(ঘাটশিলায় অনুষ্ঠিত এস ইউ সি আই (সি)’র তৃতীয় পার্টি কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনে ২১ নভেম্বর কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর মূল ইংরেজি উদ্বোধনী ভাষণের গণদাবী-তে প্রকাশিত বাংলা অনুবাদ।)
কমরেডস,
আমাদের পার্টি বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী)’র পক্ষ থেকে আমি এস ইউ সি আই (সি)’র তৃতীয় পার্টি কংগ্রেসে উপস্থিত সকল প্রতিনিধি কমরেডকে অভিনন্দন জানাই। আমার সংক্ষিপ্ত পরিচয় আপনাদের প্রিয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ আপনাদের সামনে রেখেছেন। আমি সেগুলোর পুনরাবৃত্তি করব না। আমি প্রথমে বলতে চাই, কীভাবে আমার সীমাবদ্ধ ক্ষমতা নিয়ে মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের অমূল্য শিক্ষা আমি বাংলাদেশে বহন করে নিয়ে গিয়েছিলাম। আপনারা হয়তো জানেন, ঢাকার কাছে একটি ছোট্ট গ্রামে কমরেড শিবদাস ঘোষ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সেখান থেকেই তাঁর রাজনৈতিক কাজকর্মের শুরু। প্রথমে অনুশীলন সমিতিতে তিনি যুক্ত হন, তারপর রেভলিউশনারি সোস্যালিস্ট পার্টি (আর এস পি) নামে একটি মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। সেই পার্টির মধ্যে ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী পেটিবুর্জোয়া আপসহীন সংগ্রামী ধারার প্রভাব যথেষ্ট ছিল। ব্রিটিশ শাসনকালেই তাঁরা দেখেছিলেন সিপিআই একটি প্রকৃত কমিউনিস্ট বিপ্লবী পার্টি হিসাবে গড়ে ওঠেনি। তাই নতুন করে একটি কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সে পার্টিও আদতে পুরনো অনুশীলন সমিতিরই অনুসারী ছিল এবং ফলে তা বাস্তবে একটি পেটিবুর্জোয়া বিপ্লবী পার্টি হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৪২ সালে কমরেড শিবদাস ঘোষ গ্রেপ্তার হয়ে যান। আপনারা আমার থেকে ভালই এসব জানেন। আমি কী করে কমরেড শিবদাস ঘোষের সংস্পর্শে প্রথম এলাম তাই আপনাদের বলি।
এস ইড সি আই (সি) প্রথমে একটি প্ল্যাটফর্ম অব অ্যাকশন হিসাবে কাজ শুরু করেছিল। তারপর ১৯৪৮ সালের ২৪ এপ্রিল পশ্চিমবাংলার জয়নগরে একটি কনভেনশনের মধ্য দিয়ে পার্টি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালীন কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্য কমরেড মনোরঞ্জন ব্যানার্জী, যিনি পরবর্তীকালে আর রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে থাকতে পারেননি, কিন্তু সে-সময় শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনে সামিল ছিলেন, তাঁর মাধ্যমে আমি দলের সংস্পর্শে আসি। আমি শৈশবেই বাবা-মাকে হারিয়েছিলাম। খিদিরপুরের বন্দর এলাকায় আমার বড় ভাইয়ের বাসায় তখন আমি থাকতাম, সেখানেই আমি তাঁর সাথে পরিচিত হই। তিনি আমাকে কমরেড শিবদাস ঘোষ পরিচালিত একটি স্টাডি সার্কেলে নিয়ে যান। সে-সময় আমি স্কুলশিক্ষার দিক থেকেও বেশ দুর্বল ছিলাম। আমি মাত্র অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছিলাম।
আমি যখন কমরেড শিবদাস ঘোষের কাছে এলাম, তাঁর কথাবার্তা, আলোচনা এবং তাঁর সংস্পর্শ আমাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। মার্কসীয় বইপত্র তেমন বিশেষ পড়াশোনার দ্বারা নয়, তাঁর বক্তব্য ও তাঁর সাথে মেলামেশার মাধ্যমেই আমার মধ্যে মর্যাদাময় জীবন-যাপনের ধারণা জন্ম নেয়। আমি ট্রেড ইউনিয়নের কাজে যুক্ত হই। পুলিশ আমার খোঁজে একদিন আমার বাড়ি সার্চ করেছিল। আমার বড়ভাই এতে ভয় পেয়ে যান। তিনি পাকিস্তানি (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, বর্তমান বাংলাদেশ) মানুষ ছিলেন বলে ভীত-সন্ত্রস্ত ছিলেন। তিনি আমাকে জানিয়ে দেন তাঁর বাড়িতে আর থাকা হবে না। সেই সময়ে এস ইউ সি আই (সি) খুবই সমস্যাসঙ্কুল অবস্থায় ছিল। তাই কমরেডরা যে কমিউনে থাকতেন, সেখানেও আমার থাকা সম্ভব ছিল না। আমি ভাইয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে কলকাতা সংলগ্ন বাটা এলাকার রাস্তায় কাটাতাম। কলকাতার কমরেডরা সে এলাকা জানে। আমি খবরের কাগজ পেতে রাস্তায় শুতাম। পুলিশ এসে আমার ঘুম ভাঙিয়ে তুলে দিত। এমনি করেই তখন দিন যেত। এর মধ্যেও আমি প্রায় সবদিনই প্রবল আকর্ষণে খিদিরপুর থেকে দশ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে শ্যামবাজারের টালায় কমরেড শিবদাস ঘোষের কাছে যেতাম তাঁকে দেখতে এবং তাঁর সাহচর্য পেতে। আমি তাঁর সাংস্কৃতিক, এথিক্যাল, নৈতিক আচার-আচরণের দ্বারা উদ্দীপ্ত হই। আমি জানতাম, তাঁদেরও খাওয়া-দাওয়ার সংকট ছিল। আমার তো আরও খারাপ অবস্থা, তাই তাঁদের অসুবিধায় না ফেলার জন্য দুপুরে খাবার সময়ের পরেই যেতাম। আমার রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের ওই সময়ই কমরেড প্রভাস ঘোষ, কমরেড রণজিৎ ধর তাঁরাও খুব দুঃসহ অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেছেন। রণজিৎ ধর কালীঘাটের হালদার পাড়ায় থাকতেন। কখনও কখনও আমি ও প্রভাস ঘোষ কোনও খাবার না খেয়েই পার্কে শুয়ে রাত কাটিয়েছি। দক্ষিণ কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কের বেঞ্চেও আমরা ঘুমিয়েছি। এই দু’জন কমরেড তখন নানাভাবে আমাকে সাহায্য করেছেন। সামান্য খাবার পেলেও আমার জন্য ভাগ রেখেছেন। আমিও দু’চার আনা পয়সা জোগাড় করতে পারলে প্রভাসের খোঁজ করতাম, ভাগাভাগি করে খাওয়ার জন্য। এই রকমেরই অবস্থা যাচ্ছিল তখন।
আমার মধ্যে কিছু ডেডিকেশন, মিলিট্যান্সি এবং সাহস দেখে কমরেড ঘোষ আমাকে কিছু কাজ নির্দিষ্ট করে দেন। আমি সর্বদা তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারিনি। কারণ চরিত্র তৈরি করা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সেই সময়ে সঠিক বিপ্লবী চরিত্র গড়ে তোলার সংগ্রামই ছিল তাঁর মহত্ত¡পূর্ণ শিক্ষা, যার বহু কিছু আমি অর্জন করতে পারিনি। সেই জন্য আমার চলার পথে অনেক ব্যর্থতা আছে। তিনি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন কখনও কখনও, কিন্তু ধৈর্য হারাননি। তিনি আমাকে খুবই উৎসাহ দিয়েছেন। তখন স্বর্ণশিল্পীদের একটা বড় আন্দোলন হয়। সারা ভারত জুড়ে এক বড় সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি আমাকে স্বর্ণশিল্পীদের সংগঠিত করতে বললেন। আমি প্রয়াত কমরেড মাধব রায়চৌধুরীকে নিয়ে বহু জায়গায় স্বর্ণশিল্পীদের সংগঠিত করতে থাকলাম। তিনিও আমার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। অনেক মানুষকে আমরা সংগঠিত করেছিলাম। স্বর্ণশিল্পীদের পক্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট একটি আকর্ষণীয় সংক্ষিপ্ত এবং সুনির্দিষ্ট দাবিপত্র তুলে ধরা হয়। কমরেড শিবদাস ঘোষই এই দাবি সনদ তৈরি করে দিয়েছিলেন। একটি সংবাদপত্র পুরো দাবিপত্র ছাপিয়ে ছিল, পার্টির নাম সেখানে ছিল না। স্বর্ণশিল্পীদের আকর্ষণীয়, সঠিক ও সুনির্দিষ্ট দাবি সনদ হিসাবে সংবাদপত্র তা প্রকাশ করে। এই আন্দোলনের পর আমাকে, কমরেড প্রভাস ঘোষকে এবং আরও কিছু কমরেডকে বীরভূম জেলায় তিনি পাঠান। সেখানে কমরেড প্রতিভা মুখার্জী চাষী আন্দোলন পরিচালনা করে খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। বিশেষত তথাকথিত নিম্নবর্ণ হিন্দুদের যাঁদের ‘ছোটলোক’ বলে ওখানকার জমির মালিকরা বলত, তাঁদের মধ্যে ও আদিবাসীদের মধ্যে আন্দোলন গড়ে তুলে তিনি ‘দিদিমণি’ নামে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। আমরা তাঁদের সংগঠিত করতে চেষ্টা করি। ১৯৬২ সালের নির্বাচনে কমরেড প্রতিভা মুখার্জীকে কেন্দ্র করে আমরা কাজ শুরু করি। সেখানে কাজ করার অবস্থা তখন খুবই সংকটপূর্ণ ছিল। জোতদাররা প্রচন্ড বাধা দিত, আমাদের মারধর করত, থাকা-খাওয়ার জায়গাও প্রায় মিলত না ওদের ভয়ে। কমরেড শিবদাস ঘোষ মাঝে মাঝে আমাদের সেখানে কাজ করতে পাঠাতেন। সেখানে এসব বাধাবিপত্তি সত্তে¡ও জনসাধারণের মধ্যে কাজ করে আমি অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি।
১৯৬৪ সালে কলকাতায় একটি বড় সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। তখন কমরেড শিবদাস ঘোষ সাম্প্রদায়িক সমস্যার উপর একটি প্রবন্ধ লেখেন ‘কমিউনাল ডিস্টারবেন্স ইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান’। সা¤প্রদায়িক সমস্যার মূল কারণ কী ও সমাধান কোন পথে, এই প্রসঙ্গে আলোচনা ছিল। এই পুস্তিকা নিয়ে আমি মুসলিম সমাজের বহু বুদ্ধিজীবী এবং নামকরা ব্যক্তিদের সাথে দেখা করি। আমি যখন দিল্লি যাই, এই বই বিশিষ্ট বামপন্থী ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিবকেও দিয়েছিলাম। এঁরা সকলেই বলেন, এভাবে কেউই ইতিপূর্বে এই সমস্যার বিশ্লেষণ করেননি। কলকাতায় আমি কিছু যুবককেও সংগঠিত করি। একদিন কমরেড শিবদাস ঘোষ আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, এই যুবকদের নিয়ে তোমার কী পরিকল্পনা? আমি বলি, আপনি কিছু পরামর্শ দিন। তিনি বলেন, তুমি একটা যুব সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা কর। তখন আমি ডি ওয়াই ও সংগঠিত করার কাজ শুরু করি। এরপর আমি একটা কনফারেন্সে দিল্লিতে যাই। কমরেড শিবদাস ঘোষ তখন সেখানে ছিলেন। তাঁকে বিশেষ কারণে দিল্লিতে পাঠানো হয়। ডি ওয়াই ও-র এক সদস্য আমাকে চিঠি দিয়ে জানান যে, তাঁর এক আত্মীয় দিল্লিতে যাচ্ছেন, গণদাবী পড়তে তাঁর আগ্রহ আছে, আমি দিল্লিতে তাঁর সাথে যেন যোগাযোগ করি। সে-সময় এস ইউ সি আই (সি)’র একজন এমপি ছিলেন কমরেড চিত্ত রায়। তাঁর কোয়ার্টারে আমরা থাকতাম। দিল্লিতে যোগাযোগের ব্যক্তিরা ওই বাড়িতে এসে কমরেড শিবদাস ঘোষের সাথে মিলিত হতেন। এইভাবেই দিল্লিতে রাজ্য পার্টির কাজ শুরু হয়। একদিন কমরেড ঘোষ আমাকে বলেন, তুমি আর ডি ওয়াই ও-তে নয়, এবার তোমাকে দিল্লিতে কাজের জন্য থাকতে হবে। আমি দিল্লিতে থাকতে শুরু করলাম। আমি মাঝে মাঝে পশ্চিম-উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর, মোরাদাবাদ, গাজিয়াবাদ প্রভৃতি জায়গায় যেতাম এবং সে-সব স্থানে বেশ কিছু মানুষের সাথে যোগাযোগ হয়।
একদিন মাথুর নামে যমুনা এলাকার এক ব্যক্তির সাথে আমার দেখা হয়। সে গাড়ি নিয়ে এসেছিল একটি বৈঠকে কমরেড চিত্ত রায়কে নেওয়ার জন্য। সেখানে অন্য বক্তা হিসাবে সি পি আই নেতা ভূপেশ গুপ্ত ও সি পি এম নেতা রামমূর্তিও ছিলেন। সেই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সরকার চলছিল। কমরেড সুবোধ ব্যানার্জী শ্রমমন্ত্রী ছিলেন। রাজ্য জুড়ে ঘেরাও আন্দোলন চলেছিল। উত্তর ভারতেও এই ঘেরাও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। এমনকী ঘেরাও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল পূর্ব পাকিস্তানেও, যেটা এখন বাংলাদেশ। সেই দেশের প্রখ্যাত নেতা মৌলানা ভাসানীও ঘেরাও আন্দোলন শুরু করেন। তা এক অন্য ইতিহাস, আমি তার মধ্যে যেতে চাইছি না। দিল্লির ওই সভায় ঘেরাও আন্দোলন আলোচ্য বিষয় ছিল। চিত্ত রায় তখন অসুস্থ ছিলেন। ভূপেশ গুপ্ত ও রামমূর্তি তাঁদের অন্য কাজ থাকার জন্য যাননি। আমি সেখানে গেলাম। সেখানে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অ্যাডভোকেটসহ প্রায় ৫০ জন হাজির। তাঁরা ওই এমপিদের আশায় অপেক্ষা করছিলেন। আমাকে দেখে তাঁরা বললেন, আপনি তো পশ্চিমবঙ্গের, ওখানে কী ঘটছে আপনার কাছ থেকে আমরা জানতে চাই। আপনারা জানেন, আমি ইংরেজিতে দক্ষ নই, তাই ভাঙা হিন্দি এবং ইংরেজিতে পশ্চিমবঙ্গের আন্দোলন কীভাবে গড়ে উঠল এবং কমরেড শিবদাস ঘোষ আইন ও নৈতিকতার প্রশ্নে কীভাবে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন, তা আমি বলি। এই সময়ে আপত্তি উঠেছিল যে, এই আন্দোলন আইনসঙ্গত নয়। কমরেড শিবদাস ঘোষ তার উত্তরে বলেছিলেন, যা আইনসঙ্গত, তা সবসময়ই ন্যায়সঙ্গত হবে তা নয়। আবার আইনের চোখে বে-আইনি হলেও সেটা ন্যায়সঙ্গত হতে পারে। আমি এই বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা করি, তাঁরা ভীষণভাবে প্রভাবিত হন। তাঁরা আমাকে বলেন, কমরেড আমরা আপনাকে এনেছি এবং অবশ্যই দিল্লিতে ফেরার ব্যবস্থা করব। কিন্তু আমাদের অনুরোধ এক রাত আমাদের সঙ্গে থাকুন। আমি এক রাত নয়, ওঁদের অনুরোধে সাত দিন সাত রাত ওখানে কাটালাম। যে পোশাকে গিয়েছিলাম, সেটাই শুধু আমার ছিল। তাঁরা আমাকে জামা-কাপড় ইত্যাদি পরতে দিলেন, আমার সাথে তাঁদের কথা হল। ১৫ দিন পর আবার সেখানে গেলাম। আবারও তাঁদের সাথে অনেক কথা হল, তাঁরা দারুণভাবে প্রভাবিত হলেন। আমি ঠিক করলাম এই যোগাযোগের কথা কমরেড শিবদাস ঘোষকে জানাতে হবে। আমি যখন টেলিফোনে তাঁকে জানালাম, তিনি বললেন তুমি যাও, যোগাযোগ রক্ষা কর, কেন্দ্রীয় কমিটির কোনও সদস্য যাবেন তাঁদের সাথে কথা বলতে। কমরেড প্রীতীশ চন্দকে সেখানে পাঠানো হয়েছিল। আমরা তিন দিন ধরে নানা বিষয়ে আলোচনা করলাম। আলোচনায় মূল বিষয় উঠল ভারতবর্ষের বিপ্লবের স্তর কী হবে — জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব, না সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। যাঁরা সেখানে জড়ো হতেন, তাঁদের মধ্যে কিছু জন নকশাল আন্দোলনেও ঘোরাঘুরি করতেন। তাঁদের সিপিএম ছেড়ে নকশাল আন্দোলনে যোগদান করার ইচ্ছে ছিল। আমি তাঁদের সাথেও কথা বলি। দীর্ঘ কথাবার্তার পর সেই এগারো জন এগিয়ে আসেন এবং তাঁদের এসইউসিআই(সি) দলের অ্যাপ্লিক্যান্ট মেম্বারও করা হয়। একটি সাংগঠনিক কমিটি করা হয়।
দিল্লিতে কিছুদিন কমরেড শিবদাস ঘোষের সঙ্গে থাকার সুবাদে তাঁর অনেক মূল্যবান আলোচনা শুনি। বিশেষ কয়েকটি ঘটনা ভুলবার নয়। তিনি সব সময়ই, আমরা যারা তাঁর সাথে থাকতাম, আমাদের সামনে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। কমরেড চিত্ত রায়ের যে কোয়ার্টারে আমরা থাকতাম, তার পাশের কোয়ার্টারে থাকতেন বিশিষ্ট আইনবিদ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট ও রাজ্যসভার সদস্য শ্রীযুক্ত দ্বিজেন্দ্রলাল সেনগুপ্ত। তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকেই কমরেড শিবদাস ঘোষকে জানতেন, একসাথে জেলেও ছিলেন। তিনি যে পাশের ঘর থেকে কমরেড শিবদাস ঘোষের আলোচনা শুনতেন এবং আকৃষ্ট হতেন — তা আমরা জানতাম না। একদিন দেখলাম, তাঁর ঘরে বন্দর শ্রমিক নেতা মাখন চ্যাটার্জী, কুলকার্নি ও শিল্পপতি পিলু মোদি এসেছেন। দ্বিজেন বাবু এসে কমরেড শিবদাস ঘোষকে ডেকে নিয়ে গেলেন, কারণ তাঁর ঘরে উপস্থিত ব্যক্তিরা মার্কসবাদের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। কমরেড শিবদাস ঘোষ যাওয়ার পর উপস্থিত ব্যক্তিরা তাঁকে বলেন, মার্কসবাদের আর কোনও প্রাসঙ্গিকতা নেই। কমরেড শিবদাস ঘোষ উত্তরে বলেন, মার্কসবাদ সম্পূর্ণ বিজ্ঞানভিত্তিক দর্শন। কোনও বিজ্ঞান কি আজ পর্যন্ত প্রমাণ করতে পেরেছে যে, মার্কসবাদ ভুল বা অপ্রাসঙ্গিক? এরপর তিনি মার্কসবাদ নিয়ে কিছু আলোচনা সেখানে করেন। ওঁরা সব চুপ হয়ে যান। দ্বিজেনবাবু এই আলোচনায় এতই মুগ্ধ হন যে, দিল্লিতে তাঁর অন্যান্য বিশিষ্ট পরিচিতদের সাথে কমরেড শিবদাস ঘোষের আলোচনার উদ্যোগ নিতে থাকেন। এঁদের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের এক বড় অ্যাডভোকেট ছিলেন, যাঁর নাম আজ আমার ঠিক মনে পড়ছে না। তিনি প্রায়ই আসতেন, নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। একদিন কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রের প্রসঙ্গ ওঠে। সেই আলোচনায় কমরেড শিবদাস ঘোষ শরৎচন্দ্রের পথের দাবি প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের চিঠির সমালোচনা করেন। এতে ওই অ্যাডভোকেট ভদ্রলোক অসন্তুষ্ট হন। কারণ তিনি প্রবল রবীন্দ্রভক্ত ছিলেন। কমরেড শিবদাস ঘোষ যখন আলোচনা করছিলেন, তখন ওখানে উপস্থিত দু’জন কমরেড সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়ভাবে ওই আলোচনায় ঢুকে যায়। ফলে কমরেড শিবদাস ঘোষ তাঁর বক্তব্য সম্পূর্ণ বুঝিয়ে উঠতে পারেননি। ফলে ওই ভদ্রলোক রেগে চলে যান। লক্ষ করলাম, কমরেড শিবদাস ঘোষ ওই দুই কমরেডকে কিছু বললেন না, কিন্তু নিজে তিনি খুব অস্থির হয়ে যান ওই ভদ্রলোককে সত্যটা বোঝাতে না পারার জন্য। এর আগেও দেখেছি, কমরেড শিবদাস ঘোষ যখন যাকে যে সত্য বোঝাতে চাইতেন, যতক্ষণ সে বুঝতে না পারত, ততক্ষণ খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত বন্ধ রেখে আলোচনা করে যেতেন।
সে যাই হোক, দিল্লি থেকে কলকাতায় ফিরে যাওয়ার সময় এগিয়ে আসছিল। সেসময় একদিন লক্ষ করলাম, ওই অ্যাডভোকেট ভদ্রলোক আমাদের কোয়ার্টারের সামনে রাস্তায় পায়চারি করছেন। মনে হল, আসতে চাইছেন কিন্তু ইতস্তত করছেন। আমি কমরেড ঘোষকে বিষয়টা জানালাম। তিনি বললেন, ডেকে নিয়ে এসো। তাঁকে ডাকতেই তিনি চলে এলেন এবং ঘরে ঢুকেই কমরেড ঘোষের দু’হাত ধরে বললেন, আমার সেদিনের আচরণের জন্য আমায় ক্ষমা করবেন। আপনার মতো এমন জ্ঞানী মানুষ আমি কখনও দেখিনি। এরপর থেকে ওই ভদ্রলোক আমাদের পার্টির কাগজপত্র পড়তেন, চাঁদাও দিতেন।
আর একটি ঘটনাও আমার মনে দাগ কেটে আছে। আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছে কমরেড শিবদাস ঘোষের কথা শুনে অঙ্কে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট একজন ছাত্র কোয়ার্টারে এসে দেখা করে প্রশ্ন করেন, অঙ্কশাস্ত্রের সাথে ডায়ালেক্টিকসের কী সম্বন্ধ আছে? কমরেড শিবদাস ঘোষ প্রাঞ্জলভাবে তাকে সেটা বুঝিয়ে দেন। এর দ্বারা সেই ছাত্রটি এতই আকৃষ্ট হয় যে, দলের সাথে কাজে যুক্ত হয়ে যায় এবং কিছুদিন আমার কাজের সাথে ছিল।
এরপর হরিয়ানাতেও যাই, পার্টির কাজ শুরু হয়। কমরেড সত্যবান এই সময়ে পার্টিতে আসেন। বর্তমানে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। এখন গোটা হরিয়ানা জুড়ে এসইউসিআই (সি) পার্টির সংগঠন আছে। আমি চলে আসার পর ওখানে পার্টির আরও বিস্তৃতি হয়।
১৯৭১ এবং ১৯৭২ সালে পশ্চিমবঙ্গে পর পর দু’টি বিধানসভা নির্বাচন হয়। আমি সেই কাজে অংশগ্রহণ করি। ঘটনাচক্রে সেই সময়েই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনের উপর কমরেড শিবদাস ঘোষের খুবই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে। তিনি ভারতীয় জনগণকে সচেতন করেন যে, এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাধীনতা আন্দোলন। এই আন্দোলন সম্পর্কে ভারতের বুর্জোয়া শ্রেণী ও জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি এক হতে পারে না। রাজনৈতিক মহলে এই আন্দোলন নিয়ে নানা রকম মতামত ঘোরাফেরা করতে থাকে। কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছিলেন, ভারতের কংগ্রেস সরকার ভারতের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে আধিপত্য বিস্তার করতে পাকিস্তানের বিভাজন চাইছিল। এই সংগ্রামে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। এই সময়ে কমরেড শিবদাস ঘোষ আমাকে বলেন, তুমি অনেকদিন বাংলাদেশে তোমাদের বাড়িতে যাওনি। তুমি তো কিছু বইপত্র নিয়ে ওই দেশের নানা শক্তির সাথে দেখাসাক্ষাৎ করতে পার। তাঁর কথায় তিনদিন পরে বাংলাদেশের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ি। আমি তখন বাংলাদেশের প্রায় কিছুই জানি না। অতি শৈশবে আমি সেখান থেকে চলে আসি, তারপর আর কখনও বাংলাদেশে যাইনি।
বাংলাদেশ একটু ভিন্ন ধরনের দেশ। ভারতে মানুষের সাহায্য পাওয়া অনেক কঠিন। সে তুলনায় বাংলাদেশের মাটি খুব নরম। বেশ কিছু খুবই দয়ালু মানুষের সঙ্গে আমার সেখানে দেখা হয়েছে। না না, আমি ভারতের মানুষের দোষ দিচ্ছি না। বাংলাদেশের মানুষের কাছে আমি ভারতের মানুষের মহত্ত্বের কথা বলি। তবুও বলব, বাংলাদেশ খুবই নরম মাটির জায়গা ছিল। তাঁরা আমাকে প্রভূত সাহায্য দিয়েছেন। আমি যখন সেখানে ছিলাম, তখন সেখানে ছাত্রলীগ নামে ছাত্রদের একটি সংগঠন ছিল। বাস্তবে তা ছিল মুসলিম লীগেরই ধারা। আগে এদের মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ বলা হত। তারপর নাম বদলে ছাত্রলীগ বলা হয়। মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে আওয়ামী মুসলিম লীগ ছিল, তারপর তিনি শুধু আওয়ামী লীগ নাম দেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর এবং সোহরাওয়ার্দী আদ্যোপান্ত সাম্প্রদায়িক ছিলেন। ১৯৪৬-এর রায়টের সাথে তাঁরা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। সোহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবের নেতা এবং শিক্ষক ছিলেন। আপনারা মুজিব সম্বন্ধে জানেন। আন্দোলনের উত্তাল সময়ে তিনি সেক্যুলারিজম, ন্যাশনালিজম, সোস্যালিজম এবং গণতন্ত্র — এইসব বলতে বাধ্য হন। স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দু এবং মুসলিম জনগণের ঐক্য তাঁকে সেক্যুলারিজমের শ্লোগান তুলতে বাধ্য করে। এই ধরনের শ্লোগান তখন অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু তিনি আদতে সেক্যুলার ছিলেন না। কমরেড শিবদাস ঘোষ তাঁর ২৪ এপ্রিল ১৯৭১ সালের বক্তব্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একে পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদের গর্ভে জন্ম বাংলাদেশ ন্যাশনালিজম বলে অভিহিত করেন। যদিও তারা পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন। বাংলাদেশে যাবার পর আমি ছাত্রলীগের একাংশের নেতাদের সাথে দেখা করি। তারা তখন বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের সাধারণ প্রভাবে শ্রেণীসংগ্রাম, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র এবং সমাজ বিপ্লবের শ্লোগান তুলছিল। কিন্তু তারা আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন হিসাবে তাদের সাথেই ছিল। আসলে তারা তখন ছিল পেটিবুর্জোয়া বিপ্লবী শক্তি, সাম্রাজ্যবাদ এবং সমস্ত রকম প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামী। তখন এটাই ছিল অগ্রগণ্য গণতান্ত্রিক শক্তি। আমি বাংলাদেশে মুজিব মেকার হিসাবে খ্যাত সিরাজুল আলম খানের সাথে দেখা করি। তিনিই আড়ালে থেকে মুজিবকে বঙ্গবন্ধু খেতাব দেন। সেই বঙ্গবন্ধুর কন্যা অবশ্য এখন বাংলাদেশকে নৃশংসভাবে শাসন করছেন, সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকারকে হত্যা করছেন। আমি তখন সিরাজুল আলম খানকে বলি, আপনি সমাজতন্ত্রের কথা বলছেন, কিন্তু একটি প্রকৃত বিপ্লবী দল ছাড়া কেমন করে সমাজতন্ত্র আসবে? আমি তাঁদের এই মতবাদ বোঝানোর চেষ্টা করি এবং তাঁরা একমত হন যে, অবশ্যই একটি বিপ্লবী পার্টি থাকা প্রয়োজন। তখন তিনি কমিউনিস্ট কোঅর্ডিনেশন কমিটি নামে একটি বিপ্লবী কোর গড়ে তোলার চেষ্টা শুরু করেন। এই মানুষ কমরেড শিবদাস ঘোষের বক্তব্যে আকৃষ্ট হয়ে তিনবার কলকাতায় এসে কমরেড শিবদাস ঘোষের সাথে মিলিত হন। কমরেড শিবদাস ঘোষ আমাকে বলেন যে, সিরাজুল আলম খান একজন স্বপ্নদ্রষ্টা এবং ভালো সংগঠকও। কিন্তু তাঁর তত্ত¡গত জ্ঞান এত দুর্বল যে, তিনি আন্দোলন পরিচালনা করলে অনেক ভুলভ্রান্তি ঘটবে। এটা বাস্তবে ঘটেছেও। তিনি সত্যিই অনেক ভুল করেন। … একটি সমস্যা আমি সর্বদা বাংলাদেশে লক্ষ করি। কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তা তাঁদের চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। যাঁরা অনেকেই পরিচিত নেতা, ছাত্র এবং আওয়ামী লীগেরও নেতা, তাঁরা আমার আহ্বানে সাড়া দেন। কিন্তু যখনই মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা অনুযায়ী জীবনের সর্বদিক ব্যাপ্ত করে সংগ্রামের প্রশ্ন আসে, তখন তাঁরা নানা অজুহাত তুলে বা যুক্তি খাড়া করে পিছিয়ে যান। তাঁরা তত্ত¡ বা যুক্তি স্বচ্ছন্দে গ্রহণ করেন, কিন্তু তা জীবনে প্রয়োগ করতে গিয়ে পিছিয়ে আসেন।
আমাদের সাথে প্রথম যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা বেশ কিছু ছিলেন উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির। আমি তাঁদের বললাম, আমাদের একটা সর্বহারা শ্রেণির পার্টি গঠন করতে হলে শোষিত মানুষের সংস্পর্শে থাকতে হবে। সেই সময়ে আমার আস্তানা ছিল এক বিরাট বস্তিতে। হাজার লোক সেখানে থাকতেন, শুধু একটা শৌচাগার ছিল। শোষিত নিপীড়িত মানুষেরাই অগ্রগণ্য বিপ্লবী শক্তি হয়। তাদের সংগঠিত করার জন্য আমাদের তাঁদের নিকটে থাকতে হবে। তখন অন্যরা আমার কথা মানতে পারেননি। একজন বললেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি, সারা দেশে সকলেই আমাকে জানে। আমি কেন বস্তিবাসীদের মধ্যে জীবন কাটাতে যাব। বুঝিয়ে বললাম, যদিও আপনি একজন প্রখ্যাত ছাত্রনেতা, কিন্তু আপনি বিপ্লবী ও আপনি একটা বিপ্লবী পার্টির জন্য কাজ করছেন। সুতরাং আপনার সেখানে যাওয়া উচিত। এভাবে অনেক মানুষ সেই সময়ে কমরেড শিবদাস ঘোষের যুক্তি এবং মিলিট্যান্ট বক্তব্যের আকর্ষণে এগিয়ে এসেছিল, কারণ তাঁর চিন্তার এক আলাদা রকমের আকর্ষণ আছে। কিন্তু জীবনে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রেই যত সমস্যা দেখা দেয়। এই সমস্যা সব পার্টিরই আছে, আপনাদের পার্টির মধ্যেও আছে। এই চরিত্র গঠন করার মানে, একজন বিপ্লবী যে মুমূর্ষু সমাজে বাস করছে, তার বিরুদ্ধে তাকে রিভোল্ট করতে হবে। প্রতিটি সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে সর্বদা সে একজন বিপ্লবী। সব ধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিপ্লবী আদর্শই তার কাছে মুখ্য। এই আদর্শ সর্বদা বাংলাদেশে প্রচার করি।
আমি আপনাদের বলি, এক সময়ে বাংলাদেশে আমি গভীর সংকটে পড়েছিলাম। সেই সময়ে আমার জীবন সংশয়ের মধ্যে পড়েছিল। কর্নেল তাহেরের মামলায় আমার নামও যুক্ত হয়ে যায়। তাহেরকে জিয়াউর রহমান ফাঁসি দেন। জিয়াউর রহমান ছিলেন মিলিটারির সর্বাধিনায়ক, আবার বিএনপিরও নেতা। অনেককে কারাগারে বন্দি করেন। অনেকে আমাকে সর্তক করে বলেন, হায়দার ভাই আপনি অবশ্যই ভারতে চলে যান, এখানে থাকা বিপজ্জনক। আমি তখন বিপদগ্রস্ত। ইতিমধ্যে কমরেড শিবদাস ঘোষ প্রয়াত হন, আমি জানতাম না। কমরেড নীহার মুখার্জী দু’জন কমরেডকে পাঠান আমাকে জানাবার জন্য। তাঁরা আমার সন্ধান পাননি। আমি নিরাপত্তাজনিত কারণে সারা বাংলাদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি। খুব ঝুঁকি নিয়ে কোনও রকমে আমি উত্তরবঙ্গে ঢুকলাম। কমরেড শিবদাস ঘোষ তার এক মাস আগে আমাদের ছেড়ে গেছেন। আমি এই সংবাদে প্রচন্ড ভেঙে পড়লাম। কমরেড নীহার মুখার্জী আমাকে সাহচর্য ও সান্ত্বনা দিলেন। আমি ১৯৭৬-এর সেপ্টেম্বরে এসেছিলাম। ১৯৭৭-এ বাংলাদেশে আমার যোগাযোগের লোকজন আমাকে বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য বলতে লাগলেন। আমি কমরেড নীহার মুখার্জীকে বললাম, আমার এখন বাংলাদেশে ফিরে যাওয়া উচিত। তিনি বললেন, সিদ্ধান্ত আপনি করুন। আমি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তখন থেকে আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি।
ওদেশে যাঁরা বিপ্লবী তত্ত্ব জীবনে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে গেলেন, আমি তাঁদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করি। যখন আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক শিবির ভেঙে পড়েছে, কেন সংশোধনবাদ জন্ম নিল, কীভাবে তা প্রতিবিপ্লবের জমি তৈরি করে দিল, কীভাবে সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে, সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় সত্ত্বেও কেন সমাজতন্ত্রই একমাত্র মুক্তির পথ — এগুলি আমি তুলে ধরি। কমরেড শিবদাস ঘোষের এইসব শিক্ষা, মার্কসবাদ সম্পর্কে তাঁর বিশ্লেষণ, কমিউনিস্ট নীতি-নৈতিকতা সম্পর্কে তাঁর আলোচনা, বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের এই সংকটময় পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের বহু ছাত্র-যুবককে আকর্ষণ করে। বহুসংখ্যায় যুবক-যুবতী আমাদের সাথে যুক্ত হয়। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে তিন ভাগ হয়ে যায়। অনেকেই বলতে থাকে কমিউনিজমের আর কোনও ভবিষ্যৎ নেই। সারা দুনিয়ার কমিউনিস্টরা যখন মুহ্যমান, তখন বাংলাদেশে আমাদের পার্টিকেই খুব শক্তিশালী মনে হচ্ছিল, খুবই সংগঠিত এবং প্রকৃত কমিউনিস্ট শক্তি হিসাবে প্রতিভাত হচ্ছিল। অনেক পুরনো কমিউনিস্ট পার্টির নেতা, যাঁরা সৎ, তাঁরা চিন্তা করেন কেমন করে আমরা ছেলেমেয়েদের জোটাচ্ছি। তাঁরা মনে করেন যখন নতুনদের আকর্ষণ করার মতো তাঁদের কোনও যুক্তি-নীতি কাজ করছে না, তখন আমরা কেমন করে সফল হচ্ছি। একজন প্রবীণ নেতা মঞ্জুরুল আহসান খান একদিন আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করেন, হায়দার ভাই, আপনি কেমন করে এবং কী শিক্ষা দেন যে, এই সমস্ত ছাত্র-যুবকরা আপনাদের সাথে আসছে? আমি তাঁকে বলি, এটা কমরেড শিবদাস ঘোষের আদর্শ ছাড়া অন্য কিছু নয়। কেমন করে তিনি সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, কেমন করে তিনি সোভিয়েত ইডনিয়নের পতনের ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, আজকের দিনে কীভাবে একটি কমিউনিস্ট দল গড়ে তুলতে হবে, উন্নত কমিউনিস্ট চরিত্র কী হবে — এসব কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা তাঁকে বলি। এভাবে আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলনের সামনে তিনি যে এক নতুন দিশা তুলে ধরেছেন, এ সবই যে আমাদের শক্তির উৎস, তাঁকে জানাই। তিনি দুঃখ করে বলেন, আমরাও কখনও কখনও কিছু যুবশক্তিকে জড়ো করি, কিন্তু কিছুদিন পরে তারা আর আমাদের সাথে থাকে না।
কিন্তু এই পার্টিতেও সেই পুরনো সমস্যাই থেকে গেল। এখানেও জীবনের সর্বদিক পরিব্যাপ্ত করে সংগ্রামের প্র্যাক্টিস অনেকেই করতে পারেননি। প্রথমদিকে তাঁরা কিছু দিন সংগ্রাম শুরু করেন, তারপরে তাঁরা প্র্যাক্টিসের রাস্তা পরিত্যাগ করেন। শেষ পর্যন্ত একদল কমরেড শিবদাস ঘোষকে অথরিটি হিসাবে মানতে অস্বীকার করেন। পার্টি আবার ভাগ হয়। আমরা বাসদ (মার্কসবাদী) পার্টি গড়ে তুলি। আমাদের নতুন পার্টি বাসদ (মার্কসবাদী) গঠনেও এই সমস্যা আছে। তবে আমরা সংগ্রাম চালাচ্ছি। আশা করছি, একদল দাঁড়িয়ে যাবে।
আমি অন্তত ১২ বার ইডরোপে গেছি এবং সেখানে অনেক দলের অনেক নেতার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করেছি। আমি দেখেছি তাঁরা সকলেই হতাশ। তাঁদের কেউ কেউ ম্যান অফ ইন্টিগ্রিটি, তাঁরা কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাঁরা কোনও রাস্তা খুঁজে পাচ্ছেন না। আমি তাঁদের কাছে কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার অনেক কিছু ব্যাখ্যা করেছি। একজন ‘হোয়াই এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) ইজ দি অনলি কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া’ অনুবাদ করতে শুরু করেন। এটা একটা নতুন জিনিস। যৌথতা ও যৌথজীবন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাঁদের অকৃতকার্যতার কারণ এখানেই। ইউরোপ নিয়ে গর্ববোধ এবং প্রাচ্যের দেশগুলির প্রতি তাঁদের অবজ্ঞা, তাদের মধ্যে একটা বাধা হিসাবে কাজ করে আমাদের উন্নত চিন্তা, উন্নত সংস্কৃতিকে গ্রহণের ক্ষেত্রে। তাঁরা খুব ব্যক্তিকেন্দ্রিক। আমি একবার বার্লিন থেকে রোম যাচ্ছিলাম, তা অনেকটা পথ। ইউরোপের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। ট্রেনে একটি লোক উঠে আমাকে দেখল। তারপর সে একটা পেপার বা বই বের করে বসে পড়ল। তাতেই সে নিমগ্ন, সে কথা বলবে না। ট্রেনে কোনও কথাই নেই। লম্বা ভ্রমণ, কিন্তু ট্রেনে যাত্রীদের মধ্যে কোনও কথা নেই। আমি এ ব্যাপারে জার্মানির এক কমরেড মিচেল ওপারস্কালস্কিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। প্রশ্ন শুনে হেসে বললেন, তুমি জান না কেন এরকম কারণ, এরা চূড়ান্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিক, এরা জানেই না পরস্পরের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়। এটা ভাষার সমস্যা নয়, এটা তাদের সংস্কৃতির প্রশ্ন। যদি কাউকে জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি কেমন আছেন? সে রেগে গিয়ে উত্তর দেয় আমি খুব ভাল আছি, তুমি কেন জিজ্ঞেস করছ? যদি জিজ্ঞেস করেন, তোমার বাবার নাম কী? সে বলবে, তুমি আমার বাবার কথা জিজ্ঞেস করছ কেন? তুমি তো আমার সাথে কথা বলছ, তুমি আমার বাবার সম্বন্ধে প্রশ্ন করতে পার না। এ ধরনের ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা সেখানে, প্রতিটি মানুষই পৃথক। নেদারল্যান্ডের কমরেড ভেন্ডারক্লিফ্ট একজন সহৃদয় মানুষ। তিনি ১৮ নং মোস্টারহার্টে বাস করেন। তাঁর একটি মাত্র কন্যা। সে তাঁর কাছাকাছি অন্য একটা বাড়িতে থাকে। এতেই তাঁর পার্টির কমরেডরা তাঁকে প্রশ্ন করে, তোমার মেয়ে তোমার নিকটে আছে কেন? এর মানে হল, প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে তাঁর বাবা-মার কাছে থাকতে পারে না। তাদের আলাদা পরিবারে থাকা আবশ্যক। এই রকমের ব্যক্তিকেন্দ্রিক ধারা চলছে ইডরোপে। মানুষ চূড়ান্ত ব্যক্তিবাদী। কেউ ধরুন রাস্তায় কাঁদছে, আমি তাকে সান্তনা দিতে গেলাম, আমার সাথে থাকা কমরেডরা আমাকে নিষেধ করলেন, না, না, সে রেগে যাবে। সে আপনাকে বলবে আমাকে একা থাকতে দিন। এটা আমার বিষয়। আপনি আমাকে সান্ত্বনা দেবেন না। এ এক সমস্যা। কমরেড আমার সামান্য ইংরেজি বিদ্যায় আমি চেষ্টা করছি আপনাদের কাছে আমার কথা বলতে।
বাংলাদেশে আমাদের পার্টি আবার ২০১৩ সালে বিভক্ত হয়। আমাদের নতুন পার্টি বাসদ (মার্কসবাদী) অনেক অসুবিধার মধ্যে গড়ে উঠেছে। আসলে পুরনো পার্টির পুরনো অভ্যাস আমাদের সামনে বাধা। পুরনো অনেক কিছুই তারা এখনও বহন করছে। তবে একটা জিনিস তারা বুঝতে পারছে, আগের পার্টির অপর অংশ কোনও সঠিক পার্টিই নয়। তত্ত্বগতভাবে তারা তা বুঝছে। কিন্তু অভ্যাস, কালচার, স্নেহ-ভালোবাসা যা যেকোনও মানুষের সামগ্রিক জীবনের অংশ, তার মধ্যে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার বীজ আছে।
আমরা আপনাদের পার্টি থেকে অনেক সাহায্য পাচ্ছি। আপনারা একটা মহান পার্টি। এই পার্টি আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে সব থেকে অগ্রণী, কারণ এই পার্টি কমরেড শিবদাস ঘোষের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। এই পার্টির অফুরন্ত শক্তি আছে। আছে অসীম সম্ভাবনা। সারা ভারত জুড়ে পার্টি বিকশিত হচ্ছে। জনসাধারণের দৈনন্দিন প্রতিটি লড়াইয়ে তারা অংশগ্রহণ করছে, নেতৃত্ব দিচ্ছে। তারা বড় বড় চাষী আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত করছে। এটা একটা অদ্বিতীয় পার্টি। কমরেড শিবদাস ঘোষের আদর্শে দীক্ষিত বলেই এই পার্টি আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পারবে। এটাই গুরুত্বপূর্ণ কথা। বর্তমান নেতৃত্ব সেই শক্তিতে বলীয়ান। ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টি হিসাবে আপনাদের দল ও আমাদের দল মহান মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা ও আন্তর্জাতিকতার ভিত্তিতে পারস্পরিক পরামর্শ ও সহযোগিতা গ্রহণ করে। কিন্তু কেউ অপরের উপর মত চাপিয়ে দিই না। আমাদের সম্পর্ক দ্বান্দ্বিক। আমাদের কমরেডদের কমরেড শিবদাস ঘোষের আদর্শ ও চিন্তায় গড়ে ওঠা উচিত। তাঁদের জীবন, অভ্যাস, সংস্কৃতি এবং সমস্ত রকমের মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা অর্জন করা দরকার।
কমরেড প্রভাস ঘোষ এক্ষেত্রেও সাহায্য করেন। তাঁর সম্বন্ধে আমি কিছু বলতে চাই। আমি অনেকদিন থেকে লক্ষ্য করছি এখানকার পার্টির এখন এক চমৎকার অবস্থা। কমরেড নীহার মুখার্জীর মৃত্যুর পর বহু কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছে। এতদিন পরে কমরেড প্রভাস ঘোষ সমগ্র পার্টির প্রকৃত নেতায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে তিনি নেতায় পরিণত হয়েছেন, তা নয়। জীবনের সর্বদিককে ব্যাপ্ত করে সংগ্রামের যে ধারণা কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন, তাকেও নানা দিক থেকে তিনি বিকশিত করেছেন, নতুন নতুন সমস্যার সামনে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা প্রয়োগ করে তিনি দলকে সমৃদ্ধ করছেন। এসব কিছুর মধ্য দিয়ে আমি মনে করি, তিনি যৌথ নেতৃত্বের আজ বিশেষীকৃত রূপ, যার মধ্য দিয়ে সমগ্র পার্টি আজ সংঘবদ্ধ। কমরেড প্রভাস ঘোষ একা যৌথ নেতৃত্ব হিসাবে বিকশিত হননি। তাঁর বিকাশও হয়েছে অন্যান্য কমরেডদের সাথে দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্ক পরিচালনার মধ্যে দিয়ে এবং এই পথেই কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা তাঁর মধ্যে বিশেষীকৃত হয়েছে। আমি জানি আমার থেকে বেশি আপনারা এটা গ্রহণ করেছেন। ইতিমধ্যে তাঁর কিছু বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। আমরা এখান থেকেও কিছু শিক্ষা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছি।
কমরেড নীহার মুখার্জীর পরবর্তীতে এখন তিনি দক্ষ এবং প্রাজ্ঞ নেতা, এই আমার ধারণা। এজন্য তাঁর প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা আছে। ছোটবেলা থেকে আমরা বন্ধু, আবার আমি তাঁকে নেতা হিসাবে মানি। এই পার্টির ভবিষ্যৎ আছে। মহান মার্কসবাদী কমরেড শিবদাস ঘোষ এই পার্টি গড়ে তুলেছেন। আমি আমার বক্তব্য কিন্তু গুছিয়ে একের পর এক রাখতে পারলাম না। এটা আমার লিমিটেশন। আমি ক্লাস এইট পাশ করতে পারিনি। তার পরে আমি পড়াশুনা চালাতে পারিনি। সেই জন্য আমার অনেক সীমাবদ্ধতা আছে।
কমরেড, আমি আপনাদের বলি, আপনাদের হাতে আছে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা, এক শক্তিশালী হাতিয়ার আর আছে একদল শক্তিশালী নেতা। এখানেই আমি শেষ করছি। তৃতীয় পার্টি কংগ্রেসকে আমার অভিনন্দন। আমাদের পার্টি বাসদ (মার্কসবাদী) আমাকে এই বার্তা পৌঁছে দিতে বলেছে যে, আমরা সেখানে একটি বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। আমরা নানা দিকে বিকাশের স্তরে আছি। সংগ্রামের পথে যদিও নানা জটিলতা এবং বিভিন্ন প্রতিকূলতাও থাকে, তবু আমরা এই বিশ্বাস রাখি যে, বাংলাদেশে আমরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারায় একটি শক্তিশালী বিপ্লবী দল গড়ে তুলব। আমার বয়স এখন ৮৫ বছর, আরও পাঁচ-ছয় বছর বাঁচব। (হেসে বলেন ) কমরেড প্রভাস ঘোষ অবশ্য তা বিশ্বাস করে না। সে বলে যে, আমি দুই-তিন বছর পরে মারা যাব। আমি বলেছি, না, পাঁচ বছর বা আরও বেশি বাঁচব, কারণ আমি রোজ কিছু কিছু ব্যায়াম করি। আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। আপনারা আমাকে অনেক সময় দিয়েছেন।
(সংগৃহীত: গণদাবী ৭১ বর্ষ ২০ সংখ্যা থেকে)