লুটপাটের মহা উৎসব চলার মধ্যেই, যখন দেখা গেল রিজার্ভ দ্রুতবেগে নিচের দিকে নামছে, এ দেশের ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’ সরকার আসন্ন মহাসংকট অনুভব করলেন। লুটে খেতে খেতে তারা পাত্রের তলাসহ খেয়ে ফেলছিলেন, সম্বিৎ ফেরার পর যার কাছে ছুটে গেলেন, সে এক মহাপ্রতারক। তার নাম আইএমএফ। আইএমএফ, তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিশ্ব্যাংককে নিয়ে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে কিভাবে অর্থনৈতিকভাবে হত্যা করে- তার কাহিনী হালের ওটিটি প্লাটফর্মের থ্রিলার কাহিনীকেও হার মানায়।
যাই হোক, আইএমএফের কর্তারা ঢাকায় আসলেন। গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক শেষে সিদ্ধান্ত হলো তারা বাংলাদেশকে পরবর্তী ৪২ মাসে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ দেবেন। ঋণের সাথে বেঁধে দেয়া হলো কিছু শর্ত, যা আইএমএফের ঋণের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। শর্ত অনুসারে, বাংলাদেশকে রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে এবং জ্বালানী খাতে ভর্তুকি কমাতে কমাতে শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। কাঠামোগত ও নানা ধরণের সংস্কারের আরও অনেকগুলো শর্ত আছে, কিন্তু এ দুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর প্রভাব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাধারণ মানুষ প্রতিদিন অনুভব করছেন।
প্রতি দফায় অর্থ ছাড়কে কেন্দ্র করে আইএমএফ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সাথে বৈঠক করে তাদের শর্তপূরণের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চায়। এই প্রেক্ষিতে গত ২ মে বিদ্যুৎ বিভাগের সাথে বৈঠকের সময় বিদ্যুৎ বিভাগ জানায় যে, ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু আরও কমানোর জন্য তারা বছরে চারবার বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করবে, সোজা কথায় চারবার বিদ্যুতের দাম বাড়াবে।
কেন এই শর্ত? কেন প্রাণঘাতী শর্ত মেনে বাংলাদেশ ঋণ নিচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার আগে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে কয়েক দশক। কেন এবং কিভাবে এই দুই বন্ধুর জন্ম হলো পৃথিবীতে এবং তাদের সাহায্য (ঋণ) নেয়া রাষ্ট্রগুলোর পরিস্থিতি কী?
ঋণ করে ঋণ শোধ, তারপর আবার ঋণ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে উন্নয়নশীল, স্বল্পোন্নত কিংবা অনুন্নত দেশগুলোকে ‘সাহায্য’ করার জন্য সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো জন্ম দিলো দুই বন্ধুকে- একজনের নাম ‘বিশ্বব্যাংক’ ও অন্যজন ‘আইএমএফ’। একজনের (বিশ্বব্যাংক) কাজ হলো অবকাঠামো খাতে উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ দেয়া, আরেকজনের (আইএমএফ) কাজ হলো, সেই দেশগুলোর ঋণ শোধ করার জন্য ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্ট’- এ সমস্যা দেখা দিলে তাকে ঋণ দেয়া, অর্থাৎ ঋণ শোধ করতে ঋণ দেয়া। আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) উন্নয়নের জন্য কোন ঋণ দেয় না। তারা কোন দেশের ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্ট’ অর্থাৎ ঋণ শোধ করার জন্য যে ডলার লাগে, সে ধরনের মুদ্রা সংকট তৈরি হলে ঋণ দেয়। ঋণ দেয়ার জন্য তারা দেশগুলোকে নানান শর্ত দেয়; যেমন- সরকারি ভর্তুকি কমানো, আমদানি শুল্ক কমানো, রপ্তানিভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন, উদারনীতিক অর্থনীতি চালু করা, সরকারি ব্যয় সংকোচন প্রভৃতি।
এই দুইবন্ধুর যৌথ ব্যবসা খুবই চমৎকার! বিশ্বব্যাংকের কোন ঋণ শর্তমুক্ত নয়। অর্থাৎ কোন দেশের সরকার চাইলেই নিজেদের প্রয়োজন অনুসারে এই ঋণ খরচ করতে পারবেনা। অনুন্নত দেশগুলো স্বনির্ভর হয়ে গেলে বিশ্বব্যাংকের ঋণের ব্যবসাই ডুবে যাবে। এই ঋণগুলো দেয়া হয় মূলতঃ অবকাঠামো খাতে, মেগা প্রজেক্টের জন্য। এই সকল প্রজেক্টে যথেচ্ছা লুটপাট মেগা প্রজেক্টকে সুপার মেগা প্রজেক্ট করে তোলে। ঋণের শর্তগুলো এমনভাবে দেয়া হয় যাতে দেশগুলো আরও নিঃস্ব হয় এবং একসময় বিশ্বব্যাংকের ঋণের সুদ মেটাতে মেটাতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তখন সেই দেশের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় আইএমএফ। আইএমএফ থেকে ঋণ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঋণের সুদ কিছুটা পরিশোধ করা হয়। তখন বিশ্বব্যাংক থেকে আরও ঋণ পাওয়া যায়, সেটা দিয়ে আইএমএফের কিছু সুদ পরিশোধ করা হয়। এভাবে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ঋণের চক্রে একটা দেশ জড়িয়ে পড়ে, নিঃস্ব হয় এবং তার অর্থনৈতিক মৃত্যু ঘটে। সে নির্ভরশীল হয় এই দুই বন্ধু কিংবা পরবর্তীতে জন্ম নেয়া সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর নানারকম দাতা সংস্থার উপর।
দেশের প্রয়োজনে ঋণ নয়, ঋণের প্রয়োজনে দেশের অর্থনীতিকেই বদলে দেয়া
কোন একটা অনুন্নত বা স্বল্পোন্নত পুঁজিবাদী দেশ শিল্পে উন্নত হবে কিভাবে? সাধারণভাবে আমরা বুঝি যে, সে তার নিজস্ব সম্পদের উপর ভিত্তি করেই শিল্প সৃষ্টি করবে। কিন্তু পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের স্তরে উন্নীত হওয়ার পর এ সকল দেশের সম্পদ ও সস্তা শ্রমের উপর সাম্রাজ্যবাদীদের নজর পড়লো। ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ সকল দেশের অর্থনীতির উপর সে প্রভাব বিস্তার শুরু করলো। এর মাধ্যমে রাজনীতিতে সে ভূমিকা রাখা শুরু করলো। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ ও বিভিন্ন দাতা সংস্থা হলো সেই অস্ত্র। কোন দেশের অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করা এবং একে পাল্টে দেয়ার মাধ্যমে দেশটিকে রাজনৈতিকভাবেও নির্ভরশীল করে তোলার এই প্রক্রিয়াকে বলে নয়া-উপনিবেশিকতাবাদ। অর্থাৎ আগের মতো কোন রাষ্ট্র দখল করে উপনিবেশ স্থাপন করতে হচ্ছে না। অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে এ এক নতুন উপায়ে উপনিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। এর মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো কয়েকটি উদ্দেশ্য হাসিল করে।
প্রথমত, অনুন্নত, স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের সস্তা শ্রম কাজে লাগানোর জন্য নিজস্ব কোন অর্থনীতি গড়ে তুলতে না দিয়ে তাদেরকে সাম্রাজ্যবাদী দেশের উপর নির্ভরশীল করা।
দ্বিতীয়ত, নিজেদের অলস পুঁজি বিশ^ব্যাংক-আইএমএফসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার মাধ্যমে সুদে খাটানো।
তৃতীয়ত, এই ঋণের টাকা দিয়ে সৃষ্ট প্রকল্পের কাজ সাম্রাজ্যবাদী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে পাইয়ে দেয়ার মাধ্যমে নিজেদের টাকা নিজেদের ঘরেই নিয়ে আসা।
চতুর্থত, দেশের ঋণ, রিজার্ভ, অর্থনীতি, আমদানি, রপ্তানিসহ সকল কিছুতেই তাদের অংশীদারিত্ব তৈরি হয়। এই প্রক্রিয়ায় সে দেশের রাজনৈতিক বিষয়েও হস্তক্ষেপ করে। (যদিও এর মানে গোটা দেশটাই কারও হাতে চলে গেছে তা বোঝায় না)
দেশীয় পুুঁজিপতিরা এইসকল প্রজেক্টের সাব-কন্ট্রাক্ট পায়। রাজনৈতিক নেতারা কমিশন পায়। অনেক সময় দেশীয় কোম্পানির সাথে কোলাবোরেশনে কাজ হয়। এ এক বিরাট অর্থনৈতিক চক্র।
আমাদের পরামর্শ নাও, তোমাদের জীবন বদলে যাবে
এই প্রক্রিয়ায় এক দেশ কিভাবে নিঃস্ব হয়, তার শত শত উদাহরণ আছে। এর মধ্যে বর্তমান গার্মেন্টসের বাজারে সস্তা শ্রম নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা দেশ ইথিওপিয়ার কথাই ধরি। আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়া। সত্তরের দশকে দেশটি শ্যামলপ্রান্তর ও প্রচুর বনজসম্পদে পরিপূর্ণ ছিল। সেখানকার আওয়াস নদী, বিখ্যাত রিফ্টভ্যালির দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে গেছে। বিশ^ব্যাংক সেই নদীতে ড্যাম গড়ে তোলার জন্য মেগা প্রজেক্ট হাতে নেয়ার পরিকল্পনা দিল, বললো তারা ঋণ দেবে। তাতে ইথিওপিয়ার জীবন বদলে যাবে, বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে, ক্ষেতে সেচ দেয়া যাবে।
কথামতো বন কেটে সাফ করে ড্যাম গড়ে উঠলো, বনাঞ্চল ধ্বংস হলো। প্রায় দেড় কোটি লোক বাস্তুচ্যুত হলো। গোচারণভূমি নষ্ট হলো, ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হলো পশুসম্পদ। এসবের উপর নির্ভরশীল মানুষ পথে বসলো।
ড্যাম নির্মাণের ফলে পলিমাটি আটকে গেল। চারপাশের ক্ষেতকে নদীর পলি উর্বর করতে পারলো না। অনুর্বর জমিতে উৎপাদন কমে যেতে লাগলো। বিশ্বব্যাংক বললো, উর্বরতা বাড়ানোর জন্য কেমিক্যাল সার দিতে হবে। সার নিয়ে এলো বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানি। আবার প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় শুরু হলো পোকামাকড়ের উৎপাত। সেটা থেকে ফসল বাঁচানোর জন্য বহুজাতিক কোম্পানি নিয়ে আসলো কিটনাশক। সার ও কিটনাশক আমদানি করতে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রায় টান পড়লো।
কিটনাশক ও কেমিক্যাল সার বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে পড়তে লাগলো নদী-নালায়, খাল-বিলে। এসবের পানি বিষাক্ত হতে শুরু করলো। প্রজেক্টের জন্য লক্ষ লক্ষ একর জমি নষ্ট হলো, সার-কিটনাশক দিয়েও জমির উৎপাদন তেমন বাড়লো না। দেখা দিলো খাদ্যসংকট। খাদ্য আমদানির জন্য ইথিওপিয়া হাত পাতলো বিশ^ব্যাংকের কাছে।
এবার বিশ্বব্যাংক শর্ত দিলো অর্থকরী ফসল আখ ও তুলার চাষ করতে হবে। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোকে সস্তায় আখ ও তুলার যোগান দেয়ার জন্য ইথিওপিয়া ব্যাপকভাবে এই দুই ফসলের চাষ করতে লাগলো। তাতে খাদ্যশস্যের উৎপাদন আরও মার খেলো। দেখা দিল দুর্ভিক্ষ। ফলে আবার ঋণ, আবার শর্ত, আবার ক্ষতি, আবার ঋণ- এই চক্রে ঘুরতে ঘুরতে একটি স্থায়ী দুর্ভিক্ষের দেশে পরিণত হলো ইথিওপিয়া।
দেশে দেশে এই প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী সংস্থা কাজ করে। এতে একের পর এক দেশের জনগণ নিঃস্ব হয়, বাস্তুচ্যুত হয়, প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস হয়Ñ কিন্তু দেশের একটা শ্রেণি আর্থিকভাবে লাভবান হয়। এরা বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির সাথে যুক্ত হয়ে ব্যবসা করে, লোকাল পার্টনার হয়। তাদের পুঁজির যোগান দিতে গিয়ে দেশের ব্যাংক লুট হয়, কোষাগার শূণ্য হয়।
মেগা প্রজেক্ট আর মেগা ঋণের বাংলাদেশ
এই পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়েই আমাদের দেশের অর্থনীতির আলোচনা শুরু করতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই দেশের অর্থনীতির সাথে বিশ্বঅর্থনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো যে মডেল দাঁড় করায়, তাদের সংস্থাগুলো (বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি ইত্যাদি) অনুন্নত দেশকে যেভাবে শোষণ করে, তাদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে এইসকল দেশের পুঁজিপতিরা যেভাবে স্ফীত হয়, রাষ্ট্র যেভাবে এই পুঁজিপতিদের পুঁজি যোগান দেয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার উন্মুক্ত করে দেয়- এই ঘটনাগুলো একে অপরের সাথে সম্পর্কিত এবং একইসাথে এদের বুঝতে হবে।
এদেশেও মেগা একের পর এক মেগাপ্রজেক্ট গ্রহণের জন্য ক্রমাগত উৎসাহ ও চাপ প্রদান করা হচ্ছে। এই প্রকল্পগুলোর বেশ কয়েকটি অপরিকল্পিত ও অপ্রয়োজনীয়- সরকারকে সমর্থন করেন এরকম অনেক অর্থনীতিবিদও এই মত দিয়েছেন। আর প্রকল্পগুলোর দুর্নীতি নিয়ে বাক্যব্যয় করা অনুচিত হবে, কারণ প্রতিদিনের পত্রপত্রিকায় এসকল দুর্নীতির কথা অহরহ আসছে। ২৬ হাজার টাকার বালিশের কভার থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকার পর্দার কাপড়ের গল্প এখন সবাই জানেন। প্রতি কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করতে বাংলাদেশে খরচ হয় আড়াই থেকে এগারো মিলিয়ন ডলার, সেখানে ভারত আর চীনে খরচ হয় এক থেকে দেড় মিলিয়ন ডলার। এই কাজগুলো বহুজাতিক কোম্পানিই করে, তাদের দেশের চেয়ে চার-পাঁচগুণ কিংবা তারও বেশি খরচ করে। ফুলবাড়ির কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের টাকা দিয়েছে ‘জাইকা’, বানিয়েছে জাপানি কোম্পানি ‘সুমিটোমো’ ও ‘তোশিবা’। এটা দুনিয়ার সবচেয়ে ব্যয়বহুল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প। পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরও এ যাবৎকালের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সমুদ্রবন্দর, যা নির্মাণ করছে একটি চীনা কোম্পানি। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও সবচেয়ে ব্যয়বহুল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, যার টাকা দিচ্ছে রাশিয়া, তৈরি করছে রাশিয়ার কোম্পানি ‘রোসাটম’। এমনকি বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতের কয়েক দশকের জাতীয় পরিকল্পনা করে দেয়ার জন্য ভাড়া করা হয়েছে ‘টেপকো’ নামের একটি বিদেশি কোম্পানিকে।
এর ফলাফল কী? ২০২১-২২ অর্থবছরের হিসেবে মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণ প্রায় সাড়ে ৬২ হাজার টাকা। এইসকল উন্নতির খেসারত দিতে হবে জনগণকে। তাদের গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি সবকিছু থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার করে, দাম বাড়িয়ে আবার তাদের উপর করের বোঝা চাপিয়ে- এককথায় তাদেরকে পিষ্ট করেই এই উন্নয়নের পতাকা উড়ানো হবে।
এই যুগে পুঁজিপতিদের কাছে জাতীয় স্বার্থ বলে কিছু নেই
অভ্যন্তরীণ সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবস্থাপনার ভিত্তিতে অভ্যন্তরীণ প্রয়োজন পূরণ করার জন্য উৎপাদন নয়Ñ লাভের জন্য উৎপাদনই বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য। অনুন্নত দেশের সস্তাশ্রম কাজে লাগিয়ে, তার কাঁচামাল ব্যবহার করে সস্তায় পণ্য উৎপাদন ও মুনাফার জন্য সাম্রাজ্যবাদীরা সেই দেশগুলোতে যায়। তথাকথিত উন্নয়নের প্রেসক্রিপশন দেয়, বাস্তবে সস্তায় তাদের কাজ করিয়ে নেয়। যে দেশে যায়, সে দেশের পুঁজিপতিদেরও লাভ দরকার। যেখানে লাভ আছে, সেটাই সে করবে- দেশের স্বার্থ বলে কোন ব্যাপার তার কাছে নেই। আর এই সাম্রাজ্যবাদের যুগে, বহুজাতিক পুঁজির সাথে গাঁটছড়া না বেঁধে কোন অনুন্নত দেশের পুঁজিরই টিকে থাকার উপায় নেই। ফলে সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী এই চক্রের মধ্যে পড়ে একের পর এক দেশের জনগণ নিঃস্ব হচ্ছে। মরক্কো, সাইপ্রাস, পেরু, কলম্বিয়া, শ্রীলঙ্কা থেকে বাংলাদেশ- সকল দেশে একই চিত্র। এ এক নির্মম, নিষ্ঠুর, বর্বর হত্যাযজ্ঞ- কিন্তু হচ্ছে খুবই নিঃশব্দে, তথাকথিত উন্নয়ন আর মেগা প্রজেক্টের আড়ালে।
বাংলাদেশে আমরা যা দেখতে পাচ্ছি তা কোন নতুন চমক নয়। এইসব জিডিপি, প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামো, উন্নয়নÑ সবকিছুর মূলকথা হলো মুনাফা। দেশের মানুষের দম আটকে যাচ্ছে বেঁচে থাকতে গিয়ে, অথচ সরকারের পক্ষ থেকে উন্নয়নের ছেঁড়া ঢোল বারবার পেটানো হচ্ছে। লুটের ছিটেফোঁটা পাওয়া লোকেরাও বলেই যাচ্ছেন, “দেখছেন না? গ্রামগুলো সব পাল্টে গেল। প্রত্যন্ত গ্রামেও এখন ফাস্টফুডের দোকান, বিদ্যুতের আলো, ডিশটিভির কানেকশন, পাকা রাস্তা। ইজিবাইক আর ব্যাটারি রিক্সা দিয়ে ধাই ধাই করে ঘুরে আসা যায় যে কোন সময়। উত্তরবঙ্গে মঙ্গা নেই। না খেতে পেয়ে লোক মরতে শুনেছেন? দুর্ভিক্ষের কথা শুনেছেন?”
এর বিপরীতে ঋণের দায়ে কৃষকের আত্মহত্যা, ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে সব ছেড়ে গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা পরিবারের শিল্প এলাকার ফুটপাথে সংসার বসানো, কাজের জন্য কোটি শ্রমিকের বিদেশযাত্রা, দিনে প্রায় ১৩ জন বৈধ প্রবাসী শ্রমিকের মৃত্যু, অবৈধভাবে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে সাগরে ভেসে যাওয়া, ধরা পরার আশঙ্কায় দালালের হাতে খুন হয়ে থাইল্যান্ডে গণকবরে ঘুমিয়ে পড়া, বাঁচার জন্য অঙ্গ বিক্রি করা, উচ্চশিক্ষা অর্জন করে কোনরকমে দিনমজুরের কাজ করে টিকে থাকা- এসবকিছুই যেন ভুল, মিথ্যা প্রচারণা। সুখের জীবন ফেলে যেন সবাই শখের বশে এসব করছে।
মি. কামদেশাস, এত রক্ত!
১৯৮৮ সালের ১৮ মে। গায়েনাতে আইএমএফ এর নিজস্ব প্রতিনিধি ছিলেন ডেভিসন এল বুুধু, ‘লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিকস্’ থেকে পাশ করা বড় এক অর্থনীতিবিদ। তিনি সেদিন আইএমএফ এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর মি. কামদেশাসের কাছে একটি খোলা চিঠি পাঠান। এতে তিনি বলেন, “আমার কাছে পদত্যাগ হচ্ছে অমূল্য সম্পদ, মুক্তি-অর্জন। কারণ আমার দৃষ্টিতে যা ছিল লক্ষ-কোটি গরিব ও ক্ষুধার্ত মানুষের রক্তপাত, সেই রক্তপাতে সিক্ত হাত দু’খানা ধুয়েমুছে সাফ করার এটাই প্রথম পদক্ষেপ। মি. কামদেশাস, এত রক্ত! আপনি জানেন, রক্তের নদী বয়ে যাচ্ছে। সেই রক্ত শুকিয়েও যাচ্ছে, আমার সারা গায়ে কেকের মতো লেপ্টে রয়েছে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, আপনাদের সিলমোহর মেরে এবং আপনি ও আপনাদের পূর্বসূরিদের নির্দেশে এতকাল আমাকে যা করতে হয়েছে, সে পাপ ধুয়ে ফেলতে যত সাবান লাগবে, সারা পৃথিবীতেও বোধ হয় এত সাবান নেই। যারা আপনাদের সমালোচনা করে, তাদের ‘নষ্টামির গুরু’ বা ‘কমিউনিস্ট’ বলে যত গাল আপনারা দিন না কেন, আপনাদের সংস্থা তাতে রেহাই পাবেনা বা আপনাদের সকলের লালিত ও রক্ষিত চামড়া তাতে বাঁচবেনা।
আমি জানি আমার উপর নানারকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, আইনিব্যবস্থা নেয়া হতে পারে। তা আপনারা যা ভাল বুঝবেন করুন। সভ্য দুনিয়ায় যাকে ‘ক্রিমিনালসুলভ আচরণ’ বলে, সেইসব পরোক্ষ হেনস্তা অনেক হবে জানি, কিন্তু আমি তা সাদরে বরণ করবো- কারণ সেটা আমার স্বাধীনতাবোধকে আরও পোক্ত করে তুলবে। আপনারা ভেবেছেন ভবিষ্যতের বংশধররা, যাদের জীবন-প্রাণ আপনারা ছিন্নবিচ্ছিন্ন করছেন, তারা কি ‘ন্যুরেমবার্গ’ স্টাইলে আপনাদের বিচার করবেনা?”(Enough is enough, Devison L. Budhu)
এই কথাটাই আজ সকলের মনের কথা। এই নির্মম শোষকদের জনগণ একদিন ‘ন্যুরেমবার্গ’ স্টাইলে বিচার করবে। গোটা দুনিয়ায় মুনাফাবিহীন সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠা করবে।
তথ্যসূত্র:
১. সর্বগ্রাসী অক্টোপাশ, কলকাতা থেকে প্রকাশিত
২. বিদেশি বিনিয়োগ, দুর্নীতি ও জাতীয় সক্ষমতার প্রশ্ন, মাহা মির্জা