[করোনা মহামারীর শিক্ষা, পরবর্তী কালের বিশ্ব পরিস্থিতি ও করণীয় নিয়ে ‘সোশ্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অব ইন্ডিয়া (কমিউনিস্ট)’ সংক্ষেপে এসইউসিআই(সি) পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ তাঁদের দলের কর্মীদের উদ্দেশ্যে গত ২৪ এপ্রিল অনলাইনে একটি আলোচনা করেন। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় তাঁর এই মূল্যবান আলোচনার একাংশ কিছুটা সংক্ষেপিত আকারে এখানে প্রকাশিত হলো। আমাদের বিশ্বাস, এই বক্তব্য চিন্তাশীল পাঠককে জনজীবনে বর্তমান সংকটের কারণ বুঝতে ও পথের নিশানা পেতে সাহায্য করবে।]
“… এই মুহূর্তে গোটা বিশ্বে এবং ভারতবর্ষে যে মর্মন্তুদ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যে ভয়ঙ্কর সঙ্কটের মধ্যে মানুষ এসে পড়েছে তা আমাদের প্রত্যেকের কাছে অত্যন্ত বেদনাদায়ক। বিশ্বে লক্ষ লক্ষ ঘরে আজ স্বজন হারানো কান্নার রোল। আমরা এই সভা যখন শেষ করব, তার মধ্যে করোনা আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা আরও হাজার হাজার বাড়বে। এইরকম একটা পরিস্থিতিতে অত্যন্ত ব্যথা-বেদনায় ভারাক্রান্ত মন নিয়ে অনেকটা নিজের সাথে লড়াই করে আমাকে বলতে হচ্ছে।
… এই ব্যাপক সংখ্যায় মানুষের রোগাক্রান্ত হওয়া এবং এই বিপুল সংখ্যক মৃত্যু-এটা কি অনিবার্য ছিল? আমি মনে করি নিশ্চয় তা নয়। যদিও এই রোগের আক্রমণ সম্পূর্ণ আকস্মিকভাবে ঘটেছে এবং এর প্রতিষেধক ও প্রতিবিধানের ওষুধ এখনও আবিষ্কার হয়নি। কিন্তু এই রোগের লক্ষণ কী কী, কীভাবে অতি দ্রুত এই রোগ একজন ব্যক্তি থেকে বহু ব্যক্তির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, যাকে কমিউনিটি মাস ট্রান্সমিশন বলা হয়, সতর্কতা হিসাবে কী কী ব্যবস্থা নিতে হয়, মাস ট্রান্সমিশন কীভাবে ঠেকানো যায়-এসবই রোগ শুরু হওয়ার একটু পর থেকেই জানা গেছে।
… চীনের কর্তৃপক্ষ এটাকে গুরুত্ব দিয়ে অনুসন্ধানের পরিবর্তে সেই ডাক্তারকে ধমক দিয়ে থামায়, অন্যায় করেছে বলে স্বীকারোক্তি করায় এবং খবরটা চেপে দেয়। ওই ডাক্তার কয়েকদিন বাদে এই রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে নিজেই রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যান। কেন চীন এই খবর চেপে দিতে চেয়েছিল? চীন ভেবেছিল বাইরে জানাজানি হলে অসুবিধা হবে, অল্পতেই এটা ম্যানেজ করতে পারবে।
… চীন এই উহান শহরকে লক ডাউন বা কাটআপ করে দেয়, যাতে এই রোগ সমগ্র চীনে না ছড়ায়। এটা করলেও চীন কিন্তু বিদেশের সঙ্গে তখনও এই শহরের সম্পর্ক ছিন্ন করেনি এটা জেনেই যে, অন্য দেশেও এইভাবে এই রোগ ছড়াতে পারে। বাণিজ্যিক ক্ষতি যাতে না হয় সেজন্য তা করেনি। এই না করাটা খুবই নিন্দনীয় অপরাধ। অথচ এটা করলে সমগ্র বিশ্বে এই রোগ এইভাবে ছড়াত না। এরোপ্লেন ও জাহাজের মাধ্যমে এই শহরের সঙ্গে বাইরের সম্পর্ক তখনও স্বাভাবিক ছিল। সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছিল যে, উহান শহরে এই রোগে বিপুল সংখ্যায় লোক মারা যাচ্ছে। কিন্তু এটা জেনেও সাথে সাথে কোনও সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী দেশ বাণিজ্যিক স্বার্থে উহান শহরের সাথে যোগাযোগ ছিন্ন করেনি, নিজেদের দেশেও এই মারণ রোগকে মোকাবিলা করার জন্য কোনও প্রস্তুতি নেয়নি। এটাও মারাত্মক অপরাধ।
… আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যায় আমেরিকা শীর্ষস্থানে। এটা কি অনিবার্য ছিল? মার্কিন সরকার কেন ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করল? একদিকে চীনের সাথে বাণিজ্যিক লেনদেন বন্ধ করতে চায়নি, অন্যদিকে নিজের দেশেও কলকারখানা-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে চায়নি। আর এসবই করেছে সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের স্বার্থে। ঠিক একইভাবে ইতিমধ্যে এই রোগ ভয়ঙ্করভাবে ইউরোপের ইটালি, স্পেন, ফ্রান্স ও জার্মানিসহ নানা সাম্রাজ্যবাদী দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সেইসব দেশও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মতো ভূমিকা নেওয়ার ফলে সেখানেও হাজারে হাজারে মারা যাচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিজের দেশে সমালোচনার মুখে পড়ে চীনকে দোষারোপ করে নিজের গা বাঁচাবার চেষ্টা করছেন। কারণ কয়েকদিন পরেই আমেরিকায় নির্বাচন হবে। চীনের তুলনায় মার্কিন শাসকরা কম অপরাধী নয়। ভারত সরকারও এই রোগ সংক্রমণ রোধে সময়মতো কোনও প্রস্তুতি নেয়নি। যদিও ইতিমধ্যে চীন, ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইরান ইত্যাদি দেশে ওই রোগের আক্রমণ কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে এটা তাদের অজানা ছিল না।
… ১৩ মার্চ ভারতবর্ষের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছেন, এটা কোনও সমস্যাই নয়, আমরা সতর্ক আছি। ভারতবর্ষের সরকার তখন প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে রাজকীয় অভ্যর্থনা জানাবার জন্য। এর মধ্যে মধ্যপ্রদেশে সরকার ভাঙা-গড়ার খেলাও চলছে। কংগ্রেসের এমএলএ-দের টাকা দিয়ে কিনে নিতে সমগ্র কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা, বিজেপি নেতৃত্ব ব্যস্ত ছিল। এই রোগ নিয়ে তাদের মাথা ঘামাবার সময় কোথায়! তাছাড়া চীনসহ সমগ্র বহির্বিশ্বের সাথে বিমান ও জাহাজ চলাচল পুরোদমে চালু রেখেছিল ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাণিজ্যিক স্বার্থে। তার ফলে বিদেশ থেকে ব্যাপক সংখ্যক রোগাক্রান্ত মানুষ এদেশে চলে এল, যাদের সংস্পর্শে রোগ ছড়াতে লাগল।
… ২৪ মার্চ মধ্যপ্রদেশে বিজেপি সরকার গঠনের ষড়যন্ত্র সফল করতে পারল। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে সরকার লকডাউন ঘোষণা করল। লকডাউন করেই দায় সারল, যেন এতেই রোগ ঠেকানো যাবে। বিদেশ থেকে আগতদের কোনও পরীক্ষা করা হল না, লকডাউন এলাকার মধ্যেও পাবলিকের পরীক্ষার কোনও বন্দোবস্ত হল না, পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় কিট নেই, প্রয়োজনীয় হাসপাতাল ও বেডের ব্যবস্থা হল না, প্রয়োজনীয় ভেন্টিলেটর নেই, ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য প্রয়োজনীয় পিপিই-র ব্যবস্থা করা হল না। অন্য দিকে লকডাউনের ফলে কোটি কোটি শ্রমিক কর্মচ্যুত হল, গরিব মানুষ জীবিকাচ্যুত হল, পরিযায়ী শ্রমিকরা আশ্রয় ও কর্মচ্যুত হল-এদের কী করে চলবে, কী খাবে তার কোনও বন্দোবস্ত হল না। প্রধানমন্ত্রী ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা সংবাদমাধ্যমে নানা বাণী ঘোষণায় ব্যস্ত থাকলেন, যেন মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখে তাঁদের আহার-নিদ্রা চলে গেছে! কে কত জনগণের ত্রাতা তা প্রমাণে ব্যস্ত হলেন আগামী ভোটের দিকে তাকিয়ে। প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে একদিন সারা দেশে হাততালি ও ঘণ্টা বাজানো এবং আরেক দিন ঘরের আলো নিভিয়ে অন্ধকার করে বাইরে মোমবাতি, টর্চ, মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে করোনা তাড়ানোর আজব বন্দোবস্ত করলেন। উদ্দেশ্য, একদিকে ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট সুড়সুড়ি দিয়ে তা বাড়ানো, অন্য দিকে তাদের দল ও সরকারের প্রতি অন্ধ আনুগত্য সৃষ্টি করা।
দেশের এত বড় দুঃসময়ে যথারীতি মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজও বিজেপি চালিয়ে যাচ্ছে। বাড়তি সুযোগ পেয়ে গেল তবলীগ জামাতের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। ধর্মান্ধ মুসলিমরা এটা করেছিল যথারীতি সরকারি অনুমতি নিয়েই। বিদেশ থেকেও এসেছিল সরকারি অনুমতি নিয়েই। অনুষ্ঠান বন্ধেরও কোনও নির্দেশ সরকার দেয়নি। এদের মধ্যে কয়েকজনের করোনা রোগ ধরা পড়ে এটা ঠিক। কিন্তু তারা কি এই রোগ ছড়ানোর জন্য এই অনুষ্ঠান করেছিল? তারা করেছে ধর্মীয় গোঁড়ামির জন্য। যেমন প্রায় একই সময়ে তিরুপতিতে বৃহৎ ধর্মীয় সমাবেশ হয়েছে সরকারি অনুমতি নিয়েই। এর জন্য দায়ী যদি করতেই হয় তাহলে যে সরকার অনুমতি দিয়েছে, তাকেই দায়ী করতে হয়। অথচ সমগ্র দেশে বিষ ছড়ানো হচ্ছে এই বলে যে মুসলিমরাই করোনা রোগ নিয়ে এসেছে। একদিকে এটা করে যাচ্ছে যাতে আগামী দিনে এনপিআর-এনআরসি চালু করা সহজ হয়, অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রী ও আরএসএস প্রধান সাধু সেজে বলছেন করোনার জন্য কোনও ধর্মকেই দায়ী করা উচিত নয়। এসব ভণ্ডামিও চলছে। এই দুঃসময়ে জনগণকে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির, শাসক দলগুলির ও এদের পৃষ্ঠপোষক পুঁজিপতিদের প্রকৃত চেহারা চিনে নিতে হবে।
ফলে এটাও বুঝতে হবে, যে রোগ সংক্রমণ ঘটেছে চীন থেকে, শুরুতেই যদি চীন নিজ দেশে যেটা করেছে, বিদেশের ক্ষেত্রেও সেইরকম করত এবং অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী দেশগুলিও যদি সতর্ক হয়ে চীনের সাথে যোগাযোগ ছিন্ন করত, তাতে তাদের বাণিজ্যিক লাভের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হত ঠিকই, কিন্তু তাদের দেশে এই রোগের এই ব্যাপক বিস্তার ঘটত না, এত বিপুল প্রাণহানি ঘটত না। তাহলে এর জন্য কে দায়ী? এই ব্যাপক সংখ্যক আক্রান্ত এবং বিপুল হারে প্রাণহানি, এর জন্য কে দায়ী? এর জন্য দায়ী ভারতসহ সমগ্র বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী দেশের কর্ণধাররা। কারণ এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতে মানুষের জীবনের কোনও মূল্য নেই। পুঁজিপতিদের কাছে মানুষের একমাত্র মূল্য শ্রমশক্তি হিসাবে, পুঁজিপতিদের শোষণযন্ত্রের উপকরণ হিসাবে। তাই মহান স্ট্যালিন বলেছিলেন, পুঁজিপতিদের কাছে শ্রমিক হচ্ছে মনুষ্যদেহী কাঁচামাল, হিউম্যান ‘র’ ম্যাটেরিয়াল। কারখানা চালাবার জন্য যেমন কয়লা লাগে, সেই কয়লা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ঠিক তেমনই মানুষের শ্রমশক্তিও পুঁজিবাদ ব্যবহার করে, তার রক্ত শুষে নেয়, হাড়মাংস সব চূর্ণবিচূর্ণ করে শ্রমিকদের জীবন ছাই করে দেয়। এর ভিত্তিতেই পুঁজিবাদের শোষণযন্ত্র চলে। তাই কে বাঁচল, কে মরল এ নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই।
ফলে এই পুঁজিবাদ কত নিষ্ঠুর নির্মম, অমানবিক – সেটা এই ঘটনা আবার দেখিয়ে দিয়ে গেল। একইসাথে আমরা এটাও লক্ষ করে যাচ্ছি – বৈজ্ঞানিকেরা, পরিবেশবিদরা বারবার ওয়ার্নিং দিচ্ছেন গ্লোবাল ওয়ার্মিং বাড়ছে, সমুদ্রের জলস্তর বাড়ছে। এন্টার্কটিকা ও মেরুঅঞ্চলে বরফ গলে যাচ্ছে, হিমালয়ের গ্লেসিয়ার ধ্বংস হচ্ছে, যার ফলে নদীগুলির জলের উৎসও ধ্বংস হচ্ছে। এ সবের ফলে পরিবেশের পরিবর্তন ঘটছে। এটা মানবজাতির পক্ষে বিপজ্জনক। পরিবেশবিদরা বারবার বলছেন, গ্রিনহাউস গ্যাস কন্ট্রোল কর, ফসিল অয়েল ব্যবহার কমাও। কিন্তু কে কার কথা শোনে! তাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল লাভের স্বার্থ, ওয়ার ইন্ডাস্ট্রির স্বার্থ তারা কন্ট্রোল করতে কেউ রাজি নয়। মানবসভ্যতা বিপন্ন হোক, আপত্তি নেই। কিন্তু তাদের মুনাফার স্বার্থে আঘাত দেওয়া চলবে না। এই হচ্ছে সা¤্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ। ঠিক সেই একই জিনিস এই রোগের ক্ষেত্রেও দেখা গেল।
আরেকটা জিনিসও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে, মানুষের স্বাস্থ্যরক্ষার ক্ষেত্রে এই পুঁজিবাদী দেশগুলির অবহেলা কী নির্মম! প্রত্যেকটা দেশেই দেখা যাচ্ছে, প্রয়োজনীয় সংখ্যক হাসপাতাল নেই, হাসপাতালে পর্যাপ্ত বেড নেই, ডাক্তার নেই, নার্স নেই, পরীক্ষার কিট নেই, ভেন্টিলেটর নেই, পারসোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট যা দরকার, তা নেই। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য যদি যথেষ্ট সংখ্যক হাসপাতাল থাকত, বেড থাকত, তাহলে এত মৃত্যু ঘটত না। এমনকী ডাক্তার-নার্সও মারা যাচ্ছেন। এর কারণ কী? এর কারণ স্বাস্থ্য বাজেট সব দেশেই সঙ্কুচিত। সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী রাষ্ট্র গুরুত্ব দেয় মিলিটারি বাজেটের ওপর। গত বছর সামরিক খাতে ব্যয়বৃদ্ধিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম স্থানে, চীন দ্বিতীয় স্থানে এবং ভারতবর্ষ তৃতীয় স্থানে ছিল। সব সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী দেশই সামরিক উৎপাদন প্রবলভাবে বাড়াচ্ছে, এর জন্য অঢেল ব্যয় করছে, বিজ্ঞানের মৌলিক গবেষণাকে সঙ্কুচিত করছে, বিজ্ঞানের মৌলিক আবিষ্কারকে ব্যাহত করছে। স্বাস্থ্যের জন্যও যে স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের চর্চা দরকার, তার চর্চা, তার বিকাশকে ব্যাহত করছে। এই বিজ্ঞান চর্চা এভাবে ব্যাহত না হলে হয়তো অতি দ্রুত এই রোগের ওষুধ আবিষ্কার হতে পারত। এগুলো অবহেলা করা হয়েছে।
…আপনারা জানেন, এমনিতেই বিশ্বে মন্দা চলছিল। ওরা মন্দার পরিবর্তে বলছিল স্লোয়িং ডাউন অফ ইকনমি। বাস্তবে মন্দাই চলছিল। গত বছরই আমাদের দেশে ৬ লক্ষ ৮০ হাজার ছোটবড় কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, ১০ কোটি শ্রমিক কর্মচ্যুত হয়েছিল। এগুলি সরকারি হিসাব। বিভিন্ন দেশে একই অবস্থা চলছিল। কবে করোনার আক্রমণ থামবে জানা নেই। ইতিমধ্যেই ইউরোপ-আমেরিকায় দাবি উঠেছে, আমাদের দেশেও উঠছে, এমনিতেই অনাহারে মরছি, ফলে লকডাউন তুলে নাও। মালিকরা চাইছে মুনাফার স্বার্থে, শ্রমিকরা চাইছে, গরিব মানুষ চাইছে পেটের জ্বালায়।
এই ব্যাধির আক্রমণ যখন থামবে তখন আমরা একটা নতুন বিশ্ব দেখব। সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী দুনিয়ায় ১৯৩০ সালে একটা মহামন্দা এসেছিল। তার চেয়েও আরও ভয়ঙ্কর মন্দা আসছে। অজস্র কলকারখানা বন্ধ, কোটি কোটি শ্রমিক ছাঁটাই, কোটি কোটি ক্ষুধার্ত মানুষ পথেঘাটে মরছে, ভুখা মিছিল-গোটা বিশ্বে এই চেহারা ঘটবে। এই একটা দিক। আরেকটা দিক হচ্ছে, শক্তির ভারসাম্যেরও পরিবর্তন ঘটবে। এতদিন পর্যন্ত বিশ্বে আমেরিকা ছিল একনম্বর সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। দ্বিতীয় ছিল জাপান। কিন্তু ইতিমধ্যে জাপানকে হটিয়ে চীন এসে গেছে দ্বিতীয় নম্বরে। চীন এবং আমেরিকার প্রবল বাণিজ্য যুদ্ধ চলছিল সাম্রাজ্যবাদী হিসাবে কে কোথায় কতটা লুণ্ঠনক্ষেত্র দখল করবে, কে কোথায় কতখানি আধিপত্য বিস্তার করবে – এই নিয়ে। ইতিপূর্বে দুটি বিশ্বযুদ্ধ একই কারণে ঘটেছে। এখন বাণিজ্য যুদ্ধ চলছে। অস্ত্রের আক্রমণ না থাকলেও এতে বহু কলকারখানা বন্ধ হচ্ছে, অসংখ্য শ্রমিক কর্মচ্যুত হয়ে অনাহারে মরছে। চলতি কথায় আছে, হাতে না মেরে ভাতে মারছে। করোনা পরবর্তীকালে চীন আরও শক্তি সঞ্চয় করে আসছে। ইতিমধ্যেই চীন এই সুযোগে ইউরোপে কলকারখানা কিনছিল, পুঁজি বিনিয়োগ করছিল। ভারতেও কিছু শেয়ার কিনেছে, আরও কিনতে যাচ্ছিল। এইভাবে সে তার আধিপত্য বিস্তার করছিল। ভারত সরকার আইন করেছে চীন যাতে বিনা অনুমতিতে শেয়ার বা কারখানা কিনতে না পারে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশও আতঙ্কিত হয়ে একই সিদ্ধান্ত করেছে। কিন্তু চীন ধীরে ধীরে থাবা বিস্তার করছে নানা জায়গায়। তার উৎপাদন শিল্পগুলি অক্ষত রয়েছে। অন্যান্য দেশে লকডাউন চলছে। চীনে এখন লকডাউন নেই। ফলে ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে সে বাজার গ্রাস করছে। এমনকি যে কিট সে বিক্রি করেছে সেখানেও দেখা যাচ্ছে দুর্নীতি, কাজ দিচ্ছে না। ইউরোপ তা প্রত্যাখ্যান করেছে, ভারত সরকারও প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়েছে। এরপর হয়ত দেখা যাবে চীন একনম্বর সাম্রাজ্যবাদী দেশ হিসাবে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে-যেটা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কিছুতেই হতে দিতে চাইবে না। তার ফলে চীন ও আমেরিকার প্রচণ্ড লড়াই হবে এই নিয়ে, সেটা শেষপর্যন্ত বাণিজ্য যুদ্ধেই সীমাবদ্ধ থাকবে কিনা তার নিশ্চয়তা নেই। ট্রাম্প যে আমেরিকায় দ্রুত লকডাউন তুলতে চাইছে তার কারণ আমেরিকার ইন্ডাস্ট্রি যদি পিছিয়ে যায় তাহলে চীনের আধিপত্য বাড়বে – এই তার উদ্বেগ। এটাও তার পুঁজিবাদী স্বার্থ, জনগণের স্বার্থের সাথে এর কোনও সম্পর্ক নেই। আবার লক্ষ করুন, করোনা রোগের আক্রমণে সব দেশই আক্রান্ত। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী দেশগুলির প্রত্যেকের মধ্যে মুনাফা ও বাণিজ্যিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব এত প্রবল যে এই রোগের বিরুদ্ধে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াচ্ছে না, সকলের বৈজ্ঞানিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করছে না, একে অপরকে বিপদে সাহায্য করছে না, মেডিকেল সাহায্যের ক্ষেত্রেও হিসাব কষছে কে কাকে ঠকিয়ে কত লাভ করতে পারবে।
… এইরকম সব পুঁজিবাদী স্বার্থের সংঘাত চলছে। একদিকে বিশ্বে শক্তির ভারসাম্য পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। ফলে দ্বন্দ্ব-সংঘাত আরও তীব্র হবে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির ভিত্তিও টলটলায়মান। অন্য দিকে আক্রান্ত হবে শ্রমিক শ্রেণি। আমেরিকা, ইউরোপে, আমাদের দেশে শ্রমিকদের বহু অধিকার যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তারা লড়াই করে আদায় করেছিল, তা এমনিতেই পুঁজিপতিরা ইতিমধ্যেই বহুলাংশে কেড়ে নিয়েছে। সামান্য ছিটেফোঁটা যা অবশিষ্ট ছিল, তাও সম্পূর্ণ কেড়ে নেবে। অল্প শ্রমিক দিয়ে কম মজুরিতে বেশি খাটানো চলবে, অটোমেশন, ডিজিটালাইজেশন ব্যাপকভাবে চালু হবে, অর্থাৎ লেবার ইনটেনসিভের পরিবর্তে ক্যাপিটাল ইনটেনসিভ উৎপাদন পদ্ধতি চালু হবে ব্যাপকভাবে পুঁজিবাদের মুনাফার স্বার্থে। কাজের সময়ের কোনও সীমা থাকবে না। নির্দিষ্ট মজুরি বলেও কিছু থাকবে না। যখন তখন ছাঁটাই করে দিতে পারবে, যখন তখন কলকারখানা বন্ধ করে দিতে পারবে।
আরেকটা প্রশ্নেরও সৃষ্টি হচ্ছে, তা হল, এই সঙ্কটের মধ্যে পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে কীভাবে টিকিয়ে রাখা যায়। এই সঙ্কটগ্রস্ত পুঁজিবাদকে নিয়ে এখন অনেক লেখালেখি চলছে। পুঁজিবাদকে রক্ষা করার জন্য যেসব অর্থনীতিবিদরা রয়েছে তারা নানা টোটকা বাতলাচ্ছে। একদল কেইনসের থিওরির কথা বলছে। ১৯৩০ সালে মহামন্দার সময়ে যখন পুঁজিবাদী দেশগুলিতে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা একেবারে তলানিতে ঠেকেছে, বাজার খুবই সঙ্কুচিত, ফলে কারখানার পর কারখানায় লালবাতি জ্বলছে, লোকের কাজ নেই, একমাত্র সোভিয়েত সমাজতন্ত্র ছাড়া সব দেশেই এই সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছিল তখন বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদ কেইনস সাহেব বুর্জোয়া দেশগুলিকে পরামর্শ দিয়েছিল, বাড়তি নোট ছাপাও, ছাপিয়ে পাবলিককে দিয়ে দাও, তা হলে পাবলিকের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। এটা কৃত্রিমভাবে বাড়ানো, এর ফলে উল্টো দিকে সমস্যা হয়। নোট ছাপানোর একটা নীতি থাকে। উৎপাদন যদি ১০০ হয়, সেই পরিমাণ নোট ছাপা হবে। উৎপাদন ১০০, আমি নোট ছাপলাম ১০০০, তা হলে মুদ্রার দাম কমে যায়। এতে ইনফ্লেশন অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতি ঘটে, টাকার দাম ভীষণভাবে কমে যায়, জিনিসপত্রের দাম ব্যাপক বেড়ে যায়। তিনি আরও বলেছিলেন কাজ নেই, কাজ সৃষ্টি কর। কিছু লোককে দিয়ে মাটি কেটে গর্ত সৃষ্টি কর, আবার কিছু লোককে দিয়ে সেই গর্ত ভর্তি করাও। এই সাজেশন এখন আবার কেউ কেউ দিচ্ছে মুমূর্ষু পুঁজিবাদকে বাঁচাবার জন্য। আরেক দল বলছে, মালিকরা যা লাভ করবে তার একটা অংশ রাষ্ট্র নিয়ে শ্রমিকদের দিক। এটা হচ্ছে শেয়ারিং অফ প্রফিট। এইসব নানা থিওরি আজ আসছে পুঁজিবাদকে রক্ষা করার জন্য।
… আমরা এখন দেখছি মুহূর্তে মুহূর্তে সঙ্কট, শেয়ার মার্কেট টলমল করছে। গোটা বিশ্বে পুঁজিবাদের প্রবল বাজার সঙ্কট চলছে। আর দেখছি, মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেশন, ট্রান্সন্যাশনাল কর্পোরেশন নিজেদের ন্যাশনাল ইকনমির স্বার্থের থেকেও মুনাফা লুণ্ঠনের স্বার্থকেই বড় করে দেখছে। তাই বিদেশে আউটসোর্সিং করাচ্ছে সস্তায় মজুর ও কাঁচামাল ব্যবহার করে। সেই পণ্যই নিজ দেশে ও অন্যত্র বেশি দামে বিক্রি করছে। নিজ দেশের পুঁজি ও ইন্ডাস্ট্রি অন্য দেশে নিয়ে যাচ্ছে। ভারতবর্ষের পুঁজিপতিরাও বিদেশে পুঁজি ইনভেস্ট করছে, কারখানা-খনি কিনছে। এদের জাতীয় স্বার্থ বলতে ততটুকু, নিজেদের লুণ্ঠনের স্বার্থে যতটুকু জাতীয় রাষ্ট্রকে ব্যবহার করা যায়। তাই এদের ব্যক্তিগত স্বার্থের সাথে রাষ্ট্রের সামগ্রিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হচ্ছে। যার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট দেখছেন দেশে প্রবলভাবে বেকারি বাড়ছে। ফলে এদের ওপর চাপ দিচ্ছে বিদেশে আউটসোর্সিং বন্ধ করার জন্য, নিজ দেশে পুঁজি ইনভেস্ট করার জন্য। হুমকি দিচ্ছেন, না করলে রাষ্ট্র সব সুবিধা বন্ধ করে দেবে। এটা করা হচ্ছে মার্কিন পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে বাঁচাবার স্বার্থেই। কারণ যে-কোনও মুহূর্তে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট মুভমেন্ট’ আবার মাথা তুলতে পারে, দেশে এমনই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি। যার জন্য নিজে গ্লোবালাইজেশনের হোতা হয়েও আজ তার নিজের দেশের অর্থনীতি সঙ্কটগ্রস্ত হওয়ায় নিজেই গ্লোবালাইজেশনের বিরোধিতা করছে। ঘোষণা করেছে ‘আমেরিকান ইন্টারেস্ট ফার্স্ট’।
এই অবস্থায় পরবর্তী সময়ে ১৯৩০ সালের চেয়েও ভয়ঙ্কর মন্দা আসছে। রাষ্ট্রসংঘের ওয়ার্ল্ড ফুড ডিরেক্টর ইতিমধ্যেই ওয়ার্নিং দিয়েছেন ‘ক্ষুধার মহামারি’ আসছে। তাঁর হিসাবে ইতিমধ্যেই বিশ্বে প্রায় ১০০ কোটি মানুষ প্রতিদিন ক্ষুধার্ত থাকে। এই সংখ্যা আরও বহুগুণ বাড়বে। কোটি কোটি বেকার, বুভুক্ষু মানুষের মিছিল গোটা বিশ্বের সাথে আমাদের দেশেও ঘটবে। ট্র্যাজেডি হচ্ছে, বিশ্বে কোনও শক্তিশালী কমিউনিস্ট পার্টি নেই যে আজকে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই সংঘটিত করতে পারে। ভারতবর্ষেও আমরা এককভাবে তা সংঘটিত করার মতো অবস্থায় নেই। এরকম একটা অবস্থার সম্মুখীন আমরা।
… আগামী দিনে যে প্রয়োজন আমাদের সামনে উপস্থিত হচ্ছে ভারতবর্ষের বুকে এবং বিশ্বে সেই প্রয়োজনে যাতে কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে আমরা যথার্থ ভূমিকা নিতে পারি সেই সম্পর্কে আমাদের গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা দরকার। প্রথমত, যেখানে লকডাউন শিথিল হচ্ছে সেইসব জায়গার কর্মীরা মেডিকেল সিকিউরিটি বজায় রেখে যথাসম্ভব রিলিফের কাজে আরও আত্মনিয়োগ করবেন। কিন্তু কমরেডদের মনে রাখতে হবে কে করোনা ভাইরাস ক্যারি করছে, কে করছে না তা বোঝার উপায় নেই। ফলে সব সতর্কতা মেনেই সেইসব জায়গায় রিলিফের কাজে তাঁরা নামবেন। আর যখন পুরোপুরি লকডাউন তুলে নেওয়া হবে তখন আমরা সর্বশক্তি নিয়োগ করব রিলিফ সংগ্রহ করা এবং বণ্টনের কাজে। এটা করতে হবে দলের নামে, গণসংগঠনের নামে, বিভিন্ন ফোরামের নামে। ইতিপূর্বে আমরা বিভিন্ন ফোরামের মাধ্যমে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছি, তাঁদেরও আমরা রিলিফ সংগ্রহ এবং বণ্টনের ক্ষেত্রে সামিল করব। তাতে যদি পাবলিক কমিটি করতে হয় পাবলিক কমিটিই করব। অন্য দলের লোককেও যদি এই কাজে পাই তাঁদেরও সামিল করব। আমাদের দলের সকল স্তরের সদস্য ছাড়াও গণসংগঠনগুলির সাধারণ সদস্য, দলের সমর্থক, কর্মীদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, একসময়ে কাজে ছিল এখন পারে না, আগ্রহী সাধারণ পাবলিককে সকলকেই আমরা এই কাজে যুক্ত করব। দেশে বিদেশে যে ধরনেরই হোক, যেমন যোগাযোগ আছে, এই রিলিফ সংগ্রহ করা এবং বণ্টনের ক্ষেত্রে আমরা কাজে লাগাব। এটাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে আমাদের করতে হবে। যেখানে ঝান্ডা নিয়ে কাজ করা যায় করব। যেখানে তা করা যাবে না, ঝান্ডা ছাড়াই আমরা কাজ করব। যেখানে প্রয়োজন, পাবলিক কমিটি করেই করব। আমি জানি, আমাদের দলের কর্মীদের মানবিক মূল্যবোধ উন্নত স্তরের। তারা অবশ্যই এই কাজে উদ্যোগী হবেন। অন্য দিকে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালাতে হবে যাতে ব্যাপকভাবে রিলিফ দেয়। এ ছাড়া সামগ্রিকভাবে আমাদের দল, দলের বিভিন্ন শ্রেণিসংগঠন ও গণসংগঠনগুলি এবং ফোরামগুলিকে প্রস্তুত থাকতে হবে জনগণের বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলনের জন্য। খাদ্যের দাবিতে ক্ষুধার্ত মানুষ, চাকরির দাবিতে কর্মচ্যুত শ্রমিক ও বেকার যুবক, চরম সঙ্কটগ্রস্ত ক্ষেতমজুর, গরিব ও মাঝারি কৃষক, পরিযায়ী শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বিভিন্ন স্তরের দুর্দশাগ্রস্ত জনগণ নানা স্থানে স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভে ফেটে পড়বে, বিক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠবে। পাবলিক কমিটি গঠন করে এগুলিকে সুসংহত, সংঘবদ্ধ, সুশৃঙ্খল আন্দোলনে রূপ দেওয়ার জন্য আমাদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। যেখানে যখনই সম্ভাবনা দেখা দেবে, সেখানেই কমরেডরা উদ্যোগ নেবে, ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করবে না। এই আন্দোলনে অন্য দলের লোকজনও যদি আসে আমরা আপত্তি করব না। অন্য দলও যদি কোথাও জনগণের ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে, আমরা তাতেও থাকব, না ডাকলেও যাব। এটা একটা এমার্জেন্সি পিরিয়ড। আন্দোলনটা চাই, যারা যতদূর আন্দোলনে যেতে প্রস্তুত তাদের নিয়ে আমরা আন্দোলন করব। কিন্তু উদ্যোগটা আমাদের নিতে হবে। এটা আমাদের বুঝতে হবে। শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র-যুবক, মহিলা নানা বৃত্তির সংগঠন প্রত্যেককেই প্রস্তুত থাকতে হবে জনগণের দাবি-দাওয়া নিয়ে আমরা যাতে আন্দোলনে নামতে পারি এবং জনগণের উপর যে আক্রমণ হবে সে আক্রমণ যাতে মোকাবিলা করতে পারি, তার জন্য।
এখানে আরও একটা জিনিস আমি বলতে চাই যে, গণতন্ত্রের যতটুকু ধ্বংসাবশেষ আজও বুর্জোয়া শাসকবর্গ মৌখিকভাবে হলেও বজায় রেখেছে, আগামী দিনে সেই গণতন্ত্রেরও লেশমাত্র থাকবে না। আরও নগ্ন ফ্যাসিবাদী আক্রমণ ঘটতে থাকবে এবং গণবিক্ষোভ দমনে সরকার আরও নিষ্ঠুর ভূমিকা নেবে, তার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। আরও দানবীয় আইন আসতে থাকবে তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। বিশ্বে উগ্র জাতীয়তাবাদ, বর্ণবৈষম্যবাদ, সম্প্রদায়গত বিরোধ, আমাদের দেশে প্রাদেশিকতা, ধর্মীয় হানাহানি, জাত-পাতের লড়াই, আদিবাসী-অ-আদিবাসী বিরোধ ইত্যাদি যা যা আছে বুর্জোয়ারা এগুলোকে প্রবলভাবে উস্কানি দেবে জনগণের ঐক্যকে ভাঙবার জন্য। এগুলির বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হবে এবং তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
… একটা মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে আছি, বিশ্বের এই পরিস্থিতি, ভারতবর্ষের এই পরিস্থিতি দেখে। এই অবস্থায় আমরা বিপ্লবীরা কিছু করতে পারছি না। ফলে দলের শক্তি বৃদ্ধি অত্যন্ত প্রয়োজন। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারাকে হাতিয়ার করে যাতে এ দেশে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে আরও তীব্র লড়াই করতে পারি এবং তার দ্বারা বিশ্ব বিপ্লবকে সাহায্য করতে পারি- এখানকার কমরেডরা, বাইরে যে কমরেডরা আছেন, এই পরিস্থিতিতে আবার নতুন করে এই প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করুন। …”