি হচ্ছে না। পুঁজিবাদী দুনিয়ার শ্লোগান,”PAY FIRST.” “ITS MY LIFE.” এ সমাজকে টিকিয়ে রাখতে মেরে দিতে হয় মানবিকতা, মুছে ফেলতে হয় মনুষ্যত্বকে। বিত্ত-বৈভবের তাড়নায় মানুষ কেবল ছুটছে। ফলে ডঃ জোহার মতো মূল্যবোধের মানুষ নেই। সেই চরিত্র নিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর কেউ নেই। নজরুল একদিন বলেছিল, “সত্যকে হায় হত্যা করে অত্যাচারীর খাড়ায়, নেই কি রে কেউ সত্য সাধক বুক খুলে আজ দাঁড়ায়?”
উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য উচ্চতর হৃদয় সম্পন্ন মানুষ হওয়া। শিক্ষা আমাদের ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে ও অন্যায়ের বিরোধিতা করতে শেখায়। পাকিস্তানের অন্যায় নীতির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে একদিন শামসুজ্জোহা জীবন দিয়েছিলেন। ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে জীবন বলিদানের মূর্ত প্রতীক তিনি। তার এই আত্মদান আমাদের ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে অনুপ্রাণিত করে।
ডঃ শামসুজ্জোহা লাল সালাম।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ডঃ শামসুজ্জোহা
RELATED ARTICLES