Wednesday, December 25, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - নভেম্বর ২০১৪কমরেড কৃষ্ণ কমল লাল সালাম

কমরেড কৃষ্ণ কমল লাল সালাম

934802_10205084996274723_3086556375625635400_nহাজার হাজার সহযোদ্ধা ও শুভানুধ্যায়ীকে চোখের জলে ভাসিয়ে বিদায় নিলেন বাংলাদেশের সামাজতান্ত্রিক দল – বাসদ কেন্দ্রীয় কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য ও বগুড়া জেলা শাখার সমন্বয়ক কমরেড কৃষ্ণ কমল। গত ২১ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৬টায় প্রাতঃভ্রমণকালে বগুড়ার তিনমাথায় (আদর্শ স্কুল এন্ড কলেজের সামনে) পেছন থেকে ধেয়ে আসা ট্রাকের ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই তিনি নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর সংবাদে সমগ্র পার্টিতে শোকের ছায়া নেমে আসে। আশেপাশের জেলা থেকে দলের নেতাকর্মীরা বগুড়ায় ছুটে যান।

কৃষ্ণ কমলের মৃত্যুর সংবাদে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারাদেশের দলীয় কার্যালয়ে রক্তপতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী এক বিবৃতিতে কমরেড কৃষ্ণ কমলের মৃত্যুতে দলের পক্ষ থেকে গভীর শোক জ্ঞাপন করেছেন।গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক অধ্যাপক আবদুস সাত্তার এবং কেন্দ্রীয় পরিচালনা পরিষদের সদস্য কমরেডস সাইফুল হক, শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী, মোশাররফ হোসেন নান্নু, জোনায়েদ সাকী, মোশরেফা মিশু, সিদ্দিকুর রহমান, ইয়াসিন মিয়া ও হামিদুল হক এক বিবৃতিতে কমরেড কৃষ্ণ কমলের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন।

K Komol-3সদা হাস্যময় কমরেড কৃষ্ণ কমল শোষিত-মেহনতী মানুষের মুক্তি সংগ্রামের সার্বক্ষণিক একজন কর্মী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে দলের যেমন এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তেমনি তাঁর মৃত্যু শোষিত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে সামনে দাঁড়িয়ে লড়াই করা অকৃত্রিম এক বন্ধুর বিয়োগ হিসেবে বামপন্থী ও প্রগতিশীল মহলে বিবেচিত হয়েছে। আর সে কারণে কমরেড কৃষ্ণ কমলের শবদেহ বিকাল ৪টায় যখন শহীদ খোকন পার্কের শহীদ মিনারে রাখা হয়, শতশত কমরেড ও গুণগ্রাহীদের ঢল নেমেছিলো তাঁকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। সেখানে অন্যান্যদের মধ্যে এসেছিলেন বাসদ কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য কমরেডস শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী, ওবায়দুল্লাহ মূসা, উজ্জ্বল রায়, মানস নন্দী। শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও সংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শ্যামল ভট্টাচার্য, সর্বজন শ্রদ্ধেয় ভাষাসৈনিক মাহফুজুল হক দুলু। এছাড়াও বাসদ কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটি বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, রাজশাহী, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁ, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, গাজীপুর, সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুরসহ বিভিন্ন জেলার নেতৃবৃন্দ, সমাজতন্ত্রিক ক্ষেতমজুর ও কৃষক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব মনজুর আলম মিঠু, সদস্য আহসানুল হাবিব সাঈদ-সহ বিভিন্ন জেলার নেতৃবৃন্দ, বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি জহিরুল ইসলাম-সহ কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন জেলার নেতৃবৃন্দ, সমাজতন্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাইফুজ্জামান সাকন, সদস্য কল্যাণ দত্ত-সহ বিভিন্ন জেলার নেতৃবৃন্দ, বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় নেতা অধ্যাপক রোকেয়া বেগম ও মাছুমা আল মাহবুবা-সহ বিভিন্ন জেলার নেতৃবৃন্দ।

এছাড়াও বাসদ বগুড়া জেলা শাখার আহবায়ক কমরেড সাইফুল ইসলাম পল্টু-সহ নেতৃবৃন্দ, সিপিবি বগুড়া জেলার সভাপতি কমরেড জিন্নাতুল ইসলাম জিন্নাহ, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, উদীচী-এর জেলা নেতৃবৃন্দ, জাসদের পক্ষ থেকে রেজাউল করিম তানসেন, আমিনুল ইসলাম মিঠু, জাসদ ছাত্রলীগ, যুবজোট, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, জয়পুরহাট মহিলা ডিগ্রী কলেজ, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, গণজাগরণ মঞ্চ, প্রজাবাহীনী প্রেস লেন ব্যবসায়ী সমিতিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার শতশত মানুষ।শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সর্বসাধারণের অংশগ্রহণে এক শবযাত্রা শহীদ খোকন পার্ক থেকে শুরু হয়ে সাতমাথা হয়ে বড়গোলায় শেষ হয়। এরপর কমরেড কৃষ্ণ কমলের শবদেহ তাঁর গ্রামের বাড়ি রংপুরের পীরগাছার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। দীর্ঘ পথপরিক্রমা শেষে শবদেহসহ কমরেডগণ যখন পীরগাছায় পৌঁছান, সেই রাতের বেলা শতশত মানুষ সেখানে অপেক্ষা করছিল তাঁকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য।

কমেরড কৃষ্ণ কমল কিশোর বয়সেই স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে যখন বাসদের বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন, তখন তিনি মাত্র ৮ম শ্রেণির ছাত্র। এতটুকু বয়সে তিনি এটুকু বুঝেছিলেন যে শোষণমুক্তির সংগ্রামই হচ্ছে বড় মানুষ হওয়ার একমাত্র পথ। তারপর এসএসসি পরীক্ষার কিছুদিন আগে তিনি সক্রিয়ভাবে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাথে যুক্ত হন। পীরগাছা ডিগ্রী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে কমল কিছুদিন রংপুরে পার্টির কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। পরে অনার্সে ভর্তির সূত্রে ১৯৯৭ সালে বগুড়ায় আসেন। এখানেই তার সংগ্রামী রাজনৈতিক যাত্রার শুরু। বগুড়ায় সরকারী আযিযুল হক কলেজে হিসাববিজ্ঞান বিভাগে ভর্তির পরপরই তিনি সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। একই বছর ছাত্র ফ্রন্টের বগুড়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৯৮ সালে তিনি আকসু নির্বাচনে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কলেজে রাজনীতি শুরু করার পর থেকেই ছাত্রদের স্থানীয় ও জাতীয় সংকট নিরসনের আন্দোলনের মাধ্যমে সবার হৃদয়ে এক বিশিষ্ট স্থান দখল করেন। তাঁর সংগ্রামের একাগ্রতা ও বলিষ্ঠতা এবং বিনয়ী স্বভাব কলেজের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর মনে যে রেখাপাত ফেলেন, তাতে তিনি সকলের প্রিয় ‘কমল দা’-তে পরিণত হন।

সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় কমরেড কৃষ্ণ কমল ১৯৯৯ সালে ছাত্র ফ্রন্টের পূর্ণ সদস্য, ২০০৩ সালে বগুড়া জেলার সভাপতি এবং একই বছরে কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হন। ২০০৪ সাল পার্টির সিদ্ধান্তক্রমে রাজনীতির পাশাপাশি জয়পুরহাট মহিলা ডিগ্রী কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সেই কলেজেই কর্মরত ছিলেন। ২০০৯ সালে তিনি বাসদের বগুড়া জেলা শাখার সদস্য সচিব নির্বাচিত হন। বগুড়ায় পার্টি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কমরেড কৃষ্ণ কমল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছাত্র ফ্রন্ট, কৃষক ফ্রন্ট, শ্রমিক ফ্রন্ট-সহ সকল ফ্রন্ট সমূহকে নিবিড়ভাবে পরিচর্যা করে একদিকে যেমন বিভিন্ন আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেন, অন্যদিকে মার্কসবাদী চিন্তার চর্চা ও জীবনের সর্বক্ষেত্রকে ব্যাপ্ত করে তার প্রয়োগের মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্মী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য ও সবার অনুসরণীয়।পার্টির অভ্যন্তরে শোধনবাদ-সংস্কারবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামেও কমরেড কৃষ্ণ কমল ছিলেন একজন বলিষ্ঠ সৈনিক। তিনি পার্টির প্রাণসত্ত্বা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতে নিরলস ও কষ্টকর সংগ্রাম পরিচালনা করেন। তিনি ২০১৩ সালের মে মাসে কেন্দ্রীয় কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর কমরেড কৃষ্ণ কমল বাসদ কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটি বগুড়া জেলা শাখার সমন্বয়কের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
সদালাপী ও মিষ্টভাষী কমরেড কৃষ্ণ কমল কেবল দলের কর্মী-সংগঠকদেরই নয়, বগুড়ার সকল প্রগতিশীল রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ব্যাক্তি সংগঠনের স্নেহের, শ্রদ্ধা ও ভালবাসার পাত্র ছিলেন। তিনি তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির বগুড়া জেলা শাখার সদস্য সচিবের দায়িত্বও পালন করেছেন।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments