সময়ের সাথে সাথে পাল্টাচ্ছে পত্রিকার খবর। সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় একদিকে উন্নয়নের সংবাদ আসে, আরেক দিকে থাকে গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, জমি নিয়ে কলহ, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির বীভৎস আতঙ্ক। সেই সাথে ইদানিং কিশোর হত্যাকান্ডে র কিছু ধারাবাহিক ঘটনায় ভীড় বাড়াচ্ছে অজানা এক বিভীষিকার। এমন হত্যাকান্ড একদিনে তৈরি হওয়া কোনো পরিস্থিতি নয়। হঠাৎ করে এই রকম এক ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
কিশোর বয়স, যে বয়সে শিরা টান করে বাঁচবার স্বপ্ন দেখার কথা, যে বয়সে পরস্পরের প্রতি পরস্পরের ভালোবাসা-বন্ধুত্ব-মমতা তৈরি হবার কথা, সেই বয়সে তারা জড়িয়ে পড়ছে বিদ্বেষে, জড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের অপরাধে। গত কিছুদিনে ঘটেছে তেমন কিছু ঘটনা। গত ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর রোডে ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আদনান, ১৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরীর জামালখান এলাকায় কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র আদনান ইসফার বন্ধুদের হাতে নির্মমভাবে খুন হয়। ঢাকার তেজকুনি পাড়ায় খুন হয় ১৬ বছরের কিশোর, গত ২০ জানুয়ারি খুলনা পাবলিক কলেজের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ফাহমিদ তানভির রাজিন ছুরিকাঘাতে নিহত হয়। খুব অল্পদিনের ব্যবধানে এই ঘটনাগুলো সমাজের এক ভয়াবহ বিপদেরই পূর্বাভাস দিচ্ছে।
আমাদের দেশে এক সময়ে, এই বয়সেই যুদ্ধে গিয়েছিল শহিদ মতিউর, রক্ত দিয়ে ভাষা আনতে গিয়ে শহিদ হয়েছিল রফিক। সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘আঠারো বছর’ কবিতাটি তারুণ্যের জয়গানে মুখরিত ছিল। তবে আজ কী হলো? কোথায় সমস্যা? কীসের পরিবর্তন ঘটল? কেন এই বয়সের ছেলেরা মেতে উঠছে খুন-রাহাজানিতে? এই বীভৎস পরিস্থিতি থেকে সমাজকে বাঁচাতে হলে, আমাদের কিশোর-তারুণ্যকে বাঁচাতে হলে, এই সমস্যার মূল খুঁজে বের করতে হবে।
এখন এমন এক অবস্থা সমাজে তৈরি হয়েছে, যেখানে সমস্ত দিক থেকে একটি শিশুকে বঞ্চিত করা হচ্ছে মুক্ত শৈশব থেকে। খেলার মাঠ নেই, শিশু বন্দী ভার্চুয়াল জগতে। মাঠে খেলাধুলা, একসাথে থাকার মধ্য দিয়ে সামাজিকতার যে বীজ রোপিত হয় — তা থেকেই শিশুরা আজ বঞ্চিত। খুব ছোটবেলা থেকেই তাই একাকীত্বের রোগে ভোগে। এর সাথে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে আছে বিভিন্ন পরীক্ষা, অ্যাকাডেমিক ব্যস্ততা। ফলে দেহ-মনে বিকশিত হবার সুযোগ পাচ্ছে না।
এই প্রতিযোগিতামূলক সমাজ অল্প বয়স থেকেই শিশু-কিশোরের মাথায় ঢুকিয়ে দিচ্ছে কীভাবে কেবল নিজে বড় হওয়া যায়, কীভাবে কেবল নিজে ভালো থাকা যায়। ফলাফলে কৈশোরের কৌতুহলী মনকে মেরে দিয়ে, কিশোর সাহিত্য ছেড়ে দিয়ে কেবল জিপিএ ৫ পাওয়ার আশায় আশ্রয় হয় গৎবাঁধা, মুখস্থ নির্ভর স্কুল আর কোচিং-এর দুয়ারে। এভাবেই রুদ্ধ হচ্ছে মানবিক বিকাশের পথ।
আজকাল স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও ভয়াবহ মাদকের সমস্যায় আক্রান্ত। বস্তুত, মাদক ব্যবসায়ীদের এখন বিরাট ব্যবসার ক্ষেত্র এই স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। এর সাথে যুক্ত হয়েছে পর্নোগ্রাফি দেখার অবাধ সুযোগ। এই দুইয়ে মিলে কিশোর বয়সেই জেগে উঠছে পৈশাচিক উন্মাদনা। কিশোর বয়সেই পাশবিক প্রব”ত্তির প্রবল দাপট মানবিক মানুষ হতে বাধা তৈরি করছে।
এভাবে ‘নষ্ট’ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া চলছে সমাজে। এদের দ্বারা যেকোনো নষ্ট কাজ করা সহজ। সেটিই করছে এলাকার তথাকথিত বড় ভাইয়েরা, যা বিভিন্ন গ্যাং গ্রুপের নেতা বলে পরিচিত। এলাকায় রাজনৈতিক দাপট, প্রভাব-পতিপত্তি দেখানো, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদকের ব্যবসা, খুন-ধর্ষণ কী হচ্ছে না এদের দিয়ে! কিশোর বয়সের উচ্ছল সময়গুলোকে এভাবে ধ্বংসাত্মক কাজে লাগানো হচ্ছে।
উপরে আলোচিত আদনান, ফাহমিদ হত্যাসহ প্রতিটি ঘটনার সাথে এলাকার ক্ষমতাসীনদের সম্পর্ক ছিল। তাদের ছত্রছায়াতে, তাদের ক্ষমতার গুটি হিসেবে কাজ লাগতে গিয়ে কিশোরদের এই পরিণতি হয়েছে। এই অপরাধীদের সম্পর্কে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন অবগত। বহুবার পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশনে বিষয়গুলো এসেছে। কিন্তু, কমছে না কিশোর অপরাধ।
কিশোরদের এই অবক্ষয় থামাতে হলে একদিকে যেমন ক্ষমতাসীন দল কর্তৃক কিশোরদের স্থানীয় সন্ত্রাসী বানানোর প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে, অন্যদিকে সমাজে ব্যাপকভাবে সংস্কৃতি চর্চা, বড় মনীষীদের জীবনী পালন, মননশীল-সৃজনশীল নানা আয়োজন রাখতে হবে। সমাজের সমস্ত স্তরে মানবিকতা-গণতন্ত্রের চর্চা বাড়াতে হবে। একা একা বড় হওয়ার বদলে সকলে মিলে কীভাবে ভালো থাকা যায় — তার শিক্ষা দিতে হবে। তবেই এই ধ্বংসের পথ থেকে শিশু-কিশোরদের নৈতিকতার আলোয় ফিরিয়ে আনা যাবে।