কিউবা বিপ্লবের অবিসংবাদিত নেতা কমরেড ফিদেল ক্যাস্ত্রো আর নেই। কিউবা থেকে অনেক দূরে পৃথিবীর আরেক প্রান্তের দেশ, বাংলাদেশের শোষিত মানুষেরা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এই বীর কমিউনিস্ট নেতাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে। কমরেড ফিদেল আমাদের শিখিয়েছিলেন- ছোট হলেও কীভাবে লড়াই করা যায়; শিখিয়েছিলেন— একা হলেও কীভাবে লড়াই করা যায়।
স্প্যানিশ বংশোদ্ভুত এক অভিবাসী পরিবারে জন্মেছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো। লড়াকু জীবনের অধিকারী ফিদেল মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাবার আখের খামারের শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সংগঠিত করেন। আইনজীবী হিসেবে হাভানায় তাঁর পেশাগত জীবন শুরু করার অল্পদিনের মধ্যেই দরিদ্র মক্কেলদের পক্ষে লড়ে সুনাম অর্জন করেন। তাঁর চোখেমুখে সকল সময় ছিলো স্বৈরাচারী শাসকদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার স্বপ্ন। তিনি মনে করতেন, “শোষিত ও নিপীড়িত কোনো দেশে এমনকি মৃতরাও কবরে শান্তি পায় না।”
বিপ্লবপূর্ব কিউবা ছিলো সমস্ত পলাতক ও দাগী অপরাধীদের আড্ডাখানা। কিউবা ছিলো আমেরিকার নোংরামি করার জায়গা, জুয়া-মাদক-ক্যাসিনো ব্যবসার স্থান। ফিদেল ক্ষমতাসীন হওয়ার পরপরই হাভানার সকল ক্যাসিনোতে তালা ঝোলানো হয়। জাতীয়করণ করা হয় প্রায় আড়াই হাজার কোটি ডলারের স্থাবর সম্পত্তি, সমস্ত বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কারখানা। কিউবা বিপ্লবের প্রতিশ্রুতি ছিলো এই যে, এই বিপ্লব কিউবার মানুষকে সম্মান ও মর্যাদা এনে দেবে। সেই বিপ্লবের অব্যাহত বিকাশের ভেতর দিয়ে কিউবা রূপান্তরিত হতে থাকলো এক নতুন দেশ হিসেবে। লোক ঠকানো জুয়ার আড্ডা, মাদক পাচারের সব নেটওয়ার্ক ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো। পতিতাবৃত্তি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে বিপ্লবের পরে শতকরা ৯৫ ভাগ পতিতাকে নার্সিং প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা হলো।
বিপ্লবের পর প্রবল অর্থনৈতিক অবরোধের মুখে পড়ে কিউবা। এমনকি ওষুধপত্র আসাও বন্ধ হয়ে যায়। ভয়াবহ সে অবস্থা কাটিয়ে ওঠে আজ কিউবা তার দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করেছে। কিউবার মানুষের গড় আয়ু দুই আমেরিকা মহাদেশ মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি- নারীদের ৮২ ও পুরুষের ৭৬ বছর। কিউবায় প্রতি ১৫০ জন নাগরিকের জন্য একজন চিকিৎসক রয়েছেন। যেখানে পশ্চিম ইউরোপে ৩৩০ জনে ১ জন চিকিৎসক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৪১৭ জনে ১ জন। ১৯৭৮ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাজাখস্তানের আলমা আতায় যে ‘আলমা আতা’ কনভেনশন গৃহিত হয়, যেটি গ্রহণের পর সারা বিশ্বে একে বাস্তবায়নের জন্য সাড়া পড়ে গিয়েছিলো এবং পরে কর্পোরেটদের চাপে প্রায় সকল দেশের সরকার এ থেকে সরে এসেছে, সেই ‘প্রাইমারি ও প্রিভেন্টিভ হেলথ্ কেয়ার’ এর পূর্ণ বাস্তবায়ন একমাত্র কিউবাই করেছে এবং করে যাচ্ছে। আজ কিউবার ডাক্তাররা মহান কমিউনিজমের আন্তর্জাতিকবাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার দেশে দেশে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ যখন দুনিয়াব্যাপী তার তান্ডবলীলা চালিয়ে যাচ্ছে, সেই সময়ে তার নাকের ডগায় একটি ছোট্ট দেশ কিউবাকে ফিদেল সাম্রাজ্যবাদবিরোধীতার দুর্গে পরিণত করেছিলেন। আজ পৃথিবীতে মানবতার শত্রুরা দেশে দেশে আঞ্চলিক ও স্থানীয় যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। যে কোনো দেশে যে কোনো সময় চড়াও হয়ে তার দখল নিচ্ছে, লক্ষ-কোটি মানুষকে হত্যা করছে। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে আজ ক্ষত-বিক্ষত মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশসমূহ। ফিদেল ক্যাস্ত্রো ল্যাটিন আমেরিকান দেশগুলোকে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। আমেরিকা তাকে হত্যা করতে চেয়েছে বারবার। সিআইএ’র প্রাক্তন কর্মকর্তার ভাষ্যেই এসেছে ফিদেলকে প্রায় সাড়ে ছয়শত বারের উপর হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সকল বাধা মোকেবেলা করে ফিদেল বেঁচেছিলেন কিউবার জন্য, সমাজতন্ত্রের জন্য, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর গোটা বিশ্বে যখন সমাজতন্ত্রবিরোধী প্রবল জোয়ার বইতে শুরু করলো, তখন ক্যাস্ত্রো তাঁর মুষ্টিবদ্ধ হাত হাভানার জনস্রোতে উঁচিয়ে ঘোষণা করেছেন, “হয় সমাজতন্ত্র, নয় মৃত্যু।”
ফিদেলের নেতৃত্বে শিক্ষা-চিকিৎসা-খেলাধুলা কোন্ ক্ষেত্রে এগোয়নি কিউবা? লাতিন আমেরিকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি অলিম্পিক পদক কিউবার। কিউবার খেলোয়াড়রা অন্যান্য দেশের মতো প্রচুর টাকা কিংবা স্পন্সর পান না। খেলা সেখানে ব্যবসা করার বিষয় নয়। সেই দেশই অলিম্পিকের মাঠ দাপিয়ে বেড়াতো। ফিদেল ছিল তাদের অনুপ্রেরণা। কোনো এক অলিম্পিকে এক সাংবাদিক একবার লিখেছিলেন,“অলিম্পিকে আজ ফিদেল এসেছেন। কিউবা পদক জিতবেই। ফিদেলকে দেখলে কিউবানরা দৈত্য হয়ে যায়।”
শুধু কিউবা নয়, ল্যাটিন আমেরিকা নয়, সারা বিশ্বের কোটি কোটি মুক্তিকামী হৃদয়ের প্রেরণা কমরেড ফিদেল। কমরেড ফিদেল, আমরা শপথ করছি— যে স্বাধীন, শোষণহীন, মর্যাদাময় জীবনের জন্য আপনি আপনার সমগ্র জীবন ব্যয় করেছেন, সেই মহান আদর্শ ও মহান জীবনের লড়াই আমরা আমৃত্যু চালিয়ে যাব।