গাইবান্ধা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সুন্দরগঞ্জ। সুন্দরগঞ্জ শহর থেকে পাকা সড়ক ধরে ৬ কিলোমিটার দূরে চৈতন্য বাজার। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে বাঁশের সাঁকো পার হয়ে মেঠোপথ ধরে আরো ৪ কিলোমিটার পায়ে হাঁটার পর তারাপুর ইউনিয়নের চর খোর্দা।
চর হলেও এখানকার মানুষগুলোর বসতি অন্তত ৫০ বছর ধরে। গাছ-গাছালি, আবাদী জমি, বাড়ি ঘর, দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৮টি মসজিদ, দুটি ঈদগাহ মাঠ, দুটি কবরস্থান, মাদ্রাসা, খেলার মাঠ, বাজার সবই আছে। অন্য আট-দশটি গ্রামের মতোই চর খোর্দা। গ্রামের প্রবীণ আব্দুর রহিম মন্ডল (৭০) বললেন, দফায় দফায় নদী ভাঙনে তারা যখন নিঃস্ব প্রায়, তখন বাপ-দাদারা আশ্রয় নেন চর খোর্দায়। পাশ দিয়ে বয়ে চলা তিস্তা নদী। তিস্তা এখনো ভাঙে। তবে চর খোর্দায় এখনো তিস্তার ভাঙন ধরেনি। নদীর গতি প্রবাহ পরিবর্তনের ফলে তিস্তার ভাঙন থেকে এ জনপদ অনেকটা নিরাপদ বলেই মনে করে এলাকাবাসী। সেই থেকেই বংশ পরম্পরায় মিলেমিশে চর খোর্দায় বসবাস করছে অন্তত পাঁচশ পরিবার।
এই গ্রামে বসবাসকারী মানুষগুলো সবাই কৃষিনির্ভর। মরিচ, ভুট্টা, বাদাম, রসুন, পেঁয়াজ, ধান, গম, পাটসহ নানান কৃষি ফসল ফলিয়ে সন্তানদের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো অন্নের যোগান দেয় তারা। চাষবাসের মধ্য দিয়ে এক সময়কার মঙ্গা কাটিয়ে ওঠার লড়াইটা এখনো থামেনি।
এভাবে জীবন যখন চলছে, তখনই থমকে যাওয়ার মত অবস্থায় পড়েছেন তারা। সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের নামে তাদের ভিটেমাটি, বাড়িঘর, আবাদী জমি সবই কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র বড় দুশ্চিন্তায় ফেলেছে গতর খাটা মানুষগুলোকে। দেশের বেক্সিমকো পাওয়ার কোম্পানি এবং চীনের টিবিয়ে কোম্পানিকে কাজ দেয়ার জন্য প্রায় এক হাজার একর জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এই ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করতে লড়াইয়ে নেমেছে এ অঞ্চলের শিশু, নারী-পুরুষ সবাই। গঠন করেছে ‘বাস্তুভিটা আবাদী জমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটি’।
সরকার সম্প্রতি দু’শ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কাগজে কলমে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের লাঠশালায় অকৃষি জমিতে এই প্রকল্প স্থাপনের কথা বলা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সেই নিয়ম অমান্য করছে। তারা ইতিমধ্যে লাঠশালায় কৃষি ও অকৃষি মিলে প্রায় ৬শ’ একর জমি ক্রয় করেছে। ক্রয় পদ্ধতি নিয়েও উঠেছে অভিযোগ। জমির বাজার মুল্যের চেয়ে অনেক কম দামে এলাকার মানুষকে কোম্পানির কাছে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছে। যেসব জমি বিক্রি হয়েছে সেগুলোর টাকা জমির মালিকরা এখনো পুরোপুরি বুঝে পায়নি। এলাকার দালাল, ফড়িয়া, তথাকথিত জনপ্রতিনিধিরা টাকা পয়সা লুটে নিচ্ছে। এসব ব্যাপারে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে একাধিকবার অভিযোগ করেও কোনো ফল মেলেনি।
শুধু লাঠশালা নয়, বেক্সিমকো কোম্পানি হাত বাড়িয়েছে পার্শ্ববর্তী ঘনবসতিপূর্ণ চর খোর্দা মৌজাতেও। চর খোর্দার মানুষগুলোকে জমি বিক্রি করার জন্য নোটিশ দিয়েছেন বেক্সিমকো কোম্পানির প্রকল্প সমন্বয়কারী ইয়ার আলী । শুধু তাই নয়, এলাকায় গজিয়ে ওঠা দালাল-মাস্তান বাহিনী প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষকে হুমকি দিচ্ছে। এমনকি সাজানো মামলার ফাঁদে ফেলে খেটে খাওয়া মানুষকে হয়রানি করা প্রতিদিনের ঘটনা।
অথচ চর খোর্দায় কোনো অকৃষি জমি নেই। কৃষি জমি ধ্বংস না করার সরকারি নির্দেশনা থাকলেও তা এ ক্ষেত্রে কেউই মানছেন না। এমনকি এ বিষয়ে এলাকাবাসী ও সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ইউএনও ও জেলা প্রশাসককে অবগত করা হলেও তাদের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
এলাকার মানুষ কৃষি জমি ধ্বংস করে এই সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প চায় না। তাদের আশংকা এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তিস্তা নদী নিশ্চিহ্ন হবে। ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি এলাকার মানুষের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম উৎস মাছব্যবসা ও কৃষিকাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
নিজেদের ভিটেমাটি এলাকার পরিবেশ রক্ষার এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়েছে বাসদ (মার্কসবাদী) গাইবান্ধা জেলা। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলনকারীরা তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। কর্মসূচির অংশ হিসেবে আগামী ১৪ জানুয়ারি গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক বরাবর, ১২ ফেব্রুয়ারি রংপুর বিভাগীয় কমিশনার বরাবর স্মারকলিপি প্রদানের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে ‘বাস্তুভিটা ও আবাদী জমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটি’।