তখন সন্ধ্যা প্রায়। হানিফ ফ্লাইওভারের গোড়ায় মাইক্রোবাসে ধাক্কা লাগার পর নেমে এসে কৈফিয়ৎ তলব করেছিল রাসেল সরকার। (গ্রীন লাইন) বাসের চালক ছোট মুখে বড় কথা সহ্য করতে পারেনি। দৈত্যাকার বাসটিকে রাসেলের পায়ের ওপর চালিয়ে দেয়। মুহূর্তেই প্রায় পুরো পা-ই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় শরীর থেকে। অ্যাপোলো হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে থাকা রাসেলকে তাড়িয়ে ফিরছে সে দুঃসহ স্মৃতি, চিরপঙ্গুত্বের বেদনা।
ঘটনাটিকে প্রতীক হিসেবে নেওয়া যায়। বাংলাদেশে এখন যার যে ক্ষেত্রে স্টিয়ারিং, সেখানেই সে উন্মত্ত-বেপরোয়া। অন্যের জীবনের মূল্য যেন এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া বুদ্বুদ!
রাজনীতির কথাই ধরুন। সরকার বলছে, এত উন্নয়ন আর কখনোই হয়নি। ‘মাথাপিছু আয়’, ‘প্রবৃদ্ধি’, ‘মধ্যম আয়ের দেশ’, বা ‘উন্নয়নশীল দেশ’ ইত্যাদির প্রচার এখন তুঙ্গে। প্রচারণা সত্য হলে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে শঙ্কার কিছু ছিল না। কিন্তু আমরা দেখছি উল্টো। সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের কথায় মাঝে মাঝেই ভীতি প্রকাশ পাচ্ছে – ভোটে হারলে ঘরে থাকার উপায় থাকবে না। অতএব জিততে হবে যেকোনো মূল্যে। সকল মত-পথের অংশগ্রহণে অবাধ নির্বাচন নয়, বিরোধীদের দমন-পীড়নসহ নিয়ন্ত্রণমূলক সব কৌশল খাটিয়ে অতঃপর বলছে, ‘আমরা যেভাবে চাইব, সেভাবেই ভোট হবে। আসলে আস, না আসলে নাই।’ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, সুষ্ঠু নির্বাচনের দায় – কোনো কিছুরই পরোয়া নেই।
জননিরাপত্তা, বাক স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এসবেরও কি পরোয়া আছে? যখন-তখন যে কেউ গুম হয়ে যেতে পারে। গত ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে নিখোঁজ বা অপহরণের শিকার হয়েছেন ২৮৪ জন। এদের মধ্যে মৃতদেহ পাওয়া গেছে ৪৪ জনের। এদের মধ্যে কেউ কেউ ফিরে আসছে, কিন্তু কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। কে বা কারা তুলে নিয়েছে, কেন নিয়েছে – সব প্রশ্নই অমীমাংসিত থাকছে। ৫৭ ধারা নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা, গা করার এতটুকু মনোভাব নেই।
সমাজের ভিত্তি বলা হয় অর্থনীতিকে। ভিত্তিটিই এখন সবচেয়ে নড়বড়ে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যুদস্ত। মালিকদের বেপরোয়া ইচ্ছা ও লক্ষ্যপূরণের হাতিয়ার ব্যাংকগুলোতে ঋণ দেয়ার শর্ত ও সীমা – কোনোকিছুরই বালাই নেই। সরকারের উপদেষ্টা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সরকার সমর্থক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র সংগঠনের সাবেক নেতা – লুটের অংশীদার কে নয়? ফারমার্স ব্যাংক এখন দেউলিয়া, চেয়ারম্যানের বেধড়ক লুটপাটে ধুঁকছে বেসিক ব্যাংক। সিপিডিও বলছে, ‘ব্যাংকগুলো এতিম ও বিকলাঙ্গ হয়ে গেছে।’ সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণ সোয়া লক্ষ কোটি টাকা। বেসিক ব্যাংককে পথে বসানো আবদুল হাই বাচ্চুর দুর্নীতি দিবালোকের মতো স্পষ্ট হলেও দীর্ঘসময় সরকার কর্ণপাতই করেনি। ১০ বছরে ছয় লক্ষ কোটি টাকা যারা পাচার করেছে তাদের একজনকেও খুঁজে বের করা হয়নি। এদিকে ৬ মে খবর বেড়িয়েছে, ১২.৪৯ কোটি টাকা ঋণের দায়ে কুমিল্লার সাড়ে চার হাজার কৃষকের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। ‘আইনের চোখে সকলেই সমান’ – আইন কার দিকে বোঝাই যাচ্ছে।
বড় বড় আর্থিক প্রকল্পগুলোর দিকে তাকালে দেখতে পাওয়া যাবে, সর্বশেষ ব্যয় প্রাথমিক বাজেটের কয়েকগুণ হয়ে যাচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকার চেয়েও অন্তত তিন গুণ বেশি ব্যয়ে রাস্তা নির্মাণের বিষয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন, কিন্তু তা হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। উন্নয়নের মাশুল হিসেবে দফায় দফায় বেড়েছে বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম। গ্রামে সারাদিনে দু-একবার বিদ্যুতের দেখা না মিললেও বিদ্যুৎ সচিব বলবেন, ‘বর্তমানে দেশে লোডশেডিং নাই’। সুন্দরবন নিয়ে এত যুক্তি, এত কথা কানে তোলেনি সরকার। এখানেও গায়ের জোরই শেষ কথা।
অর্থনীতিতে যে লুটপাট ও কর্তৃত্ব চলছে, রাজনীতি-সংস্কৃতিসহ সমাজজীবনের সর্বত্র তারই ছাপ। গণতান্ত্রিক আচরণ-মূল্যবোধ নির্বাসিত প্রায়। উঁচু স্তরের ক্ষমতার দম্ভ নিচের স্তরেও একইভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। গত কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের নগর সভাপতি নুরুল আযম রনি ২০ লক্ষ টাকা চাঁদার জন্য কলেজের এক অধ্যক্ষ ও একজন কোচিং ব্যবসায়ীকে বেদম পিটিয়েও বহাল তবিয়তে আছেন। মামলা হয়েছে কিন্তু আসামী খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ! কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উপর নির্যাতনকারী ছাত্রলীগ নেত্রী পরবর্তীতে বরমাল্য পেয়েছে স্বয়ং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের হাতে। কুকর্মের দায় এড়াতে রাতারাতি বহিষ্কারাদেশ দিন কয়েক পরেই সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনের স্বীকৃতি স্বরূপ তুলে নিয়েছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি। প্রকাশ্যে অপরাধীর পক্ষাবলম্বনে এতটুকু কুণ্ঠা নেই! অধঃপতিত রাজনীতির বলয়ে তারুণ্যের শক্তি কীভাবে নিঃশেষিত হয় – ঘটনা দুটি তারই সাক্ষ্য বহন করছে।
তারুণ্যের শক্তিক্ষয়ের আরো নমুনা আছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামে তাসফিয়া নামের এক কিশোরী তারই ফেসবুক বন্ধু আদনান ও তার বন্ধুদের দ্বারা ধর্ষিত হবার পর খুন হলো। ভোগবাদী এ সমাজে প্রবৃত্তির প্রবল তাড়নায় মানুষের মানবিক চেতনা কীভাবে লুপ্ত হয়ে যায় – দেখে গা শিউরে ওঠে। বাসের মধ্যে ধর্ষণ চেষ্টার কয়েকটি ঘটনাও এসময় ঘটেছে।
আরও কয়েকটি খবর দেখা যাক। ভর্তি ফরমের দুই কোটি টাকার ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও শিক্ষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব। (বাংলা ট্রিবিউন, ২৮ এপ্রিল ’১৮) নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে দুই দিনের মাথায় সড়কের কার্পেটিং উঠে গেছে। (ইত্তেফাক, ২৭ এপ্রিল) ইত্যাদি। প্রতিদিন হত্যা-খুনের যত খবর পত্রিকায় আসে, তার বিবেচনায় এগুলো নগণ্য। আমরাও এভাবে দেখি-ভাবি বলেই ছোট ছোট অন্যায় ন্যায্যতা পেতে পেতে বড় ঘটনাতেও সংবেদন হারিয়ে ফেলি।
এই সমাজে শিক্ষকের নেই নৈতিকতার পরোয়া, যুবক-তরুণদের নেই বিবেকের পয়োয়া, পেশাজীবীর নেই দায়িত্ববোধের পরোয়া, সরকারের নেই জনগণের পরোয়া! কেন নেই? জাতীয় ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট দেখলে এটাই দেখবো – যেখানে পুঁজির দাপট, লাভ-মুনাফার উদগ্র লোভ, সেখানে মানুষের পরোয়া থাকে না। অর্থনীতিতে কর্তৃত্ব, রাজনীতিতে ক্ষমতার একচ্ছত্র দাপট, কুক্ষিগত আইন-বিচার ব্যবস্থা, সংস্কৃতিতে ভয়-ভীতি অথবা ‘কিছু হবে না’ মনোভাব – ফ্যাসিবাদের এই ভয়ঙ্কর জমিন অতীতের সব সংগ্রামের ফসলকে চিটায় পরিণত করেছে। পাল্টা রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রচেষ্টা ছাড়া এ থেকে উত্তরণের কোনো পথ আছে কি?